নিউজউইক, ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১
উপমহাদেশ: পরাজয়োন্মুখ যুদ্ধ
রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলো সাধারণত মামুলি আলাপ আলোচনা আর সম্ভাষণেই সীমিত থাকে। গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউজের সাউথ লনে প্রেসিডেন্ট নিক্সন যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাগত জানালেন, তিনিও চেস্টা করেছিলেন সেই গৎবাঁধা নিয়মই মেনে চলতে, এমনকি আলোচনার নিয়ে এসেছিলেন ওয়াশিংটনের স্নিগ্ধ আবহাওয়াও। কিন্তু মিসেস গান্ধী ছিলেন অন্য মেজাজে। বাঙ্গালিদের উপর পাকিস্তানীদের অত্যাচার এবং এর ফলে সৃষ্টি হওয়া ৬০ লাখ শরণার্থির ঢলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করে তিনি নিক্সনকে বলেছিলেন যে তাঁর দেশ “এক বিশাল মানবসৃষ্ট বিপর্যয়” এর মোকাবেলা করছে। এদিকে ভারত ও পাকিস্তান যখন পরস্পরের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, তিনি বললেন “আমি এখানে এসেছি আমাদের ওদিকের অবস্থার ব্যাপারটা (আপনাদের কাছ থেকে) গভীর ভাবে বুঝতে”। কিন্তু তাঁর সব চেষ্টাই ব্যর্থ বলেই মনে হচ্ছে, কেননা প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার এই সমস্যা মেটানো তো দুরের কথা, ওয়াশিংটন আর নয়া দিল্লির মধ্যকার সম্পর্কের টানাপড়েন কিভাবে ঠিক করা যাবে সে ব্যাপারেও একমত হতে পারেননি।
শুরু থেকেই মিসেস গান্ধীর আশা ছিল তিনি হয়ত নিক্সনকে বুঝিয়ে পাকিস্তানীদের উপর চাপ প্রয়োগ করে তারা স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীদের উপর যে অত্যাচার চালাচ্ছে তা বন্ধ করাতে পারবেন। তিনি আগের মতই বলেছেন যে কেবল মাত্র আমেরিকাই, যারা এখনও পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে এবং যারা এখনও বাঙ্গালিদের প্রতি পাকিস্তানের দমনমূলক নীতির সমালোচনা করেনি, পারবে ইসলামাবাদের সরকারকে বুঝিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু মিসেস গান্ধীর এই প্রস্তাবে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া, হোয়াইট হাউজ মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলবার এর মতে, “নতুন কোন সম্ভাবনা তুলে ধরেনি”। তেমনিভাবে আমেরিকার তরফ থেকে ভারতকে দেয়া পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়া এবং আন্তর্জাতিক মধ্যস্ততার প্রস্তাবও মিসেস গান্ধীর কাছে হালে পানি পায়নি। “আমার দেশের লোকেরা বুঝতে পারছেনা”, তিনি হোয়াইট হাউজের এক ডিনারে বলেই ফেললেন, “কিভাবে আমাদেরকে, যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি তাদেরকে যারা এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী তাদের সাথে এক করে দেখা হচ্ছে”।
সব মিলিয়ে ভারতের নেত্রীর জন্য সপ্তাহটা ভালো ছিল না। একদিকে আমেরিকাকে বুঝানোর ব্যর্থতা, অন্যদিকে তাঁর নিজের দেশে বিশাল ঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের ফলে অনেক মানুষ মারা গেছে। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী উড়িষ্যার নিম্নভুমিতে প্রায় ১০০০০ মানুষ মারা গেছে। সবাই ধারনা করছে যে এর ফলে ধানক্ষেত নস্ট হবার কারনে এবং নদীতে ভাসমান লাশের কারনে নস্ট হওয়া পানির কারনে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
অজেয় এক যুদ্ধ:
ভারতের জন্য বঙ্গোপসাগর তীরের এই বিপর্যয় এর চেয়ে খারাপ কোন সময়ে আসতে পারতো না। কারন এর ভঙ্গুর অর্থনীতি ইতিমধ্যেই পাকিস্তানি শরনার্থিদের চাপে ধ্বসে পরার মত অবস্থায় চলে এসেছে। তাঁর উপর আবার আছে ক্রমশই অস্থির হয়ে ওঠা পাকিস্তান সেনাবাহিনির সাথে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধে জড়িয়ে পরার ভয়। যদিও ভারতের বেশিরভাগ সেনাই মোতায়েন করা আছে পশ্চিম দিকে, কিন্তু যুদ্ধ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি আছে পুর্ব দিকেই। যুদ্ধ পরিস্থিতির অবস্থা যাচাই করতে নিউজউইকের সিনিয়র এডিটর আরনাউড ডি বোরশগ্রেভ গত সপ্তাহে পাকিস্তান সফরে গিয়ে এই রিপোর্টটি পাঠিয়েছেন:
“আপনার যেখানে খুশি গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসুন” এমনই বলেছিলেন আমাকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। আর ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়ানোর কত কাছাকাছি আছে সেটা দেখার জন্য পুর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা সীমান্তের মত আদর্শ জায়গা কমই আছে। তাই আমি চড়ে বসলাম একটি দুই বগির সাপ্লাই ট্রেনে, যেটা যাচ্ছিল স্থানীয় হেড কোয়ার্টারের দিকে। যদিও সেখানে ভারতীয় গোলাবর্ষনের আশঙ্কা ছিল, সেনাবাহিনীর এক কর্নেল আমাকে নিশ্চিন্ত করতে বললেন “ওদের লক্ষ্যভেদ ভালো না”। নিরাপত্তা হিসাবে ইট দিয়ে ঘেরা এক বগিতে করে, যা কোন এক কালে হয়ত দ্বিতীয় শ্রেণীর কম্পার্টমেন্ট ছিল, আমি নার্ভাস ভাবে ভ্রমন করছিলাম। সীমান্তের সমান্তরালে আমরা ঘটাং ঘটাং করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় ট্রেনটা থামানো হল, রেল লাইনের সামনের অংশে রিকোয়েললেস রাইফেলের গুলি বর্ষন চলছে। এই অবস্থায় হেঁটে কাছের কমান্ড পোস্টে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। একজন লম্বা পাঞ্জাবি সার্জেন্ট তার লাল দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল “ এই তো মাইল খানেক দুরেই”।
সেই এক মাইল গিয়ে ঠেকল সাত মাইলে। রেল লাইনের ধারের কর্দমাক্ত ধান ক্ষেতে একটু পরপরই মর্টার শেল এসে পরছিল আর রেললাইনের উচু মাটিতে রাইফেলের বুলেট গুলো এসে বিঁধছিল। ধান ক্ষেতের পানি মর্টার শেলের টুকরোগুলোকে আটকে রাখছিল আর ভারতীয় রাইফেলধারিরা আসলেই লক্ষ্যভেদে অপটু ছিল, সুতরাং প্রায় তিন ঘন্টা পর আমি নিরাপদেই পৌঁছে গেলাম ৩০তম পাঞ্জাব ব্যটেলিয়নের ডেল্টা কোম্পানির হেড কোয়ার্টারে। আশেপাশের নারকেল আর খেজুর কাছের কান্ডে এসে লাগছিল বুলেট আর কলাগাছ ভেদ করে চলে যাচ্ছিল সারাক্ষন। কোম্পানি কমান্ডারের ব্যাটম্যান কিছুক্ষণ আগেই নামাজ পরার সময়ে নিহত হয়েছে। এই ৯ মাইল সীমানা এলাকা রক্ষার দায়িত্বে থাকা এই ১৫০ জন সৈন্য সারাক্ষন দুটো জিনিষের মোকাবেলা করছিল, ভারতীয়দের গোলাবর্ষন আর মুক্তিবাহিনির (পুর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য লড়াইরত বিদ্রোহী দল) জন্য চোরাগোপ্তা হামলা।
তবে সম্মুখ সমরে থাকা সেনাদের জন্য যতই ভয়ানক মনে হোক না কেন ভারতীয় বাহিনীর এই গোলাবর্ষন, তা পাকিস্তানি কম্যান্ডারদের উপর খুব একটা প্রভাব ফেলেনি দেখা গেল। ‘এসব আমরা হজম করতে পারি’ সহজভাবেই বললেন ব্রিগেডিয়ার এম এইচ আলিফ, “আমরা এতে ভীত নই, ভারতীয়রা যদি তাদের গোলা খরচা করতে চায়, তো করুক। এই লম্বা ৪৩ বছর বয়স্ক পাঞ্জাবি অফিসারটি, যিনি পাকিস্তান অলিম্পিক হকি দলের একজন সদস্য, এইমাত্র টেনিস খেলে এসেছেন; সীমান্তের যুদ্ধের চাইতে খেলা নিয়েই কথা বলতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। পাকিস্তান সদ্যই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে (ভারত হয়েছিল তৃতীয়) এবং আলিফের কাছে এর আলাদা একটা গুরুত্ব ছিল। সে তার হকি দলকে টেলিগ্রামে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছিল, “ভারতের বিরুদ্ধে তোমাদের জয় আমাদের মনোবল বারইয়ে দিয়েছে এবং এটিকে একটি সুলক্ষণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে এদিকে। তোমাদের নিয়ে গর্বিত।” তারপর সে বলল, পাকিস্তানের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি হকি খেলোয়াড় আছে ভারতে, কিন্তু তারপরেও আমরা ওদেরকে হারাই।” সে আসলে যা বুঝাতে চাচ্ছিল, সেটা ছিল পরিষ্কার, ভারতের বিপক্ষে সামরিক হিসাবে পাঁচ ভাগের একভাগ হওয়া সত্বেও পাকিস্তান হকির মত যুদ্ধেও ভারতের বিরুদ্ধে জয়ী হবে।
এরকম চিন্তাধারা অবশ্য প্রকাশ করে দেয় যে গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে কত কম জানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কারন যতদিন তাদের সৈন্যরা সীমান্তে নিয়োজিত ছিল, মুক্তিবাহিনী দাপট দেখিয়েছে পুরো পুর্ব পাকিস্তানে। সরকার তাদের মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছে রাজাকারদেরকে দিয়ে, তারা মূলত স্থানীয় কম বয়সী গুণ্ডাপাণ্ডা, যাদেরকে নিয়ে একটি প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন করা হয়েছে। কিন্তু রাজাকাররা সরকারকে সহায়তা করার বদলে ক্ষতিই করছে বেশি। “তারা মনে করে যে যেহেতু তাদের হাতে বন্দুক আছে, তারাই খোদা” এমনটি বলেছিলেন আমাকে এক গ্রামবাসী। তারা সবাইকে বলে যে পাকিস্তানি সেনারা তাদের বিদ্রোহীদের জীবন ঝালাপালা করার জন্যে যে কোন কিছু করার অধিকার দিয়েছে, কিন্তু আসলে তারা তাদের শক্তি দেখায়, যারা তাদেরকে খাবার দাবার দিতে অথবা মেয়েদেরকে তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানায় তাদের উপর। আমার গাড়িও রাজাকাররা কয়েকবার থামিয়েছে, তাড়াহুড়ো করে বানানো টোল সেতুর সামনে, যেখানে জানালা দিয়ে একটি বন্দুকের নল তাকিয়ে আছে। তারা আমার কাছে “টোল” দাবী করেছে। এরকম অত্যাচার যখন তারা সাধারণ জনগণের উপর চালিয়েছে, তখন বেশির ভাগ বাঙ্গালিই হয়ে গেছে মুক্তি বাহিনীর সমর্থক: তাদেরকে আমি যখন জিজ্ঞাসা করেছি যে তারা কি পাকিস্তানের অংশ হিসাবে থাকতে চায় নাকি নতুন দেশ বাংলাদেশ এ থাকবে, বেশিরভাগই উত্তর দিয়েছে, “বাংলাদেশ”।
এদের বাইরেও অনেকেই স্বাধীন বাংলাদেশকে আশা করছে। রাজধানী ঢাকার অদুরে এক ফেরি পারাপারের সময় আমি সরকারই চাকরিরত একজন যুবককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম দেশের মানুষের জন্য কি ভালো হবে। শুরুতে সে উত্তর দিল “আমার এসব বলা নিষেধ আছে”। তারপর তাড় নাম না প্রকাশ করার শর্তে সে খুব মৃদু স্বরে বলল “অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া উচিৎ। আমরা সবাই সেটাই চাই”। এবং হাজার হাজার লোক তাইই চায়। যদিও সবুজ শাদা পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে বেশিরভাগ বাড়ির উপর, এবং চাষাভুষোরাও তাদের জাতীয় রঙের পোশাক পরে থাকছে, তাদের অনেকেই ফিসফিস করে আমাকে জানিয়েছে যে তারা এসব করছে শুধু মাত্র রাজাকারদের ভুল বুঝানোর জন্য।
দক্ষিণ ভিয়েতনামে থাকা আমেরিকানদের মতই পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ মনে হচ্ছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমর্থন ও আনুগত্যের ব্যাপারে ভয়ানক উদাসীন। সরকারিভাবে সবই যে ঠিক থাক আছে সেটা জোর করে বলার চেষ্টা দেখা যায় ইস্টার্ন সেক্টর কমান্ডার জেনারেল এ এ খান নিয়াজির বক্তব্যেও। বিদ্রোহীরা এমন কোন বড় সমস্যা না, “আমাদের রাজাকাররাই তাদেরকে সামাল দিতে সক্ষম”, ভারতের সীমান্তের দিক থেকে আসা গোলাবর্ষনও বড় কোন সমস্যা না, “আমাদের সেনারা বিচলিত না, তারা যতক্ষণ বাঙ্কারের ভেতরে আছে, তারা আরাম করে এমনকি তাস খেলতে পারে”। আর মুক্তিবাহিনীর নেতারা ঢাকার রাস্তায় যুদ্ধ করার জন্য দেশবাসীকে ডাক দিচ্ছে, এমন সংবাদের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, সেরকম হলে ভালই হবে। “আমি চাই তারা সেরকম কিছু করুক”, তিনি আমাকে বলেছেন। “আমার ট্যাঙ্কগুলো শহরের কাছেই আছে”। তারপর গত মার্চে বাঙ্গালী বিদ্রোহ দমনের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন ” তারা দেখেছে আমরা কি করতে পারি, এবং দরকার হলে আমরা আবার করে দেখাব”।
এই জেনারেল যেটা স্বীকার করছেন না সেটা হল ক্রমাবনতিশীল আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং মুক্তিবাহিনীর সাংগঠনিক দক্ষতা। গত সপ্তাহের হিসাব মতে সরকার পুর্ব পাকিস্তানের ২৫% পুলিশ থানার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। জেলা প্রশাসকদের একটি বড় অংশ গোপনে গেরিলাদের সহায়তা করছে এবং ঢাকার উত্তরের বড় একটা অংশ এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। আমার সাথে মুক্তিবাহিনীর দূত ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেছে ঢাকায় আমার হোটেলে উঠার ৩০ মিনিটের মধ্যেই, পুলিসের কঠিন প্রহরা থাকা সত্বেও। মুক্তিবাহিনী মনে হচ্ছে বেশ গোছানো একটা পদ্ধতিতে কাজ করছে, কোন দল হয়ত চাঁদা আদায় করছে, কোন দল ব্যাঙ্ক ডাকাটি করছে, কোন দল হয়ত কাজ করছে অন্তর্ঘাতক হিসাবে, আবার কেউ কেউ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধ করছে।
বাঙ্গালীদের সংগ্রামের তিক্ত সত্যটা শুধু যে স্থানীয় গভর্নর এ এম মালেকের কাছেই চেপে যাওয়া হচ্ছে তা না, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকেও ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে। টাদের দুইজনেরই ধারনা যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এখানে কার্যকরভাবে এবং নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেই গেরিলাদের সাথে যুদ্ধও করছে। কিন্তু ওয়াকিবহাল বিদেশী সংবাদদাতারা সৈন্যদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ এনেছেন। দৃশ্যত বিদ্রোহীদের ধাওয়া করার নামে সৈন্যরা কিছুদিন আগে ডেমরা গ্রাম ঘেরাও করে (যেখানে মুক্তিবাহিনী কখনোই ছিল না) সেখানকার ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সব মেয়েকে ধর্ষন করে এবং ১২ বছরের বেশি বয়সের সকল পুরুষকে গুলি করে হত্যা করে। তার মাত্র কয়েকদিন পরেই পাকিস্তানি গানবোট চালনর কাছে নদীতে টহল দিতে গিয়ে মাছ ধরা নৌকা ডুবিয়ে দেয় ও সাঁতরে পারে উঠতে চাওয়া জেলেদেরকে গুলি করে মারে। এসবের ফলে পুর্ব পাকিস্তানের প্রতিরোধ সংগ্রামই কেবল শক্তিশালী হচ্ছে, আরো নিবেদিত হচ্ছে। জনগণের বেশিরভাগই এখন পাকিস্তান ভেঙ্গে বের হয়ে যেতে অধীর অপেক্ষায় আছে, আর অন্যদিক সেনা কমান্ডাররা যতই বাগাড়ম্বর করুক না কেন, তারা নিজেরাও বুঝতে শুরু করেছে যে তারা এমন এক গেরিলা যুদ্ধে জড়িয়ে পরছে যেটায় জেতা সম্ভব না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি সাক্ষাৎকার
দুই সপ্তাহ আগে নিউজউইকের আরনাউড ডে বোরশগ্রেভ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। গতসপ্তাহে, ভারত আর পাকিস্তান যখন প্রায় যুদ্ধের মুখোমুখি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিউজউইকের ফরেন এডিটর এডওয়ার্ড ক্লাইনকে একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দেন। নীচে সেই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ।
পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ:
বেশ একটা লম্বা সময় ধরে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের হুমকি মূলক ভাষণ, কাজ এবং উস্কানির মুখেও ভারত কিছুই করেনি। এখন যদি আমরা নিজেদেরকে হুমকির সম্মুখীন মনে করি, তাহলে তো আমরা আমাদের সীমান্ত অরক্ষিত রাখতে পারি না। আমি জানি না পৃথিবীর কোন দেশটা বলবে “আমরা আমাদের সীমান্ত অরক্ষিত রেখে দিই …” আমাদের কি করা উচিত যখন আমাদের সীমান্তে এরকম কিছু হয়? আমরা কি চুপ করে বসে থাকব আর বলব “ তোমাদের যা ইচ্ছা হয় কর, যদিও এসব কাজের গুরুত্ব আমাদের কাছে অসীম?” … আমি বরং এভাবে বলব, ভারতের সাধারন জনগন যুদ্ধ চায় না। আমাদের মধ্যে যুদ্ধের ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ কিছু লোক অবশ্যই আছে, কিন্তু আমাদের জনগনের মধ্যে পাকিস্তান বিরোধী ধারনা নেই, যদিও পাকিস্তানীদের মধ্যে ‘ভারত ঘৃনা কর’ মতবাদ জনপ্রিয়। আমি মন থেকে আশা করি যে যুদ্ধ হবে না, এবং আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি সেটা নিশ্চিত করার জন্য … যুদ্ধের সম্ভাবনা আমরা অনেকটা কমিয়ে এনেছি পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে সেনা পাঠিয়ে। কিন্তু অবস্থা ঘোলাটে হয়ে উঠছে পুর্ব দিকে, আর সেখানে যুদ্ধের হাতছানি। আমরা মনে করি পর্ব ভারতের উপর বিপদের আশঙ্কা প্রতিদিন বাড়ছে।
বাঙ্গালিদের সমর্থনের ব্যাপারে:
শুধুমাত্র যখন শরণার্থিরা আসা শুরু করলো তখনই কেবল মাত্র ভারত এই পাকিস্তান সঙ্কটে জড়িয়ে পরতে বাধ্য হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক অত্যাচারের দেখার পরেই আপনি বলতে পারেন “ হ্যাঁ, কিছু গেরিলারা হয়ত ভারত থেকে আসছে” … হয়ত কিছু ট্রেনিং হচ্ছে আমাদের এদিকে, কিন্তু কিন্তু নিশ্চয়ই পুরোটা নয়। এমনকি এখনো গেরিলারা ভারতের উপর নির্ভরশীল নয়। আপনারা জানেন যে গেরিলাদের একটা বড় অংশই পুর্ব পাকিস্তানের প্যারা মিলিটারিরর অংশ … আর এখন তারাই নতুনদেরকে ট্রেনিং দিচ্ছে … বাঙ্গালীদের জনগনের স্পৃহার মর্মমূলে গভীর আঘাত হেনেছে ওরা। আর যতদিন এই স্পৃহা থাকবে, পাকিস্তানী বাহিনীকে পুর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষকেই মেরে ফেলতে হবে যদি তারা সে অঞ্চল নিয়ন্ত্রন করতে চায়। ভারত শুধুমাত্র সেই গনহত্যাকে রুখতে পরোক্ষ ভাবে কিছু কাজ করতে পারে। আর আমি দ্ব্যার্থহীনভাবে বলতে পারে যে আজ যদি আমি বাঙ্গালীদের অবস্থানে থাকতাম, তাহলে আমি যুদ্ধ করে যেতাম। কারন আমরা এর আগেও ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ করেছি এবং আমরা পৃথিবীর সর্বত্রই স্বাধীনতাকামীদের সমর্থন করে এসেছি।
বাঙ্গালী শরণার্থিদের ব্যাপারে:
এত শরণার্থিদের আশ্রয় দেয়া মানেই হচ্ছে অনেক খাতে খরচ কমিয়ে দেয়া। এর মানেই হচ্ছে একটু মিতব্যায়িতার সাথে জীবন চলা, সরকারী অনেক খরচ কমিয়ে আনা এবং অনেক পরিকল্পনা আর কার্যক্রমে পরিবর্তন আনা। এটা অবশ্যই একটি বিরাট এবং ভারী বোঝা। আমি মনে করিনা এর জন্যে আমাদের অর্থনীতি ভেঙ্গে পরবে, আমরা এর জন্যে ভেঙ্গে পরব না, তবে এই বিরাট অর্থনৈতিক বোঝাও আসলে মূল সমস্যা না। কিন্তু এর কারনে কে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলো নিয়েই আমাদের মাথা ব্যাথা। আমাদের নিরাপত্তার জন্য একটা বিশাল ঝুকি আছে বলেই আমরা মনে করছি।
পাকিস্তানের ভাঙ্গন সম্পর্কে:
আমি মনে করিনা যে সুস্থ মস্তিকের কেই চাইবে তার প্রতিবেশি দেশ ভেঙ্গে যাক। আমাদের এমনিতেই অনেক সমস্যা আছে, প্রতিবেশি দুর্বল না হওয়া সত্বেও, এটা একটা সুস্থ অবস্থা না … (কিন্তু) আমাদের মুল্যায়ন হচ্ছে যে পুর্ব বাংলা আর কোনভাবেই আগের মত করে পাকিস্তানের সাথে থাকতে পারবে না।
ভারতে দেয়া সোভিয়েত সাহায্য সম্পর্কে:
আমি কখনই কারো কাছে সাহায্য চাইনি। আমি যখন শিশু ছিলাম তখনও আমি কাউকে বলিনি “আমাকে কি এই কাজটা করে দেবে, অথবা এটা কি আমাকে দেবে”। আমি সোভিয়েত ইউনিয়নকে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করিনি। আমি তাদের কাছে অন্যান্য দেশের মতই অবস্থাটা আসলে কি সেটা ব্যাখ্যা করেছি। এখন এটা সোভিয়েত ইউনিয়ন বা অন্যান্য দেশের ভেবে দেখার ব্যাপার যে এই এলাকার জন্য ভারতের স্থিতি গুরুত্বপুর্ন কি না। আমরা যে কোন জায়গা থেকেই সহায়তাকেই স্বাগত জানাই। আমরা সহানুভুতিকে স্বাগত জানাই। কিন্তু আমি সারাজীবন নিজের পায়ে দাড়াতে শিখেছি এবং আমি চাই ভারত সব সময়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক। আমরা পৃথিবীর কোন দেশের উপর নির্ভরশীল হতে চাই না।
ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে:
সে হচ্ছে এমন এক লোক যে তার নিজের দেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাতে জিততে পারতো না। আমি বলবো, সে এমনকি তার নিজের প্রদেশের নির্বাচনে জিততে পারবে না যদি নির্বাচনটা সুষ্ঠু হয় … গত সপ্তাহের নিউজউইকে দেয়া ইয়াহিয়া খানের সাক্ষতকারের ব্যাপারে কিছু বলতে বলা হলে ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে ইয়াহিয়া তাঁকে “সেই মহিলা” বলে ইঙ্গিত করেছিলেন সেখানে। সেই মহিলা! আমি তার বক্তব্য নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাই না, কিন্তু এই মতব্য থেকেই বোঝা যায় সে কি ধরনের মানুষ। সে কিভাবে নিজেকে পুর্ব পাকিস্তানকে সামলানোর জন্য যোগ্য ভাবে? সে যদি তার নিজের দেশের একটা অংশকেই ঠিকমত সামলাতে না পারে, তাহলে ভারতের ব্যাপারে তার মতামতের কি গুরুত্ব আছে? সে কি জানে আমাদের ব্যাপারে? এটা তার চেনাজানা গন্ডির বহু বাইরের ব্যাপার।