হাত তোল, যোগ দাও আমার সাথে
টাইম ম্যাগাজিন, ৫ই এপ্রিল, ১৯৭১
গত সপ্তাহে শেখ মুজিবর (মুজিব) রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা তাকে এমন এক রেকর্ড করার সুযোগ করে দিয়েছেন, যা পৃথিবীর কোন মানুষ কোনদিন ভাংতে চাইবে না। ৯ বছর ৮ মাস সময় জেলে কাটিয়েছেন মুজিব, পাকিস্তানের অন্য যেকোন প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক নেতাদের কারাবাসের তুলনায় অনেক বেশি।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা শেখ মুজিবের প্রতি এত বিদ্বেষ পোষণ করার মুল কারন, প্রায় ২৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য তিনি পূর্বদেশ (আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন) প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। গত ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচারনায়, এই পূর্বদেশই ছিল মুজিবের প্রচারনার মুল বিষয়। নির্বাচন শুরু হওয়ার ঠিক পূর্বেই তিনি জলোচ্ছাসে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় এলাকা পরিদর্শনে যান। সেখানে যেয়ে তিনি বক্তৃতায় বলেন- “ যদি নির্বাচনে আমরা হেরে যাই, তবে এই লক্ষ মানুষের কাছে আমাদের দায় থেকে যাবে। জলোচ্ছাসের আঘাতে নিহত এই মানুষগুলোর জীবন বিসর্জন বৃথা যাবেনা। এই লক্ষ মানুষের সর্বচ্চো আত্মত্যাগ আরো লক্ষ বাঙ্গালীর স্বাধীনতার অধিকার আদায়ের দাবিতে শক্তি যোগাবে”।
বাঙ্গালীদের তুলনায় লম্বা (৬ ফুট), গাঁট্টাগোট্টা শরীর, মাথাভর্তি পাকা চুলের মুজিবকে সবসময় দেখা যায় ঢিলেঢালা পাঞ্জাবির সাথে একটি কালো হাতকাটা কোর্ট পরিহিত অবস্থায়। একজন গম্ভীর মানুষ, বাঙ্গালীদের তিনি নিজের সন্তানের মতই ধমকান। ৫১ বছর আগে, পূর্ববাংলার টুঙ্গিপাড়ার এক মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারে তার জন্ম (গৃহস্থের পদমর্যাদার কারনেই শেখ পদবী দেয়া হয়)। মুজিব কলকাতা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা বিষয়ে অধ্যয়ন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ধানমন্ডির অভিজাত এলাকায় অবস্থিত তার দোতলা বাড়িটি বেশ অনাড়ম্বর হলেও ছিমছাম। এবাড়িতেই স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তার বসবাস। মাত্র সামান্য কিছুদিন বীমাকর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করলেও, তার জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি রাজনিতীকেই উৎসর্গ করেছেন। প্রথমে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৪৭ এর দেশবিভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের উপর চালানো পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতিটি শোষণের প্রতিবাদ করেছেন প্রচন্ড কড়া ভাষায়। তিনি তার সমরথকদের উদ্দেশ্যে বলেন- “ভাইয়েরা আমার, তোমরা কি জানো করাচি শহরের প্রতিটি রাস্তা সোনা দিয়ে মোড়া? তোমরা কি সেই লুট হয়ে যাওয়া সোনা ফিরিয়ে আনতে চাওনা? তবে হাত তোল, হাত তোল, যোগ দাও আমার সাথে। পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ছাত্রআন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রথমবারের মত তিনি গ্রেফতার হন ১৯৪৮ সালে।
এখনও পর্যন্ত, অনেকক্ষেত্রেই, তিনি রাজনৈতিকভাবে মধ্যপন্থী হিসেবে রয়ে গেছেন। তিনি একজন সামাজিক গণতন্ত্রবাদী, যিনি বড় বড় শিল্পকারখানা, ব্যাংক এবং বীমা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির রাষ্ট্রায়ত্তকরনে বিশ্বাসী করেন। এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার নীতিতেও তিনি মধ্যপন্থাই অবলম্বন করেন। যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো গণচীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং কঠোরভাবে ভারত-বিরোধিতা করেন, সেখানে মুজিব ভারতের সাথে বানিজ্যে আগ্রহী এবং কিছুটা পশ্চিমা ধ্যানধারনার বাহক হিসেবেই পরিচিত।