You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.23 | নিউজ উইক, আগস্ট ২৩, ১৯৭১ ঘনিষ্ঠ বন্ধু - সংগ্রামের নোটবুক

নিউজ উইক, আগস্ট ২৩, ১৯৭১
ঘনিষ্ঠ বন্ধু

যখন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমইকো গত সপ্তাহে নয়াদিল্লী গেলেন, স্থানীয় কূটনীতিক গোষ্ঠী বলতে গেলে খেয়ালই করেনি। কিছু ভিনদেশী দূতদের ভারতীয় কর্মকর্তাগণ আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে গ্রোমইকোর সফরে তেমন বিশেষ কিছু ফলতে যাচ্ছেনা। আবার দূতদের অনেকেই তীব্র গরম আর বৃষ্টি থেকে বাঁচতে (ভারতের) পাহাড়ি উত্তরাঞ্চলে গিয়েছিলেন চাঙ্গা হতে। তবে আগমনের এক দিনের মধ্যেই রাশিয়ার এক নম্বর কূটনৈতিক সমস্যা সমাধানকারী (গ্রোমইকো) সাফ জানিয়েছেন যে তিনি ভারতের রাজধানীতে জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছেন। নয়াদিল্লীর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পতাকা-খচিত টেবিলে বসে গ্রোমইকো সফল স্বাক্ষর করেন ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার বিশ বছরের শান্তি, বন্ধুত্ব, ও সহযোগিতার এক চুক্তিতে।

বাহ্যিকভাবে চুক্তির কথাগুলো এত স্থুল ছিল যে, এক পশ্চিমা বিশ্লেষকের মতে, এটি “কার্যতঃ যেকোনো কিছুই” বোঝাতে পারে। তবে এই চুক্তির গুরুত্ব অল্পই নির্ভর করছে এতে কি বলা হয়েছে বা এর দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে তার উপর। আরেকটি পরাশক্তির সাথে আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ভারত তার জোটবদ্ধ না হওয়ার নীতি থেকে অনেকখানি দূরে সরে এসেছে। দৃঢ়ভাবে ভারতের সমর্থনে এগিয়ে এসে রাশিয়া পাকিস্তানকে যেকোনো বেপরোয়া পদক্ষেপ নেয়ার বিরুদ্ধে সাবধান করে দিলো (আর এভাবে, মনে হয় আপাতত উপমহাদেশের দুই তিক্ত শত্রুর মধ্যে যুদ্ধের হুমকি হ্রাস পেয়েছে )। অবশ্য, এর মাধ্যমে মস্কো খোলামেলাভাবে চীনের (যে দেশটি পাকিস্তানের বিশ্বস্ত পৃষ্ঠপোষক) বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ঘোষণা করলো, এবং দক্ষিণ এশিয়াতে হঠাৎ করেই শক্তির ভারসাম্য বদলে দিলো। একই ধারাবাহিকতায়, এ চুক্তি এতদাঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব হওয়ার প্রতিফলন, এমন একটা সময়ে যখন অনেক ভারতীয় রিচার্ড নিক্সন এবং হেনরি কিসিঞ্জারকে ঘোর খলনায়ক হিসেবে দেখছেন। আর সেই অর্থে, ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি পিকিং আর ওয়াশিংটনের মধ্যে বিরাজমান সুসম্পর্কে আজ অবধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিপর্যয় বলে গণ্য করা যেতে পারে।

আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হলেও এ চুক্তি অকস্মাৎ তৈরি হয়নি, কারণ মস্কো এবং নয়াদিল্লী কমপক্ষে দু’বছর ধরে এই অভিপ্রায় পর্যবেক্ষণ করে আসছিলো। অবশ্য কিছুদিন আগ পর্যন্ত কোনো সরকারই ব্যাপারটি এগিয়ে নেয়ার তাগিদ অনুভব করেনি। অতঃপর এ বসন্তে পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত সহসা ঘটনার পট পরিবর্তন করেছে; যখন কয়েক মিলিয়ন বাঙালী শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে এবং সীমান্তে সংঘর্ষ চরমে উঠেছে। ফলে দুই দেশের মধ্যবর্তী সম্পর্ক অগ্নিগর্ভ হয়ে পড়েছে। খবর রটেছিল যে, সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদে ডানপন্থীদের পাহাড় সমান চাপের মুখে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশকামী বিদ্রোহীদের প্রতি কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রসারিত করতে উদ্যত হয়েছিলেন—এমন একটি পদক্ষেপ যা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান “যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য” বলে সতর্ক করেছিলেন। এরকম জরুরী পরিস্থিতিতে, মস্কো-দিল্লী চুক্তির প্রতি আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। আর মস্কোতে প্রায় দুই সপ্তাহ গোপন আলাপ-আলোচনার পর, আন্দ্রে গ্রোমইকো কাজ সমাধা করতে নয়াদিল্লীর পথে পাড়ি জমান।

বারো অনুচ্ছেদের এই চুক্তির অনেকটুকু নিয়োজিত হয়েছে প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং সংস্কৃতি বিনিময়ের নিরীহ অঙ্গীকারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অনুচ্ছেদ ৯, স্বাক্ষরকারী দেশের উপর তৃতীয় পক্ষের হামলা হলে তাৎক্ষণিক “পারস্পরিক পরামর্শের” প্রতিশ্রুতি দিয়েছে (সর্বসমক্ষে, স্বাক্ষরকারীরা জোর দিয়ে বলেন যে তারা কোনো বিশেষ তৃতীয় পক্ষের কথা মাথায় রেখে এ চুক্তি করেন নি; তবে কারো তেমন সন্দেহ নেই যে এ বর্ণনা প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান, এবং কিছুটা পরোক্ষভাবে চীনকে উদ্দেশ্য করে রাখা হয়েছে )। শব্দচয়ন যদিও নির্দিষ্ট নয়, তথাপি এ অনুচ্ছেদে “পরামর্শের” প্রতিশ্রুতি অবধারিতভাবে অস্ত্র সহায়তার দিকেই জোরাল ইঙ্গিত করে। একজন পর্যবেক্ষক বলেন, “ভারত নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যাতে যুদ্ধ শুরু হলে গোলাবারুদের সরবরাহ ঠিক থাকে।”

মুল্যঃ
এই প্রত্যাশার আশ্বাসে আনন্দে উদ্বেল হচ্ছে ভারত। “আমাদের জন্য এটা নতুন যুগের সূচনা,” একজন ভারতীয় কর্মকর্তা তার উচ্ছাস ব্যক্ত করেন, “জাপান এক পরাশক্তিতে পরিণত হতে পেরেছে কারণ মার্কিনীরা তাকে সুরক্ষা দিয়েছিল, তাই জাপানকে অস্ত্রের জন্য নিজের সংস্থান অপচয় করতে হয়নি। আমরা যেহেতু রাশিয়ার ছাতার নিচে আশ্রয় পেয়েছি, আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হতে পারে।” কিন্তু আসলেই কি তাই? এ জন্য কি ভারতকে তার “জোটবদ্ধ না হওয়ার নীতি” বিসর্জন দিতে হবে? যদিও মিসেস গান্ধি জনসমক্ষে নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থানের উপর এই চুক্তি প্রভাব ফেলবে না; বাস্তবতা হচ্ছে প্রথম বারের মতো ভারত এবং বিশ্বের অন্য একটি পরাশক্তি এমন একটা চুক্তির সমঝোতায় পৌঁছেছে যাতে স্বতন্ত্র সামরিক আভাস রয়েছে। “যেটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সেটা হলো, ভারত সবসময় নিরপেক্ষ থাকার গর্ব করে এসেছে” দিল্লীতে একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বিশ্লেষণ করেন, “এবার রাশানরা যে অভূতপূর্ব সাফল্য পেল, এভাবে তারা এখানে আরো অনেক মিত্র পেতে পারে।”

তবে স্পষ্টতঃ মস্কো যে কেবল ভারতের কল্যাণেই আগ্রহী তেমন নয়। যেমন গ্রোমইকো স্বয়ং গত সপ্তাহে সোভিয়েতের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে ইঙ্গিত দেন, ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির অন্যতম প্রধান কারণ হলো গণচীন। মস্কোতে পশ্চিমা কূটনীতিকদের দৃষ্টিতে, চীন ও আমেরিকার মধ্যেকার “পিং পং কূটনীতি ” রাশানদের হতচকিত করেছে, আর রাষ্ট্রপতি নিক্সনের পিকিং সফরের পরিকল্পনা তাদের স্তম্ভিত করেছে। এর মানে এই যে, এশিয়ায় সকল বাজীর পথ রুদ্ধ হলো, এবং ওয়াশিংটন-পিকিং লেনদেনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিলো—এটা রাশানদের অবরুদ্ধ করে ফেলবে এমন একটা অঞ্চলে (এশিয়ায়) যেখানে তারা (প্রতিবেশি দেশের সাথে) খাতির জমানোর অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়েছে। তাই দরকারী মুহূর্তে ভারতের পাশে দাঁড়িয়ে রাশানরা উপমহাদেশে প্রভাবশালী শক্তি হওয়ার দর হাঁকিয়েছে। অধিকিন্তু এমন একটি পদক্ষেপ সম্ভবতঃ সোভিয়েত নৌবহরকে ভারত মহাসাগরে বিস্তৃত হতে সহায়তা করবে।

পরাজিত পক্ষঃ
গত সপ্তাহে সোভিয়েত ইউনিয়নের বড় বিজয়ের সামনে আমেরিকাকে অনেকখানি পরাজিত দেখাচ্ছে। আমেরিকার চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা ভারতের রাশান শিবিরের প্রতি পরিচালিত হওয়ার জন্য আংশিকভাবে দায়ী। গত মাসে গোপন মিশনে পিকিং যাবার পথে ভারতে কিসিঞ্জারের যাত্রাবিরতির প্রতি ইঙ্গিত করে নয়া দিল্লীর একজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, “আমরা ভেবেছিলাম উনি (কিসিঞ্জার) স্বাধীনতার পর থেকে উপমহাদেশ যে চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেদিকে দৃষ্টি দিতে এই এলাকায় এসেছেন। তিনি আমাদের কথা যত্ন নিয়ে শুনলেন। অথচ পুরোটা সময় জুড়ে তার মাথায় ছিল চীন। তার সফরটাই ছিল একটা ছল।”

উপরন্তু, পাকিস্তানকে আমেরিকার অব্যাহত সাহায্য ও অস্ত্র প্রদান ভারতে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। “আপনি যদি জানতে চান কেন (ইন্দো-সোভিয়েত) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে,” মস্কোতে একজন ভারতীয় কূটনীতিক জানান, “আমি আপনাকে বলবো, মার্কিনীরা (পাকিস্তানকে) অস্ত্রের চালান দিয়ে আমাদের এর দিকে ঠেলে দিয়েছে।” বর্তমানে সত্যিই ভারত আমেরিকার কৌশলগত হিসাব নিকাশে পাকিস্তানের চেয়ে কম গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে যদিও নিক্সন প্রশাসন ইয়াহিয়া খানের সাথে সৌজন্য সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ বাড়িয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে, পাকিস্তানী রাষ্ট্রপতি একেবারেই মনোযোগ দিয়ে শুনছেন না।

বাঙালী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার স্থগিত করা বা বাদ দেয়ার মার্কিন আহ্বান স্বত্বেও ইয়াহিয়া গত সপ্তাহে দক্ষিণ পাঞ্জাবের বস্ত্র নগর লিয়ালপুর -এর কাছে এক কারাগারে তিন সদস্য বিশিষ্ট সামরিক আদালতে গোপন বিচার সম্পাদনে অগ্রসর হন। ইয়াহিয়া এর মধ্যে জনসমক্ষে বলেছেন যে মুজিব বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত। একজন পাকিস্তানী সম্পাদক মন্তব্য করেন, “একইসাথে রাষ্ট্রপতি এবং সামরিক প্রশাসনের প্রধান এমন একটা লোক যখন কাউকে দোষী বলে সব্যস্ত করে, তখন আপনি আশা একরকম ছেড়ে দিতে পারেন যে কয়জন সামরিক কর্মকর্তা তাকে নির্দোষ পাবে”। এটা ব্যাপকভাবে ভাবা হচ্ছে যে, আদালত মুজিবকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করবে, যাতে করে ইয়াহিয়া ইচ্ছেমতো রায় বহাল রাখা অথবা মহান সেজে শত্রুকে ছেড়ে দেয়ার সুযোগ পান।

তবে মুজিবের সমব্যথীরা আশাবাদী হতে পারছেন না। “এই মানুষটাকে হত্যা না করা যৌক্তিক হতো—আশেপাশে রাখা যেত যদি কখনো মন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে”, বলেন ইসলামাবাদের একজন পশ্চিমা কূটনীতিক, “কিন্তু তাকে বিচারের সম্মুখীন না করাটাও যৌক্তিক ছিল, যেমন যুক্তিসংগত ছিল শুরুতে তাকে গ্রেফতারই না করা। তবে এ সরকার এতদিন যৌক্তিক ও ন্যায্য উপায় প্রত্যাখ্যানে যেমন লক্ষণীয় কৃতিত্ব দেখিয়েছে, আবারো সেটা করতেই পারে।”

ইয়াহিয়ার কর্মকাণ্ড একজন মার্কিন কূটনীতিককে খেপিয়ে তুলেছে; “ইয়াহিয়া একটা বোকার হদ্দ!” আমেরিকা বর্তমানে যে পথে চলছে, হোয়াইট হাউজের নির্দেশ অনুযায়ী সে পথেই চলবে এমনটাই এখনো শোনা যাচ্ছে। “আমরাই একমাত্র পশ্চিমা সরকার যাদের ইয়াহিয়াকে প্রভাবিত করার কোনো রকম আশা আছে,” স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর একজন কর্মকর্তা যুক্তি দেখান, “খোলাখুলি বলতে গেলে, আমি মনে করি একটা পরিবর্তনের জন্য আমাদের যথেষ্ট বাস্তবধর্মী কর্মপন্থা আছে।” এরপর তিনি বিষন্ন কন্ঠে যোগ করেন, “কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এ নিয়ে কাজ করা কঠিন হবে।”