You dont have javascript enabled! Please enable it! 1970.12 | সত্তরের নির্বাচন ও বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন - সংগ্রামের নোটবুক

বিদ্রোহ

সত্তরের নির্বাচন ও বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ১৯৭০-এর এপ্রিলে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে পােস্টিং হয় আমার। ব্যাটালিয়ন তখন লাহােরে অবস্থান করছিল। এক মাসের মধ্যে মেজর র্যাঙ্কে উন্নীত করা হয় আমাকে মে মাসে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আসে। ডিসেম্বরের প্রথমদিকে নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনকে সহযােগিতা করার দায়িত্ব দিয়ে একটা কোম্পানিসহ সিলেটের হবিগঞ্জে পাঠানাে হলাে আমাকে নির্বাচন যথারীতি হয়ে গেলো। ফলাফল, আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়। অথচ তাৱপৱও পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে শাসনভার ছেড়ে দিতে চাইলাে না পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের জনগণ স্বাধিকারের দাবিতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠায় পরিস্থিতি ক্রমশই চরম অবনতির দিকে যেতে থাকে ছয় দফা এগারাে দফার আন্দোলন তখন তুঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বাঙালির মুকুটহীন সম্রাট। সারা বাংলাদেশ তাকিয়ে আছে তার দিকে।  ১ মার্চ আমাকে এবং পাঞ্জাবি অফিসার মেজর সাদেক নওয়াজকে সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার অজুহাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিজ নিজ Battle location-এ গিয়ে অবস্থান নেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হলাে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা বলছিল, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ অনিবার্য। কাজেই এই প্রস্তুত এটা ছিল পাকিস্তানিদের সুপরিকল্পিত তৎপরতার অংশমাত্র। বেশিসংখ্যক বাঙালি সৈন্যদের এক জায়গায় একসঙ্গে রাখার ব্যাপারটাকে তারা নিরাপদ মনে করে নি। তাই বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলােকে বিভিন্ন ছােট ছােট ইউনিটে ভাগ করে যুদ্ধ এবং অন্যান্য অজুহাতে বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল। চতুর্থ বেঙ্গলের দুটো কোম্পানিকে (আমার আর সাদেক নওয়াজের) ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং একটিকে খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে ভারতীয় নকশালদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করার কথা বলে শমসেরনগর পাঠিয়ে দেয়া হয়।

উল্লেখের দাবি রাখে এসব এনসিও (নন-কমিশন্ড অফিসার) ও জওয়ানদের অনেকেই পরে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হন। কবির, হারুন, আখতারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে স্থির করলাম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিলেও আমরা সেটা মেনে নেবে না। বরং বিদ্রোহ করে বেরিয়ে গিয়ে জনগণের পক্ষে যুদ্ধে যােগ দেবাে বাংলাদেশের পক্ষে লড়বাে। এর মধ্যে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে খবর এলাে, সেখানে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে তাক করে বিভিন্ন অবস্থানে মেশিনগান, মর্টার ইত্যাদি বসানাে হয়েছে। আমরা সবাই এ খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। দু’দিন পরপর কুমিল্লা থেকে রেশন আনার জন্য এনসিওরা যেতাে। এছাড়া সিএমএইচ থেকে ফিরে আসা কিংবা ছুটি শেষে যােগ দেয়া জওয়ান বা অফিসারদের কাছ থেকে বিভিন্ন খবর পাওয়া যেতাে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন কাজের অজুহাতেও এনসিওদের কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাঠাতাম। তাদেরকে দিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবাইকে সতর্ক থাকতে বলে পাঠালাম। সেন্ট্রি ডিউটি দ্বিগুণ করার পরামর্শ দিলাম। পাকিস্তানিরা নির্দেশ দিলে অস্ত্র সমর্পণ না করে তেমন পরিস্থিতিতে বিদ্রোহ এবং প্রয়ােজনে যুদ্ধ করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ারও পরামর্শ দিলাম।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

মার্চের ৭ তারিখে ক্যান্টনমেন্টে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে আমার বাবা ও শ্বশুর কুমিলায় এসে আমার স্ত্রী ও দু’ছেলেকে ঢাকা নিয়ে গেলেন। সেদিনই রেসকোর্সে ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু। ৮ মার্চ রেডিওতে সেই ভাষণ শুনলাম আমরা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে একদিক থেকে অনেকটা নিস্তেজই হয়ে পড়লাম। এতােদিন সলাপরামর্শ করে বিদ্রোহ করার জন্য মানসিক দিক থেকে একরকম প্রস্তুত ছিলাম আমরা। বঙ্গবন্ধু ওই ভাষণ না দিলে হয়তাে সেদিনই কিছু একটা করে বসতাম। কিন্তু তিনি সুনির্দিষ্টভাবে সেরকম কোনাে নির্দেশ দিলেন না। মনে মনে তার কাছ থেকে একটা আদেশ চাইছিলাম আমরা। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা বললেও তা একটি বিলম্বিত সংগ্রামের আহ্বান বলে মনে হলাে আমাদের কাছে। আমি ভাবছিলাম, প্রথমে আক্রমণ করতে পারলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা এড়াতে পারতাম। এখন এরাই হয়তাে সে সুযোগটা নেবে। তাই কদিনের উত্তেজনায় টান টান আমরা ক’জন একটু ঝিমিয়ে পড়লাম। তবে বঙ্গবন্ধুর সেই আহ্বান, ‘তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তােমরা বন্ধ করে দেবে এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’– আমাদের মধ্যে আবার দ্রুত উদ্দীপনা ফিরিয়ে আনলাে পরে ভেবে দেখেছিলাম, তাৎক্ষণিক উদ্যোগের কথা না থাকলেও বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে যুদ্ধের ইঙ্গিত ও দিক-নির্দেশনা তাে ছিল সবকিছু মিলিয়ে তখন একটা উদ্বেগের মধ্যে সময় কাটতে লাগলাে।

দু’একদিন পর লে. কর্নেল সালাউদ্দিন মুহাম্মদ রেজা (পরে (অব.) কর্নেল ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলেন। তিনি ঢাকার আর্মি রিক্রুটিং অফিসের সিও ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই তার বাড়ি। একজন আত্মীয়ের মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে এসেছিলেন তিনি। লে. কর্নেল রেজার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা হলাে। তিনি জানালেন যে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটার পর একটা আর্মি ইউনিট ঢাকায় আসছে। এসব দেখে খারাপ কিছু একটা ঘটার আশঙ্কা করে কিছু অফিসার কর্নেল (অব.) ওসমানীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু ওসমানী নাকি তাদের কথার তেমন একটা আমল দেন নি। যুদ্ধ করার কথা তখনাে ভাবছিলেন না তিনি। এই পরিস্থিতিতে ঢাকায় বাঙালি অফিসাররা প্রচণ্ড অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন। লে. কর্নেল রেজা আমাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার পরামর্শ দিলেন। একসময় আমাকে বললেন, তােমার কোতে (Kote সাধারণত যে ঘর বা তাঁবুতে অস্ত্র ও গােলাবারুদ রাখা হয়) চলাে, দেখি অস্ত্রশস্ত্র কেমন আছে। তাকে আমার সঙ্গে নিয়ে গিয়ে অস্ত্রগুলাে দেখালাম। আমার কোম্পানির যাবতীয় অস্ত্র ও গােলাবারুদ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এমনকি যারা ছুটিতে ছিল তাদের অসও বাদ দিই নি। লে, কনেল রেজা আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও সতর্কতা দেখে বেশ খুশি হলেন। তিনি আরাে বলেছিলেন, তােমাদেরকে ইন্সট্রাকশন দেয়ার মতাে কেউ নেই। ওসমানী সাহেব এধরনের কোনাে কিছু ভাবছেনই না। যা করার তােমাদের নিজেদেরই করতে হবে। কারাে নির্দেশের অপেক্ষায় বসে থেকো না। আমিও সময়-সুযােগ মতাে তােমাদের সঙ্গে যােগ দেবাে। লে. কর্নেল রেজা সত্যিই ২৯ মার্চ অসুস্থ অবস্থাতেই ঢাকা থেকে হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে এসেছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে তাঁর পা ভীষণরকম ফুলে গিয়েছিল।

মে’র দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এরপর কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের পুরাে সময়টা তিনি সেখানেই ছিলেন। ওসমানীর সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরােধ থাকায় লে. কর্নেল রেজাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া থেকে বিরত রাখা হয়। দুঃখজনকভাবে তার মতাে একজন অভিজ্ঞ অফিসারকে মুক্তিযুদ্ধে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে হয়। উল্লেখ্য, সালাউদ্দিন রেজাই ছিলেন একমাত্র কর্মরত লে. কর্নেল, যিনি নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে যুদ্ধে যােগ দেয়ার উদ্দেশ্যে ২৯ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে এসেছিলেন। ১১ মার্চ কুমিল্লা থেকে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার আমাকে নির্দেশ দিলেন ৩১ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের ১৭টি ট্রাকের একটা কনভয় (গােলাবারুদ ও রেশনবাহী সামরিক যানের বহর) এসকর্ট করে সিলেট পৌঁছে দিতে। ব্যাটালিয়নটি তখন ছিল সিলেটের খাদিমনগরে। ইতিমধ্যেই পথে বেশ কয়েকবার জনতার বাধার সম্মুখীন হতে হতে ট্রাক কনভয়টি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেছিল। শামসুল হক নামে চতুর্থ বেঙ্গলের একজন নায়েব সুবেদার দশজন বাঙালি জওয়ানকে সঙ্গে করে কনভয়টি ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে আসেন। তাদের সঙ্গে কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যও ছিল। কনভয়টিতে ছিল তেলসহ বিভিন্ন রসদ। এতােগুলাে ট্রাক নিরাপদে সিলেট পৌছে দেয়ার জন্য আমাকে দেয়া হলাে মাত্র একটা প্লাটুন (৩৫জন সৈন্য)। রাস্তায় ৫/৬ মাইল পরপরই সামনে বড়াে বড়াে গাছের ব্যারিকেড পড়তে লাগলাে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী জনগণ পাকিস্তানিদের জন্য রসদ নিয়ে যেতে দেবে না। আমি ও আমার সঙ্গী সৈন্যরা প্রতিটি ব্যারিকেডে অনেক কষ্টে সংগ্রাম কমিটির সদস্য ও সাধারণ লােকদের বােঝালাম যে, রসদ পৌছে দিতে না পারলে আমাদের বন্দি করে কোর্ট মার্শাল করা হবে।

সময়মতাে আমরা অবশ্যই আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াব। আর্মি কনভয় এমনিতেই ধীরগতিতে চলে, তার ওপর এতােগুলাে ব্যারিকেডের কারণে ১২০ মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে ২/৩ দিন লেগে গেলো। ১৬ মার্চ সিলেট পৌছুলাম আমরা। পৌছুবার পর ৩১ পাঞ্জাবের কমান্ডিং অফিসার সাফল্যের সঙ্গে কনভয় নিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ জানালেন আমাকে। তারপর তাদের ছাউনিতে থাকার এবং আমাদের অস্ত্রশস্ত্র তাদের কোতে জমা দেয়ার প্রস্তাব করলেন তিনি। কিন্তু পাকিস্তানিদের মতলব বুঝতে পেরে আমি তাতে রাজি হলাম না। সিনিয়র এনসিওরা আমাকে বলেছিল, আমরা একটা অপারেশনাল এরিয়া থেকে এসেছি, তাই আমরা নিজেদের অস্ত্র দিয়েই একটা ছােটোখাটো অস্ত্রাগার বানিয়ে রাখবাে। সিওকে আমার মতামত জানিয়ে দেয়া হলাে। তিনি আর এ ব্যাপারে চাপাচাপি করলেন না। পরে মনে হয়েছে, ঐ সময় পাকিস্তানিরা বেশি জোরাজুরি করে নি এজন্য যে, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পরিকল্পনাটি তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারতাে। তারা চায় নি বাধ্য হয়ে আমরা এমন একটা কিছু করি, যাতে ২৫ মার্চের আগেই পরিস্থিতি বদলে যায়। যাই হােক, আমাকে বলা হলাে, শিগগিরই আমার পরবর্তী অর্ডার আসবে। Unofficially বলা হলাে, সিলেটে বিভিন্ন চাবাগানে কর্মরত অবাঙালি অফিসারদের পরিবারকে এসকর্ট করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে হবে। তাদের জড়াে করতে সময় লাগবে এবং সে পর্যন্ত আমাদের ৩১ পাঞ্জাবের সঙ্গেই থাকতে হবে। পরদিন (১৭ মার্চ) আমার প্রতি কি অর্ডার আছে জানতে চাইলাম। কিন্তু কেউই কিছু বললাে না। কুমিল্লায় আমাদের ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের সঙ্গেও আমাকে টেলিফোনে কথা বলতে দেয়া হলাে। শেষে কুমিল্লার বাঙালি এস এম (সুবেদার মেজর) ইদ্রিস মিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলাে।

তার সঙ্গে আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আমার অধীনে একজন বিশ্বস্ত জেসিও (জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার) হিসেবে কুমিল্লা ও জয়দেবপুরে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ইদ্রিস মিয়াকে বললাম, “কিছু বুঝতে পারছেন ইদ্রিস সাহেব? এরা আমাকে কোনাে অর্ডারও দিচ্ছে না, যেতেও দিচ্ছে না।’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘স্যার, সবই বুঝছি। আপনি কিছু বলবেন না, আমি সিও সাহেবকে বলবাে তিনি যেন আপনাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিয়ে আসেন। অধিনায়কের ওপর একজন সুবেদার মেজর প্রচুর প্রভাব খাটিয়ে থাকেন। চতুর্থ বেঙ্গলে অবস্থানরত অন্যান্য বাঙালি অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করে ইদ্রিস মিয়া আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সিওকে চাপ দিলেন। শেষ পর্যন্ত সিও কর্নেল খিজির হায়াত খান কুমিল্লা ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির সঙ্গে পরামর্শ করে আমাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরে আসবার নির্দেশ দেন। ১৯ মার্চ আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরে এলাম। চারদিকে তখন চাপা উত্তেজনা।

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের অস্বাভাবিক ঘটনা

যুদ্ধ বােধহয় করতেই হবে এরকমই মনে হচ্ছিল। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন উৎস থেকে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ কানে আসছিল। আর ক্রমশই বাড়ছিল উত্তেজনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আমি সব সময় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত বাকি দুই কোম্পানির সঙ্গে যােগাযােগ রাখতাম। সুবেদার আবদুল ওহাব খবর আদান-প্রদানে আমাকে খুব সাহায্য করতাে। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, মেশিনগান ও মটার তাক করা ছাড়াও পাকিস্তানিরা আমাদের ইউনিট লাইনের চারদিকে উঁচু পাহাড়ে পরিখা খনন করছে। জিগ্যেস করলে তারা বলতাে, ট্রেনিং-এর কাজ করা হচ্ছে। পুরাে মার্চ মাস ধরেই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে এধরনের বিভিন্ন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে থাকে। আমাদের ইউনিট লাইনের চারদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার ও জেসিও, বিশেষ করে আর্টিলারি বাহিনীর লােকজন সন্দেহজনকভাবে ঘােরাফেরা করতাে। কমান্ডারসহ ব্রিগেডের অন্যান্য অফিসার প্রায়ই অপ্রত্যাশিতভাবে ইউনিট লাইন পরিদর্শনে আসতেন ব্রিগেড কমান্ডার ও ব্যাটালিয়ন কমান্ডার সপ্তাহে একবার সৈন্যদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতেন, যেটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হতাে না। এছাড়া চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও জেসিওদের সঙ্গে ব্রিগেডের অফিসার ও জেসিওদের প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলাের প্রতিযােগিতা হতাে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সাধারণত যেটা ঘটে থাকে ছয় মাসে একবার কি দুবার। এসময় খেলার মাঠে নিরাপত্তার জন্য অন্য রেজিমেন্টের সশস্ত্র প্রােটেকশন পার্টি নিযুক্ত করা হয়। আরাে আশ্চর্যের বিষয়, আমাদেরকে ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছিল, অথচ সেই জরুরি পরিস্থিতিতেও অস্বাভাবিকভাবে ছুটির ওপর কোনাে কড়াকড়ি আরােপ করা হয় নি।

বরং চতুর্থ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার ও ব্রিগেড কমান্ডার জওয়ানদেরকে বলেন, যে যার ইচ্ছেমতাে ছুটি নিতে পারাে। এদিকে ১৮/১৯ তারিখে আর্টিলারি থেকে একজন বাঙালি সৈনিক এসে খবর দেয়, চতুর্থ বেঙ্গলের ইউনিট লাইনের ওপর সেদিন রাতে পাকিস্তানিরা হামলা করবে। একথা শুনে চতুর্থ বেঙ্গলের বাঙালি সৈন্যরা ক্যাপ্টেন মতিনের পরামর্শে এবং এ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন গাফফারের উদ্যোগে ও নির্দেশে অস্ত্রাগার থেকে যার যার অস্ত্র বের করে হামলা মােকাবিলার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা আর হামলা করে নি। পরদিন চতুর্থ বেঙ্গলের সৈন্যরা অস্ত্র ফেরত দেয়ার সময় বিনা নির্দেশে অস্ত্র বের করার জন্য তাদের কোনাে জবাবদিহি করতে হয় নি। সিও স্বয়ং এ ঘটনা জেনেও তাদের কিছু বলেন নি। একের পর এক এ ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনায় সন্দিহান হয়ে পড়ি আমি। সুবেদার ওহাবকে দিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে বলে পাঠাই সবাইকে সতর্ক থাকতে এই সন্দেহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হওয়ার পর কুমিল্লা থেকে আমার ও সাদেক নেওয়াজের কোম্পানির উদ্বৃত্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিয়ে আসি। আমার আশঙ্কা ছিল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের দুই কোম্পানি সৈন্যকে পাকিস্তানিরা অতর্কিতে হামলা চালিয়ে অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করবে। এ আশঙ্কা থেকে সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নিই আমি পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আমার ও সাদেক নেওয়াজের কোম্পানির জেসিওদেরকে আত্মরক্ষার জন্য ক্যাম্পের চারদিকে পরিখা খোড়ার নির্দেশ দিই। কাজগুলাে করতে হয়েছে খুবই সতর্কতার সঙ্গে কারণ পাঞ্জাবি। অফিসার সাদেক নেওয়াজ আমার গতিবিধির ওপর সবসময় নজর রাখতে প্রায়ই সে আমাকে জিগ্যেস করতাে এই সব পরিখা খনন, পজিশন নেয়ার উদ্দেশ্য কি।

আমি উত্তর দিতাম, জওয়ানদের ডিগিং এবং পজিশন নেয়ার অনুশীলন করাচ্ছি। এছাড়া বিশৃঙ্খল জনতার সম্ভাব্য হামলা থেকে সেনাসদস্য ও অস্ত্র-গোলাবারুদ রক্ষার অজুহাত দেখিয়েছিলাম। কুমিল্লার সঙ্গে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ক্যাম্পের যােগাযােগের মাধ্যম ছিল একমাত্র টেলিফোন এবং একটি সিগন্যাল সেট। সিগন্যাল সেটটি অপারেট করতে পাকিস্তানিরা। অস্বাভাবিকভাবে এই সেট দিয়ে কুমিল্লা ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করা হতাে, যদিও কোম্পানি পর্যায়ে ব্যাটালিয়নের সঙ্গে যােগাযােগ করারই নিয়ম ছিল। এসময় আমি খুব অস্বস্তির মধ্যে ছিলাম। সব সময় মনে হতাে, কুমিল্লায় থেকে-যাওয়া জুনিয়র বাঙালি অফিসাররা যদি সময়মতাে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে হয়তাে ব্যাটালিয়নের অর্ধেক অস্ত্র-গােলাবারুদ এবং সৈন্য হারাতে হবে।

এদিকে ২৩ মার্চ ঢাকায় জঙ্গি ছাত্র যুব কর্মীরা ঢাকা বিশ্বদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়। ২৪ মার্চ বিকেলে ঢাকা থেকে আমার স্ত্রী রাশিদা ফোন করলাে কুশলাদি বিনিময়ের পর রাশিদা বললাে, ‘ঢাকার যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে যুদ্ধ অনিবার্য। যুদ্ধ তােমাদেরকে করতেই হবে। সময়মতাে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করাে না। আমি বলেছিলাম, নিরস্ত্র দেশবাসীর পাশে তাে আমাদের দাঁড়াতেই হবে। আমি সময় আর সুযােগের অপেক্ষায় আছি একজন গৃহবধূর এই চেতনা ও দায়িত্ববােধের প্রতিফলন তাৎক্ষণিকভাবে আমার মনে গভীর রেখাপাত করে। রাশিদার সঙ্গে এরপর বেশ কিছুদিন যােগাযােগ হয় নি। দেখা হয় একেবারে মে’র ২০/২২ তারিখে ভারতের আগরতলায়।

খালেদ মােশাররফের সঙ্গে সাক্ষাৎ

এদিকে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়ােগপ্রাপ্ত হয়ে মেজর খালেদ মােশাররফ (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল এবং শহীদ) ২২ মার্চ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে এলেন। এর আগে তিনি ঢাকায় পদাতিক ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ পদ ব্রিগেড মেজরের দায়িত্ব পালন করছিলেন। কয়েক ঘন্টার নােটিশেই তাকে ঢাকা থেকে কুমিল্লায় বদলি করা হয়। ২৪ মার্চ তাকে একটা কোম্পানি নিয়ে সেদিনই সীমান্তবর্তী এলাকা শমসেরনগরে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেয়া হলাে খালেদ মােশাররফকে বলা হয়েছিল, শমসেরনগর সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় নকশালরা পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে তাদেরকে দমন করতে হবে। শমসেরনগর যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমার সঙ্গে খালেদ মােশাররফের দেখা হয়। কুমিল্মী থেকে শমসেরনগর যেতে হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়েই যেতে হয়। গভীর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপকণ্ঠে এসে পৌছান খালেদ মােশাররফ। শহরের ওই অংশে তখন প্রচুর ব্যারিকেড। ব্যারিকেড সরাতে সরাতেই ধীর গতিতে এগুচ্ছিলেন তিনি কিন্তু শহরের নিয়াজ পার্কের কাছের সেতুটির সামনে ছাত্র-জনতার প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হলাে তাকে। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে কয়েক হাজার লােক রাস্তায় শুয়ে পড়ে জানায়, সামরিক বাহিনীর কোনাে কনভয় যেতে দেয়া হবে না। তৎকালীন সাংসদ লুৎফুল হাই সাচ্চু, আলী আজমসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতা খালেদ মােশাররফকে বলেন, বাংলাদেশের অনেক জায়গায় পাকসেনারা আবার গুলি চালিয়েছে এবং মিলিটারির চলাচল কেন্দ্রীয় নির্দেশে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। তারা আরাে বলেন, পাকিস্তানিরা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদেরকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কুমিল্লা থেকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। নেতৃবৃন্দ তাদেরকে যেতে দিতে অস্বীকৃতি জানান।

খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গেলাম উপস্থিত নেতৃবৃন্দসহ জনতাকে ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলার জন্য বােঝাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারা কিছুতেই রাজি হলাে না। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলে। আমরা তাদেরকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলাম, বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাংলাদেশেরই রেজিমেন্ট। বাঙালির প্রয়ােজনের সময় এই রেজিমেন্ট পিছিয়ে থাকবে না; কিন্তু এখন আমাদেরকে বাধা দেওয়া ঠিক হবে না। শেষ পর্যন্ত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ব্যারিকেড উঠিয়ে নিতে সম্মত হলেন। খালেদ মােশাররফকে আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে এলাম। ক্যাম্পে তার সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি এবং আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলােচনা হলাে। রাতের খাবারের সময় মেজর খালেদ বললেন, পাকিস্তানিরা পার্লামেন্ট বসতে দেবে না, ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। একটা গণহত্যা ঘটানাের পরিকল্পনা চলছে। আমাদের সর্বতােভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। সিভিলিয়ানের বেশে পিআইএ-এর বিমানে করে বেশ কিছু পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ন ঢাকায় এনেছে তারা। এছাড়া জাহাজে করে অস্ত্রশস্ত্রও আনা হয়েছে ক্র্যাকডাউন হবেই এবং তাহলে বাঙালি সৈন্যদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাই তার আগে বাঙালি সৈন্যদেরকে নিরস্ত্র করে ফেলার চক্রান্ত করছে। খালেদের এই চেতনাটা বাংলাদেশের সেই সময়কার চাকরিরত অনেক অফিসারের ভেতরেই অনুপস্থিত ছিল। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধের প্রথমপর্বে (২৫ মার্চ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত) সেনাবাহিনীতে চাকরিরত মাত্র ২৫ থেকে ৩০জন অফিসার সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে যােগদান করেন। পুরাে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানে কমিশনপ্রাপ্ত বাঙালি অফিসার বলতে ছিলেন এঁরাই।

তখন বেশির ভাগ বাঙালি অফিসারেরই পােস্টিং ছিলাে পশ্চিম পাকিস্তানে। যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশে কর্মরত এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটি বা বিভিন্ন উপলক্ষে এদেশে এসেছেন, আবার চলে গেছেন এমন অফিসারের মােট সংখ্যা দেড় শতের মতাে ছিলাে। অর্থাৎ দেড়শাে অফিসারেরই মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার সুযােগ ছিলাে। অথচ যুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন উল্লিখিত ২৫/৩০ জনই এদিক দিয়ে অফিসারদের তুলনায় সাধারণ সৈন্যদের ভেতরেই সংগ্রামী চেতনা বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এই চেতনা ও দূরদৃষ্টির অভাবেই বহু বাঙালি অফিসার অসহায়ভাবে বন্দি ও পরবর্তীকালে নিহত হন। যাই হােক, খালেদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় ঢাকার খবর পাওয়া ছাড়াও আর যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলাে, তা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে যােগাযােগ স্থাপনের একটা ব্যবস্থা করে গেলেন তিনি। খালেদ মােশাররফ আমাকে একটা বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক করে দিয়ে বললেন, প্রয়ােজন হলে এতে টিউনিং করে তার সঙ্গে যােগাযােগ করতে। যােগাযােগের একটা উপায় পেয়ে আমি খানিকটা ভরসা পেলাম।

সিও এলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়

পরদিন, অর্থাৎ ২৫ মার্চ সন্ধ্যায়, কুমিল্লা থেকে নির্দেশ এলাে, আরাে লােক আসছে। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা সে অনুযায়ী। ব্যবস্থা করলাম, কিন্তু জানতাম না কারা আসছে রাত আটটার দিকে সিও কর্নেল মালিক খিজির হায়াত খান কুমিল্লায় অবস্থিত চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাকি কোম্পানিগুলাে নিয়ে উপস্থিত হলেন। সিওর সঙ্গে এলাে ক্যাপ্টেন মতিন (পরে ব্রিগেডিয়ার অব.), ক্যাপ্টেন গাফফার (পরে লে. কর্নেল অব.), লে, আমজাদ সাইদ (পাকিস্তানি অফিসার) ও ডা. লে. আবুল হােসেন (পরে ব্রিগেডিয়ার)। ডা. আবুল হােসেন এসেছিল আখতারের বদলে টেম্পােরারি ডিউটিতে আখতারের পােস্টিং অর্ডার নিয়ে এসেছিল সে আখতারের পােস্টিং হয়েছিল আজাদ কাশ্মিরের একটি স্টেশনে সিও বললেন, যুদ্ধ আসন্ন বলে ব্রিগেড কমান্ডার তাকে কুমিল্লা থেকে চতুর্থ বেঙ্গলের প্রায় সব সৈন্যকে দিয়েই পাঠিয়ে দিয়েছেন। ক্যান্টনমেন্টে তখন রয়েছে শুধু LOB (Let out of Battle) সেনা সদস্যরা, অর্থাৎ বয়স্ক, অবসর অত্যাসন্ন এমন, কিংবা অসুস্থ এবং পাহারায় নিয়ােজিত অল্পসংখ্যক সৈন্য । রাত ১১টার দিকে সিও আমাকে শাহবাজপুরে আমার অবস্থানে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ মতাে রওনা হয়ে গেলাম। ১২ মাইল দূরের গন্তব্যে পৌছুলাম রাত তিনটার দিকে তারপর তিতাস নদীর পাড়ে খোড়া ট্রেঞ্চে অবস্থান নিলাম আমরা কিন্তু সকাল ছ’টাতেই (২৬ মার্চ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরে যাওয়ার আদেশ এলাে।

কি আর করা! ঘণ্টাখানেক পর আবার রওনা হলাম ব্রাহ্মবাড়িয়ার দিকে আশ্চর্য ব্যাপার, কিছুদূরে যেতেই দেখলাম রাস্তার ওপর পড়ে আছে বিশাল একটা গাছ। পড়ে আছে মানে কেটে ফেলে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে আর কি! অথচ ঘণ্টা তিনেক আগেও রাস্তা ছিল একেবারে পরিষ্কার। বুঝতে পারলাম জনতা সেনাবাহিনীর গতিরােধ করার জন্যই এ কাজ করেছে। পরে জেনেছিলাম পঁচিশে মার্চের রাতে ঢাকায় পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের খবর সেই রাতে পেয়েই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য জনতা শেষ রাতের দিকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অনেকগুলাে ব্যারিকেড তৈরি করে। যাই হােক, জওয়ানরা গাড়ি থেকে নেমে গাছ কেটে রাস্তা থেকে সরানাের পর আবার যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু কিছুদূর যেতে-না-যেতেই আবার ব্যারিকেড। ১২ মাইল পথে অন্তত কুড়ি জায়গায় এরকম ব্যারিকেড সরিয়ে এগুতে হলাে। রাস্তা একদম ফাঁকা। কোনাে লােকজনের দেখা পাচ্ছিলাম না। ব্যারিকেডের কারণে ১২ মাইল রাস্তা পেরােতে ঘণ্টা তিনেক লেগে গেলাে দশটার দিকে ক্যাম্পে পেীছে দেখলাম সাদেক নওয়াজ, ক্যাপ্টেন গাফফার, লেফটেন্যান্ট আমজাদ, লেফটেন্যান্ট আখতার, হারুন এদেরকে নিয়ে সিও বসে আছেন আমার সঙ্গে ছিল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট কবির। সিও এবং অন্যদেরকে বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছিলাে। সিও আমাকে জানালেন, দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে পাঠানাে হয়েছে সান্ধ্য আইন কার্যকর করার জন্য। তিনি আমাকে তখুনি পুলিশ লাইনে গিয়ে পুলিশদের নিরস্ত্র করার নির্দেশ দিলেন আমি তাকে বললাম, পুলিশদের নিরস্ত্র করতে গেলে অহেতুক গােলাগুলি, রক্তপাত হবে। সিও অবশ্য প্রথমটায় চেয়েছিলেন সাদেক নেওয়াজ গিয়ে প্রয়ােজনবােধে শক্তি প্রয়ােগ করে পুলিশদের নিরস্ত্র করুক রক্তপাত এড়ানাের জন্য আমি সিও-কে পরদিন নিজে গিয়ে পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে আসার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিলাম। আমার কথায় তখনকার মতাে নিবৃত্ত হলেন তিনি।

যুদ্ধের পূর্বাভাস

দুপুরের দিকে সিগন্যাল জেসিও নায়েব সুবেদার জহির তার ওয়্যারলেস সেট র্যান্ডম স্ক্যানিং করার সময় কিছু অর্থপূর্ণ ম্যাসেজ ইন্টারসেপ্ট করে। ম্যাসেজগুলােকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সে আমাকে তা জানাতে এলাে। পাক আমির দুটো স্টেশনের মধ্যে উর্দু ও ইংরেজিতে কথাবার্তাগুলাে ছিল এরকম—আরাে ট্যাঙ্ক অ্যামুনিশন দরকার… হেলিকপ্টার পাঠানাের ব্যবস্থা কর। আমাদের অনেক ক্যাজুয়েলিটি হচ্ছে… EBRC-র (East Bengal Regimental Centre) অর্ধেক সৈন্য অস্ত্রসহ অথবা অস্ত্র ছাড়া বেরিয়ে গেছে ইত্যাদি। বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম । যুদ্ধ কি তাহলে শুরু হয়ে গেলাে! হারুন, কবির আর আখতারকে নিয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে বসলাম। ম্যাসেজগুলাে পেয়ে ওরা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতি যে গুরুতর, সে বিষয়ে সবাই একমত হলাে। বিশ্বস্ত জেসিও, এনসিওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাদের মনােভাব বােঝার চেষ্টা করলাম। দেখলাম আমাদের চেয়ে তারা এক ধাপ এগিয়ে। জেসিও-এনসিওরা জানালাে, তারা পুরােপুরি প্রস্তুত রয়েছে, কেবল আদেশের অপেক্ষা একটু আশ্বস্ত হলাম। বিকেল পাঁচটা নাগাদ দেখতে পেলাম শত শত লােক ঢাকার দিক থেকে পালিয়ে আসছে। নারীপুরুষ আর শিশুদের ঐসব দলকে জনস্রোত বললেই বােধহয় দৃশ্যটার সঠিক বর্ণনা দেয়া হয়। তাদের মুখে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা আর পথশ্রমের ছাপ। কেউ আসছে গােকর্ণঘাট হয়ে, অনেকে আসছে ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল লাইন ধরে স্রেফ হাঁটাপথে। পালিয়ে আসা লােকগুলাের সঙ্গে আগে কথা বলার চেষ্টা করলাম। আর্মির পােশাক দেখে অনেকেই ভয়ে রাস্তা ছেড়ে মাঠ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাে। আমরা বাংলায় কথা বলছি দেখে সাহস করে যে দু’একজন এলো, তাদের কাছ থেকে জানলাম, ঢাকায় গতকাল অর্থাৎ ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি আর্মি সাধারণ মানুষের ওপর ট্যাঙ্কসহ ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করেছে। বহু লােক মারা গেছে।

কথা বলার মতাে মানসিক অবস্থাও অনেকের ছিল না। তারা শুধু বলছিল, আগুন গুলি ঢাকা শেষ লাখ লাখ লােক মারা গেছে এই রকম অসংলগ্ন কথা। এরপর আর বুঝতে বাকি রইলাে না কিছু বুঝলাম আর দেরি নয়, এবার সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা। জওয়ানদের মনােভাব এর মধ্যেই জানা হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যার দিকে জহিরের সিগন্যাল সেট দিয়ে শমসেরনগরে মেজর খালেদ মােশাররফের সঙ্গে যােগাযােগ করলাম। ঢাকাইয়া বাংলায় ইন্টারসেন্টেড মেসেজগুলাে শুনিয়ে তার মতামত জানতে চাইলাম। বললাম, পুরাে ব্যাটালিয়ন এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের হামলার শিকার হয়ে লােকজন যে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসছে তাও জানলাম। খালেদ মােশাররফকে বললাম আমরা তৈরি। তাকে তাড়াতাড়ি কোম্পানি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসার অনুরােধ করলাম। আমাদের কথােপকথনের সময় সাদেক নেওয়াজ, আমজাদ এবং সিও খিজির হায়াত খান খুব তীক্ষ দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ্য করছিলেন বলে বেশি কথা বলা সম্ভব হয় নি। খালেদ মােশাররফও শমসেরনগর থেকে বেশি কথা বলেন নি। সব শুনে তিনি একটি মাত্র কথা বললেন, আমি রাতের অপেক্ষায় আছি।’ মেজর খালেদের এই একটি কথা থেকেই বুঝে নিলাম কি বলতে চাইছেন তিনি। বুঝলাম, তিনি বিদ্রোহের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন এবং আজ রাতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন। ২৭ মার্চ বেলা তিনটা নাগাদ তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের মধ্যে আর যােগাযােগ হয় নি। শমসেরনগর যাওয়ার পর তার withdrawal route অর্থাৎ পশ্চাদপসরণের রাস্তা পাকিস্তানি ৩১ পাঞ্জাব-এর এক কোম্পানি সৈন্য দিয়ে বন্ধ করে রেখেছিল। তাই তিনি চা বাগানের ভেতর দিয়ে বিকল্প রাস্তা ধরে পরদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ বেলা প্রায় তিনটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌঁছান।

অফিসার ও জওয়ানদের মধ্যে উত্তেজনা

খালেদ মােশাররফের সঙ্গে কথা হওয়ার পর থেকেই জুনিয়র অফিসাররা দ্রুত কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আমাকে চাপ দিচ্ছিল। সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ শুনে তারা আরাে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখুনি অস্ত্র তুলে নেয়ার নিদের্শদানের জন্য তারা আমাকে পিড়াপিড়ি করতে থাকে। আমি ব্যাটালিয়নের অন্য কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ জুনিয়র অফিসারের চূড়ান্ত মতামতের অপেক্ষা করছিলাম। কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামান্য ভুল কিংবা সিদ্ধান্ত সময়ােপযােগী না হলে সৰ পণ্ড হয়ে যাবে এবং অপ্রয়ােজনীয়ভাবে লােকক্ষয় ঘটবে। দ্বিধাগ্রস্ত একজন অফিসার ও জ্যেষ্ঠ একজন জেসিওকে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সারারাত সময় দিলাম। সন্ধ্যার একটু পর আমার কোম্পানির সৈন্যদের দেখতে টেন্টে গেলাম । সঙ্গে কবির, আখতার, হারুন ছাড়াও বেলায়েত, শহীদ, মুনীর, ইউনুস, মইনুলসহ কয়েকজন বিশ্বস্ত এনসিও। পাকিস্তান আর্মিতে অফিসার ও সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে একটা সামাজিক দূরত্ব ছিল। তাই সৈন্যরা কেউ অফিসারদের কাছে খােলামেলাভাবে মনের কথা বলতাে না। যাই হােক, সৈন্যরা এই সময় বসে তাস খেলছিল আমাকে দেখে তারা উঠে দাঁড়ালাে একজন আমার কাছে এসে বললাে, ‘স্যার, বাংলাদেশে যে কি হইতাছে তাতাে জানেন আমরাও সব বুঝি, জানি এবং খেয়াল রাখি সময়মতাে ডিসিশন দিয়া দিয়েন, না দিলে আমগােরে পাইবেন না। যার যার অস্ত্র নিয়া যামুগা।’ জওয়ানরাও আমাদের মতাে করে ভাবছে দেখে গর্বিত ও আশান্বিত হলাম আমি। কিন্তু কোনাে মন্তব্য না করে কেবল পিঠ চাপড়ে দিয়ে আশ্বস্ত করতে চাইলাম তাকে এতােক্ষণে পুরােপুরি নিশ্চিত হলাম, তারা আমাদের ইঙ্গিতের অপেক্ষায় রয়েছে মাত্র। জাতির দুর্ভাগ্য, সামরিক অফিসারদের সবাই এদের মতাে চেতনা, সতর্কতা এবং দায়িত্ববােধসম্পন্ন ছিলেন না, তাই সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি।

পারলে হয়তাে পাকিস্তানিদের পক্ষে মাত্র ৪ থেকে ৫শ’ সৈন্য দিয়ে চট্টগ্রামে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রধারী আমাদের দুই হাজার যােদ্ধাকে কাবু করা সম্ভব হতাে না এবং যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটাও হতাে। না। চট্টগ্রাম মুক্তাঞ্চল হিসেবে আমাদের অধিকারে থাকলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যােগাযােগের সুবিধাসহ সমগ্র অঞ্চলটি মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারতাে। শুধু শুভপুর (ফেনী)-সীতাকুন্ড এলাকাটি দখলে রাখতে পারলে এর দক্ষিণে পুরাে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে বিস্তীর্ণ মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা যেতাে। দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গল এবং তিনটি আংশিক ব্যাটালিয়নের (প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম) সহায়তায় এটা করা অসম্ভব ছিল না। আর তাহলে হয়তাে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থনের জন্য কোনাে একটি রাষ্ট্রের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতাও বহুলাংশে হ্রাস পেতাে।

রাতে আমরা কয়েকজন টেন্টের সামনে ক্যাম্প চেয়ারে বসে আছি। এমন সময় দেখলাম, সিও খিজির হায়াত এস এম ইদ্রিস মিয়া আরাে কয়েকজন জেসিও-কে নিয়ে সৈন্যদের টেন্টের কাছাকাছি ঘােরাঘুরি করছেন। সৈন্যদের টেন্ট ছিল আমাদের থেকে খানিকটা দূরে সিও-র গতিবিধি দেখে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ব্যাপারটা আমার কাছে সুবিধের মনে হচ্ছিল না। এসময় এনসিও বেলায়েত, শহীদ, মনির আমাকে বললাে, ‘স্যার আজ রাতে আমরা আপনার টেন্ট পাহারা দেবাে পাঞ্জাবিদের মতিগতি ভালাে নয়। রাতে কোনাে পাঞ্জাবি অফিসার অস্ত্র হাতে কাছে এলে সােজা গুলি চালাবাে আপনাকে আমাদের প্রয়ােজন।

সে রাতে জনা দশেক এনসিও এবং জওয়ান পালা করে আমার টেন্ট পাহারা দেয়, যদিও হাবিলদাররা কখনাে পাহারা দেয় না, সেটা সিপাইদের কাজ। কিন্তু আমি ওদেরকে বারণ করতে পারলাম না। মেজর সাদেক নেওয়াজ এবং লে, আমজাদও সারারাত আমার তাবুর ১০০/১৫০ গজ দূর থেকে আমার ওপর নজর রাখে। পাঞ্জাবি অফিসার দু’জন সারারাত জেগে ছিল।  চিন্তাক্লিষ্ট মন নিয়েই গভীর রাতে কোনাে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি শেষ রাতের দিকে একটা ফোন এলাে কোম্পানিগঞ্জ পিসিও থেকে একজন অপারেটর আমাদের এখানকার সিনিয়র বাঙালি অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল। আমি ফোন ধরলে সে বললাে, ‘স্যার, আমি একজন সামান্য সরঝরি কর্মচারী। একটা খবর দেয়া অতি জরুরি মনে করে এতাে রাতে ফোন করে আপনার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটালাম একটু আগে পাক আর্মির ১২টা ট্রাক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওনা হয়েছে। মিনিট পাঁচেক আগে তারা কোম্পানিগঞ্জ ত্যাগ করেছে বুঝতে পারলাম, পাকিস্তানিরা পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদেরকে অস্ত্র সমর্পণ করাতে আসছে।

অবশেষে বিদ্রোহ

২৭ মার্চ ভাের হতেই সিও খবর পাঠালেন, তার অফিসে সকাল নটায় অফিসারদের মিটিং হবে অবশ্য এরি মধ্যে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি আমি সােয়া সাতটায় অফিসার্স মেসের দিকে রওনা হলাম। সঙ্গে কবির ও হারুন এবং বেলায়েত, শহীদ, মুনিরসহ কয়েকজন জওয়ান। সবাই সশস্ত্র  আমাদের বের হতে দেখেই অন্য জওয়ানরা অ্যামুনিশনের বাক্স খুলে যার যার অস্ত্র লােড করা শুরু করলাে। অফিসার্স মেসে গিয়ে সিও, সাদেক নওয়াজ, আমজাদ, গাফফার, আখতার আর আবুল হােসেনকে দেখলাম। আমরা নাশতার টেবিলে বসলাম  ওয়েটার অর্ডার নিতে এলাে সিও নাশতা করছিলেন। তার পাশে বসা আমজাদ আর সাদেকের খাওয়া শেষ। খেতে খেতে সাদেকের সঙ্গে কথা বলছিলেন সিও একটু দূরে সােফায় বসা আখতার আর আবুল হােসেন। এমন সময় একজন জ্যেষ্ঠ জেসিও এসে সিওকে বললাে, সাদেক নওয়াজের কোম্পানিতে একটা সমস্যা হয়েছে, তাই তাকে এক্ষুনি সেখানে যেতে হবে। কথাটা শােনা মাত্র সিও তার সঙ্গে যেতে উদ্যত হলেন। আমজাদ তার সাদেকও উঠে দাঁড়ালাে। আমার সন্দেহ হলাে, সিও-কে সরিয়ে নিয়ে বিদ্রোহ বানচাল করার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে না তাে? দ্রুত উঠে সিওকে বাধা দিলাম আমি বললাম, পরিস্থিতি না জেনে এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না, আগে সবাই অফিসে যাই তারপর কথাবার্তা বলে কোম্পানিতে যাওয়া যাবে তাছাড়া কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে সাদেক নওয়াজ আছে, আমি আছি। তাই তার এতাে ব্যস্ত হওয়ার প্রয়ােজন নেই। সিও আমার কথা মেনে নিলেন। সাদেক নওয়াজ তখন তার স্টেনগানটা আনার জন্য রুমে যেতে চাইলাে।

আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, চাইলে আমার স্টেনগানটা নিতে পারে সে এতে আশ্বস্ত হলাে সাদেক। এরি আগে এক ফাকে আখতারকে সাদেকের রুমে পাঠিয়েছিলাম তার স্টেনগানটা সরিয়ে রাখার জন্য এখন সাদেক তার ঘরে গেলে আখতার ধরা পড়ে যাবে। তাই কৌশলে ঠেকালাম ওকে আখতার সাদেকের ঘরে গিয়ে আটটা ম্যাগাজিনসহ তার স্টেনটা নিয়ে নেয়। আমি সময় নষ্ট করতে চাইছিলাম না। পাক কনভয় আসার খবর তাে পেয়েছিলাম, তাছাড়া এখানকার পরিস্থিতি যথেষ্ট উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল (পরে জেনেছিলাম, সকালের দিকে পাক কনভয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মাইল দুয়েকের মধ্যে পৌছানাের পর সম্ভবত আমাদের বিদ্রোহের খবর পেয়ে ফিরে যায়)। যাই হােক, সবাইকে নিয়ে অফিসে গেলাম। অফিসটা ছিল একটা তাঁবুতে। পাকিস্তানি অফিসার তিনজন তাবুতে ঢুকে চেয়ারে বসা মাত্রই সশস্ত্র কবির আর হারুন দুপাশে দাঁড়ালাে এবং আমি সিও ও অন্য দুজনকে বললাম, “You have declared war against the unarmed people of our country. You have perpetrated genocide on our people. Under the circumstances, we owe our allegiance to the people of Bangladesh and the elected representatives of the people. You all are under arrest. Your personal safety is my responsibility. Please do not try to influence others.”  বিদ্রোহ ঘটে গেলাে। এতােক্ষণ ছিল একরকম পিন পতন নীরবতা। হঠাৎ দেখলাম ওয়াপদার তিনতলা কোয়াটার থেকে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ হাতে একটা দোনলা বন্দুক নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার আর ফাঁকা গুলি করতে করতে ক্যাম্পের দিকে ছুটে আসছে। গুলির আওয়াজ আর ‘জয় বাংলা’ শুনেই যেন সবার মধ্যে সংবিৎ ফিরে এলাে।

ক্যাম্পে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিলাে জওয়ানরা সামরিক বাহিনীর কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে কন আর কোথেকেই-বা ওয়া তাকাটা পেলাে, তখন আমার মাথায় সেটা ঢুকছিল না। বন্দি পাকিস্তানি অফিসার তিনজনকে সিও-র টেন্টে কঠোর পাহারায় রেখে বাইরে বেরিয়ে আসতেই আমাকে দেখে জওয়ানরা ‘জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে উঠলাে। একসঙ্গে পাঁচ-ছয়শ’ জওয়ানের মুখে ‘জয় বাংলা স্লোগান শুনে সারা দেহ রােমাঞ্চিত হয়ে উঠলাে আমার কয়েকজন উল্লাসে সমানে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে যাচ্ছিল আমি চিৎকার করে বললাম, কেউ যেন এখন একটা গুলিও বাজে খরচ না করে। বলতে গেলে গালিগালাজ করেই জওয়ানদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলাম। সাময়িকভাবে ব্যাটালিয়নের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করলাম আমি   গুলির আওয়াজ আর ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুনে কয়েক মিনিটের মধ্যেই শহর এবং আশপাশের গ্রামগুলাে থেকে পিল পিল করে অসংখ্য লােক এসে হাজির হলো ক্যাম্পে। অনেকের হাতে বল্লম, মাছ মারী কোচ এইসব দেশী অস্ত্র এমন কি কয়েকটা মরচে-পড়া তলােয়ারও দেখলাম  জনতা শুধু পাকিস্তানি অফিসারদের চায় ঐ উন্মত্ত লােকদের হাতে পড়লে পাকিস্তানি অফিসারদের অবস্থা কি দাঁড়াবে সেটা সহজেই অনুমেয় কথা দিয়েছি, তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার, তাই উত্তেজিত লােকজনকে অনেক কষ্টে নিবৃত্ত করলাম পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধটি পাকিস্তানিদের হত্যা করার জন্য বন্দুক নিয়ে তেড়ে আসছিলেন।

তাকে আমি স্টেনগানের বাট দিয়ে ঠেকালাম। সবাইকে বললাম,এরা Pow অর্থাৎ Prisoner of War। সুতরাং এদেরকে হত্যা করা যাবে না। আমরা এদের প্রতি জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করতে বাধ্য। তারপর প্রােটেকশনের জন্য বন্দি পাকিস্তানি অফিসার তিনজনকে আখতারের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় থানা হাজতে পাঠিয়ে দিলাম। আখতার গিয়ে সিআই-কে বলে, ‘এদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনার। মেজর শাফায়াত বলেছেন, বন্দিদের কোনাে ক্ষতি হলে আপনার রক্ষা নেই।’ এর আগে কয়েকশ’ সৈন্যের কণ্ঠে “জয় বাংলা’ স্লোগান শুনে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য ও বিহারি পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুদূর যেতেই তারা জনতার হাতে ধরা পড়ে নিহত হয়।  বিদ্রোহের প্রাথমিক উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে এলে জওয়ানদের আশপাশের গ্রামগুলােতে ছড়িয়ে পড়ে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিলাম কারণ পাকিস্তানি বাহিনী বিমান হামলা চালাতে পারে একজন অফিসারকে একদল জওয়ানসহ কুমিল্লার দিক থেকে পাকসেনাদের আক্রমণ ঠেকানাের জন্য শহরের দক্ষিণে অ্যান্ডারসন খালের পাশে অবস্থান নিতে পাঠালাম বেলা তিনটার দিকে মেজর খালেদ মােশাররফ তার সেনাদল নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌছুলে আমি চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব তার হাতে অর্পণ করলাম।

খালেদ মােশাররফের মিটিং

খালেদ মােশাররফ এসেই ঘােষণা করেছিলেন, বিকেল সাড়ে তিনটায় রেস্ট হাউসে অফিসার আর জেসিওদের এক মিটিং হবে। সবার ধারণা ছিল, খালেদ মােশাররফ ব্রিফিং দেয়ার পরই কুমিল্লা বা ঢাকার উদ্দেশ্যে মার্চ শুরু হবে। সবার মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনা। জীবনে সামরিক শৃঙ্খলবদ্ধ অল্প সময়ের ব্যবধানে ঘটিত এই বিরাট পরিবর্তনে কয়েকজন অফিসার, জেসিও এবং এনসিও কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছিল। কারাে গায়ে নিমেষেই প্রবল জ্বর উঠে যায় একজন সুবেদারতাে উত্তেজনায় অজ্ঞান হয়ে গেলাে। একজন জেসিও তেমন কথাবার্তা বলতাে না, কিন্তু বিদ্রোহের পর তার মুখ থেকে কথার তুবড়ি ছুটতে লাগলাে অনবরত ‘স্যার, আমাদের এই করতে হবে, সেই করতে হবে’ এসব বলে যাচ্ছিল। আমি নিজেও একটু অস্থির হয়ে পড়েছিলাম সভাকক্ষে উপস্থিত সবাই পুরাে ব্যাটল ড্রেসে সজ্জিত হেলমেটটা পর্যন্ত ঠিকঠাক থুতনির কাছে স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকানাে। কিন্তু মিটিংয়ে সবার উত্তেজনার গনগনে আগুনে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিলেন খালেদ মােশাররফ। প্রথমে তিনি বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসার জন্য সবার তারিফ করলেন। তারপর বললেন, প্রাথমিক ৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান আর্মি এখন পুরােপুরি সংগঠিত হয়ে গেছে। স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টগুলাে এরি মধ্যে ওদের দখলে চলে গেছে এখন আমরা আক্রমণ করলে কিছু পাকিস্তানি সৈন্য মারা গেলেও যুদ্ধে জেতা যাবে না। আমাদের লােক ও অস্ত্রবল খুবই সীমিত আপাতত এর বেশি সাপ্লাই পাওয়ার কোনাে সম্ভাবনাও নেই–ঢাকা, কুমিল্লা বা চট্টগ্রামের খবরও আমরা সঠিক জানি না আমাদের এখানকার খবর পাকিস্তান আর্মি এতােক্ষণে নিশ্চয়ই জেনে গেছে। কাজেই শিগিরই এখানে এয়ার অ্যাটাক হবে। আমাদের এখন একটাই করার আছে, তা হলাে সাময়িক উইথড্রয়াল এবং কনসােলিডেশন খালেদের কথা শুনে প্রায় সবার মনেই বিস্ময়ের ঝড় বয়ে গেলাে।

যুদ্ধের জন্য সকলে প্রস্তুত, আর খালেদ বলছেন কি না এখন যুদ্ধ হবে। একজন জেসিও উঠে কিছু বলার অনুমতি চেয়ে নিয়ে উত্তেজিতভাবে বললাে, ‘স্যার, পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর এই জুলুম চালাইছে, মা-বােনদের ইজ্জত মারছে আমরা ওদের অ্যাটাক করতে চাই অনেকেই তার এ কথা সমর্থন করলাে। খালেদ মােশাররফ অবিচলিত কণ্ঠে বললেন, ‘সুবেদার সাহেব, আপনার জীবনটা এখন দেশের জন্য মূল্যবান, আপনি চাইলে মারা যেতে পারেন, কিন্তু তারপর দেশের কি হবে? অথচ আপনি বেঁচে থাকলে আরাে দশটা জওয়ান তৈরি হবে যুদ্ধে আপনাকে একদিন যেতে হবে, তবে আজ নয়।’ খালেদ মােশাররফ আরাে বললেন, ‘পাকিস্তানিরা যে বিল্ডআপ করেছে তাতে এখন ঢাকার উদ্দেশে মার্চ করা হবে আত্মহত্যার শামিল আমাদেরকে এখন একটা অঞ্চল মুক্ত রাখতে হবে। লােকবল বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সংগ্রহের মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। আপাতত গেরিলা এয়াফেয়ারের মাধ্যমে শক্রদের ক্যাজুয়ালটি ঘটানােই হবে আমাদের লক্ষ্য। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ করার চেষ্টা করতে হবে। ট্রেনিংয়ের জন্য সিলেটের সীমান্ত অঞ্চলে জায়গাও দেখে এসেছি আমি।’ খানিকটা হতােদ্যম হলেও মেজর খালেদের কথায় যুক্তি থাকায় তা মেনে নিলাম। অন্যরাও আর উচ্চবাচ্য করলাে না।

নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগাযােগ

বিকেলের দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসডিও বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ এবং এসডিপিও আমার সঙ্গে দেখা করে সর্বাত্মক সহযােগিতার আশ্বাস দিলেন। তার কিছুক্ষণ পর এসেছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আলী আজম, লুৎফুল হাই সাচ্চু, মাহবুবুর রহমান, হুমায়ুন কবীর, জাহাঙ্গীর ওসমান প্রমুখ তারাও আমাদের সবরকম সহযােগিতার আশ্বাস দিলেন। তারা সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে যােগাযােগ রাখার প্রয়ােজনীয়তার কথা বললেন। আমরাও এ ব্যাপারে একমত হলাম। মিটিংয়ের পর কিছু টুপস চলে যায় আশুগঞ্জ ব্রিজে অবস্থান নিতে খালেদ মােশাররফের আলফা কোম্পানি দিয়ে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মাহবুবকে পাঠানাে হলাে শায়েস্তাগঞ্জে। মাহবুব থােয়াই ব্রিজের দু’পাশে অবস্থান নেয়। বিদ্রোহের খবর প্রচার সিওর উপস্থিতিতে টুআইসি’র (2nd in Command) নির্দিষ্ট কোনাে দায়িত্ব থাকে না। এখন থেকে আমার মূল কাজ হলাে বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন করা টুপসের তদারকি এবং সমন্বয় সাধন করা। ২৭ মার্চ বিকেল থেকেই পুলিশ ও তিতাস গ্যাস অফিসের ওয়্যারলেস এবং টেলিফোন অফিসের অপারেটরদের সহায়তায় সারাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চতুর্থ বেঙ্গলের বিদ্রোহ করার খবর ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হতে লাগলাে। আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে মুক্তাঞ্চল ঘােষণা করে সবাইকে এখানে আসার আহ্বান জানালাম। বললাম, অন্য কেউ বিদ্রোহ করে থাকলে যেন আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করে স্থানীয় পুলিশ, ইপিআর, এসডিও, এসডিপিও এবং টেলিফোন অপারেটররা এই মেসেজ প্রচারে যথেষ্ট সহযােগিতা করেন সন্ধ্যা নাগাদ ওয়াপদা এলাকা থেকে সরে গিয়ে শহরের উত্তরদিকে একটি গাছপালা-ঘেরা জায়গায় অবস্থান নিলাম আমরা পাশেই ছিল একটি প্রাইমারি স্কুল আমাদের সঙ্গে তখন একটা রাইফেল কোম্পানি, একটা হেড কোয়ার্টার কোম্পানি এবং ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার এখন থেকে পুরােপুরি যুদ্ধাবস্থায় চলে গেলাম আমরা। বিমান আক্রমণের ভয়ে তাবু খাটিয়ে থাকা যাবে না। ট্রেঞ্চ ও বাঙ্কারে অবস্থান নিয়েই রাত কাটাতে হবে সে রাতে আর উল্লেখযােগ্য কিছু ঘটলাে না।

সূত্র : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ  রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্ণেল শাফায়াত জামিল, প্রকাশনী সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮