You dont have javascript enabled! Please enable it! কোলকাতা যাত্রা - প্রবাসী সরকার ও সিইনসি'র সঙ্গে সাক্ষাৎ - সংগ্রামের নোটবুক
তৃতীয় বেঙ্গলের দায়িত্ব গ্রহণ
কোলকাতা যাত্রা এবং প্রবাসী সরকার ও সিইনসি’র সঙ্গে সাক্ষাৎ
এপ্রিলের শেষদিকে আগরতলায় BDF (Bangladesh Force)-এর পূর্বাঞ্চলীয় হেড কোয়ার্টার স্থাপিত হয়। ১০ মে বি ডি এফ হেড কোয়ার্টার থেকে আমার পােস্টিং অর্ডার হলাে। পােস্টিং অর্ডারে কোলকাতাস্থ বিডিএফ হেড কোয়ার্টারে গিয়ে C-in-C (কমান্ডার ইন চিফ) কর্নেল (অব.) ওসমানীর কাছে রিপাের্ট করতে বলা হলাে। তিনিই আমাকে আমার পরবর্তী দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবেন। ১৫ মে চতুর্থ বেঙ্গল থেকে বিদায় নিয়ে আগরতলা থেকে ইভিয়ান এয়ার কোর্সের বিমানে করে কোলকাতার উদ্দেশে রওনা হলাম। সঙ্গে সামান্য। টাকা চতুর্থ বেঙ্গলের সৈনিকদের বেশির ভাগেরই বাড়ি ছিল কুমিল্লানােয়াখালি-চট্টগ্রাম অঞ্চলে তারা তাদের নিজেদের এলাকায় থেকেই লড়াই করতে চাওয়ায় তাদের কাউকে সঙ্গে নিলাম না। আমার সঙ্গে এলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার। এসকর্ট হিসেবে সঙ্গে ছিল আরাে তিনজন ছাত্র মুক্তিযােদ্ধা—তান্না, শাহেদ ও তার আত্মীয় ইকবাল এবং ব্যাটম্যান ল্যান্স নায়েক মুজিব। কোলকাতায় পৌছে নিউ মার্কেট এলাকার একটা হােটেলে। উঠলাম। পয়সার অভাবে এক বেডের একটা রুম ভাড়া করলাম। শাহেদরা। কোলকাতায় আত্মীয়-স্বজনের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে। 
এদিকে কোলকাতাস্থ পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনার বাঙালি কর্মকর্তা হােসেন আলী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ইতিমধ্যে তার আনুগত্য প্রকাশ করে মিশনে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর দপ্তরে ডেপুটি হাইকমিশনার হােসেন আলীর সঙ্গে কথাবার্তা হলাে। তিনি পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টে যুদ্ধের খবরাখবর জানতে চাইলেন। আমরা মােটামুটি প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পেরেছি জেনে আশ্বস্ত ও অনুপ্রাণিত হলেন তিনি। আমাদের অগ্রগতির কথা শুনে বেশ আশাবাদী মনে হলাে তাকে ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসেই মুজিবের থাকার ব্যবস্থা হলাে। আমি আর খন্দকার সাহেব উঠলাম গিয়ে হােটেলে আগেই বলেছি, রুমে একটা মাত্র বিছানা ছিল। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার পদ এবং বয়স দু’দিক থেকেই আমার বেশ সিনিয়র কাজেই তাকে বিছানায় থাকতে বলে আমি ভূমিশয্যা নিলাম। মেঝেতে কার্পেট বা সেই জাতীয় কিছুই নেই, কিন্তু তারই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে দেরি হলাে না ; কারণ এতােদিনে এসব অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল পরদিন বাংলাদেশ দূতাবাসে গেলাম। সেখানকার লােকজনের কাছে জানতে চাইলাম, সিইসি কোথায় বসেন? কিন্তু সন্দেহবশত বােধহয় কেউ কিছুই বললাে না। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয় কোথায় সেটাও জানাচ্ছিল না কেউ এসময় কেউকেটা গােছের একজন লােককে খুব তৎপরতার সঙ্গে চলাফেরা করতে দেখলাম। আচার-আচরণে তাকে খুব চৌকশ দেখাচ্ছিল। সবাই তাকে খুৰ সমীহ করছে। জানা গেলাে, তার নাম রহমত আলী। তার কাছে আমাদের পরিচয় দেয়ার পর তিনি জানালেন, তার আসল নাম আমীরুল ইসলাম (ব্যারিস্টার)।
তিনি আমাদেরকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ের ঠিকানা দিলেন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার ও আমি ঠিকানা অনুযায়ী বালিগঞ্জের সেই অফিসে গেলাম। বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ে পৌছে সিইসি কর্নেল (অব.) ওসমানীর কাছে রিপাের্ট করলাম আমরা। ওসমানী সাহেব আমাদের দেখে খুব খুশি হলেন। বললেন, চলাে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই তােমাদের। আমাদেরকে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন তিনি। সেখানে একটা চৌকির ওপর লুঙ্গি আর স্যান্ডাে গেঞ্জি পরা অবস্থায় বসে ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আরাে ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ এবং এম. মনসুর আলী। এএইচএম কামরুজ্জামান এবং খন্দকার মােশতাক তখন অফিসে ছিলেন না। কর্নেল ওসমানী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তিন স্থপতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাদের। তিন নেতা দেশের পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধ কেমন চলছে, জানতে চাইলেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের লােকবল, জনগণের মনােভাব, মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল, কি কি প্রয়ােজন ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। যুদ্ধ কতােদিন চলতে পারে সে সম্পর্কে আমাদের ধারণাও জানতে চাইলেন তারা কথাবার্তা শেষ হলে কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে তার কক্ষে গেলাম ওসমানী আমাকে বললেন, চতুর্থ বেঙ্গলে দু’জন মেজর থাকার কোনাে প্রয়ােজন নেই। আমরা এখন অফিসার সঙ্কটে ভুগছি। তাই আরাে গুরুত্বপূর্ণ কাজে অন্য জায়গায় পাঠানাের জন্য তােমাকে চতুর্থ বেঙ্গল থেকে ডেকে এনেছি। তােমার প্রথম কাজ হচ্ছে আগামী তিনদিন আমার সঙ্গে থাকবে তুমি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণের বসিরহাট থেকে শুরু করে উত্তরে কুচবিহার পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পগুলাে পরিদর্শন করতে চাই আমি তুমি আমার সাথে থাকবে।
মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল বাড়ানাের জন্য তাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখবাে আমি তাদের সুবিধা-অসুবিধাগুলােও সরেজমিনে জানা দরকার। কর্নেল ওসমানী আরাে জানালেন, ফেরার পথে বালুরঘাটের কাছে বাঙালিপাড়া নামে একটা জায়গায় আমাকে নামিয়ে দেবেন তিনি সেখানে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ড গ্রহণ করতে হবে আমাকে ওসমানী আমাকে দায়িত্ব দেয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যে পদ্মা নদীর উত্তরের সবগুলাে ক্যাম্প থেকে ইপিআর, পুলিশ, মুজাহিদ, আনসার, ছাত্র-জনতা এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে তৃতীয় বেঙ্গলের পুনর্গঠনের নির্দেশ দিলেন। ক্যাপ্টেন আনােয়ার (পরে মে. জেনারেল) তখন ১৮৭ জন সৈনিকসমেত তৃতীয় বেঙ্গলকে নিয়ে বাঙালিপাড়ায় অবস্থান করছিলেন। উল্লেখ্য, সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকালে ৩০/৩১ মার্চ তৃতীয় বেঙ্গলের ওপর পাকবাহিনী হামলা চালায়। আকস্মিক হামলায় তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেকেই নিহত ও বন্দি হয় এবং অন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধে তৃতীয় বেঙ্গলের ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধে তৃতীয় বেঙ্গলের ভূমিকা ও সামগ্রিক অবদান ছিল ঈর্ষণীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে তৃতীয় বেঙ্গলের অধিনায়কত্বের দায়িত্বপালনের দুর্লভ সম্মানে আমি গর্বিত। প্রাণপ্রিয় এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়কত্ব গ্রহণের পূর্বকালীন সময়ের (২৫ মার্চ—মের তৃতীয় সপ্তাহ) সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আমি পাঠকদের জন্য বিশ্বস্ততার সঙ্গে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।  মার্চ মাসের ৪ তারিখে তৃতীয় বেঙ্গলের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে। দিনটি ছিল ব্যাটালিয়নটির Raising Day বা প্রতিষ্ঠা দিবস। উল্লেখ্য, ১ মার্চ থেকে পাকবাহিনী বাংলাদেশের অন্যান্য সেনানিবাসের মতাে এখানেও তৃতীয় বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা চালায়। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে ৪ মার্চ এক দরবার অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে ব্যাটালিয়নের সিও সৰ ব্ল্যাঙ্কের সদস্যদের উদ্দেশে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। দরবার চলার সময় অত্যন্ত অস্বাভাবিক ও বিধিবহির্ভূতভাবে তৃতীয় বেঙ্গলের আবাসিক এলাকার চারপাশে ২৫ এফএফ রেজিমেন্ট ও সশস্ত্র সেনাদল নিয়ােগ করা হয়। এই ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে তৃতীয় বেঙ্গলের সেনাসদস্যের (এদের প্রায় সবাই বাঙালি) মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয় এরপর থেকে তৃতীয় বেঙ্গলের ব্যারাকগুলাের আশপাশে অস্ত্রধারী পাকসেনাদের গতিবিধি ক্রমশই বাড়তে থাকে এর মধ্যে তারা তৃতীয় বেঙ্গলকে ঘিরে পরিখাও খোড়ে পাকিস্তানিদের এসব ষড়যন্ত্রমূলক কাজকর্ম দেখে বাঙালি সেনাদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তৃতীয় বেঙ্গলের বাঙালি সেনাসদস্যরা আত্মরক্ষা ও প্রয়ােজনে স্বজাতির মুক্তির জন্য লড়াইয়ের প্রত্যয় নিয়ে পরবর্তীকালে বিভিন্ন ঘটনায় বেশ কয়েকবার অননুমােদিতভাবে অস্ত্রধারণ করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ২৫ মার্চের আগে থেকেই বাংলাদেশে অবস্থিত বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্য সব ব্যাটালিয়নের মতাে তৃতীয় বেঙ্গলের শক্তি কমিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে তাদেরকে ছােট ছােট দলে ভাগ করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। অজুহাত হিসেবে ভারতীয় আগ্রাসন ঠেকানাের মনগড়া কাহিনী শােনানাে হয়। পাকবাহিনীর পাশবিক পরিকল্পনা কার্যকর করায় তৃতীয় বেঙ্গল যেন সংগঠিত হয়ে বাধা দিতে পারে, সেজন্যই তাদেরকে এভাবে ছত্রখান করে দেয়া হয়। এর ফলে প্রয়ােজনে পরবর্তীকালে শক্তি প্রয়ােগ করে তাদেরকে অস্ত্র সমর্পণ করাতে সুবিধে হবে, এ ব্যাপারটাও পাকবাহিনীর বিবেচনায় ছিল। এই নীল-নকশা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আলফা কোম্পানিকে পার্বতীপুরে পাঠানাে হয়। সঙ্গে যায় পাকিস্তানি মেজর (পরে নিহত) সৈয়দ সাফায়েত হুসেন। চার্লি কোম্পানিকে ক্যাপ্টেন আশরাফের (পরে মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁও পাঠানাে হয়। পলাশবাড়ি/ঘােড়াঘাট এলাকায় অবস্থান নেয় ব্রাভাে ও ডেল্টা কোম্পানি। এদের সঙ্গে পাঠানাে হয় মেজর নিজামউদ্দিন (পরে নিহত), ক্যাপ্টেন মুখলেস (পরে লে. কর্নেল অব.) এবং লে, রফিককে (পরে বন্দি ও নিহত)। | সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করছিল উল্লিখিত কোম্পানিগুলাের রিয়ার পার্টি, ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার ও হেড কোয়ার্টার কোম্পানির কিছু সেনাসদস্য। ৩১ মার্চ পাকসেনাদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার দিন পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আনােয়ার (পরে মেজর জেনারেল), লে. সিরাজ (পরে বন্দি ও নিহত) ও সুবেদার মেজর হারিস এদের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করছিলেন। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে আরাে ছিলেন সিও লে. কর্নেল ফজল করিম ও সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর আকতার। এই দুজনই ছিলেন পাকিস্তানি। সিও ফজল করিম ছিলেন প্রবলভাবে বাঙালি-বিদ্বেষী।
২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার মাধ্যমে পাকবাহিনী বাঙালিদের বিরুদ্ধে অঘােষিত যুদ্ধ শুরু করার পর ঘােড়াঘাটে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙ্গলের সৈন্যরা ২৮ মার্চ পলাশবাড়িতে লে. রফিকের নেতৃত্বে একটি বড়াে ধরনের অ্যামবুশ স্থাপন করে। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল, বগুড়ার দিকে অগ্রসরমান ২৫ এফএফ রেজিমেন্টের ওপর অতর্কিত আঘাত হেনে তাদেরকে নির্মূল করে দেয়া। ২৫ এফএফ রেজিমেন্টের অভিন্ন পাকিস্তানি লে. কর্নেল গােলাগুলি শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে অনভিজ্ঞ তরুণ লে, রফিককে যুদ্ধের বদলে আলােচনার মাধ্যমে সঙ্কট অবসানের আহ্বান জানান। সিংহহৃদয়ের অধিকারী এই তরুণ বাঙালি অফিসার সরল বিশ্বাসে পাকিস্তানি কর্নেলের কাছে যাওয়ামাত্রই পাকসেনারা তাকে জোর করে কর্নেলের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে রংপুরের দিকে রওনা হয়। এই ঘটনার মুখে দু’পক্ষের মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে গুলি বিনিময় শুরু হয়ে যায়। প্রচণ্ড গােলাগুলির এক পর্যায়ে ২৫ এফএফ রেজিমেন্ট টিকতে না পেরে রংপুরের দিকে পালিয়ে যায়। তাদের পক্ষে অনেকে হতাহত হয়। রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে তৃতীয় বেঙ্গলের দু’জন সৈন্য শহীদ, একজন অফিসার বন্দি এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। বন্দি অবস্থায় হতভাগ্য রফিককে পরে। রংপুর সেনানিবাসে হত্যা করা হয়। এই সংঘর্ষের পর শত্রু-মিত্র চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত হয়ে গেলাে। সংঘর্ষের এই খবর সৈয়দপুর পৌছানাে মাত্র সেখানে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙ্গলের সেনাদের মধ্যে উত্তেজনা আরাে বেড়ে যায়। 
৩০ মার্চ তৃতীয় বেঙ্গলের ব্যাটালিয়ন অ্যাডজুট্যান্ট সিরাজকে রংপুর ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে একটা কনফারেন্সে যােগ দেয়ার জন্য পাঠানাে হয়। তার সঙ্গে ১০/১২ জন সশস্ত্র প্রহরী ছিল। পাকিস্তানিরা পথে তাদেরকে বন্দি করে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় সে রাতেই প্রায় সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। দলটির মাত্র একজন সদস্য দৈবক্রমে বেঁচে যায়। পরে সে তৃতীয় বেঙ্গলের সঙ্গে আবার মিলিত হতে পেরেছিল। উল্লেখ্য, তখন রংপুর ব্রিগেডের গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিগেড মেজর পদে আসীন ছিলেন একজন বাঙালি মেজর আমজাদ খান চৌধুরী। উল্লেখ, তিনি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কুমিল্লার ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন এবং তারই নিয়ােজিত সেনা দল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের পাহারার | দায়িত্বে ছিল। আক্রমণকারীদের প্রতিরােধে এরা সেদিন ব্যর্থ হয়। সব সম্ভবের দেশ এই বাংলাদেশে তিনি পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। ৩০ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি ২৫ এফএফ রেজিমেন্ট সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙ্গলের আবাসিক অবস্থানগুলােতে কামানের প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ করে। সেখানকার একমাত্র বাঙালি অফিসার আনােয়ার ছিল কোয়ার্টার মাস্টার। আনােয়ার ও সুবেদার মেজর হারিস মিয়ার নেতৃত্বে সেনানিবাসে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙ্গলের স্বল্পসংখ্যক সৈন্য দ্রুত সংগঠিত হয়ে এই আক্রমণ প্রতিরােধের উদ্দেশ্যে অমিত বিক্রমে রুখে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা এক পর্যায়ে কামানের গােলাবর্ষণ থামিয়ে উত্তরদিক থেকে Assault line বানিয়ে হামলা চালায়। তৃতীয় বেঙ্গলের বীর সেনারা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতার সঙ্গে এ হামলাও প্রতিরােধ করে।
নিজেদের পক্ষে ব্যাপক হতাহত হওয়ায় এবং আক্রমণে খুব একটা সুবিধে করতে না পারায় পাকসেনারা তখনকার মতো রণে ভঙ্গ দেয়। কয়েক ঘন্টা পর ২৫ এফএফ রেজিমেন্ট আবার কামানের গােলার ছত্রছায়ায় আক্রমণ চালায়। এবারের আক্রমণ আসে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে। এ পর্যায়ের প্রচণ্ড সংঘর্ষে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে আক্রমণকারী পাকসেনা দল এক সময় পিছিয়ে যায়। ভোর হয়ে এলে লড়াই স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু দিনের আলােয় রংপুর থেকে ট্যাঙ্ক আনিয়ে নতুন করে পাক হামলার আশঙ্কা দেখা দেয়। এদিকে আবার ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে মার্চের প্রথম সপ্তাহেই তৃতীয় বেঙ্গলের ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী কামানগুলাে সামরিক মহড়ার নামে সুকৌশলে ব্যাটালিয়ন থেকে সরিয়ে দিনাজপুরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এ অবস্থায় দিনের আলােয় ক্যান্টনমেন্ট থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছিল আত্মহত্যার শামিল। নিজেদের পক্ষে প্রচুর হতাহত এবং শত্রু পক্ষের ভারি অস্ত্র ও লোকবলের কারণে আনােয়ার তৃতীয় বেঙ্গলের সেনাদেরকে কৌশলগতভাবে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেয়।
তৃতীয় বেঙ্গলের সেনাদল বিক্ষিপ্তভাবে গুলি চালাতে চালাতে দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পিছিয়ে আসে। একদল পাকিস্তানি কামানের আওতার বাইরে বদরগঞ্জে অবস্থান গ্রহণ করে। অন্য দলটি অবস্থান নেয় ফুলবাড়িয়ায়। ক্যান্টনমেন্টের এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তৃতীয় বেঙ্গলের প্রায় ২০ জন শহীদ এবং ৩০ থেকে ৩৫ জনের মতাে সদস্য আহত হয়। এছাড়া কয়েকজন নিখোঁজ হয়েছিল। পাকসেনাদের পক্ষেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এদিকে ক্যান্টনমেন্টের রিয়ার পার্টির ওপর হামলার খবর পেয়ে ঠাকুরগাঁও ও পার্বতীপুরে অবস্থানরত চার্লি ও আলফা কোম্পানি সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের উদ্দেশ্যে এপ্রিলের ২ তারিখে ফুলবাড়িতে একত্র হয়। ফুলবাড়িতে দিনাজপুর সেক্টরের ইপিআর (সাবেক)-এর বহু সদস্য বিদ্রোহ করে তৃতীয় বেঙ্গলের সেনাদলের সঙ্গে যােগ দিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। এদিকে আলফা কোম্পানি ফুলবাড়ি চলে যাওয়ায় একদল পাকসেনা ও প্রচুর অস্ত্রধারী বিহারি-অবাঙালি পার্বতীপুর এলাকা দখল করে নেয়। ৪ এপ্রিল অলক্ষা কোম্পানি পাক অবস্থানে আক্রমণ চালিয়ে পার্বতীপুর পুনর্দখল করে। এ আক্রমণে টিকতে না পেরে সেখানে অবস্থানরত পাকসেনা ও সশস্ত্র বিহারিরা সৈয়দপুর পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে তৃতীয় বেঙ্গলের একজন শহীদ ও কয়েকজন আহত হয়। প্রায় একই সময় চার্লি কোম্পানি ভূষিরবন্দরের পাক অবস্থানে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। চার্লি কোম্পানির আক্রমণের তীব্রতার কারণে পাকসেনাদের প্রথমবারের মতাে যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্ক ব্যবহার করতে হয়। এ যুদ্ধে চার্লি কোম্পানির বেশ কয়েকজন হতাহত হয়ে পড়লে আক্রমণ বন্ধ করে তারা এক পর্যায়ে পিছিয়ে আসে। চার্লি কোম্পানি এবার অবস্থান নেয় চরখাইয়ের কাছে খােলাহাটিতে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ প্রায় গােটা তৃতীয় বেঙ্গল চরখাইখােলাহাটিতে প্রতিরক্ষাগত অবস্থান গ্রহণ করে। খােলাহাটিতে স্থাপন করা হয়।
হেড কোয়ার্টার  বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি যুদ্ধে হতাহতের কারণে ব্যাটালিয়নের সদস্য সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছিল। বিচ্ছিন্ন হয়ে-যাওয়া কিছু সেনাসদস্য ব্যাটালিয়নের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আশায় দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়ার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করতে থাকে। অফিসারদের মধ্যে একমাত্র আনােয়ার তখন ব্যাটালিয়নে। আশরাফ ও মুখলেস তখন নিখোজ এবং নিজামউদ্দিন শহীদ।
তৃতীয় বেঙ্গল খােলাহাটি থাকার সময় সম্ভবত ৯ এপ্রিল আনােয়ার রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের উদ্দেশ্যে বদরগঞ্জে রেকি (পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান) করতে যায়। তার সঙ্গে ছিল মাত্র কয়েকজন প্রহরী। এ সময় ভুল করে হঠাৎ সে জিপসহ ২৫ এফএফ রেজিমেন্টের সেনাদের মধ্যে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানি এফএফ রেজিমেন্ট আর ইপিআর বাহিনীর চামড়ার সরঞ্জামাদি (Web Equipment) দুটোই কালাে রঙের ছিল বলে এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। মুহূর্তের মধ্যে দু’পক্ষই নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। শুরু হয়ে যায় গুলি বিনিময়। মাত্র কয়েকজন যােদ্ধাসহ আনােয়ার বন্দি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে মরণপণ যুদ্ধ করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এ যুদ্ধে আনােয়ার গুলিবিদ্ধ হয়। পরে কৌশলে পাকিস্তানিদের ঐ শক্তিশালী অবস্থান অতিক্রম করে আনােয়ার ও তার সহযােদ্ধারা সেদিনই খােলাহাটিতে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙ্গলে ফিরে আসে। তবে ঐ এলাকার ম্যাপসহ জিপগাড়িটি শত্রুপক্ষের হাতে পড়ে যায়। ম্যাপটিতে তৃতীয় বেঙ্গলের বিভিন্ন কোম্পানির অবস্থান চিহ্নিত ছিল বলে বিমান আক্রমণের আশঙ্কায় সেদিনই তৃতীয় বেঙ্গলকে দুই ভাগে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এক অংশ চলে যায় চরখাই-ফুলবাড়ি এলাকায়, অন্য অংশ অবস্থান নেয় হিলি এলাকায়। উল্লেখ্য, এই ঘটনার দিন দুয়েক আগে আলফা কোম্পানি বদরগঞ্জে একটি বড় ধরনের অ্যামিবুশ করে, যাতে পাকসেনাদের বেশ কয়েকতন হতাহত হয়।
এপ্রিলের ১৩ থেকে ১৪ তারিখে চরখাইয়ে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙ্গলের সেনাদল ও ইপিআর-এর বাঙালি সদস্যরা রেল লাইন ধরে অগ্রসরমান সেনাদের বড়াে দলের মোকাবেলায় ব্যাপক আকারের অ্যামবুশ স্থান করে। পাকসেনারা রেল লাইন ধরে হিলির উদ্দেশে যাচ্ছিল। রেল লাইনের দু’পাশের গ্রামগুলােতে আগুন লাগাতে লাগাতে অগ্রসর হচ্ছিল তারা অ্যামবুশের ফালে আসামাত্র পাকসেনারা প্রচণ্ড গােলাগুলির মধ্যে পড়ে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে বহু পাকসেনা হতাহত হলে আত্মরক্ষার জন্য তারা পার্বতীপুরের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীরও কয়েকজন হতাহত হয়।  ১৪ এপ্রিল আলফা কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার নায়েব সুবেদার (পরে ক্যাপ্টেন অব.) ওহাবকে ঘােড়াঘাট-হিলি রােডে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে রেইড করতে পাঠানাে হয়। অগ্রসরমান এই সেনাদলটির অলক্ষ্যে পাঁচবিবি-হিলি রােড ধরে আসা আরেকটি শক্তিশালী শত্রু-সেনাদল অতর্কিতে তাদেরকে পেছন দিক থেকে হামলা করে বসে। তৃতীয় বেঙ্গলের সামনের এবং একটু কোনাকুনিভাবে পেছনের শত্রু-অবস্থান থেকে অবিরাম মেশিনগান আর মটার ফায়ার হতে থাকে। একমাত্র রাস্তা ছাড়া কভার নেয়ার জন্য কোনাে উচু আড়াল নেই। রাস্তার দু’পাশে বিস্তৃত ধানখেত। ঐ অবস্থানে সারাদিন যুদ্ধের পর রাতের অন্ধকারে ওহাবের পাটুনটি পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হয়। এই সংঘর্ষে তৃতীয় বেঙ্গলের একজন শহীদ ও ১৩জন আহত হয়। ওহাৰ আহতদের সবাইকে তাদের মূল প্রতিরক্ষা অবস্থানে নিয়ে আসতে পেরেছিল। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আলফা ও চার্লি কোম্পানির যৌথ সেনাদল মােহনপুর ব্রিজ এলাকার শত্রু অবস্থানে আক্রমণ করে। এ হামলায় দু’পক্ষেরই বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
তৃতীয় বেঙ্গলের দু’জন এনসিও নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। এই অভিযানের দু’একদিন পর আলফা কোম্পানি দিনাজপুরের রামসাগর এলাকায় পাক অবস্থানে রেইড করে এবং সাফল্যের সঙ্গে শত্রুপক্ষকে পর্যুদস্ত করে ফিরে আসে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই তৃতীয় বেঙ্গল মিত্র বাহিনীর পরামর্শমতাে আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ এড়িয়ে গিয়ে রেইড, অ্যামবুশ, রােড মাইন স্থাপন ও ব্রিজ ডেমােলিশনের মতাে কম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে থাকে। উদ্দেশ্য, শত্রুপক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটিয়ে তাদের মনােবলে চিড় ধরানাে এবং যাতায়াত বাধাগ্রস্ত করা। এ রকমই একটা অ্যাকশনে মে মাসের মাঝামাঝি পাঁচবিবি-জয়পুরহাট রাস্তার ওপর এক মাইন বিস্ফোরণে পাকবাহিনীর একটি গাড়ি বিধ্বস্ত হলে একজন অফিসার ও ১৩জন সৈন্য নিহত হয়। চরখাই থাকাকালীন এপ্রিলের শেষে মিত্র বাহিনীর সঙ্গে তৃতীয় বেঙ্গলের যােগাযােগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তৃতীয় বেঙ্গলে তখন রয়েছে একজন অফিসারসহ বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ৪১৬ জন সেনাসদস্য। পরবর্তীকালে মিত্র বাহিনীর পরামর্শে দুটো কোম্পানি স্থানান্তরিত হয় ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা রায়গঞ্জে। আনােয়ারের দুই কোম্পানি হিলি-বালুরঘাট এলাকায় থেকে যায়। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আনােয়ারের কোম্পানি দুটোর অধিনায়কত্ব গ্রহণের মাধ্যমে আমি বালুরঘাটের কামারপাড়া নামের একটা জায়গায় তৃতীয় বেঙ্গলের পুনর্গঠনে হাত দিই।
কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে সীমান্ত ক্যাম্প পরিদর্শন
বালিগঞ্জে লে, নূরুন্নবীর (পরে লে. কর্নেল, অভ্যুত্থানের অভিযােগে বরখাস্ত) সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কোলকাতায় নূরন্নবী যেখানে অবস্থান করছিলাে, আমাকে সেখানে থাকার আমন্ত্রণ জানায়। সে তখন ক্যাপ্টেন ডালিম (পরে মেজর, অব.), ক্যাপ্টেন নূর (পরে মেজর, অব.) ও ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (পরে কর্নেল এবং ১৯৮১-র চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানে নিহত) এদের সঙ্গে সম্ভবত একটা স্কুলে ঠাই নিয়েছিল। একদিন নুরন্নবীদের ওখানে গেলাম। ক্যাপ্টেন ডালিম, নূর, মতি এরা সবাই ক’দিন আগে পাঞ্জাব সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছে। সারা রাত গল্পগুজব হলাে। তারা পাকিস্তান থেকে তাদের পালিয়ে আসার কাহিনী শােনালাে খুব খুশি হলাম। আরাে তিনজন অফিসারকে পাওয়া গেলাে। নবী এ সময় আমাকে অনুরােধ করলাে তাকে সঙ্গে নিতে। নিয়ে নিলাম তাকে। সঙ্গে আরাে তিন জন কর্নেল ওসমানী, ড্রাইভার ও আমার ব্যাটম্যান। শুরু হলাে প্রায় আড়াইশাে মাইলের যাত্রা পথে বেশ কয়েকটি ক্যাম্পে থামলাম আমরা। ওসমানী সব জায়গায় মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখলেন, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। ওসমানীকে এ সময় বেশ অসহিষ্ণু মনে হতে লাগলাে। কোনাে বড় ধরনের সমস্যা দেখলেই তিনি শুধু বলছিলেন, ‘আমার পক্ষে এতাে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আই উইল রিজাইন। পুরাে সফরে তিনি প্রায় কুড়িবার পদত্যাগের হুমকি দিলেন। প্রায় সব ক’টি ক্যাম্পের কমান্ডার এবং কোনাে কোনাে জায়গায় স্থানীয় সাংসদদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করলেন ওসমানী। বসিরহাটের কাছে একটি ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন জলিলের (পরে মেজর অব., জাসদ নেতা) সঙ্গে দেখা হয়। ওসমানী জলিলকে রীতিমতাে অশালীনভাবে তিরস্কার করলেন। তার এহেন আচরণ আমাকে লজ্জিত না করে পারলাে না। জলিলের অপরাধ ছিল, বরিশালে পাকবাহিনীর আচমকা হামলায় বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্রসহ তার একটি লঞ্চ ডুবে যায়। ক্যাপ্টেন জলিল চুপচাপ ওসমানীর বকাঝকা মাথা পেতে নিলাে। আমার তখন যুদ্ধক্ষেত্র আর কোলকাতার নিরাপদ জীবনের ফারাকটা বেশি করে মনে পড়ছিলাে। মনে হলাে, ওসমানী সশরীরে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকলে হয়তো জলিলকে এভাবে দোষারােপ এবং তিরস্কার করতে পারতেন না। 
বগা ক্যাম্পে দেখা হলাে প্রথম বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিনের (পরে মেজর অব.) সঙ্গে। সব র্যাঙ্ক মিলিয়ে প্রায় দুশাে সেনাসদস্যকে নিয়ে সেখানে অবস্থান করছিল সে। প্রসঙ্গত বলতে হয়, প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল যশাের সেনানিবাসে। ২৫ মার্চের আগে থেকেই ট্রেনিংয়ের কারণে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ছিল ব্যাটালিয়নটি। ৩০ মার্চ তাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়। প্রথম বেঙ্গল সেই মতাে ফিরে এলে পাকিস্তানিরা পদাতিক ও গােলন্দাজ বাহিনী দিয়ে তাদেরকে ঘেরাও করে অস্ত্র সমর্পণ করানাের চেষ্টা করে। প্রথম বেঙ্গলের বাঙালি সিও অস্ত্র সমর্পণের জন্য তৈরি হয়ে যান। ঐ পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে জেসিও এনসিওরা বিদ্রোহ করে এবং যুদ্ধ করে অস্ত্রসহ বেরিয়ে আসে। তারপর ঐ শ’দুয়েক সৈনিক ছােট ছােট প্রতিরােধ যুদ্ধ করতে করতে বনগাঁ সীমান্তে একত্র হয় এবং নাে ম্যানুস ল্যান্ডে ক্যাম্প স্থাপন করে। আশপাশের বিওপিগুলাে থেকে বেশ কিছু বাঙালি ইপিআর তাদের সঙ্গে যােগ দেয়। যশাের সেনানিবাসে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে প্রথম বেঙ্গল বিদ্রোহ করার পর বাঙালি সিওসহ অনেকে আত্মসমর্পণ করে, কেউ পালিয়ে যায়। এছাড়া যুদ্ধে বেশ কয়েকজন বাঙালি সৈন্য হতাহত হয়।
যাই হােক, ক্রমশ আরাে উত্তরে এগােলাম আমরা। শেষ পর্যন্ত এসে পৌছলাম বাগডােগরা এয়ারফিল্ডে। এয়ারফিল্ডের কাছাকাছি মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আওয়ামী লীগের সাংসদ সিরাজ সাহেবের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করলেন কর্নেল ওসমানী। এক পর্যায়ে দুজনের মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হলে অতি কষ্টে আমি সেটা সামাল দিলাম। কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল ওসমানীর এহেন কার্যকলাপ ও আচরণে অত্যন্ত নিরাশ হলাম আমি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দেহ জাগলাে। স্থিরতাহীন মানসিকভাবে অশান্তি একজন লােককে মুক্তিবাহিনীর সর্বোচ্চ পদে বসানাে কতােটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে, এরকম প্রশ্ন জাগলাে মনে। তিনদিনের এই সফরে মুক্তিযুদ্ধ, অপারেশন, যুদ্ধকৌশল, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদের সংস্থান সম্পর্কে বলতে গেলে একটি কথাও উচ্চারণ করেন নি ওসমানী। দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আইনের ক্ষেত্রে MPML (Manual of Pak Military Law) কতােটুকু গ্রহণযােগ্য আর কতােটুকু তার বাদ দেয়া উচিত, সারা পথ সেই আলােচনাতেই মেতে রইলেন তিনি যুদ্ধের কেবল শুরু, বিজয় কতাে দূরে রয়েছে তার কোনাে ঠিক-ঠিকানা নেই, অথচ সেনাবাহিনীর আইন নিয়ে এখনি চিন্তার অন্ত নেই তার! সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ভারতের মতাে নিরাপদ জায়গাতেও পাকিস্তানি কমান্ডাে হামলার ভয়ে সারাক্ষণ আতঙ্কিত হয়ে রইলেন তিনি। তৃতীয় বেঙ্গলের অধিনায়কত্ব লাভ ও পরিবারের সঙ্গে দেখা ভুরুঙ্গামারীতে জয়মনিরহাট ক্যাম্পে দেখা হয় ক্যাপ্টেন নজরুলের (পরে লে, কর্নেল অব.) সঙ্গে। এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথে বালুরঘাটের বাঙালপাড়ায় গাড়ি থামালাম। সেখানে ক্যাপ্টেন আনােয়ার ১৮৭ জন সৈন্য নিয়ে অপেক্ষা করছিল।
সিইসি ওসমানী আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাসদস্যদের উদ্দেশে ‘দরবার’ করে ব্যাটালিয়নটির অধিনায়কত্ব আমার ওপর অর্পণ করলেন। এরপর তিনি বালুরঘাট থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের বিমানযােগে কোলকাতার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন।  দিন দুয়েক পর খবর পেলাম, আমার স্ত্রী ও দুই ছেলে কাজীর সঙ্গে মতিনগর ক্যাম্পে পৌছানাের পর সেখানে একরাত থেকে আগরতলা চলে গেছে। সেখানে ওরা মেজর খালেদ মােশাররফের পরিবারের সঙ্গে কোনাে একটা সরকারি কোয়ার্টারে রয়েছে। এ খবর পাওয়ার পর তিনদিনের ছুটি নিয়ে কোলকাতায় গেলাম। সেখান থেকে বেসামরিক বিমানে করে আগরতলায় গিয়ে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হলাম। পরদিনই আবার ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের একটা ফেয়ার চাইল্ড’ পরিবহন বিমানে করে সপরিবারে কোলকাতার উদ্দেশে যাত্রা করি। একই প্লেনে ছিলেন জোহরা তাজউদ্দিন ও তােফায়েল আহমেদ। তােফায়েল আহমেদের সঙ্গে পরিচয় হলাে। বাগডােগরাতে যাত্রাবিরতির সময় প্রায় দু’ঘণ্টার আলাপে ঘনিষ্ঠতা আরাে বাড়লাে। তার নেতৃসুলভ আচরণে মুগ্ধ হই আমি। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের ডেরা ইসমাইল খাঁ শহরে থাকাকালে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে তােফায়েল আহমেদের উজ্জ্বল ভূমিকা সম্পর্কে অবগত ছিলাম। এ.আর.এস. দোহার সম্পাদনায় রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রকাশিত ‘ইন্টার উইং’ পত্রিকাটি বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য নেতাসহ তােফায়েল আহমেদের সংগ্রামী ভূমিকা ভালােভাবেই তুলে ধরতাে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নায়কের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব ভালাে লাগছিলাে। কোলকাতায় পৌছে রাশিদা ও দু’ছেলেকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসভার স্পিকার মনসুর হাবিবুল্লার বাসায় রাখলাম। ওঁর সঙ্গে রাশিদার আত্মীয়তা ছিল। তারপর সেখান থেকে সরাসরি বালুরঘাটে চলে গেলাম।
তৃতীয় বেঙ্গলের পুনর্গঠন ও কয়েকটি অপারেশন
বালুরঘাট পৌছানাের পরবর্তী তিন সপ্তাহ তৃতীয় বেঙ্গলের পুনর্গঠনের কাজে ব্যস্ত থাকতে হলাে। শিলিগুড়ি থেকে মালদহ পর্যন্ত প্রতিটি ক্যাম্প থেকে শত শত ইপিআর, পুলিশ আর ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধার সমন্বয়ে এগারােশাে সদস্যের তৃতীয় বেঙ্গল গড়ে তুললাম। এই রিক্রুটমেন্টে ডা. মেজর এমএইচ চৌধুরী (পরে ব্রিগেডিয়ার) আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন। তিনি আগে। থেকেই বাঙালপাড়ায় অবস্থান করছিলেন। ট্রেনিংয়ের সঙ্গে কিছু কিছু প্র্যাকটিকাল ওয়ার্কও করানাে হলাে। দিনাজপুর, হিলি ও নওগাঁতে বিভিন্ন পক অবস্থানে প্লাটুন পর্যায়ের প্যাট্রলিং এবং রেইড চালানাে হয়। এসব অভিযানে লে, নবী, লে. (অব.) ইদ্রিস এরা যথেষ্ট সফলতার পরিচয় দেয়। বেশ ক’টি অভিযানে তারা পাকবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে ক্যাপ্টেন আনােয়ার যুদ্ধে আহত হওয়ায় ক্যাম্পে থেকেই পুনর্গঠন কাজে ব্যস্ত ছিল। লে. (অব.) ইদ্রিস ছিল পাক সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। মুক্তিযুদ্ধের আগে কর্মরত ছিল উত্তরবঙ্গের একটি চিনিকলে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ব-প্রণােদিত হয়ে যুদ্ধে যােগ দেয় ইদ্রিস বাঙালপাড়া ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধা ও ইপিআর-দের সঙ্গে বেশ কয়েকটি রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে অংশ নেয় সে। বাঙালপাড়ায় এসে তৃতীয় বেঙ্গলের দায়িত্ব নেয়ার পর এই অফিসারটির বীরত্বের কথা শুনে তাকে আমার ব্যাটালিয়নে যােগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানাই। আমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সানন্দে তৃতীয় বেঙ্গলে যােগ দিল লে, ইদ্রিস পরবর্তীকালে সে নবীর সঙ্গে দিনাজপুর শহর এলাকায় বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে। জুনের মাঝামাঝি আমরা যখন বালুরঘাট ছেড়ে মেঘালনের সীমান্ত এলাকায় চলে যাই তখন যাওয়ার সময় ইদ্রিস তাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরােধ জানায়।
বালুরঘাটে থেকেই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে সে। আমি আর তাকে ধরে রাখি নি। পরে শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের বাকি সময়টাতেও সে সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতা-বিরােধীরা ইদ্রিসের ওপর দু’বার হামলা চালায়। প্রথমদফায় বেধড়ক মারধাের করার পর গুরুতর আহত ইদ্রিসকে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। কিন্তু কপাল জোরে সেবারের মতাে বেঁচে যায় সে। দ্বিতীয়বার যাতে প্রচেষ্টা ব্যর্থ না হয় সেটা নিশ্চিত করতে ঘাতকরা ইদ্রিসকে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় ডা. মেজর এম, এইচ. চৌধুরী নামে একজন অফিসার বালুরঘাট এলাকার একটি ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। তাকে আমার ব্যাটালিয়নে যােগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানালে সােৎসাহে রাজি হলেন। এরপর থেকে সীমান্ত এলাকার ক্যাম্পগুলাে পুনর্গঠনের সময় তিনি আমার সঙ্গে থাকতেন। পরবর্তীকালে তেলঢালায় যাওয়ার সময়ও মেজর চৌধুরীকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাই। তেলঢালা ক্যাম্পে পৌছে সেখানে কয়েকদিন থাকার পর তিনি বালুরঘাটে ফিরে যেতে চাইলেন। মেজর চৌধুরী বললেন, তার পরিবার বালুরঘাট এলাকায় রয়েছে। এছাড়া ঐ এলাকার ক্যাম্পগুলাের মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকতে পারেন তিনি। তাকে আর আটকে রাখলাম না। ডা. মেজর চৌধুরী বালুরঘাট চলে গেলেন। তার জায়গায় মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে এলাে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র ওয়াহিদ।
গারাে পাহাড়ের তেলঢালায়
১৭ জুন পশ্চিম দিনাজপুরের রায়গঞ্জ রেল জংশন থেকে দুটো বিশেষ ট্রেনে করে তৃতীয় বেঙ্গলের পরবর্তী গন্তব্য মেঘালয়ের তেলঢালার উদ্দেশে রওনা হলাম। তেলঢালার ভৌগােলিক অবস্থান ময়মনসিংহের উত্তর-পশ্চিমে গারাে পাহাড়ের পাদদেশে। দুদিন পর গৌহাটি রেলস্টেশনে পৌছুলাম। সেখান থেকে ৭০ থেকে ৭২টি বেসামরিক ট্রাকে করে আরাে একদিন চলার পর ব্রহ্মপুত্র নদী বরাবর মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত তেলঢালায় পৌছুলাম। জায়গাটা গৌহাটি থেকে দুশাে মাইল পশ্চিমে। ছােট ছােট পাহাড় আর ঘন জঙ্গলে ভর্তি এলাকাটি সাপ, বুনাে শুয়াের আর বাঘের আখড়া এখন থেকে এটাই আমাদের ঘাটি। কয়েকটি পাহাড় পরিষ্কার করে কোম্পানিগুলাের থাকার ব্যবস্থা করা হলাে। আগে থেকেই জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়া তার হেড কোয়ার্টার নিয়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন। জিয়ার সঙ্গে ছিল জেড ফোর্সের ব্রিগেড মেজর ক্যাপ্টেন অলি আহমদ (পরে কর্নেল অব.) এবং ডি.কিউ, ক্যাপ্টেন সাদেক (এখন ব্রিগেডিয়ার)। জেড ফোর্সের অন্য একটি ব্যাটালিয়ন প্রথম বেঙ্গল ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে বনগাঁ থেকে এসে পৌছুলাে। দিন দশেক পর জেড ফোর্সের তৃতীয় ব্যাটালিয়ন অষ্টম বেঙ্গল ক্যাপ্টেন আমিনুল হকের (পরে ব্রিগেডিয়ার অব.) নেতৃত্বে চট্টগ্রামের রামগড় পাহাড় থেকে দীর্ঘ ভারতীয় ভূখণ্ড পাড়ি দিয়ে তেলঢালায় আমাদের পাশাপাশি অবস্থান নেয়। ২৫ জুন নাগাদ জেড ফোর্স বাংলাদেশের প্রথম পদাতিক ব্রিগেড হিসেবে সংগঠিত হয়। তিনটি ব্যাটালিয়নের যার যার অবস্থানে ট্রেনিং চলতে থাকে। একটি পদাতিক বাহিনীর যেসব অস্ত্র ও গােলাবারুদ থাকা দরকার, তার সবই জেড ফোর্সের কাছে ছিলাে। ছিলাে না কেবল যােগাযােগের উপকরণ আর ম্যাপ।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনো সিগন্যাল সেট বা ম্যাপ দেয় নি। হয়তাে তাদের ওপর আমাদের নির্ভরশীল করে রাখার উদ্দেশ্যেই এমনটা করা হয়েছিলাে। ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের তিনটি ব্যাটালিয়নের আলাদা আলাদা সাঙ্কেতিক নাম দিয়েছিল। তাদের নথিপত্রে আমাদের পরিচিতি ছিলাে 1 Arty (প্রথম বেঙ্গল), 2 Arty (তৃতীয় বেঙ্গল) এবং 3 Arty (অষ্টম বেঙ্গল)। ২৮ জুলাই পর্যন্ত তেলঢালায় সর্বাত্মক যুদ্ধের ট্রেনিং চলতে থাকে। প্রায় সারাদিন ট্রেনিং চলে। রাতে প্রচণ্ড মশার কামড় আর শুয়াের, সাপ ইত্যাদির উৎপাতে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাে আমাদের। বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকার জন্য মনে মনে সবাই অস্থির হয়ে উঠছিলাম।

সূত্র : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ  রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্ণেল শাফায়াত জামিল, প্রকাশনী সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮