সাপের দাঁত থেকে মধু আশা করতে পারি না – পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামাে
(দ্বিতীয় অধ্যায়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামাে কীভাবে গড়ে উঠেছিল এবং সেই কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অধিকার কীভাবে বিপন্ন করা হয়েছে তার নানা ঘটনাবলি। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল পূর্ববঙ্গের । রাজধানী হওয়ার কথা ছিল কোলকাতা। এ লক্ষ্যে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, শরৎ বসু, আবুল হাশিম প্রকাশ্যে অখন্ড স্বাধীন যুক্তবাংলার পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। অন্যদিকে জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলী খান দেখলেন কোলকাতা নিয়ে যদি অখন্ড স্বাধীন যুক্তবাংলা হয় তাহলে তাদের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে, বলতে গেলে তা চলে যাবে বাঙ্গালিদের হাতে। সেজন্য তারা ভারতের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কোলকাতার বদলে লাহােরকে পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য দরকষাকষি করেন। কোলকাতাকে ছাঁটাই করেন, লাহাের পেয়ে যান। ঢাকার বদলে করাচীকে করা হয় রাজধানী। সেই থেকে শােষণ শুরু। শশাষণের মূল অজুহাত ছিল কাশীর নিয়ে যুদ্ধ। যুদ্ধের মাসুল জোগাতে দু’হাতে লুট করা হতাে পূর্ব বাংলাকে। কোরিয়ার যুদ্ধে পাটের দাম অসম্ভব বেড়ে যায়। প্রায় সমুদয় অর্থ রাজধানী গঠনে এবং সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা জন্য ব্যয় করা হয়। পাকিস্তানের বাজেটের শতকরা ১০ ভাগও প্রতিরক্ষা খাতে পূর্ব বাংলায় ব্যয় করা হয়নি। এমনকি গভর্নর জেনারেলের অনন্ত অসীম ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করা হয় এবং তাদের দ্বারাই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। জনগণকে ঘােড়াই কেয়ার করা হয়। প্রথম থেকেই আঘাত হেনেছে ভাষার ওপর, সংস্কৃতির ওপর, এবং আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ফলে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। জনগণ হয়ে পড়েছে বিপন্ন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর যে গণপরিষদ গঠিত হয় সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের ভাষা নিয়ে, আর্থিক বৈষম্য নিয়ে, প্রশাসনিক অসমতা নিয়ে, সামরিক বাহিনীর অনুপাত নিয়ে এবং সর্বোপরি একনায়কতন্ত্র শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের পক্ষে কতিপয় গণপরিষদ সদস্য সােচ্চার ভূমিকা পালন করেন। তাদের দাবি ছিল স্বায়ত্তশাসনের, এক ইউনিট বিরােধী প্রথা বাতিলের পক্ষে এবং সংখ্যাসাম্যের নীতির বিরুদ্ধে। ১৯৫৭ সালে গণপরিষদে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ গণতন্ত্র চায়। নির্বাচন চায়। নির্বাচন হবে কিনা জানি না। কারণ সাপের দাঁত থেকে আমরা মধু আশা করতে পারি না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান পরিচালিত হয়। এই ব্যর্থ অ্যুত্থানের নায়ক মেজর জেনারেল আকবর খান, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ এবং অন্যরা তারা লিয়াকত আলী। খান সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করে। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর গণপরিষদ সদস্যপদ বাতিলের পর তিনি আইনজীবী হিসেবে দু’বছর ধরে তাদের জন্য আইনী লড়াই করেন। সেজন্য সহজেই ধরে নেয়া যায় প্রথম থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশ শাসনে অংশগ্রহণের দৃশ্যমান ইচ্ছা ব্যক্ত হয়। কারণ পাকিস্তানের সেনা কাঠামাে পাঞ্জাবের সেনাসদস্য ও কর্মকর্তাদের প্রাধান্য ছিল ব্যাপক। তাছাড়া শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তান’-এর নিরাপত্তার জন্য বার্ষিক বাজেটের প্রায় শতকরা ৭৫% ব্যয় হয়। তরতর করে সেনাবাহিনী গড়ে উঠছিল।
পাকিস্তান আর্মি হেডকোয়ার্টার ৪ জুন ১৯৯২ সালে এক রিপাের্টে এর উল্লেখ আছে। পাকিস্তানের আর্মির রেগুলার কমিশন কোর্সে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১৯৬৬৬৯ পর্যন্ত প্রার্থী ছিল ৪০৭২, আর পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যা ছিল ৪৭৩ জন। এর মধ্যে চাকরিতে নেয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে ৯৯৬ জন ও পূর্ব পাকিস্তানের ১৫২ জনকে সুপারিশ করা হয়, এর মধ্যে সফলকাম হয় পূর্ব পাকিস্তানে ১২২ জন পশ্চিম পাকিস্তানে ৮২৭ জন। বলা হয়ে থাকে, বাঙালিরা সেনাবাহিনীতে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন না। মূল কারণ হিসেবে বলা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান অঞ্চলসমূহ ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গা। ভাষা ভিন্ন। আচার-আচরণ ভিন্ন। আবহাওয়া বিপরীতমুখী। লে, জেনারেল মােঃ আতিকুর রহমান যিনি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ছিলেন, তিনি বলেন, ১৯৫২ ও ৫৪ সালে ১০০ জনের মধ্যে বাংলাদেশের ক্যাডার ছিল মাত্র ছয় জন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে তেমন সামরিক শক্তি ছিল না। তখন নিউ ইয়র্ক টাইমসে রিপাের্ট হয়েছিল যে, চীনের কারণে ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেনি। কাশ্মীরের যুদ্ধকে সামনে রেখে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যাপক টাকা বরাদ্দ করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিরক্ষা খাতে এবং সামরিক সরঞ্জামের উৎপাদনের কারখানায় যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিকভাবেই তার ১০ শতাংশ টাকা বরাদ্দ করা হয়নি।
পাকিস্তান জন্মের মাত্র সতের দিনের মাথায় পহেলা সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদের আলােচনা, অনুমােদন ও সিদ্ধান্ত বহির্ভূতভাবে ‘পুঁজি ও প্রযুক্তি এবং পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনিক বিশেষ করে প্রতিরক্ষা ব্যয়ভার বহনের জন্য মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী গােলাম মােহাম্মদের একান্ত উদ্যোগ ও সক্রিয়তাকে অনুমােদন দিয়ে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতিবিদ, মন্ত্রিপরিষদ ও শাসনতান্ত্রিক আওতার বাইরে আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার সুযােগ করে দিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় শাসনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রীতি পদ্ধতির বাইরে এবং মন্ত্রিপরিষদকে এড়িয়ে গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে সরাসরি আমলাচক্রের শীর্ষস্থানীয়দের গােপন সম্পর্কে আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রের নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। জাদরেল আমলা গােলাম মােহাম্মদ প্রণীত আমেরিকার ওপর নির্বিচার নির্ভরতার কনসেপ্টটি গভর্নর জেনারেল অত্যন্ত ব্যগ্রতার সঙ্গে লুফে নেন। ব্যাপক সাহায্য ও নির্ভরতার ক্ষেত্রগুলাে চিহ্নিত করতে বিশেষ দূত হিসেবে মীর লায়েক আলীকে ওয়াশিংটনে পাঠাতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেননি। মীর লায়েক আলী অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে গােলাম মােহাম্মদ কর্তৃক প্রণীত ও গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক অনুমােদিত ডকুমেন্ট পেশ করতে সমর্থ হন।
ইতােমধ্যেই রাজধানী করাচী হতে মার্কিন চার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্স মি, লুইস পাকিস্তানের ব্যাপক সাহায্য প্রার্থনার বিষয়টি সেক্রেটারি অব স্টেট জর্জ মার্শালকে জ্ঞাত করিয়ে রেখেছিলেন। মীর লায়েক আলীর তৎপরতা অব্যাহত থাকা অবস্থাতেই ১৯৪৭ সালের ৮ অক্টোবর পাকিস্তানের অ্যামব্যাসাডার মি. ইস্পাহানীর পরিচয়পত্র গ্রহণকালে প্রেসিডেন্ট ট্রম্যান অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলেন যে, পাকিস্তানকে সর্বতােভাবে সাহায্য দেয়া হবে এবং এতে দুটি দেশই উপকৃত হবে। নতুন রাষ্ট্রটির জন্মলাভের পরপরই এমনিভাবে জাতীয় ক্ষেত্রে তাকে লালন-পালনের দায়িত্ব আমলাচক্রের উপর অর্পিত হলাে যাদের রাষ্ট্রটির জন্ম-সংগ্রামে কোন অবদান ছিল না। বললেই চলে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদ তােষণ, নতজানু ও পরনির্ভরতার দাসখত তার ললাট লিখন হয়ে দাঁড়াল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির সমন্বয় সাধক নীতিনির্ধারক ও বাস্তবায়করূপে আমলাতন্ত্র অত্যন্ত নগ্নভাবেই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির পরিচালনায় মুখ্য নিয়ামক শক্তি হয়ে ওঠে। একনায়ক উন্নাসিক এবং গণবিচ্ছিন্ন গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর অসীম ক্ষমতা আমলাতন্ত্রের চকচকে ফোলিওর মধ্য থেকে বিকিরণ হতে থাকে। এর পাশাপাশি একথাও অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর কন্টকপীড়িত রােগগ্রস্ত জীবদ্দশাতেই আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের রাজনীতিতে সমান্তরাল শক্তির ভূমিকা পালনে আবির্ভূত হয়েছে।
অসীম ক্ষমতা
কথা ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলাের অন্তর্গত এলাকাসমূহ হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম। ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের এই মূল ঘোষণা বাস্তবায়ন তাে দূরের কথা-১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দ্বিজাতি তত্ত্বের ধর্মীয় আবেগের নিদারুণ বৈরী জোয়ারে ভেসে গেল। পাকিস্তান জাতির জনক মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর জীবদ্দশাতেই পূর্ব পাকিস্তান শক্তিশালী আমলা শাসক গােষ্ঠীর এক উপনিবেশে পরিণত হলাে আর এতে সাহায্য করল এদেশেরই বুর্জোয়া ও ভূস্বামী শ্রেণীর অশক্ত দুর্বল প্রতিনিধি পূর্ববঙ্গের দালাল শ্রেণী। সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রশাসন, পুলিশ, সামরিক বাহিনী, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার ক্ষেত্রসমূহ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক-শােষক চক্রের পুরােপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে গেল। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান হওয়ার পর দেশটির জনক’ ও শাসকদল মুসলিম লীগের প্রধান কায়েদে আযম মােহম্মদ আলী জিন্নাহর ভূমিকায় রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার বাইরে অবস্থিত বিশাল জনগােষ্ঠীর কাছে তার একনায়কত্বসুলভ ব্যক্তিত্ব ও স্বেচ্ছাচারিতায় প্রতীয়মান হয়েছে তার আদেশ নির্দেশেই রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা ছিল এর বিপরীত। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে মি, জিন্নাহ খুবই অসুস্থ ছিলেন। এই অসুস্থ অবস্থায় চারদিকে প্রকটিত সংকট ও অসংখ্য সমস্যার সমাধান তার পক্ষে ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার। মাঝে মাঝে তার কিছু কিছু কার্যক্রমে এরূপ ধারণা হওয়া স্বাভাবিক ছিল যে, তিনি হয়ত দৃঢ়হস্তে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন, কিন্তু নেপথ্য বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে, তিনি ছিলেন একান্ত উপায়হীন অসহায়। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালনার ক্ষেত্রে তাকে প্রথম থেকেই যে সব আমলা অফিসারদের উপর নির্ভর করতে হয়েছে তারা প্রায় স্বাধীনভাবেই কাজ করা অধিকার অর্জন করেছিলেন।
ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট (১৯৪৭) অনুযায়ী গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর হাতে আইনগত ও সাংবিধানিক সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল যা ছিল ‘অনন্ত অসীম তা প্রকারান্তরে আমলাদের হাতকেই শক্তিশালী করেছে। বলা যায়, একমাত্র লিয়াকত আলী খানসহ জিন্নাহ তার চারপাশে যে সমস্ত লােক জোগাড় করেছিলেন তারা। ছিলেন মূলত মেরুদণ্ডহীন। সেজন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অনিচ্ছাকৃতভাকে খাটো করে রাষ্ট্রপ্রশাসনে আমলাদের কর্তৃত্ব শক্তিশালী করা ব্যতীত জিন্নাহর করণীয় বিকল্প ছিল না। তিনি সমস্ত আমলার উপরে সেক্রেটারি জেনারেল পদ সৃষ্টি করেন। এই পদ সৃষ্টির লক্ষ্য ছিল মন্ত্রিসভাকে উপেক্ষা করে আমলাতন্ত্রের পর্যায়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমন্বয় এবং বাস্তবায়ন করা। ব্রিটিশ ফ্রেমওয়ার্কে প্রশিক্ষিত ঝানু ব্যুরােক্র্যাট চৌধুরী মােহাম্মদ আলী অত্যন্ত কৌশল ও দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসনের এই সর্বোচ্চ পদে বসে আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী ও সংহত করতে নিরলস প্রয়াস চালিয়েছেন। এমন দেখা গেছে যে, মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে মতদ্বৈততার ক্ষেত্রে সেক্রেটারি জেনারেল সরাসরি গভর্নর জেনারেলের কাছে হতে আদেশ গ্রহণ করে এনেছেন-রাজনীতিবিদদের পাশ কাটানাে এবং অশ্রদ্ধা জানিয়ে চলার একটা রীতি যেন রীতিমতাে চালু হয়ে যাচ্ছে। জিন্নাহর জীবিত অবস্থাতেই পাকিস্তান গণপরিষদের কতিপয় সদস্য রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কার্যকরী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাদির প্রয়ােগ ও আমলাতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান শক্তি প্রবাহকে খর্ব করার দাবি উত্থাপন করলে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ধমকের সুরে গণপরিষদকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে, বর্তমানে সংবিধানে সকল ক্ষমতা গভর্নর জেনারেলের হাতে ন্যস্ত। তিনি যা চাইবেন তাই করতে পারেন”। এই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার স্বৈরতান্ত্রিক নমুনা।
আমলাতন্ত্রের দ্বিতীয় পর্যায়
জিন্নাহর মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দিন গভর্নর জেনারেল হলেন। সংবিধান উদ্ভূত এই পদটি রাষ্ট্র পরিচালনায় সকল শক্তি কাঠামাের উৎস হলেও নাজিমুদ্দিন ছিলেন দুর্বল ও অক্ষম ব্যক্তি। জনগণের চোখে তখন জিন্নাহর উত্তরাধিকারী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। লিয়াকত আলী খান, আমলাতন্ত্রের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপন করার মতাে যােগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তিনিও গণতান্ত্রিক প্রশাসন প্রবর্তন ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়নে তেমন উৎসাহী ছিলেন না। অত্যন্ত দুর্বল দৃষ্টিশক্তির কারণে ফাইল পত্রের খুঁটিনাটি দিক পরীক্ষা ও ‘নােট’ নির্দেশ প্রদান তার পক্ষে ছিল অসম্ভব। আমলাদের হাতে সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন এবং ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম লীগকে পুনর্গঠিত করারও ব্যর্থ প্রয়াস চালাননি । গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল জাদরেল এই প্রধানমন্ত্রী পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠতা খর্ব করার মতলবে তখন ব্যস্ত, ভাষা বিরােধকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গের দাবি দাওয়া উত্থাপনকারীদের ইসলাম পাকিস্তান জাতির শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার মহান উদ্যোগে অত্যন্ত উৎসাহী ভূমিকায় অবতীর্ণ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৮ নভেম্বর তেজগাঁও বিমান বন্দরে অবতরণ করলে আমলাতন্ত্রী স্বৈরাচারের হাতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকগণ অপমানিত ও উপেক্ষিত হন। এই সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদটির সঙ্গে প্রায় সমান্তরালভাবে সংযুক্ত আমলাতন্ত্রের এই চক্র কাঠামাের প্রতিরক্ষা সচিব এবং অর্থমন্ত্রী, যিনি সিনিয়র ব্যুরােক্র্যাট, যথাযথ অর্থেই শক্তিধর ব্যক্তি হিসেবে অচিরেই পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রে আবির্ভূত হন।
প্রতিরক্ষা সচিব জেনারেল ইসকান্দার মীর্জা যার পেছনে ছিল সামরিক বাহিনী আর অর্থমন্ত্রী গােলাম মােহাম্মদের পেছনে ছিল আমলা ও পাঞ্জাবি চক্র ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ রাজনৈতিক মহলের সমর্থন। রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অবর্তমানে এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের মধ্যে ক্রমবর্ধমান কোন্দল ও গণবিচ্ছিন্নতার কারণে এবং তদানীন্তন গণপরিষদের অধিষ্ঠিত সদস্যদের অধিকাংশ সামন্ত শ্রেণী চরিত্রের অধিকারী হওয়ার ফলে তাদেরই সম্মিলিত মানসিক ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক উদ্যোগ অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে এড়িয়ে যাওয়া হয়। কেননা গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় এই আমলাতন্ত্রের হাত থেকে ক্ষমতা সামরিকতন্ত্রের কর্তৃত্বে আনয়নের এক চক্রান্তে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হন।’ এর কিছুদিনের মধ্যে নাজিমুদ্দিনকে সরিয়ে গােলাম মােহাম্মদ গভর্নর জেনারেলের এই অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন পদটি দখল করতে সক্ষম হলেন। গভর্নর জেনারেল হিসেব ব্রিটিশ ভারতের অডিট ও একাউন্টস সার্ভিসের একজন সিনিয়র অফিসার গােলাম মােহম্মদের নিয়ােগে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে আমলাতান্ত্রিক শাসনের দ্বিতীয় পর্যায় দৃঢ়তার সঙ্গে শুরু হয়। পাকিস্তানে বহিরাগত ‘এলিট নেতৃত্ব’-এর আকস্মিক অন্তর্ধান পাকিস্তান আমলাচক্র বিশেষ করে পাঞ্জাবি চক্রের কুক্ষিগত ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলের পথকে অবারিত করে। পাকিস্তানের পরবর্তী রাজনৈতিক অঙ্গন এই চক্রান্ত ষড়যন্ত্রমূলক পথ ধরেই। আবর্তিত ও বিবর্তিত হয়েছে। অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ দিন পর্যন্ত ক্রিয়াশীল ছিল।
গণতন্ত্রের দাবি যেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত
১৯৫১ সালে ইরানে তেল জাতীয়করণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি মােকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি নতুন সম্পর্ক গড়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে।” মার্কিন সামরিক প্রভাব বলয়ে পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করার বু প্রিন্টকে সামনে রেখে মার্কিনী মিত্র গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ ও সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে চক্রান্ত করে গণপরিষদে মেজরিটি সদস্যের আস্থাভাজন, নতজানু ও দুর্বলচিত্ত প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনকে হটিয়ে দেয়া হলাে। চরম অসাংবিধানিকভাবে গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভাকে বাতিল করে দেন। নাজিমুদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণের বড় তৃণটি ছিল আসন্ন খাদ্য সংকট। ১৯৫৩ সালে ফসল ভালাে হয়নি-মার্কিন সি, আই, এর-র বিশেষজ্ঞ দ্বারা একটানা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হবার ফলে খাদ্য সংকটের আশংকায় ব্যাপকভাবে মজুতদারি বেড়ে যায়। খাদ্যসহ জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন অত্যন্ত মরিয়া হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খাদ্য প্রার্থনা করে। যুক্তরাষ্ট্র এক সপ্তাহের মধ্যে খাদ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিলেও খাজা নাজিমুদ্দিনের অপসারণ এবং মার্কিনী বশংবদ বগুড়ার মােহাম্মদ আলীর প্রধানমন্ত্রীর পদ দখল না করা পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার খাদ্য পাঠাতে বিলম্ব করেছিলেন। ১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেবা করার ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার মতাে মানসিক শক্তি দুর্বলচিত্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ছিল না।
খাজা নাজিমুদ্দিনের বিদায় গ্রহণের পরপরই ১৯৫৩ সালের মে মাসে জন ফস্টার ডালেস পাকিস্তান সফরে আসন এবং এর পরপরই প্রতিরক্ষা সচিব ইস্কান্দার মীর্জা ও প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান ন্যাটোর ঘাটি তুরস্ক এবং তুরস্ক থেকে সামরিক শক্তিসমূহের পারস্পরিক সমঝােতার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে উঠল যে শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, গণতান্ত্রিক বিধি বিধান ও প্রথাসমূহকে আমলাচক্র থােড়াই পরােয়া করে। অত্যন্ত অন্যায় অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মোেহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভার কে কে সদস্য হবেন, তাদের কী কী দায়িত্ব দেয়া হবে তাও গভর্নর জেনারেল ঠিক করে দেন। এভাবে পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র অপ্রতিরােধ্য এক রাজনৈতিক শক্তি ও ক্ষমতা অর্জন করে। গণতন্ত্রহীনতা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ, উঠতি ধনিক, বণিক, ভূস্বামী ও সামরিকতন্ত্রের নগ্ন চক্রান্ত ও খেলায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠায় দাবি-দাওয়া রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে থাকল। গণপরিষদে পূর্ববাংলার প্রতিনিধি শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসন, গঠনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বৈষম্য হ্রাস, এক ইউনিট প্যারেটি বিষয়ে তীব্রভাবে শাসক চক্রকে আক্রমণ করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগােষ্ঠী পূর্ববঙ্গের অধিবাসী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে এ অঞ্চলের মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক বিধি-বিধান পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিল। কারণ গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের নীতিমালা বাঙালি মুসলমানদের জন্য অধিকার প্রতিষ্ঠার রক্ষা কবজ হিসেবে কার্যকর থাকবে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিভ্রান্তিকর ধর্মীয় প্রবহমানতায় বাঙালির মনন ও চিন্তা-চেতনা আচ্ছন্ন ছিল বলেই কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রপরিচালনায় শাসকগােষ্ঠীর চতুর ও চক্রান্তমূলক পদক্ষেপগুলাে বাঙালির মােহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে সামগ্রিকভাবে ধরা পড়েনি। ধর্মীয় উন্মাদনা ও চেতনা বাঙালির আত্মপরিচয় ও সত্তাকে বিভ্রন্তির চোরাবালিতে ঠেলে দেয়।
বাঙালিরাই পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বাঙালি তার বাঙালিত্ব বিস্মৃত হয়ে মনেপ্রাণে কেবলমাত্র একজন পাকিস্তানি’ হবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এই মনােভাব থেকে সে তার নিজস্ব বাঙালি স্বার্থও একে একে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিতেও কুষ্ঠিত হয়নি। কারণ বাঙালি ভেবেছিল সবাই। যখন পাকিস্তানি, মুসলিম এবং ভাই ভাই তখন সর্বক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তানি ও পূর্ব পাকিস্তানিদের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। সেজন্য ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ভাষার দাবিতে ঢাকায় ছাত্রদের প্রথম শােভাযাত্রা স্থানীয় অধিবাসীদের পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ও ‘ইসলাম রক্ষার ধ্বনি তুলে সশস্ত্র আক্রমণ লক্ষণীয়।” ১৯৫০ সালে কেন্দ্রীয় শাসক গােষ্ঠীর উস্কানিতে দাঙ্গা সংঘটিত করতেও তাদের উৎসাহের অভাব ছিল না। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জি ও সি) স্মরণ করেন, “স্বাধীনতার অল্পকাল পরেই সেখানে কেবল দুই ব্যাটিলিয়ন পদাতিক বাহিনী ছিল। এদের একটিতে ছিল তিনটি কোম্পানি, যাদের সৈনিক হওয়ার মতাে যােগ্যতার যথেষ্ট অভাব ছিল। সদর দফতরে কোনাে টেবিল, চেয়ার, সাজসরঞ্জামাদি, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র কোন কিছুই ছিল না। কর্মকর্তারা চালাঘরে বাস করত, মুষলধারে বৃষ্টি হলে তাতে ক্রমাগত পানি পড়ত, কখনও ত্রিপলঢাকা হাদ উড়ে যেত। ১৯৪৭-এর আগস্টে ঢাকায় চাকরিরত একজন সামরিক কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী: “১৯৪৭ সালের আগষ্টে মনে হচ্ছিল, প্রদেশটি অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার কবলে পড়েছে। তিনি আরও মন্তব্য করেন: “সে অবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ সাফল্যের জন্য যা পাওয়া গিয়েছিল, তাও ছিল তুলনামূলকভাবে অপ্রতুল, এক কথায় একেবারেই অপর্যাপ্ত।”
পুলিশ বাহিনী তাদের নিজেদের মূল্যায়নে অত্যন্ত হীন অবস্থায় ছিল। আইনের প্রয়ােগ এবং শৃঙ্খলা রক্ষা উভয় দায়িত্বই ব্রিটিশ আমলের মতাে তখনও পুলিশ বাহিনী পালন করত। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ প্রশাসনের। প্রতিবেদনে পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল স্বাধীনতার প্রথম বছর সম্পর্কে বলেন, “এটি নজিরবিহীন প্রবল চাপ ও সংকটের বছর।” মজার ব্যাপার এই যে, প্রারম্ভিক অনিশ্চয়তার এ সময়ে সরকারি প্রতিবেদনসমূহ সদয়ভাবে নতুন দেশকে অভিহিত করেছে ‘শিশুরাষ্ট্র’ বলে অথচ শিশুরাষ্ট্রের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র চক্র ছিল কৌশলী এবং দক্ষ। রাজনৈতিক স্বাধীনতা রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য অবধারিতভাবে এক অনিশ্চয়তার জন্ম দিল। তার মধ্যেও এ পরিস্থিতিতে কখনও কখনও জনগণের আবেগ ও উদ্যম ছিল অত্যন্ত প্রবল। কর্মকর্তাদের বিবেচনায় রাষ্ট্র ছিল জনগণের উপর চেপে বসা ভারি যন্ত্র। পক্ষান্তরে সরকার সম্পর্কে জনগণের ধ্যানধারণা ও প্রত্যাশা প্রায়শ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ধাঁধায় ফেলে দিত। একদিকে রাষ্ট্রের প্রয়ােজন এবং কাম্য ছিল জনগণের আনুগত্য, নতুন রাষ্ট্রের কাছে যাদের প্রত্যাশা মাঝে মাঝে ছিল একেবারে অবাস্তব। অন্যদিকে রাষ্টের প্রশাসনযন্ত্রকে সুসংগঠিত করার প্রয়ােজন ছিল; কেননা রাষ্ট্রে ইতােমধ্যে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলাে ছিল অগণতান্ত্রিক, দমনপীড়ক এবং নিকৃষ্টতম শক্তির ধারক। রাষ্ট্রের ও সরকারের এই নিপীড়কমূলক ভূমিকা থেকে পবিত্রতার ভূমিকায় যারা অবতীর্ণ হতে পারতেন তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও দল থেকে তাড়িত। পাকিস্তানের আমলাচক্র হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা ফজলুল হকের প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানে রাষ্ট্র প্রশাসনে তারা ছিল অবাঞ্ছিত ও অবহেলিত।
অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী এইচ, এস, সােহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের সংসদীয় দল থেকে নেতৃত্বচ্যুত হয়ে উদ্যোগী হলেন অবনতিশীল বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্ককে উন্নত করার কার্যক্রমে। যখন দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতা শহরকে স্বাধীনতা-পরবর্তী বিজয়ােৎসবের আনন্দ আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, তখন তিনি এক দরিদ্র মুসলমানের জীর্ণগৃহে অনশনরত গান্ধীজীর অনশন ভাঙানাের চেষ্টা করেছিলেন। শেরে বাংলা ফজলুল হক, যিনি যুগ যুগ ধরে বাঙালি মুসলমানদের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন, তিনি জিন্নাহর কূটকৌশলের ম্যারপ্যাচে বাংলার মুসলিম লীগের রাজনীতিতে প্রস্তাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে কলকাতায় নিজের বাসভবনে নিরাসক্ত মর্মবেদনা নিয়ে কালাতিপাত করছিলেন। মুসলিম লীগের সেক্রেটারি আবুল হাশিম, যিনি মৃতপ্রায় সংগঠনটিকে একটি কর্মপরিকল্পনা ও প্রাদেশিক কর্মসূচির ঘােষণাপত্র দিয়ে এর উদ্যমী তরুণ ছাত্র-সদস্যদের উজ্জীবিত করেছিলেন, তিনিও দেশবিভাগের সময়কার গােলযােগ ও প্রান্তিক সময়ে যে তত্ত্ব নিয়ে উপস্থিত হন তা জনগণের নিকট পৌঁছে দেবার মত সময় ছিলনা । তিনি তখন সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে একটি সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার জন্য তার সমস্ত কর্মোদ্যোগ নিয়ােগ করেন। অবশ্য এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে তিনি অবশেষে বর্ধমানে তাঁর গ্রামের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করেন। আসামের মুসলিম লীগের প্রেসিেিডন্ট মওলানা ভাসানী, যিনি পূর্ববঙ্গ থেকে আসামে এসে বসবাসকারী মুসলমান কৃষকদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আসামের জেলা সিলেটকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, তিনিও দেখতে পেলেন, স্বাধীনতা-উত্তরকালে নতুন মুসলিম লীগের দলীয় বিন্যাসে তার কোনাে স্থান নেই এবং অল্প দিনের মধ্যেই তিনি আসাম সরকারের কারাগারে বন্দি হলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান ও আবুল মনসুর আহমদ বঙ্গদেশ বিভক্ত হওয়ার পর কিছুদিন কলকাতায় থেকে যান। আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দীন আহমেদ, শামসুল হক প্রমুখ ঢাকাভিত্তিক বিশিষ্ট মুসলিম লীগ নেতা তখন স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের নতুন কেন্দ্র ঢাকার নবাববাড়ী ‘আহসান মঞ্জিল’ থেকে তাদের দূরত্ব পরিমাপ করে চলেছেন। কিন্তু একথা বলা যায়, তাদের প্রত্যেকেই স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিরােধীদলীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খাজা নাজিমউদ্দীন এবং মওলানা আকরাম খাঁ যথাক্রমে প্রাদেশিক সরকার ও মুসলিম লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রাক্তন ঔপনিবেশিক গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক বাের্ন স্বাধীন পূর্ববঙ্গের প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হন। মূলত পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ। তিনটি হাত কেন্দ্রের কাছে বাঁধা পড়ে। এগুলাে হচ্ছে নেতৃত্বের জন্য আহসান মঞ্জিল, প্রচারের জন্য দৈনিক আজাদ, অর্থের জন্য ইস্পাহানির বাণিজ্যিক সংস্থা।
সংক্ষেপে এই ছিল তদানীন্তন মুসলিম লীগের ভিত্তি। ভারতের মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে মুসলিম লীগকে স্বীকৃতি দিয়ে ব্রিটিশ রাজ মুসলিম লীগের কাছেই রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর করে। যেখানে বাঙালিদের অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। যারা ছিল তারা দালাল ও উর্দু প্রেমিক। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরা ছিল সংখ্যাগুরু। ভােটারসংখ্যার দিক থেকেও তাদের ছিল সংখ্যাধিক্য। প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহের অনুপস্থিতি ছিল সবচেয়ে ক্ষতিকর। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণভার বাঙালিদের কেউ কোন পর্যায়ে পায়নি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে তিনজন বাঙালি প্রধানমন্ত্রীরূপে কাজ করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন সাক্ষীগােপাল এবং একজন ছিলেন একটি কোয়ালিশনের সংখ্যালঘু অংশীদাররূপে ক্ষমতাসীন। কিন্তু সংসদীয় আইনের কোনাে তােয়াক্কা না করে মাত্র ১৩ মাসের মধ্যে শেষােক্ত জনকে অপসারিত করা হয়। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান দুজন সৈনিক প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাসীন হন। তারা কেন্দ্রে অবিসংবাদী ও সীমাহীন ক্ষমতা ভােগ এবং প্রয়ােগ করেন। বিশেষ করে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ ও চক্রান্ত করেন। প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহের দুর্বলতার দরুন এবং জাতীয় আইনসভাসমূহের গুরুত্ব না থাকার কারণে পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র, সশস্ত্রবাহিনী এবং শেষদিকে ভূস্বামী ও ব্যবসায়ী শ্রেণী সমন্বয়ে কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়। ঐ ব্যবসায়ীরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপােষকতা পেয়ে প্রবল হয়ে উঠেছিল। ফেডারেল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। কেন্দ্রীয় সরকার কেবল অভ্যন্তরীণ রাজস্বের মূল উৎসগুলাে এবং বৈদেশিক সাহায্য ও রপ্তানি আয় বরাদ্দের ক্ষমতাই হাতে রাখেনি, অর্থনীতি সংক্রান্ত সকল প্রধান নীতিনির্ধারক সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে থাকে। ফলে প্রাদেশিক সরকারগুলাে ছিল কেন্দ্রের সৃষ্ট পুতুল।
স্বায়ত্তশাসন ছিল ভূলুষ্ঠিত। কেন্দ্রীয় সরকার সম্পূর্ণভাবে আমলাতন্ত্র ও সশস্ত্র বাহিনীগুলাের কর্তৃত্বাধীন ছিল এ প্রতিষ্ঠানগুলােতে, বিশেষত তাদের উচ্চতর স্তরে প্রাধান্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের। কেন্দ্রের ক্ষমতাকাঠামাের গঠন কী রকম ছিল তা বিশ্লেষণ করে দেখা যাবে। ক্ষমতার উচ্চতর স্তরগুলাে বাঙালিদের কোটার পরিমাণ বাদ দিয়ে রাখা হয়েছিল। পাকিস্তান ছিল মূলত অতিকেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন একটি অপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার। জেনারেল আইয়ুব খান ও পরে ইয়াহিয়া খানের মতাে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্ট থাকার মানে হচ্ছে বাঙালিদেরকে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার সম্পূর্ণ বাইরে রাখা। পাকিস্তানের ইতিহাসে কোন বাঙালি অর্থমন্ত্রী হননি কিংবা বৈদেশিক সাহায্য সংক্রান্ত আলাপ আলােচনা নিয়ন্ত্রণকারীর পদে কোনাে বাঙালি কখনও নিযুক্ত হননি। ১৯৭১ সালে পরিকল্পনা কমিশন বন্ধ হয়ে যায় । কিন্তু সে অবধি কোন বাঙালি পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়াম্যান হননি। শুধু ১৯৬৯ সালে একজন বাঙালি প্রথমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নিযুক্ত হন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কোন বাঙালি।
কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নর হননি। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতাে। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কোন বাঙালি যুগ্ন-সচিবের পদ পর্যন্ত উঠতে পারেননি। আর সশস্ত্রবাহিনীগুলাে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদেরই একচেটিয়া। এ কথা বলা মােটেই অত্যুক্তি হবে না যে, ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বাঙালিদেরকে অত্যন্ত কার্যকরভাবে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের উচ্চতর এবং এমনকি মাঝারি পদ থেকে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রগুলাে থেকে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক নীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কেন্দ্রগুলাে থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। জনগনের বা জনমতের কোন তােয়াক্কা করার কোনাে মানসিক বা ইচ্ছা পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠীর ছিল না।
১৯৫০-এর দশকে কেন্দ্রের প্রাথমিক অপকর্মগুলাে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ সরকার নিষ্ক্রিয় দর্শকের মতাে প্রত্যক্ষ করে। এই সচেতন নিষ্ক্রিয়তা আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করেছিল। প্রাদেশিক সরকারের প্রতিনিধিত্বমূলক ক্ষমতা ও মর্যাদা না থাকায় কেন্দ্রের মােকাবেলা করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। ১৯৫৪-৫৮ সালে যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ শাসনেরকালে কেন্দ্রের কাছ থেকে সম্পদ ও স্বায়ত্তশাসন দাবি প্রদেশের ক্ষমতা রক্ষার জন্য গণপরিষদে বিভিন্ন বিষয়ে তুমুল বিতণ্ডা করতে হয়। এর বিশ্লেষণে তিক্ত-বিরক্ত শেখ মুজিব পার্লামেন্টে বিতর্কে আবেদন জানিয়ে বলেন “জুলুম মাৎ করাে ভাই” যদি তােমরা জোর খাটাও তাহলে আমরা অসংবিধানিক পন্থা বেছে নেব। তােমাদের অবশ্যই সাংবিধানিক পথে এগােতে হবে। যদি জনগণকে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে না দেও, তাহলে তারা বাধ্য হয়ে অসংবিধানিক পথ বেছে নেবে। আমি দেখেছি দুনিয়ার ইতিহাসে এরূপই হয়েছে এবং এরকম ঘটনাই ঘটেছে। সুতরাং আমি আর একবার। আবেদন করি, যদি তােমরা পাকিস্তানকে ভালোবাস, যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানের সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই তােমরা ক্ষমতায় আছ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের সবকিছুর শীর্ষে আছাে তারপরেও এ কথা পরিষ্কার যে সকল জনগণ সংগ্রাম করে এদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল তারা তােমাদের সাথে নাই।” ১৯৫৫ সালে ২১ সেপ্টেম্বর। করাচী। বুধবার বেলা ১০টা। শেখ মুজিব বলেন, আমরা একুশ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়েছি। প্রকৃত সত্য হলাে এই আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, একুশ দফায় শুধু দেশরক্ষা, বিদেশনীতি ও মুদ্রা ব্যতীত কেন্দ্রের হাতে আর কিছু থাকবে না, সবকিছু চলে যাবে প্রদেশের হাতে। এক ইউনিট বিল পাশ করার সময় স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি বিবেচনা করা হবে বলে বলা হয়েছে।
কিন্তু তার কোন কিছুই হয়নি। তিনি ঐ অধিবেশনে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের মতাে আত্মত্যাগ করেনি। তিনি বলেন, পাকিস্তানের যে চক্র বর্তমানে শাসন করছে তাদের আমরা চিনি। তারা ধারালাে ছুরি হাতে পূর্ব বাংলাকে মাছের মতাে কাটছে। তিনি বলেন, দিল্লী কনভেনশনে বলা হয়েছিল, কোন ইস্যু বিচারের ক্ষেত্রে যখন ন্যায়বিচার ব্যর্থ হবে, সমতা থাকবে না এবং সমঅধিকার থাকবে না তখন শুধু ভালাে কথায় কাজ হবে।জনগণকে বিভ্রান্ত করবেন না এবং আগুন নিয়ে খেলবেন না । আপনারা যদি করাচী থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যেতে চান যেখানে পূর্ব পাকিস্তান বেশি টাকা পিয়েছে, শতকরা ৬০ ভাগ টাকা ব্যয় করেছে, সেখানে আমিও সরাসরি বলতে চাই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। কেন্দ্রের হাতে মাত্র তিনটি বিষয় রাখতে হবে। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমতা আনতে হবে। যুক্ত নির্বাচন দিতে হবে। এ সম্পর্কে বিল নিয়ে আনুন। ঐ দিনই তিনি বলেন যদি এক ইউনিট পাস করতে চান তাহলে আমাদের স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাস করতে হবে। ঐ তিনটি বিষয় ছাড়া কেন্দ্রের হাতে আর বেশি কিছু দেয়া যাবে না।” বাংলা ভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের বাংলায় কথা বলতে দিতে হবে। আমরা ইংরেজি জানলেও বাংলায় কথা বলতে চাই, যদি তা অনুমতি না দেয়া হয় তাহলে আমরা অধিবেশন বয়কট করব। এটাই হলাে আমাদের স্ট্যান্ড।
২২ সেপ্টেম্বর। করাচী। ১৯৫৫।২.৩০ মিনিট। শেখ মুজিব বলেন, গণতন্ত্রের মৌলিক অধিকার ভঙ্গ করে গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরের হাতে যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে তাতে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। যিনি জনগণের প্রতিনিধি নন তিনি হতে পারেন রাষ্ট্রপ্রতি। তার হাতে সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করা সঠিক হবে না। ৩০ সেপ্টেম্বর। করাচী। গণপরিষদে শেখ মুজিব বলেন, পাকিস্তানের একজন নাগরিক হিসেবে আমি এ অভিমত প্রকাশ করছি যে, এক ইউনিট প্রবর্তিত হলে পাকিস্তান ভাঙনের দিকে চলে যাবে। ঐদিনই তিনি বলেন সর্বক্ষেত্রে আমরা সমতা চাই। সংখ্যাসাম্য চাই, দেশ রক্ষার প্রতিটি বিভাগে এবং প্রতিটি বিষয়ে। এ সময় হামিদুল হক চৌধুরী যিনি যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন তারা একুশ দফা ভুলে গিয়ে শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য এক ইউনিটের সমর্থন করছেন। এখন পর্যন্ত বাংলায় রিপােটিংয়ের ব্যবস্থা হয়নি। দেশের গরিব মানুষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে কিন্তু তাদের জন্য কিছুই করা হচ্ছে না। শাসকগােষ্ঠী পাকিস্তানের স্বাধীনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। ১ অক্টোবর। ১৯৫৫। পাকিস্তানে চক্রান্ত করে ষড়যন্ত্র করে এবং দুর্নীতি-পন্থায় গভর্নর জেনারেল করা হচ্ছে। যাদের গণতন্ত্রের নীতির প্রতি শ্রদ্ধা নেই। বর্তমান শাসকেরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নয় । সেজন্য জনগণের পক্ষে তারা কাজ করছে । তিনি বলেন অবশ্য আমি সাপের দাঁত থেকে মধু আশা করতে পারি না।” গভর্নর জেনারেলকে যেভাবে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাতে পাকিস্তান কোথায় যাবে আমি জানি না এবং কী করবে তাও জানি না। তার একচ্ছত্র ক্ষমতা এক নােটিসে গণপরিষদের ক্ষমতা খর্ব করতে পারে । গণপরিষদ ভেঙে দিতে পারে। এভাবে চললে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী হবে?
আমরা জেলজুলুম মােকাবেলা করেই এখানে এসেছি। কিছুদিনের জন্য জনগণকে বােকা বানাতে পারে কিন্তু সর্বসময়ের জন্য সবলােককে রাফ দেয়া যায় না। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে দু’মাসের মধ্যে ৯২-কে (ক) ধারা জারি করে কেন্দ্রের কুচক্রী মহল জনগণের কল্যাণে নয়, তাদের ক্ষমতা হাতে রাখার জন্য ৯২ (ক) ধারা জারি করেছিল। আমলাতন্ত্র ও নেপথ্যে সামরিক চক্রের কারসাজি এগুলাে । ৯ নভেম্বর ১৯৫৫ করাচী। শেখ মুজিব বলেন, আমার কতিপয় বন্ধু বলে থাকেন, কেন্দ্রের হাতে দেশ রক্ষা, বিদেশনীতি ও মুদ্রা থাকলে কেন্দ্র দুর্বল হয়ে যাবে। তারা শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে। দীর্ঘ আট বছর ধরে পূর্ব বাংলার জনগণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম করছে। আমি দেখাতে পারি কীভাবে তাদের শােষণ করা হচ্ছে। এখন যারা দেশ শাসন করছে তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দুই আনা সদস্য ছিলেন না। তারা ইসলামের নামে পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়। যদি একুশ দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন করা হয় তাহলে আমরা তার সমর্থন করব, না হলে পূর্ব বাংলার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করব। ১৯৪০-১৯৫০-এর দশকে কেন্দ্রীয় সরকারগুলাের অধীন প্রাদেশিক আমলাতন্ত্রের উচু পদগুলােতে বসেছিলেন অবাঙালিরা। ভাষা, সংস্কৃতি ও চাকরিসূত্রে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকায় এসব অবাঙালি অফিসার কেন্দ্রের বাঙালি মন্ত্রীদেরকে খুব কমই সমর্থন দিতেন। আওয়ামী লীগ সরকার আমলাতন্ত্রের বাইরে গিয়ে কেন্দ্রের সমর্থনে প্রবীণ বাঙালি অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটা পরিকল্পনা বাের্ড গঠনের প্রয়াস নেয়। কিন্তু তাদের এসব প্রচেষ্টা প্রাদেশিক প্রশাসনকে অবাঙালি আমলাদের কবলমুক্ত করতে অথবা কেন্দ্রের সাথে তাদের অমলাতান্ত্রিক সংযােগ বিচ্ছিন্ন করতে সফল হয়নি। ফলে, পরিকল্পনা বাের্ড প্রাদেশিক প্রশাসনের মধ্যে একটি নতুন কর্তৃত্বের উৎসরূপে কাজ করতে না পেরে কেন্দ্রের সাথে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বৈঠকে বাঙালিদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বৈঠক আলােচনার একটি সংস্থায় পরিণত হয়।
১৯৬০-এর দিকে বাঙালিরা প্রাদেশিক সচিবের পদ লাভ করতে শুরু করার পর। কেন্দ্রের সাথে সম্পদ বরাদ্দ সংক্রান্ত বিতর্কে বাঙালিদের দাবি উত্থাপনের অধিকতর সচেতন প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু সামরিক আইন প্রবর্তন এবং জাতীয় ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে এক পশ্চিম পাকিস্তানি প্রধান নির্বাহীর কুক্ষিগত হওয়ার পর কেন্দ্র ও প্রদেশ উভয় স্তরে বাঙালি মন্ত্রী ও প্রাদেশিক গভর্নরদের চাকরি প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা বা খেয়ালখুশির অধীন হয়ে পড়ে। তাঁদের প্রতিনিধিত্বমূলক মর্যাদা কিংবা রাজনৈতিক সমর্থন না থাকায় অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার উপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর প্রাধান্যের বলয়ে বাঙালি আমলাদেরকে এমন একটা অবস্থার মধ্যে কাজ চালাতে হয়, যেখানে বাঙালি মন্ত্রীরা কেন্দ্রের সাথে যেকোন পরিস্থিতির মােকাবেলায় তাদেরকে রক্ষা করতে পারতেন না। প্রাদেশিক প্রশাসনের ক্ষমতাহীন ও সম্পদহীন অবস্থার দরুন শক্ত ভূমিকার সুযােগ এমনিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রদেশে ও কেন্দ্রে কর্মরত বাঙালি আমলারা এভাবে প্রায় ক্ষেত্রেই গােপন তথ্যের উৎস হিসেবে কাজ করতে পেরেছেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে সমর্থনকারী অর্থনীতিবিদদের পরামর্শদাতায় পরিণত করা হয়েছে, যে পরামর্শ শেষ পর্যন্ত প্রহসনে রূপান্তরিত হয়েছে।”
জনগণকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে টেনে আনার কর্মসূচি ও কৌশল গ্রহণ না করলে পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী পেশা মানিয়ে কিছু বাড়তি সুযােগ সুবিধা দিয়ে আন্দোলন দমিত করা সম্ভব হতাে। ১৯৬০-এর দশকে এবং বেশি করে ১৯৬৯-এর মার্চের পরে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি বিনিয়ােগ বৃদ্ধি, একটি বাঙালি বুর্জোয়াশ্রেণী গড়ে তােলা, পাবলিক ওয়ার্কস প্রােগ্রামের মাধ্যমে গ্রামের ধনী কৃষকদের দিকে সম্পদ প্রবাহিত করা ও কেন্দ্রীয় সরকারের পদগুলােতে বাঙালি সিভিল সার্ভেন্টদেরকে উন্নীত করার একটি প্রচেষ্টা নেয়া হয়। এ কৌশল পূর্ণ অংশীদারিত্ব পেত না, কিংবা ছয় দফার স্বায়ত্তশাসন দাবি মেনে নেয়া পর্যন্ত এগুতে
, তবে এটা বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীগুলোর জন্য সুযােগের ছিটেফোটা সুযােগ খুলে দিতে পারত। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অগ্রণী বাহিনী মধ্যবিত্তকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে স্বশাসনের সংগ্রামকে বানচাল করার সম্ভাবনাটি শেখ মুজিবুর রহমানের নজরে পড়েছিল। তিনি যে আন্দোলনকে জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার ও জনগণকে ভাষা আন্দোলনের আপােসহীন লড়াই সংগ্রামের মধ্যে বাঙালির আত্মজাগরণের যে বিষয় সূচিত হলাে, তার মাধ্যমে বাঙালি জাতি আবিষ্কার করল স্বদেশ চেতনার নব ধারা আত্মবিস্মৃত জাতি নতুন জাগরণে সাহসী হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি শাসন চক্র অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে প্রাসাদ চক্রান্তের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে ভাঙনের প্রচেষ্টা নেয়। যুক্তফ্রন্টের নেতা ও জনগণের মধ্যে যে বৃহৎ পরিসরে যে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান শাসক গােষ্ঠী সে ঐক্য ভাঙন ধরাতে সক্ষম হয়। তাদের সামনে ক্ষমতার প্রলােভিত দরজা খুলে দেয়া হয়। বাঙালি নেতৃত্ববৃন্দ বিভক্ত করে পাকিস্তানি শাসন-শােষণ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়।
এই অপচেষ্টার এক পর্যায়ে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে ফাঁসি দিতে চেয়েছে। কিন্তু ততদিনে সংগ্রামী ছাত্র সমাজ উপলব্ধি করেছে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বাঙালির পৃথক জাতিসত্তার প্রয়ােজন। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে মিছিল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এই নব উথিত শক্তিকে তারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। শেখ মুজিবসহ কতিপয় নেতা পাকিস্তানি শাসকদের এসব চাতুর্য ও কৌশল থেকে বাঙালি জাতিকে অগ্রসর করে নেয়ার প্রশ্নে আপােসহীনভাবে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ধারায়, নানা ঘটনা প্রবাহে জাতিকে তাদের খপ্পর থেকে মুক্তি পথ-অন্বেষায় জেল-জুলুম কারাগারকে বেছে নিতে দ্বিধা করেনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন বাস্তবতার মুখােমুখি হওয়ার পর পাকিস্তান রাষ্ট্র বুঝতে পারে যে, এ নেতৃত্বকে কিনে ফেলা যাবে না। হয় স্ব-শাসনের বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে নতুবা বাঙালি জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বকে ধ্বংস করে দিতে হবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রকেই ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র যে তার রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবিগুলোকে জায়গা করে দিতে পারেনি। পাকিস্তানের শিল্প-পুঁজি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হলেও তাকে আমলাতন্ত্রের নানা রকম বাধা পেরিয়েই বিকশিত হতে হয়েছে। এ সব আমলাতান্ত্রিক বাধা-নিষেধের অনেকগুলােরই উৎস ব্রিটিশ আমল থেকেই, কারণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সঙ্গত কারণেই ভারতবর্ষের দেশীয় শিল্প পুঁজির বিকাশকে ‘নিয়ন্ত্রণ করতে চাইত।
কিন্তু স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানে এসব বিধি-নিষেধের তেমন কোনাে প্রয়ােজন না থাকলেও বাস্তবে দেখা যায় যে এ সব বিধি নিষেধকে বহাল রাখা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে বাড়ানাে হয়েছে। আইন-কানুনের নিয়ন্ত্রণ এতই ব্যাপক ও জটিল হয়ে উঠল যে সে ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের তথ্য প্রদান ও পারমিট লাইসেন্স গ্রহণের নানা রকম বিধি-নিষেধের বেড়াজাল থেকে তাদের বের হওয়ার পথ দেখাতে সরকারকে “ইনভেস্টমেন্ট ইনফরমেশন ব্যুরাে স্থাপন করতে হয়। এর ফলে ব্যক্তি ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর আমলাতন্ত্র তার নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করে। এই সত্যটা থেকেই যায় যে রাষ্ট্রকে প্রান্ত পুঁজিবাদের নিয়ম-নীতি মেনেই চলতে হতাে। যারা শ্রেণী ও রাষ্ট্রের সম্পর্ককে খুব সহজ করে দেখেন তারা রাষ্ট্র ও কর্তৃত্বশালী শ্রেণীর সম্পর্কের মধ্যেও যে মাঝে মাঝে আপাত স্ববিরােধিতা দেখা যায়, সেই প্রকৃত দ্বান্দ্বিক সত্যটা বুঝে উঠতে পারেন না । রাষ্ট্রের শক্ত নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তানের পুঁজিবাদী বিকাশ ঘটলেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র ও বুর্জোয়ার মধ্যেকার। স্ববিরােধিতা ও দ্বন্দ্বকে বুঝতে এ বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা প্রয়ােজনীয়। আমলাতন্ত্রের ওপর পুঁজিবাদীদের এই নির্ভরশীলতার কারণে আমলাতন্ত্র ব্যাপক পরিমাণে ঘুষ গ্রহণের পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে যা উদ্বৃত্ত অর্থ সৃষ্টি করে। আমলাতান্ত্রিক শুধু জমি বা সম্পত্তি কেনে না, কোন ব্যবসায়ীর সঙ্গে মিলিতভাবে ব্যবসাতেও খাটায়। আমলাতন্ত্র বা সামরিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে যােগাযােগ থাকার কারণে কিছু পরিবার দেশের বৃহত্তম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে পড়ে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তা রাষ্ট্রের উপরে আমলাতন্ত্রের প্রভাব খর্ব করার মতাে যথেষ্ট ছিল না। জেনারেল আইয়ুব খানের সময়ে এ ব্যাপারে কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়, কিন্তু তার নিজের পরিবারও দেশের অন্যতম বৃহত্তম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে বসেছিল। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ধনী হওয়ার নতুন দিক শুরু হয়। অপেক্ষাকৃত ধনী ব্যবসায়ীরাই আমলাতন্ত্রের উপর মহলে প্রবেশ ও তা থেকে সুযােগ আদায় করে নিতে পারে।
এর ফলে ধনী ও পুরােদস্তুর বিবেকবােধ বর্জিত ব্যবসায়ীরাই অপেক্ষাকৃত কম ধনী ও সৎ ব্যবসায়ীদের থেকে বেশি সুযােগ-সুবিধা আদায় করে নেয়, স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীরা ক্রমশ প্রতিযােগিতায় হেরে যেতে থাকে এবং সম্পদ ধনী ব্যবসায়ীদের কুক্ষিগত হয় । ধনী পুঁজিপতিরা শুধু তাদের অধিক ধন-সম্পদের কারণেই নয়; রাষ্ট্রীয় কাঠামাে ও সেখানে তাদের ভূমিকার কারণেও অপেক্ষাকৃত কম ধনী ব্যবসায়ীদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। পাকিস্তানে যে পর্বতপ্রমাণ ধনবৈষম্য, যার কথা পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান অর্থনীতিবিদ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, এটা তার অন্যতম কারণ । ১৯৬৮ সালের মাঝে আমরা দেখি যে দেশের মােট শিল্প পুঁজির শতকরা ৬৬ ভাগ মাত্র ২২টি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।” প্রথমত, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সরকার কাঠামােটি সবসময় এমন একটি প্রশাসনিক চক্রে আটকে ছিল যার প্রধান বৈশিষ্ট্যই ছিল সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক একনায়কসুলভ প্রাধান্য। পাকিস্তান নামের দেশটি এরূপ একটি প্রশাসনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার তুঙ্গে পৌছেছিল আইয়ুব খানের আমলে। এর সবটার দায়দায়িত্ব এককভাবে আইয়ুব খানের নয়, ধারাবাহিকতায় স্ফীত হয়েছে কেবল। আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্যের ভিত্তি গড়ে উঠেছিল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আমলেই। এরা দুজনেই অতি মাত্রায় আমলানির্ভর ছিলেন। এর কারণ ছিল সম্ভবত এই যে, জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলী দু’জনেরই প্রশাসনিক কাজের বাস্তব কোনাে অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে উভয়কেই আমলাদের উপর বেশি নির্ভরশীল হতে হয়েছিল। এ আমলাদের কয়েকজন প্রবাসী ব্রিটিশ আইসিএস অফিসার।
জিন্নাহর তার প্রকৃতি জেদী, একরােখা এবং নিজস্ব ধ্যান-ধারণার মধ্যেও কিছুটা আমলাতান্ত্রিক মনােভাব কাজ করত। যেমন ১৯৩৫ সালে অভিযােজিত ভারত শাসন আইন অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রথম সরকার-প্রধান হিসেবে তিনি প্রধানমন্ত্রী না হয়ে গভর্নর জেনারেলের পদটি বেছে নিয়েছিলেন। মাউন্টব্যাটেনের পর ক্রিপসকে একটি চিঠিতে লিখলেন, “আমার কাছে গােপন খবর হলাে যে, মি, জিন্না যে পথ নিচ্ছেন, তাতে তার ঘনিষ্ঠ অনুচররা আর পরামর্শদাতারা ভীত হয়ে উঠেছেন। এটা প্রায় অবিশ্বাস্য যে, একজন মানুষের অহং এত দুরারােগ্য হতে পারে, যাতে সে এক্ষুণি ‘হিজ এক্সেলেন্সি’ হয়ে ওঠার জন্য তার নিজের ভবিষ্যৎ ডােমিনিয়নের জন্য প্রয়ােজনীয় বাস্তাব সুবিধাগুলােকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারে, আট মাস পরে যখন এমনিতেই সে এই শিরােপটি পেত। জওহরলাল নেহরু এই মতটি মানেন, কিন্তু বল্লভভাই প্যাটেল জিন্নার উদ্দেশ্যকে আরও অশুভ হিসেবে দেখেন, আর ভাবেন যে তিনি ভারতীয় ডােমিনিয়নের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত দুরভিসন্ধি নিয়ে এক ধরনের ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব তৈরি করতে চান অথচ উল্লিখিত আইনটিতে স্বাধীন পাকিস্তানের জন্যে একটি সংসদীয় সরকার পদ্ধতির বিধানই সংযােজিত ছিল। জিন্নাহর অধীনে চারটি প্রদেশের মধ্যে তিনটির গভর্নরই ছিলেন আইসিএস অফিসার। তিনি সচিব পর্যায়ে তার নিজস্ব পছন্দের কিছু কর্মকর্তাসহ এসব গভর্নরের কাছ থেকে সরাসরি পরামর্শ গ্রহণ করতেন এবং এভাবেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অবস্থান তার সময় থেকেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। ফেডারেল পাকিস্তান সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার সকল মন্ত্রীরই একই রকম প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ছিল অথবা তাদের উত্তরসূরি মন্ত্রী এবং আইন প্রণেতারা পরবর্তী বছরগুলােতে (১৯৪৭-১৯৫৮) নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে ভালাে কিছু প্রদর্শন করতে পেরেছিলেন।
বরং জিন্নাহর মৃত্যু এবং লিয়াকত আলীর হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল মুসলিম লীগে ভাঙন দেখা দিতে শুরু করল এবং দলটিতে গােষ্ঠীরাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে সাথে যখন তখন প্রদেশগুলােতে গভর্নরের এবং কেন্দ্রে গভর্নর জেনারেল কিংবা প্রেসিডেন্ট শাসন জারির ঘটনায় এ অবস্থাটির আরও সঙ্গীন আকার ধারণা করেছিল। এ ধরনের শাসনকালীন সময়গুলিতে সাধারণ প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ বাতিল থাকত এবং দেশ কার্যত শাসিত হতাে আমলাদের দ্বারা। ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু হওয়া আইয়ুব খানের সামরিক শাসন এ অবস্থাটিকে কেবল একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল এবং সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনায় আমলাদের ছিল বাড়তি বা অপরিমেয় স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা। গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ ও প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের একক নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের অধীনে গড়ে ওঠা প্রধান দুটি নিখিল পাকিস্তান সার্ভিস (সিএসপি ও পিএসপি) পাকিস্তানের লােকজন প্রশাসনটিকে অতিমাত্রায় একটি এককেন্দ্রিক চরিত্র প্রদান করেছিল, যা অন্য কোন ফেডারেল পদ্ধতির সরকারে দেখা যায় না। বিভিন্ন শক্তির। কেন্দ্রবিমুখ প্রবণতাকে মােকাবিলা করার সামর্থ্য এবং দ্রুততার সাথে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্যে ‘চেইন অব কমান্ড’ প্রক্রিয়াটি গুরুত্ব অক্ষুন্ন রাখতে এ পদ্ধতিটির প্রাসঙ্গিকতা অপরিহার্য ছিল। পাকিস্তানের সংবিধান একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার লক্ষ্যে আর্থিক ও প্রশাসনিকভাবে প্রদেশগুলােকে কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল করে রাখতে চেয়েছিল এবং তা নিখিল পাকিস্তান এবং কেন্দ্রীয় সার্ভিসসমূহ ও আনুষঙ্গিক কিছু বিধি-বিধান চালু করেছিল। বিশেষত আইয়ুব খানের আমলে ঘােষিত ১৯৬২ সালের সংবিধান পাকিস্তানকে একটি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন-ব্যবস্থায় নিয়ে যায়, যেখানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডসমূহ প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জারিকৃত অধ্যাদেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতাে।
এছাড়া প্রাদেশিক গভর্নর এবং প্রদেশ মন্ত্রিসভার সদস্যরাও নিয়ােজিত হতেন কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর সমন্বয়ে গঠিত একটি নির্বাচকমণ্ডলীর পরােক্ষ ভােটে দেশের প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হতাে। যাদের অধিকাংশই তাদের স্রষ্টা আইয়ুব খানের বশংবদ । এভাবেই পাকিস্তানের প্রশাসন ব্যবস্থাটি অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত চরিত্র অর্জন করেছে। কিন্তু ক্ষমতা প্রায় সবটাই ফেডারেল সরকারের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। এ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটি বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমান্বয়েই খুব বেশি বিরূপ সমালােচনার মুখােমুখি হতে লাগল এবং দেশটি বিখণ্ডিত হয়ে পড়ার গুরুত্বপূর্ণ উৎসগুলাে ক্রমাগতভাবে দৃশ্যমান হচ্ছিল। এ অবস্থায় বিশেষ করে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র ব্যবস্থার যেক্ষেত্রে গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা জনগণের ন্যায্য দাবি। দাওয়ার বিষয়ে সােচ্চার কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যাবে এ ধরনের নিপীড়ক ও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তরুণ সমাজ বিশেষ করে ছাত্রসমাজ যেখানে এগিয়ে আসে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কখনাে কখনাে সবেগে চলে আসে বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর ও জাতির আকাক্ষার পরিপূরক কর্মসূচি ও পদক্ষেপ। সেই ক্ষেত্রে উপরিকাঠামাের এসব শাসকচক্র নির্দয়ভাবে তাদের দমন করে অথবা শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের বৃত্তে বন্দি ও অসহায় হয়ে পড়ে। এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয় জনগণই। কিন্তু তার জন্য বড় বেশি মূল্য দিতে হয় জাতিকে। যেমনটি, দিতে হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ