You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.10 | ক্ষমতার সীমানা দ্যা টাইমস, লন্ডন, এপ্রিল ১০, ১৯৭১ - সংগ্রামের নোটবুক

ক্ষমতার সীমানা
দ্যা টাইমস, লন্ডন, এপ্রিল ১০, ১৯৭১

পিটার হেজেলহারস্ট

যশোর, ৯ এপ্রিলঃ এ এমন এক যুদ্ধ যা কারো পক্ষে জেতা সম্ভব নয়। আমার বামে নিজেদের ব্যারাকে আক্রমণের জন্য তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে এক ডিভিশন সশস্ত্র সৈন্য, আর অন্যদিকে প্রায় ২০০০ মুক্তিযোদ্ধা আর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর ৫০০ সদস্য তাদের ঘেরাও করেছে।

আধমাইল দূরে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকে ছোড়া একটা শেলের বিস্ফোরনের শব্দ ভেসে আসলো, আরো একটি ঘর পরিণত হল ধ্বংসস্তূপে।

একজন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা তার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বোল্ট একশন রাইফেল থেকে এক রাউন্ড গুলি ছুরলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কিছু হালকা মেশিনগান আর পাকিস্তানীদের কাছে থেকে লুট করা মরটার ও রয়েছে।

আজ সকালে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গোলাগুলি হয়েছে। কিন্তু দুই পক্ষই নিদেজের গোলাবারুদ সংরক্ষনের চেষ্টা করছে, যার ফলে এখন শুধু বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি চলছে।

বাঙ্গালিরা চিন্তিত হয়ে পড়ছেন। যশোরে সেনাবাহিনীর এই ব্যারাক খুবি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর অবস্থান ভারতীয় সীমানার খুব কাছেই, আর এর মধ্যে অবস্থানকারী পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা সকলেই যথেষ্ট প্রশিক্ষন ও ভারী অস্ত্রসজ্জিত। তাদের সংখ্যাও অনেক। এখন পশ্চিম পাকিস্তানিরাও সচেতন যে আসলে মুখোমুখি হয়েছে ৭.৫ কোটি বাঙ্গালীর। তারা জানে তাদের হাতে সময় খুব কম। যদি সবাই একসাথে পশ্চিমাদের উপর ঝাপিয়ে পরে, তবে তাদের সামনে একটাই পথ খোলা থাকবে। গত সপ্তাহেই তাদের ছোট ছোট দলে ব্যারাক থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যারাকের বাইরে বের হলেই উন্মত্ত জনতা তাদের আক্রমন করছে, হত্যা করছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদের পরিমাণও খুব বেশি না, তারাও আশংকায় আছে, যশোর এয়ারপোর্ট এখনও পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মিদের দখলে আছে, এবং আকাশপথে যদি সাহায্যের জন্য আরো লোক পাঠানো হয়, তবে তারা ত্রিমুখি আক্রমনের সম্মুখীন হবে। কিন্তু এর ফলে আর্মির কোন লাভ হবেনা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হয়ত বড় বড় শহরগুলি নিজের দখল রাখতে পারবেন, কিন্তু গোটা দেশ তিনি কিভাবে নিয়ন্ত্রন করবেন!

এই প্রদেশে বেশ লম্বা সময় ধরে ভ্রমন করে আমার মনে হচ্ছে, পূর্বাংশে এই অঞ্চলকে এখন বৃহত্তর বার্মার অন্তর্গত হিসেবে ছেড়ে দেয়াই হবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য সরবোত্তম পন্থা। সরকারি আদেশ বলবত থাকবে শুধু এ প্রদেশের রাজধানীতে।

ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া নিকটবর্তী ১০০ মাইলের মধ্যে এখন একজন সেনাও বাইরে খুজে পাওয়া যাবেনা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায়, সকল বাঙালি এখন এক হয়ে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। সীমান্তের রক্ষী থেকে শুরু করে সাধারন পুলিশ বা জনগন, সকলেই এখন এক হয়ে অস্ত্র ধরছে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন আছে ও তাদের সাথে এক হয়ে এই বিদ্রোহ দমনের যুদ্ধে যুক্ত হয়েছেন প্রায় ১৯০০০ বাঙালি। বিদ্রোহ দমনের লক্ষে তারা বিভাগীয় কমিটি গঠন করে কাজ করলেও কেউ জানেনা, প্রেসিডেন্ট কিভাবে বা কখন এমন একজন ব্যক্তিকে খুজে পাবেন যিনি এই দেশ শাসন করতে পারে।

গোটা পুলিশ বাহিনী মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেছে। সীমান্ত রক্ষীরা ভারতীয়দের জন্য সীমানা খুলে রেখেছে, সরকারি কর্মকর্তা কিংবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের মতন ব্যাক্তিরাও এখন গ্রামে গ্রামে গেরিলা যুদ্ধে যোগ দিচ্ছেন।

কিন্তু যদি বড় শহর ও বন্দরগুলোতে সেনাদের দখল থেকে যায়, তবে কল্কারখানাগুলো অচল হয়ে পড়বে, থেমে যাবে অর্থনীতির চাকা, আর অন্যদিকে জালানিসহ প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহের অভাবে পড়বে মুক্তিযোদ্ধারা। খাদ্য সরবরাহে সমস্যা থাকার কারনে কিছু শরণার্থী ভারতীয় অঞ্চলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।

চারদিকে ঘেরাও অবস্থায় থাকা যশোর শহরের ২২ মাইল পশ্চিমে বেনাপোল সীমান্ত অবস্থিত, যেখান দিয়ে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে যাওয়া আসা করলেও বাঙ্গালিরা ভ্রুক্ষেপ করেনা। সীমান্ত পার হওয়ার সময় দেখা যায়, যুদ্ধের সাজে সজ্জিত ভারতীয় সেনাদল সীমান্তের নিকটবর্তী অবস্থানে ক্যাম্প করে আছে। তারপর অল্প কিছুক্ষন হাটলেই পূর্ব পাকিস্তান। কখনও কখনও পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধারা যশোর যাওয়ার পথে সাংবাদিকদেরও নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের স্টেশন ওয়াগনে চড়ে চাকার কর্কশ আরতনাদ শুনতে শুনতে আমরা যশোর এর দিকে এগিয়ে যাই। একেকটি গাড়িতে উরদিপরা দুইজন সশস্ত্র পাহারাদার অবস্থান করে। কোন গ্রামের পাশ দিয়ে গেলে গ্রামবাসী মুক্তিযদ্ধাদের হাত নেরে শুভেচ্ছা জানায়, কিংবা ‘জয় বাংলা”স্লোগান দেয়। যশোরের ৭ মাইল পশ্চিমে, ঝিকরগাছা গ্রামে এসে গারিটি থামল। জাতীয় আওয়ামী পার্টির লোকেরা শুনেছে যে পাকসেনারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে এইদিকে আসতে পারে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহ মজুদ বিষয়ে তল্লাসি করতে।

যেসকল গ্রামবাসির আছে অস্ত্র নেই, তারা ভিতসন্তস্ত্র হয়ে আছেন। রিকশা করে চালের বস্তা সরিয়ে নেয়া হচ্ছে আরো পশ্চিমে, সীমান্তের কাছাকাছি। সেখান থেকে আমাদের নতুন একটি বাহন দেয়া হল। আমরা যশোরে পৌছলাম একটি জিপে করে। রাস্তা থেকে মিলিটারি হটিয়ে দেয়া হয়েছে। আমাদের বামে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্টে তারা অবস্থান করছে। শহর থেকে ফিরে আসার পথে আমাদেরকে গত সপ্তাহে আর্মিদের হামলা পরে নিহত বাঙ্গালীদের একটি গনকবর দেখানো হল। কারো পক্ষে মৃতের সংখ্যা আন্দাজ করা সম্ভব নয়।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একজন সংগঠক, মিঃ কাশি আব্দুল শহিদ আমাদের জানান যে তিনি গত সপ্তাহে পাক বাহিনীর হামলায় প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হতে দেখেছেন। যশোরের অনেক রাজনৈতিক নেতা গ্রেফতার হয়েছেন এবং তাদের ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে এ অঞ্চলে গৃহযুদ্ধ আঘাত হানার পর প্রায় ১৫০০ জন মানুষ হতাহত হয়েছেন বলে তিনি জানান।
একজন আওয়ামী কর্মী একটি পরিত্যাক্ত ঘরের দিকে দেখিয়ে বলল- ৫০০ থেকে ৬০০ ঘরবাড়ি পুরিয়ে দিয়েছে পাকবাহিনী, শেলের আঘাতে ধংস হয়েছে আরও ১০০ ঘরবাড়ি।

উত্তর দিকে অবস্থিত কুষ্টিয়া অঞ্চলে আমাকে দেখানো হল কিছু পাঞ্জাবি সৈন্যদের পচে-গলে যাওয়া লাশ। সেনাদের তিনটি কোম্পানি গত সপ্তাহে এই অঞ্চলে আসার পর প্রায় ৪০,০০০ উন্মত্ত মানুষের আক্রমনের মুখে পরে।

কুষ্টিয়া জেলার আওয়ামী লীগের সংগঠক সচিব জনাব শামসুল আলম দুদু আমাদের বর্ণনা দেন যে কিভাবে সর্বদলীয় লিবারেশন ফ্রন্ট সেনাদের উপর ঝাপিয়ে পরে।

“৩ মার্চ, ১৯৭১ এর মধ্যরাতে প্রায় ৩০০ পাঞ্জাবি সেনা কুষ্টিয়া শহরে ঘাটি গারে। সাথে সাথেই তারা সকল প্রধান স্থাপনা, টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কর্তৃত্ব সব নিজেদের হাতে তুলে নেয়। তারা কাউকে না জানিয়েই কারফিউ জারি করে এবং পরদিন সকাল থেকে নারী পুরুষ নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করতে শুরু করে যেন তারা মানুষ নয় পশুপাখি হত্যা করছে। জনাব দুদুর মতে ঐদিন তারা প্রায় ২০০ মানুষ হত্যা করে। এখানেও অন্য সকল শহরের মত পাকিস্তানি সেনাদের প্রথম টার্গেট ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সৈন্যরা। তারা রাজনীতিবিদ ও উদীয়মান নেতাদের গ্রেফতার করে শহরে এনে বন্দী করে রাখতে শুরু করে।

জনাব দুদু বলেন, তারা সোমবার সকালে পাল্টা আক্রমনের পরিকল্পনা করেন। প্রায় ৩০,০০০ লোক, লাঠি আর পাথর হাতে জেলা স্কুল ঘেরাও করে যেখানে এই ৩০০ সেনাদের ঘাটি ছিল। জেলার প্রায় ৩০০ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর জওয়ান ও আনসার বাহিনীও এই আক্রমনে রাইফেল হাতে যোগ দেয়। পাকিস্তানি সেনারা জনতার উপর কামান ও মর্টার আক্রমন চালায়। কিন্তু প্রায় ২৮ ঘন্টা ধরে গোলাবর্ষণ করার পর তাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায়।

জনতা স্কুলে প্রবেশ করা মাত্র কিছু সৈন্যকে হাতেনাতে ধরে সেখানেই হত্যা করে। কিছু সেনা রাতের অন্ধকারে সাধারন পোষাকে ঘাটি ছেড়ে পালিয়ে গেলেও, গ্রামবাসীরা পাঞ্জাবিদের ঠিকই চিনতে পেরে ধরে ফেলে ও তাদের মৃত্যু হয় গণধোলাইয়ে। কিন্তু, এখন অবস্থা অতটাও ভালনা, যতটা লিবারেশন ফ্রন্ট দাবি করছে। জনাব দুদ স্বীকার করেন যে তাদের রসদ ফুরিয়ে আসছে এবং ফ্রন্টের কাছে যথেষ্ট ঔষধ সরবরাহও নেই। কিন্তু, তারচেয়েও গুরুতর বিষয় হচ্ছে, এধরনের প্রতিরোধ এখনও অঞ্চলভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক ভাবেই হচ্ছে, এবং এখনও পর্যন্ত এই লরাইকে সঙ্ঘবদ্ধ করার জন্য কোন কেন্দ্রিয় পর্যায়ের নেতা আসেননি। তিনি আরো বলেন- “পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা সবধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা আর প্রধান শহরগুলো নিয়ন্ত্রন করছে, যার কারনে আমাদের কাছে কেন্দ্রিয় নেতাদের সাথে যোগাযোগ করার মত কোন উপায় নেই’।