কাদিয়ানী দাঙ্গা
আদর্শপ্রস্তাব অনুমােদিত হওয়ার ছুতা ধরে জামাত নেতারা তাদের পার্টির মতাদর্শ ও কর্মতৎপরতা সংশােধন করে। তারা নতুন রূপ ধারণ করে জনপ্রিয়তা অর্জন করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। মূলত এসময় থেকেই জামাত নেতারাতাঁদের বিশেষ ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ছদ্মাবরণে সরাসরি দেশ ও জাতির স্বার্থ-পরিপন্থী বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়ার ব্যাপারে কিছুটা সংযত হওয়ার চেষ্টা করে। তারা এ কথা ভালভাবে বুঝতে পারে, আর যাই হােক স্বাধীনতা-পূর্বকালীন নীতির মাধ্যমে পাকিস্তানে কিছু করা যাবেনা। এসময়ে জামাতে ইসলামীর সবচাইতে উল্লেখযােগ্য কাজ হলাে নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের কাজে দেশের অন্যান্য দলমতের আলেমদের ব্যবহার করা। বিভিন্ন বিষয়ে শােচনীয় পরাজয় বরণের পর জামাত নেতারা বুঝতে পারলাে যে, ক্ষমতাসীন সরকারকেবাগে আনা একাতাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তারা ইসলামী শাসনতন্ত্র দাবীর নামে বিভিন্ন মতের আলেমদের সমন্বয়ে দেশব্যাপী একটা আন্দোলন গড়ে তােলার পরিকল্পনা নেয়। অথচ জামাতে ইসলামীর ইতিহাসের প্রতি তাকালে দেখা যায়, এমনটি আর কখনাে তারা করেনি। পূর্বে জামাতে ইসলামী কারােসাথেই কোনরূপসমঝােতা করতােনা। এমনকি পুরােপুরিজামাতপন্থী না হলে কারাে ভাল কাজের স্বীকৃতিও দেয়া হতাে না। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলাে স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের বিরােধিতা। ইসলামী তাহজিব-তমদ্মন ও ধর্মীয় আদর্ঘে আলােকে সমাজব্যবস্থা গড়ে তােলার শ্লোগান দিয়েই তাে মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবী করেছিলাে। এমতাবস্থায় জামাতে ইসলামীর পাকিস্তান দাবীর বিরােধিতা করার কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মওলানা মওদুদী ও তাঁর জামাতে ইসলামী সেদিন মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রবল বিরােধিতা করেছিলেন। অবশ্য এই বিরােধিতার প্রধান কারণ ছিলাে জামাতের বৃটিশপ্রীতি, বৃটিশসমর্থক এক শ্রেণীর নওয়াব ও পদস্থ সরকারী কর্মচারীর আনুকূল্য লাভ করা। একথা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে।
সে যাই হােক, মওলানা মওদুদী ও তাঁর দলের প্রচেষ্টায় ১৯৫১ সালের জানুয়ারী মাসে করাচীতে নানামতের শীর্ষস্থানীয় ৩৩ জন আলেমের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ইসলামী রাষ্ট্রের ২২টি মৌলিক নীতি প্রণীত হয়। এগুলাে সরকারের নিকট পেশকরা হয়। এনীতিমালা সম্পর্কে আলােচনা প্রসঙ্গে মওলানা মওদুদী বলেছেন, “… হয় তারা সরাসরি এসব বিধান মেনে নিন এবং দেশের শাসনতন্ত্রে এগুলাে সন্নিবেশিত করে বিস্তারিত সবকিছু যেভাবে ভাল মনে করেন প্রণয়ন করুন নতুবা পরিষ্কার বলে দিন, আমরা কোরআন-সুন্নাহ কিছুই মানি না। আমরা সে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী যার উত্তম।
আদর্শ আমেরিকা, ইল্যান্ড ও ভারতের রাষ্ট্রতন্ত্রে আমাদের দৃষ্টিগােচর হয়।‘১ পরবর্তীকালে উল্লিখিত নীতিমালাকে জামাতে ইসলামী আট দফা দাবীতে রূপান্তরিত করে। এই আট দফা দাবীতে কাদিয়ানীদের সংখ্যালঘু গণ্য করার প্রস্তাব ছিলাে না। এরপর ১৯৫৩ সালের ২১ ; ডিসেম্বর খাজা নাজিমুদ্দিন আইন পরিষদের শাসনতান্ত্রিক সুপারিশ পেশ করেন। মওলানা মওদুদী ও আলেমদের পক্ষ থেকে তাতে সংশােধনী প্রস্তাব করা হয়। এসময় কাদিয়ানীদের সংখ্যালঘুসম্প্রদায়। গণ্য করার দাবি তােলা হয়। তাতে করে জামাতে ইসলামীর আট দফা দাবিতে কাদিয়ানী সম্পর্কিত ধারাটি সংযােজন করা হয় এবং তা নয় দফার রূপ লাভ করে। ১৯৫৩ সালের ৩০ জারি লাহােরে একবিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। মওলানা মওদুদী তাতে ভাষণ দেন। কাদিয়ানীদের সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তারা (ক্ষমতাসীনরা) কাদিয়ানী, সমস্যার প্রতি পুনরায় উপেক্ষণীয় মনােভাব প্রদর্শন করছে। অথচ সকল মুসলমান একবাক্যে বলেছিলাে, কাদিয়ানীদের অমুসলিম সংখ্যালঘু গণ্য করা হােক। …পরিস্থিতি যদি এরূপ চলতে থাকে….তাহলে নির্ঘাত এদেশে কাদিয়ানী-মুসলিম দাঙ্গা আরম্ভ হবে, যেরূপ পূর্বে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছিলাে।”২
এ সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। জামাতে ইসলামী খাজা সাহেবের দুর্বলতা ও ধর্মপরায়ণতার পুরােপুরি সদ্ব্যবহার করে। তারা জনপ্রিয়তা অর্জন ও পূর্বে পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। এ উদ্দেশ্যে প্রথমে তারা সকল দলমতের আলেমদের একত্র করে ইসলামী শাসনতন্ত্রের শ্লোগান তােলে। কিন্তু তাতে খুব একটা সুবিধাকরতে না পেরে কাদিয়ানী সমস্যাকে এইসঙ্গে টেনে আনে। মূলত কাদিয়ানী সমস্যা ছিলাে জামাতে ইসলামীর উপলক্ষ মাত্র। জামাত নেতারাসম্ভবত মনে করেছিলেন, এ পথে একটা বিশৃংখলা সৃষ্টি করে ঘােলা পানিতে স্বার্থোদ্ধার করা যাবে। এছাড়া জামাত নেতাদের কাদিয়ানী সমস্যা নিয়ে হৈ-হুল্লোড় সৃষ্টি করার কোনাে কারণ আমরা খুঁজে পাই না। জামাতে ইসলামীর এ তৎপরতার পেছনে যদি নিছক ধর্মীয় তাগিদ হতাে তবে জামাতে ইসলামী ও তার অনুগামীরা এতদিন ছিলেন কোথায় ? কাদিয়ানী মতবাদ তাে তখন নতুন কিছুছিলাে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বেশ কিছুকাল পূর্বেই এর উৎপত্তি হয়েছে। কিন্তু মলানা মওদুদী এর পূর্বেদীর্ঘ কর্মজীবনেএসম্পর্কেকিছুই বলেননি। এমনকি শাসনন্ত্র সম্পর্কে প্রথমে যে আটদফা সুপারিশ জামাতের তরফ থেকে বের করা হয় তাতেও কাদিয়ানী সমস্যাটি স্থান পায়নি। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, মওলানা মওদুদী ও তাঁর অনুসারীদের কাদিয়ানী-বিরােধী আন্দোলনের পেছনে। ধর্মীয় তাগিদ ছিলাে না। জামাতে ইসলামীর প্রতি জনমত আকৃষ্ট করার একটা উপলক্ষ ছিলাে মাত্র। সকল দিক থেকেচরম ব্যর্থতাবরণের পরজনমতসগ্রহের এই একটিমাত্র পথই তখন তাদেরসমানে খােলা ছিলাে। তাই তারা দেশ ও জাতীয় ঐক্যের মারাত্মক ক্ষতিকর একটি বিষয় নিয়ে তােলপাড় করে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।১৯৫৩ সালের ১৮ জানুয়ারি করাচীতে কাদিয়ানী-বিরােধী সর্বদলীয় কনভেনশনের সংগ্রাম কমিটির এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে কাদিয়ানী প্রশ্নেপ্রত্যক্ষ সংগ্রাম প্রস্তাব অনুমােদন করা হয়।
মওলানা মওদুদী ও অন্যান্য উগ্রপন্থীদের লেখা ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হতে থাকে। কাদিয়ানী প্রশ্নের ছদ্মাবরণে জনসাধারণ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টির প্রবল প্রচেষ্টা চালানাে হয়। কাদিয়ানীদের সংখ্যালঘু গণ্য করার জোর আন্দোলন আরম্ভ করা হয়। এ সময়ই মওলানা মওদুদীর কাদিয়ানী সম্পর্কিত পুস্তিকাটি উর্দু ও ইংরেজীতে প্রকাশ ব্রা হয়। বইটি প্রজ্বলিত উনুনে লে ছিটানাের কাজ করে। পাঞ্জাব, বিশেষ করে লাহােরেম ওকাদিয়ানীদের মধ্যে মারাত্মক দাঙ্গা আরম্ভ হয়। সেখানকার পথঘাট নিরপরাধ জনতার রক্তে লালে লাল হয়ে যায়। তাতে করে কাদিয়ানী প্রশে দাঙ্গাঅনুষ্ঠিত হওয়ার মওলানা মওদুদীর ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয়। কাদিয়ানী দাঙ্গাঅনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে কেবলমাত্রউগ্রপন্থী দলগুলােই দায়ী ছিলােনা, তৎকালীন ক্ষমতাসীনসরকারের দুল প্রশাসন ব্যবস্থাও এই অপ্রতিকর ঘটনার জন্য অনেকটা দায়ী ছিলাে। কারণ সরকার প্রথমে একে শক্ত হাতে দমন করলে পরিস্থিতি এতটুকু গড়াতে পারত না। অবশেষে সরকারের চৈতন্যোদয় হয়। লাহােরে সামরিক আইন জারি করা হয়। এ ব্যাপারে মলানা মওদুদীকেও গ্রেফতার করা হয়। সামরিক আদালতে মওলানামওদুদীর বিচার আরম্ভ হয়। এদিকে ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য লাহাের হাইকোর্টের বিচারপতিদের সমন্বয়ে একটি বিচারবিভাগীয় কমিশন নিয়ােগ কাহয়। এই কমিশনের প্রধান ছিলেন লাহাের হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জনাব মুনির। সামরিক আদালত ও মুনির কমিশনের সামনে মানা তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগগুলাের জবাবদানকালে বলেছিলেন, “তিনি কোন সময়ই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সমর্থন করেননি এবং তাঁর দলও তাতে অংশগ্রহণ করেনি। তিনি এবং তাঁর দল যথাসম্ভব প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেদিন মলানার এই অস্বীকারােক্তিতে কোনই ফলােদয় হয়নি। তিনি এই সাফাই দ্বারা সামরিক আদালত কিবা মুনির কমিশন কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারেননি। কারণ ১৯৫২ সালের আগস্ট মাস থেকে মওলানা মওদুদী ও তাঁর দল জামাতে ইসলামী কাদিয়ানীদের সংখ্যালঘু গণ্য করার দাবী জানিয়ে আসছিলেন। বিভিন্ন সবাদপত্র ও সভা-সমিতিতে মানার অসখ্য কাদিয়ানী-বিরােধী বক্তৃতা-বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিলাে।
প্রত্যক্ষ সশ্যাম প্রস্তাব সমর্থন ও অনুমােদন থেকে আরম্ভ করে প্রতিটি ক্ষেত্রে জামাতে ইসলামী সক্রিয় ছিলাে। এমনকি কাদিয়ানী-বিরােধী আন্দোলনখন পাঞ্জাবে ভয়াবহরূপ ধারণ করে তখনাে মওলানা আন্দোলনকারীদের সমর্থনেপ্রবল উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কয়েকটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। ৫ মার্চ মওলানার ‘কাদিয়ানী সমস্যা’ নামক পুস্তিকাটি প্রকাশ করা হয়। এ সময় কাদিয়ানী প্রলে পাঞ্জাবের একটা বিরাট এলাকায় বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলাে এসব প্রমাণ মওলানা মওদুদীর পক্ষে খুন করা সম্ভব হয়নি। সামরিক আদালত মলানাকে ফাঁসি দেয়ার নির্দেশ দেন। পরে তা চৌদ্দ বছর কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করা হয়। মুনির কমিশনের রিপাের্টে জামাতে ইসলামী সম্পর্কে যে রায় প্রকাশ করা হয় তার কয়েকটি সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। জামাতে ইসলামী ও তার প্রতিষ্ঠাতার তৎপরতা বিস্তারিতবিকৃত হওয়ার পর যেসবতথ্য জামাতে ইসলামী স্বীকার করেছেকিংবাতারবিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে, তা হলাে : “(১) জামাতে ইসলামী পাঞ্জাবের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম অনুমােদনকারী সগ্রাম কমিটির একটি পক্ষ ছিলাে। (২) নিখিল পাকিস্তান মুসলিম দলগুলােরকনভেনশন যেসগ্রাম কমিটি গঠন করে এবং ১৯৫৩ সালের ১৮ জানুয়ারী করাচীতে প্রত্যক্ষ সামপ্রস্তাব অনুমােদিত হয়, জামাতে ইসলামী সেকমিটিরও অন্যতম পক্ষ ছিলাে। (৩) মওলানা সুলতান আহমদ, যিনি ২৬ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির অধিবেশনে যােগদান করেছিলেন, তিনি নিজেকে সংগ্রাম কমিটির কার্যক্রম থেকে পৃথক করেননি। তাঁর উপস্থিতিতেই গবর্নর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে রাজাকার পাঠানাের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়,কিন্তুতিনি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেননি। (৪) প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত জামাতে ইসলামীর কোন কোন প্রতিনিধি লাহাের ও করাচীর সগ্রাম কমিটির অধিবেশনগুলােতে সবসময়ই অংশগ্রহণ করেছেন। (৫) প্রত্যক্ষ সংগ্রাম প্রস্তাব অনুমােদন হওয়ার তারিখ থেকে দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করা পর্যন্ত জামাতে ইসলামী এমন কোনাে সাধারণ বিজ্ঞপ্তি বাবিবৃতি প্রকাশ করেনি, সেপ্রত্যক্ষ সংগ্রামের সাথে জড়িত নেই। (৬) ৫ মার্চ গর্বর্ন হাউসে মলানা মওদুদী বক্তৃতাদানকালে বলেছেন, সরকার এবং জনসাধারণের মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগে রয়েছে। যে পর্যন্ত সরকার শক্তিপ্রয়ােগ পরিহার করে গণপ্রতিনিধিদের সাথে আলাপ-আলােচনা আরম্ভ না করবে, শান্তি-শৃংখলা বিধানের জন্য আবেদন করার কোনাে সুযােগ নেই। (৭) জামাতে ইসলামী তার ৫ মার্চের প্রস্তাবে এ অভিমতই পুনরুল্লেখ। করেছে।
৫ মার্চের পূর্বে ‘তসনীমে’ (জামাতের মুখপত্র) এমন একটি শব্দও নেই যাতে বুঝা যায় যে, জামাতে ইসলামী প্রত্যক্ষ সংগ্রাম পরিকল্পনার সমর্থক কিংবা সহায়তাকারী নয়। ৫মার্চগবর্নর্বহাউসে মওলানা মওদুদী যে ভূমিকাগ্রহণ করেছিলেন…..তা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারি যে, তিনি পুরাে শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ারআশাকরছিলেন। সরকাআেকাংক্ষিত দুরবস্থায়….আনন্দঅনুভব করছিলেন। ৪ মার্চ সন্ধ্যায় এক উচ্ছল জনতা সৈয়দ ফেরদাউস শাহকে (পুলিশ অফিসার) হত্যা করে। … এ ঘটনার পরও জামাতে ইসলামী কোরূপ দুঃখ প্রকাশ করেনি। এই বর্বরােচিত হত্যার নিন্দায় সে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। পক্ষান্তরে জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী) রক্ত ও আগুনের এই বিভীষিকাময় ভিড়ে ‘কাদিয়ানী মাসআলার’ বােম ছুঁড়ে মারেন।” ১) পরিশেষে মুনিরকমিশনরায় দানপ্রসঙ্গে বলেছেন, “আমাদের মতে জামাতেরসত্যিকারমানসিক অবস্থা এই ছিলাে যে, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিলাে সে যদিও তাসঙ্গত মনে করেনি, কিন্তু জনপ্রিয়তা ক্ষুন্ন হওয়ার আশংকায় নিজেদের মত নির্ভীকভাবে জনসাধারণ্যে প্রকাশ করেনি। আগাগােড়াই তার এই ভূমিকা ছিলাে। সুতরাং মানসিক অবস্থা ও কর্মধারার দিক থেকে জামাতে ইসলামী (ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট) অন্য কোন রাজনীতিক বা সংস্থার।
চাইতে ভিন্নতর ছিলাে না। অন্যান্যদের মত সে জনসাধারণের সমালােচনার শিকারে পরিণত হতে পারে, এরূপ যেকোন পদক্ষেপ গ্রহণে শংকিত ছিলাে।” মওলানা মওদুদী আদালতে যে সাফাই বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে সহযােগী শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একটি বিরাট অংশও তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন। দাঙ্গায় নিজেকে নির্দোষ প্রকাশকার সাথেসাথেতিনিঅপর চারটি পক্ষকে দোষারােপ করেছিলেন। তাঁরহলেন,কাদিয়ানী জামাত, কেন্দ্রীয় ও পাঞ্জাব প্রাদেশিক সরকার এবংপ্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথপ্রদর্শক আলেমগণ। মওলানার ভাষায়, “উক্ত চার সম্প্রদায়ের কারাে অন্যায়ই অপরের চাইতে কম নয়। তাদের সবার বিরুদ্ধেই মকদ্দমা চালান। উচিত।‘৪ মওলানা মওদুদীর এ ধরনের নাটকীয় অভিনয়ে শুধু একশ্রেণীর আলেম নয়, সাধারণ মানুষও মওলানা ও তাঁর জামাতের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে। কারণ যে জামাতে ইসলামী ও তার নেতার। কাদিয়ানীবিরােধী আন্দোলনে একটা বিশেষ ভূমিকা ছিলাে, তিনিই কিনা আদালতে পরিষ্কার বলে ফেললেন, তাতে তিনি বা তাঁর জামাত জড়িত ছিলাে না। এ সময় ‘খতমে নবুয়ত’ আন্দোলনকারী একটি সম্প্রদায় তাঁর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযােগ করে। দেশের যেসব শীর্ষস্থানীয় আলেমের দস্তখত প্রদর্শন করে মওলানা এতােদিন সরকার ও জনসাধারণকে ভয় দেখিয়ে আসছিলেন, তাঁরাই এবার মলানার বিরুদ্ধে ফতােয়া প্রকাশকরতে আরম্ভ করেন। ধর্মোদ্রোহী’, ‘আল্লাহতে অবিশ্বাসী। ইত্যাকার যেসব অভিযােগ মলানা মওদুদী ১৯৩৩ সাল থেকে অন্যদের প্রতি আরােপ করে আসছিলেন, এবার খােদ মওলানাই এসবের শিকার হতে লাগলেন। নিজের তথাকথিত মতবাদের নিকট ক্ষমতাসীন সরকারকে নতি স্বীকার করানাের উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সাল থেকে নতুন ফ্রন্ট খুলে ১৯৫৩ সালের প্রথম ভাগ পর্যন্ত অধিকাংশ আলেমদের এক প্লাটফরমে জমায়েত করে যে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন, কাদিয়ানীবিরােধী আন্দোলনের ফলে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফলে এ পথেও জামাতে ইসলামীকে ব্যর্থতা বরণ করতে হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য যে,কাদিয়ানী দাঙ্গাকালের সামরিক আদালত মলানা মওদুদীকে প্রাণদণ্ড মওকুফ করে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। মাত্র পঁচিশ মাস কারাভােগের পর ১৯৫৫ সালের ২৮ এপ্রিল তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়।
Source: জামাতের আসল চেহারা–মওলানা আবদুল আউয়াল