গণপরিষদ প্রশ্নে জামাত
কাদিয়ানী দাঙ্গা কেন্দ্র করে ১৯৫৩ সালের ৬ মার্চ লাহােরে সামরিক আইন জারি করা হয়। ২২ মার্চ পাঞ্জাবে দৌলতানা মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। ১৭ এপ্রিল খাজা নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয়া হয়। ৮ মে মওলানা মওদুদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং পরে তা ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করা হয়। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানের রাজনীতিতে পুরাে এক বছর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। তারপর আবার প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনৈতিক তৎপরতা আরম্ভ হয়। এ সময় জামাতে ইসলামী ও ক্ষমতাচ্যুত নাজিমুদ্দিন গ্রুপের মধ্যে অনেকটা সমঝােতা লক্ষ্য করা যায়। উভয় দল একই সুরে ক্ষমতাসীন সরকারের সমালােচনায় তৎপর হয়ে ওঠে। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে নুরুল আমিন সরকার শােচনীয় পরাজয় বরণ করে। নির্বাচনের পর দেশের উভয় অংশ, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার জন্য প্রবল দাবী জানানাে হয়। বলা হয়, বর্তমান পরিষদ সদস্যদের প্রতি জনসমর্থন নেই, নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় বরণ করার পর তারা এখন আর জনপ্রতিনিধি নন। সুতরাং এই পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন করে আইন পরিষদ গঠন করা হােক। পরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার এ দাবী ছিলাে একান্ত ন্যায্য। ‘ এ সময় জামাতে ইসলামী পরিষদ বাতিল বিরােধীদের সথে হাত মিলায়। আইন, পরিষদ বাতিলকরণ রােধ করার জন্য জামাতে ইসলামীর তরফ থেকে প্রবল আন্দোলন চালানাে হয়। তাদের গােটা প্রচার মিশন এ ব্যাপারে নিয়ােগ করা হয়। বিভিন্ন স্থানে সভাশােভাযাত্রা বের করা হয়। আইন পরিষদ বাতিল করাে না ইত্যাকার শ্লোগান লেখা পােষ্টার দ্বারা পাকিস্তানের শহর-বন্দর-নগরের প্রাচীর ও রাস্তাঘাট ভরে ফেলা হয়। জামাত নেতারা নানা স্থানে জনসভা করে তাদের বিশেষ প্রচারভঙ্গিতে‘ জনমত সংগ্রহের জন্য উঠেপড়ে লেগে যান। ১৯৫৪ সালের ১৮ অক্টোবর লাহােরের মুচি গেটে এক জনসভায় জামাতে ইসলামীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা জনাব নঈম সিদ্দিকী বলেছেন, “আপনারা বলছেন আইন পরিষদ জনপ্রতিনিধিশূন্য। কিন্তু বিগত সাত বছর থেকে আপনারা কোথায় ঘুমিয়ে ছিলেন। •আইন পরিষদ বাতিল করার শ্লোগান দেয়া খুবই সহজ কাজ, কিন্তু তা ভেঙ্গে দেয়াটা খুবই কঠিন হবে।১
জামাতে ইসলামীর মুখপত্র “তসনীম‘ ১৯৫৪ সালের ১৫ অক্টোবর সংখ্যায় এ সম্পর্কে লিখেছে, “এই আইন পরিষদ আজ যদি প্রতিনিধিত্বহীন হয়ে থাকে তবে কালও তা প্রতিনিধিত্বহীন ছিলাে। কাল যদি তা প্রতিনিধিত্বহীন না হয়ে থাকে তবে আজো প্রতিনিধিত্বহীন নয়। আইন পরিষদের রূপরেখায় এমন কী পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, যার দরুন আজ তাতে শত শত দোষ বের করা হচ্ছে ?” এ সময় জামাতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে আরম্ভ করে সাধারণ কর্মীরা পর্যন্ত আইন পরিষদ বাতিল-বিরােধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। তাদের পত্রপত্রিকা ও প্রচার পুস্তিকাগুলাে নিরলসভাবে কলম চালায়। ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে বিশেষ বিশেষ। ব্যাখ্যা-বিবৃতি দিয়ে আইন পরিষদ বাতিলের বিরুদ্ধে জনমত সংগ্রহ করার চেষ্টা করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলাে, এ সময় যে পরিষদ না ভাঙ্গার জন্য জামাত নেতারা এতাে পরিশ্রম করেন, এই জামাতে ইসলামীরই আমীর মওলানা মওদুদী মাত্র চার বছর আগে সর্ব প্রথম আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে মওলানা বলেছেন, “আপনারা যদি চান, পাকিস্তান সত্যিকার অর্থে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হােক এবং এদেশের নাগরিকরা ইসলামী সাম্য ও ন্যায়নীতির প্রাচুর্যের ফল ভােগ করুক, তাহলে এসব সুপারিশের বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদ করাই যথেষ্ট নয়; বরং আপনাদের কর্তব্য হলাে,অত্যন্ত ফলপ্রসূ পন্থায় একথা তুলে ধরা যে, বর্তমান আইন প্রণয়নকারী পরিষদ জাতির আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন একটি আইন পরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হােক।”২ ১৯৫০ সালের ১১ অক্টোবর এক বিবৃতিতে মওলানা মওদুদী বলেছেন, “এই পরিষদের গঠন পদ্ধতি, সদস্যদের চরিত্র, তার বিগত কার্যাবলী এবং আদর্শ প্রস্তাব (অনুমােদনের) পূর্বাপর কর্মধারা দেখে আমরা প্রথম থেকেই সিদ্ধান্তে পৌছি যে, এই পরিষদ ইসলামী কিংবা গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র কোনটা প্রণয়নেরই যােগ্য নয়। ইসলামি ও দেশের সামগ্রিক স্বার্থের প্রতি এই পরিষদের আনুগত্য পর্যন্ত আমাদের নিকট সন্দেহজনক ছিলাে। আমরা একে বিশেষ ক্ষমতাশীল চক্রের স্বার্থের হাতিয়ার বলে মনে করতাম।
এজন্য অনেক পূর্বেই আমরা জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম, তারা যদি একটি খাঁটি ইসলামী শাসনতন্ত্র চায়— সর্বসম্মতভাবে একটি নতুন আইন পরিষদ গঠনের দাবি উত্থাপন করতে হবে যা প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি নির্বাচন করা হবে।”৩ ১৪ অক্টোবর লাহােরের মুচিগেটে ভাষণদান প্রসঙ্গে মওলানা বলেছেন, “এখন সকল পাকিস্তানীর একবাক্যে এই পরিষদের উপর অনাস্থা প্রকাশ ছাড়া অন্য কোনাে কিছু করণীয় নেই। পরিষ্কারভাবে দাবি করা দরকার, এটা ভেঙ্গে দেয়া হােক। তার স্থলে অন্য আর একটি আইন পরিষদ গঠন করা হােক যা প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি নির্বাচিত হবে।”৪ আপনারা দেখতে পেলেন, ১৯৫০ সালে মওলানা মওদুদী কিরূপ জোরালােভাষায় ‘দাবী তুলেছিলেন আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার জন্য। পরিষদের সমালােচনা প্রসঙ্গে তিনি এরূপ। উক্তিও করেছেন যে, “ইসলাম ও দেশের সামগ্রিক স্বার্থের সাথে এই পরিষদের আনুগত্য পর্যন্ত আমাদের নিকট সন্দেহজনক ছিলাে। কিন্তু এর মাত্র চার বছর পর জামাতে ইসলামী উক্ত আইন পরিষদ বাতিল না করার জন্য প্রবল আন্দোলন আরম্ভ করে। নেতাদের সকল বক্তৃতা-বিবৃতি তারা বেমালুম ভুলে গেলেন। শুধু তাই নয়, অন্য কেউ যদি তাদের সামনে সেসব উদ্ধৃতি তুলে ধরতাে, তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। সেসব কথার প্রতি কোনরূপ কর্ণপাতই করতেন না। আবার কোন কোন সময় সেগুলাে অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ারও অপচেষ্টা করতেন। এক্ষেত্রে জামাতে ইসলামীর মুখপত্র “তসনীমের একটি উদ্ধৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। পত্রিকাটিতে ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে বলা হয়েছে, “আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার শর্তহীন শ্লোগান সর্বপ্রথম কম্যুনিস্টরা তুলেছিলাে।
এখন পরিষদের কোন কোন সদস্য বিশেষ বিশেষ কারণে এ শ্লোগান কম্যুনিস্টদের নিকট থেকে, ধার নিয়েছেন। •••••পাকিস্তানে এ দাবী কোন কোন স্বার্থান্বেষী, প্রাদেশিকতায় নিমগ্ন, বেদ্বীন ও কম্যুনিস্টদের তরফ থেকে করা হচ্ছে।” » এবার মওলানা মওদুদীর উল্লিখিত বিবৃতিগুলাের সাথে ‘তসনীমের’ এ উক্তিটি একটু মিলিয়ে দেখুন, স্ববিরােধিতা আর কাকে বলে! ১৯৫০ সালে তারা ইসলামের দোহাই দিয়ে যে পরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার দাবী তুলেছিলেন, ১৯৫৪ সালে সে পরিষদ রক্ষার আন্দোলনেও ইসলাম তাদের হাতিয়ার ছিলাে। ২ = এক্ষেত্রে হয়তাে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সময় ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অনেক সময় বিশেষ কোনাে ব্যাপারে পূর্বনীতি পুনর্বিবেচনা করতে হয়। এ প্রশ্ন যথার্থ। কারণ স্থবিরতা রাজনীতিতে অচল। কিন্তু জামাতে ইসলামীর বেলায় এ প্রশ্ন উথাপন করা চলে না। মওলানা মওদুদীর মতে জামাতে ইসলামী একটা বিশেষ আদর্শের অনুসারী (?)। আর তা হলাে ইসলাম। তাদের সবকিছুই নাকি ইসলামের ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ! খােদ মওলানা মওদুদী বলেছেন, “আমাদের সম্পর্ক সে আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত যার নেতা ছিলেন নবীগণ (আঃ)। ••••আমরা যেকোন দেশ ও যুগেই হই না কেন, আমাদের আশপাশের জীবনের সমস্যাবলী যেকোন ধরনেরই হােক না কেন, আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাই যা নবীদের ছিলাে। সে মন্জিলে পৌঁছার পথ তাই, যে পথে আম্বিয়া কেরাম প্রতিটি যুগে চলেছেন।”৫
মওলানা মওদুদী ও তাঁর অনুসারীদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও গ্রন্থরাজিতে এ ধরনের অসংখ্য উদ্ধৃতি রয়েছে যাতে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ইসলামই জামাতে ইসলামীর একমাত্র আদর্শ। তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, পার্টির নীতি-পরিকল্পনা সবকিছুই ইসলামানুগ! সুতরাং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মত ও পথ পরিবর্তনের সাধারণ নীতি জামাতে ইসলামীর বেলায় অবান্তর। কিন্তু এ নীতিটি জামাতে ইসলামীই সবচাইতে বেশি প্রয়ােগ করেছে। জামাতের কর্মধারার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এ ব্যাপারে সে যেকোন রাজনৈতিক দলকে হার মানিয়ে দিয়েছে। তাও আবার ইসলামের দোহাই পেড়ে। ইসলামকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার এর চাইতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর একটি আছে কিনা সে ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আমরা যতটুকু জানি, সেবার জামাতে ইসলামীর আইন পরিষদ বহাল রাখার আন্দোলনের সাথে ইসলাম, ইসলামী শাসনতন্ত্র কিংবা দেশ ও জাতির স্বার্থের কোনরূপ সম্পর্ক ছিলাে না। পরিষদের কিছুসংখ্যক সদস্যের সমর্থনেই জামাতে ইসলামী আইন পরিষদ বাতিল করাে না” আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাে। তাঁরা জামাতে ইসলামীর। প্রাথমিক সদস্যও ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন মুসলিম লীগের ক্ষমতাচ্যুত নাজিমুদ্দিন গ্রুপের। তাঁদের সমর্থনের খাতিরেই জামাতে ইসলামী তার চার বছর আগেকার নীতি, বক্তৃতাবিবৃতি ও ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জলাঞ্জলি দিয়েছিলাে।
Source: জামাতের আসল চেহারা–মওলানা আবদুল আউয়াল