ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে চায় – ইন্দিরা
দৈনিক স্টেটসম্যান
২০ অক্টোবর ১৯৭১
নয়া দিল্লি, ১৯ অক্টোবরঃ ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতি বর্ননা করতে গিয়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আজ ঘোষণা করেন যে, ভারত সশস্ত্র সংঘাত এড়াতে সবকিছুই করতে পারে। তিনি যোগ করেন, “কিন্তু যে হাত মুঠো করে রেখেছে তার সাথে করমর্দন করা যায় না।
তবে, কেউ যুদ্ধের বিষয়ে ভবিষ্যতবাণী করতে পারে না। পাকিস্তান বাহিনী সব সীমান্তে ভীড় করেছে। ভারতও প্রয়োজনীয় আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে একটি প্রেস কনফারেন্স বলেন যে পাকিস্তানের ভয়প্রদর্শন সত্ত্বেও ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার আসন্ন সফর যাচ্ছেন। সরকার এই পরিস্থিতিতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করবেন কিনা।
আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, প্রধানমন্ত্রী স্বচ্ছন্দে এবং খোশমেজাজে জবাব দেন যে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির যে প্রস্তাব, সেটা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভারত শুধুমাত্র একটি ব্যাপারে জড়িত আছে আর তা হল বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১৩% এখন ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থান করছে। এবং এটা হচ্ছে তাদের গণহত্যার কারণে।
তিনি এটা স্পষ্ট বলেন যে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছিল। বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তান ইস্যু ছিল। বাংলাদেশ মূলত পাকিস্তানের সামরিক শাসন এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে একটি ব্যাপার ছিল। যত দ্রুত শরণার্থীরা তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারবে ততই তা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্ভাব্য অগ্নিদাহ দূর করবে।
মিসেস গান্ধী বলেন মার্কিন বা সোভিয়েত ইউনিয়ন কেউ বলেনি কীভাবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়া যায়। সবাই শুধু ভারতের কথা প্রশংসা করেছে। আর অন্যরা অস্ত্র নিয়ে বসে আছে।
মিসেস গান্ধী জানান যে সমস্যা পাকিস্তানের সরকার ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ছিল। তাই তিনি এসব নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। সামরিক শাসকদের অধীনে একটি স্বাধীন নির্বাচন হয়েছিল – নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সুযোগ দেয়া হলে হয়ত অবস্থা এমন হতনা। এই প্রতিনিধিরা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হয়, “যে নির্বাচনের উপেক্ষা করা যায়না”।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার প্রথম কাজ হল একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির দিকে যাওয়া। বাংলাদেশে নৃশংসতার বন্ধ করা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য অবস্থার সৃষ্টি করা।
মিসেস গান্ধী বলেন জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক পাঠাবে বলেছে। এই ব্যাপারে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে বিভ্রান্তির কোন সুযোগ নাই। ভারত উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশনের সদস্যদের জন্য এমনকি সংসদ সদস্য ও সাংবাদিকদের জন্য সব শরণার্থী শিবির দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। এটা ইউ এন এর দায়িত্ব যে তারা উদ্বাস্তু শিবির ঘুরে দেখবে যে বাংলাদেশে কি ঘটছিল এবং শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে। এটা করার পর জাতিসঙ্ঘ আমাদের এপ্রোচ করতে পারে। এই মুহুর্তে ভারত এটার দেখাশোনা করছে। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে ভারত যা করছে তা সহজেই নষ্ট করা যাবেনা। পাশাপাশি, পাকিস্তানী শাসকরা যদি বাংলাদেশে একটি পাপেট সরকার বানীয়ে রাখে তাতেও সমস্যা দূরীভূত হবেনা।
মিসেস গান্ধী ভারত-চীন সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের উত্তর দেন কিন্তু নতুন কোণ তথ্য দেন নি। ভারতের প্রতি চীনা মনোভাব ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তিতে জনাব চৌ এন লাই এর প্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। জনাব চৌ এর কাছ থেকে কোণ চিঠি এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। চীন কেন রাষ্ট্রদূত বিনিময় করবেনা তাঁর আসলে কোণ যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। মিসেস গান্ধী বলেন, তিব্বত বর্ডারে চিনা সৈন্য আছে। তিনি মনে করেন না যে তার পরিমাণ খুব বেশী। মার্শাল টিটোর সঙ্গে তার আলোচনার ইঙ্গিত করে যে, চীন সম্পর্কে ভারত ও যুগোস্লাভিয়ার মনোভাব বিস্তৃতভাবে একই রকম।
ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির এক প্রশ্নের একটি উত্তপ্ত জবাবে ইন্দিরা গান্ধীর বলেন কোন বিদেশী রাষ্ট্র জাতীয় স্বার্থে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ করন থামাতে পারবেনা। এই ব্যাপারে জনসাধারণের মনে কোন সন্দেহ নেই। এটা শুধুমাত্র কৌতূহলী কিছু সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর ছড়ান গুজব। এতে সরকারের স্ট্যান্ড কোনো পার্থক্য হবে না। চুক্তিটি ভারতের অবস্থান শক্তিশালী করেছে এবং ইন্দো-সোভিয়েত মৈত্রী আরও শক্তিশালী হবে।
মিসেস গান্ধী স্বীকার করেন যে শরণার্থী অন্তঃপ্রবাহ দেশের অর্থনীতির উপর একটি তীব্র চাপ সৃষ্টি করেছে। তাই, সরকার মনে করে তা ছিল চতুর্থ পরিকল্পনা। অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যে অতিরিক্ত সম্পদ তোলার সম্ভাবনা পরীক্ষা করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। দামের প্রশ্ন চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সম্পর্কিত। তাই সরকার রাজস্ব ও অন্যান্য নীতিসমূহ ঠিক করছেন মূল্যের উপর যাতে প্রভাব কম হয়।
প্রেস সবচেয়ে বড় যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করেছিলে সেটা হল যে তারা বলেছিল আমি শরনার্থিদের ফিরে যাবার জন্য ৬ মাস সমসয় বেঁধে দিয়েছি। আমি আসলে পার্লামেন্ট বলেছিলাম আপনারা আমাকে হিসাব করে জানান ৬ মাসে কত আর্থিক বোঝা সৃষ্টি হবে এমন একটা ধারণা দিতে। কারণ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার জন্য আমার এই ধারণা নেয়া দরকার ছিল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কি ঘটেছিল সেটা বোঝাও আমাদের দরকার। তাছাড়া অসাধারণ এই অর্থনৈতিক বোঝা থেকে, আরও কি কি সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনার সম্ভাবনা হতে পারে তাও আমাদের ধারণা নেয়া দরকার ছিল। সেখানকার শান্তি, নিরাপত্তা ও পূর্ব অঞ্চলের স্থিতিশীলতার সমস্যা আমাদের ভাবতে হবে।
শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা ও সরকারি অগ্রাধিকার এর মধ্যে পার্থক্য করা অর্থহীন। ভারত আর্থিক সহায়তা চায় ঠিক কিন্তু উদ্বাস্তুদের এখানে থাকার ব্যাপারে তাদের কোণ প্রশ্ন আপাতত নেই। তারা একটি অস্থায়ী ভিত্তিতে এখানে আছে এবং যত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি ভালো হবে তারা ফিরে যাবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা সফল হবেই। ইতিহাস দেখিয়েছে যে, এই ধরনের সংগ্রামে বাধা আসে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জিতে। উপরন্তু, বাংলাদেশের সমগ্র মানুষ মুক্তিবাহিনীতে সমর্থিত। এমনকি দেশের বাইরে অবস্থিত বাংলাদেশি নাগরিকরাও সাহায্য করছিল।
ইউ.এন.আই এবং পিটিআই যোগ করে পশ্চিম এশিয়া ও ইন্দো-চীন এর পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে একই রয়ে গেছে। যদিও সেখানে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বৈরিতার অবসান করার জন্য। তবে এশিয়ায় দ্বন্দ্ব চলছেই।
টানা অট্রহাসি শোনা গেল যখন প্রেস কনফারেন্সে মিসেস গান্ধী বললেন যা বের করা সাংবাদিকদের দায়িত্ব, তা ফাস করে দিয়ে তিনি তাদের ভাত মারতে চান না, অতঃপর মন্ত্রী সভার পূন বিন্যাস এর খবরটিকে তিনি গুজব হিসেবে বর্ননা করলেন।