বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২০শে ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ৪ঠা পৌষ, ১৩৮০
সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী
সত্যের জয়- ন্যায়ের জয় অবশ্যম্ভাবী। অন্ততঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় এবং তার প্রতি বিশ্ববাসীর গভীর অভিনন্দন, আস্থা আর শ্রদ্ধাই তার আরেকটি ঐতিহাসিক প্রমাণ। সেই প্রমাণটিকে আরো দৃঢ়তর করেছেন বর্তমানে ইসলামাবাদের ফ্যাসিস্ট শক্তির কবল থেকে মুক্তিলাভের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে রত সিন্ধু-বেলুচ ও সীমান্তের জনগণের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মানুষ, সরকার এবং সর্বোপরি বাঙালি জাতির জনকের প্রতি অভিনন্দন জ্ঞাপনের মাধ্যমে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, সিন্ধু ও বেলুচ জনগণের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান সিন্ধু ও বেলুচিস্তান পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা জনাব করিম বালুচ লন্ডন থেকে বাঙালি জাতি ও জাতীয়তাবাদের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে এক অভিনন্দন বাণী পাঠিয়েছেন গত ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালির জাতীয় দিবস উপলক্ষে। অভিনন্দন বাণীতে তিনি বলেছেন, ইসলামাবাদের ফ্যাসিষ্টদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বিতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে সিন্ধু ও বেলুচিস্তান পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি আপনাকে, আপনার প্রিয় সহকর্মীবৃন্দকে এবং বাংলাদেশের বীর জনগণকে জানাচ্ছে তাদের গভীর আন্তরিকতাপূর্ণ সৌভ্রাতৃত্বের অভিনন্দন। আপনাদের দুর্জয় সংগ্রাম ও মহান আত্মত্যাগ পৃথিবীর জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছে। ইসলামাবাদের ঘাতক ও হানাদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামেরত আমাদের জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছে এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে দৃঢ়তর করে গড়ে তোলার সংগ্রামে এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলাদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের নবতর বিজয় কামনা করছে।
বস্তুতঃ আজকের বাংলাদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান আর সীমান্ত এলাকা নিয়ে একদা পত্তন হয়েছিল যে পাকিস্তানের সেই পাকিস্তানের আজ শুধু নামটাই বা ঠাটটাই কিছুটা বজায় রয়েছে বাকী আর কিছু নেই।
শেরে বাংলার ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবকে বানচাল করে পাঞ্জাবি সামন্ত প্রভুদের ও ধনিক শ্রেণীর প্রতিভূরা একদা ধোকাবাজী ভুয়া আর তথাকথিত দ্বি-তত্ত্বের ভিত্তিতে যে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলেন, সেই পাকিস্তানে দীর্ঘ ২৭ বছর যাবৎ একটানা চলে আসছে সেই পাঞ্জাবি ফ্যাসিবাদীদেরই শাসন আর শোষণ। অনেক রক্ত, অনেক ত্যাগ আর অনেক তিতিক্ষার ও দীর্ঘ ২৫ বছর প্রতীক্ষার পর বাঙালীরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সেই ফ্যাসিবাদের নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন হলেও শোষকচক্রের শোষণ লিপ্সা আর রক্ত লোলুপতা থামেনি।
বাঙালিরা হাতছাড়া হয়ে যাবার পর তাদের শোষণ নির্যাতনের কালো হাত নেমে আসে বেলুচ, পাঠান আর সিন্ধীদের উপর। কিন্তু বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় আজ ওদেরও- বেলুচ সিন্ধী আর পাঠানদের চোখ খুলে দিয়েছে। রক্তের দামে স্বাধীনতা কিনে নেবার উন্মাদনায় আজ দৃঢ় প্রত্যয়ী। স্বাধীনতার সূর্যকে ওরা আজ ছিনিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর।
বাংলাদেশের জনগণ, সরকার এবং জনক ঘোষনা করেছেন, বাংলাদেশ বিশ্বের যেকোন এলাকার নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াবে, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দেবে। সেই ঘোষণার প্রতিধ্বনি করে আজ আমরাও বালুচ আর সিন্ধী পাঠানদের এই আশ্বাস দিতে চাই, তোমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি আমরা যেমন একাত্মতা প্রকাশ করছি- তেমনি আমাদের মতো তোমাদেরও বিজয় কামনা করি। কারণ একই রক্তের ঐতিহ্যে তোমাদের সাথে আমাদের বন্ধন। ন্যায়ের সংগ্রামে তোমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী।
বাঙালীর মুক্তি-সংগ্রাম ও তার ইতিহাস প্রণয়ন প্রসঙ্গে
যে কোনো জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সেই জাতির পক্ষে একটি সর্বকালীন বা সার্বজনীন বাইবেলের সমান। একটি অমূল্য সম্পদ এবং যে কোন জাতীয় সমস্যার বলিষ্ঠ পথ-নির্দেশিকা ও সুষ্ঠু সমাধান।
অথচ, অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, আমাদের চির শোষণ-জর্জরিত সোনার বাংলাদেশ তার সর্বশেষ শত্রু পাঞ্জাবি হার্মাদদের কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দীর্ঘ দু’বছর পেরিয়ে তৃতীয় স্বাধীনতা বছরে পা’ ফেলা সত্ত্বেও আমাদের মুক্তি সংগ্রামের একটি প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস প্রণয়নের ব্যাপারে আজো পর্যন্ত সরকারিভাবে বা জনসাধারণের দিক থেকে তেমন কোনো বাস্তব উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা চালানো হয়নি।
অবশ্য, অস্বীকার করা যায়না, এমন একটি ইতিহাস প্রণয়নের জন্য যে একটি জাতীয় উদ্যোগ প্রয়োজন এবং এমন একটি ইতিহাস প্রণয়ন যে একটি জাতীয় প্রয়োজন সে সম্পর্কে অনেকেই অনেক আবেগজড়িত বক্তব্য রেখেছেন আমাদের তথ্য ও বেতার বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর জাতীয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত কোনো এক আলোচনা সভায় উদ্বোধন কালে।
তিনি বলেছেন, এমন ইতিহাস প্রণয়নের মাধ্যমেই জাতিকে তারা কাঙ্খিত লক্ষ্যপথে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। আমরাও এ বিষয়ে একমত, কিন্তু কথা হচ্ছে, শুধুমাত্র এমন সুন্দর সুন্দর ভাবনা ও পরিকল্পনা রেখে চুপচাপ বসে থাকলে চলবেনা, এজন্য তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নেয়া এবং এ সম্পর্কিত যাবতীয় পরিশ্রম ভার গ্রহণ করাও একান্ত প্রয়োজন। সেদিক থেকে আমরা জাতিগতভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে কে কতটুকু উদ্যোগী হয়েছি বা কতটুকু সফলতা আমরা অর্জন করেছি, তা আমাদের প্রথমেই তলিয়ে দেখা প্রয়োজন।
তবে ইতিহাস লেখার যে কোনো পরিশ্রম উঠানোর আগে প্রথমেই আমাদের ইতিহাসের প্রকৃত স্বরূপ বা ঐতিহাসিকের প্রকৃত গুনাগুণ বা ভূমিকা পালন সম্পর্কেও অত্যন্ত স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে। তা’না হলে ইতিহাস লেখার মহান দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে আমরা আমাদের অস্বচ্ছ ধারণায় যা কিছুই লিখে যাবো বা যে পরিশ্রমই করে যাব তা আগামী ইতিহাসের পাতায় শুধুমাত্র অহেতুক ও জঞ্জাল বলেই আখ্যায়িত হবে। এতে জাতি বা জগত মানুষের কোন অপকার ছাড়া কোন উপকারই হবে না।
১৯৫৭ সনে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হবার পর থেকেই বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের প্রকৃত বীজ রোপিত হয়। এর পর থেকে সমস্ত ঘটনা, সমস্ত কাহিনী, সমস্ত সংগ্রাম, সমস্ত আত্মহুতি ও রক্তদান- সবই ইতিহাসের পর্যায়ভুক্ত। এর অনেক কথা আমরা জেনেছি, এর অনেক কথা আমরা জানি এবং এর অনেক কথা আমাদের এখনো জানতে বাকি। আমরাও একদিন অনন্তকাল স্রোতে ইতিহাসের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াবো। আমাদের আগামী নাগরিকদের কাছে জানবার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াবো।
সেদিন প্রয়োজন একটি লিখিত দলিলের এবং এই লিখিত দলিলের নামই ইতিহাস। আজকে অনেক কিছুই যা’ আমাদের কাছে চাক্ষুষ তা’ একদিন গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। সেদিন আমাদের রেখে যাওয়া স্বাক্ষরই আগামী মানুষের ভাবনা যোগাবে। আমরা আজ যদি কোন মিথ্যা স্বাক্ষর রেখে যাই, কিম্বা অতিরঞ্জনে কোন ঘটনার বিবরণ দিয়ে যাই, কিম্বা কারো মন রক্ষা কথার মালিকা রেখে যাই, তবে আমাদের আগামী দিনের নাগরিকেরাও বিপথে পরিচালিত হতে বাধ্য, সত্যের বিভ্রান্ত চেহারা দেখতে বাধ্য। সুতরাং, ঐতিহাসিকদের দায়িত্ব মহান ও অপরিসীম। আমাদের প্রথমেই জানতে হবে ইতিহাস কাকে বলে এবং ইতিহাসের প্রকৃত ভূমিকা কি, কিম্বা এর মধ্যে ঠিক কি কি উপাদান থাকলে একে প্রকৃতই সার্বজনীন, সর্বকালীন বা কালজয়ী করে একে মানুষের উপকারে নিয়োজিত করা যায়।
এজন্য ঐতিহাসিককে নির্ভীক, স্পষ্টবাদী ও নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে। কোন যুগের মানুষের কি বাসনা, চাহিদা বা সাধ আহ্লাদ ছিল, সে বাসনা বা চাহিদা প্রকাশে তাদের মাধ্যমে বা সীমানা কি ছিল, কেমন করে সময়ান্তরে তার বিবর্তন বা রূপান্তর ঘটেছে, কোন কোন প্রভাবে এ বিবর্তন ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত সে রূপ কোন রূপ পরিগ্রহ করেছে, এতে লাভ বা লোকদান কতটুকু হয়েছে- ইত্যাদি নানান বিষয়ে স্পষ্ট ও নিরপেক্ষ বক্তব্য রাখাও ঐতিহাসিকের প্রধান কর্তব্য।
আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে, যে জাতি তার নিজের ইতিহাসকে মনে না রাখে কিম্বা তাকে ধরে রাখতে না পারে কিম্বা তাকে ধরে রাখার চেষ্টা না করে, সে জাতি ইতিহাসের আগামী সাগরে বিস্মৃতির অতল তলে তলিয়ে যেতে বাধ্য।
আমাদের সমস্ত বিদগ্ধ ঐতিহাসিক ও উৎসাহী জনসাধারণের প্রতি আমাদের আবেদন আপনারা যারা আমাদের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস ইতিহাস বিধৃত করার প্রয়াসে এগিয়ে আসছেন তারা আলোচিত আলোকে আর একবার নিজেদের কর্তব্য, দায়িত্ব, ভূমিকা ও যোগ্যতা সম্পর্কে ঝাড়াই মাড়াই করে নিয়ে এমন মহান দায়িত্বে নিয়োজিত হবেন বলেই আমরা আশা রাখি। কারণ, ইতিহাস এক মহাশক্তিশালী স্বয়ক্রিয় বিরচন। এ সজাগ মানুষের বক্তব্য পাশাপাশি বা কখনো সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠলেও এ প্রকৃত পক্ষে নর বা নর-ভ্রূকুটি ও প্রভাব নিরপেক্ষ।
সাজিয়ে মূর্তি তৈরি করা যায়, কিন্তু ইতিহাস নয়। অপূর্ণ বা অসত্য চিত্রায়ন করে কিম্বা মন রক্ষা চিত্রায়ন করে কোন একটি যুগের মানুষকে ফাঁসি দেয়া যায়, কিন্তু অনন্ত আগামীকে ফাঁকি দেয়া যায় না। ইতিহাস না লেখা হলেও নিজেই লিপিবদ্ধ হতে সম্পূর্ণ সক্ষম। সুতরাং, আমাদের দায়িত্ব-সজাগ লিপিকার বিষয়ে যত্মবান হবেন এবং আমাদের জাতীয় সংগ্রামের একটি প্রকৃত, পূর্ণাংগ ও অব্যর্থ ইতিহাস প্রণয়নে ব্যপৃত হয়ে আমাদের দ্বিধাহত জাতিকে প্রকৃতই মুক্তির পথে নির্দেশিত করবেন, এটাই আজ আমাদের একটি জাতীয় প্রয়োজন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক