You dont have javascript enabled! Please enable it! দিন বদলায় বাংলাদেশ বদলায় না - সংগ্রামের নোটবুক

দিন বদলায়, বাংলাদেশ বদলায় না

আমরা নিজেদের সাফল্য নিয়ে যত উচ্চবাক, ব্যর্থতা নিয়ে ততটা নই। শুধু বিদেশির প্রশংসার সার্টিফিকেট বুকে ঝুলাব, আর তাদের নিন্দার কাঁটা অগ্রাহ্য করব, সেটি খুব যুক্তিযুক্ত নয়। প্রথমটি যদি আমাদের সাফল্যের প্রমাণ হয়, তাে দ্বিতীয়টি যে আমাদের ব্যর্থতার সূচক, সে কথা মানা সুবুদ্ধির পরিচায়ক হবে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সদর দফতরে বিশ্ব সংস্থায় বাংলাদেশের চল্লিশ বছর উপলক্ষ্যে একটি অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয় তাতে জাতিসংঘ মহাসচিব থেকে নিয়ে প্রায় সকল মান্যবর বিদেশি অতিথিবর্গ বাংলাদেশের সাফল্যে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। মহাসচিব বান কি-মুন তাে বাংলাদেশকে উন্নয়নের মডেল বলে বসলেন। এই মূল্যায়নে কোনাে ভুল নেই। প্রতিদিন আমরা একটু একটু করে এগুচ্ছি। নারীর ক্ষমতায়নে, শিশু মৃত্যু রােধে ও দারিদ্র্য দূরীকরণে আমাদের সাফল্য তর্কাতিত ।কিন্তু পিছিয়ে আছি, অথবা প্রতিদিন আমরা একটু একটু করে। পিছাচ্ছি, এমন ক্ষেত্রেরও অভাব নেই। সমস্যা হলাে, আমরা নিজেদের সাফল্য নিয়ে যত উচ্চবাক, নিজেদের ব্যর্থতা নিয়ে ততটা নই। শুধু বিদেশির প্রশংসার সাটিফিকেট বুকে ঝুলাব, আর তাদের নিন্দার কাঁটা অগ্রাহ্য করব, সেটি খুব যুক্তিযুক্ত নয়। প্রথমটি যদি আমাদের সাফল্যের প্রমাণ হয়, তাে দ্বিতীয়টি যে আমাদের ব্যর্থতার সূচক, সে কথা মানাও সুবুদ্ধির পরিচায়ক হবে।

যারা আমাদের উন্নয়নের সার্টিফিকেট দিয়েছেন, তারাই বলেছেন দেশটা এখনাে নানা সমস্যায় আকীর্ণ। যেমন, ফ্রিডম হাউসের হিসেবে বাংলাদেশ এখনাে পূর্ণ গণতান্ত্রিক নয়, সে বড়জোর ‘অংশত স্বাধীন। রাজনৈতিক অধিকার (পলিটিক্যাল রাইটস) ও নাগরিক দাবি, দাওয়া (সিভিল লিবারটিস)- গণতন্ত্রের এই দুই প্রধান সূচকেই বাংলাদেশ আগের বছরের তুলনায় পিছু হটেছে। টোঙ্গা বা ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগাের মতাে দেশ পূর্ণ স্বাধীন’, অথচ বাংলাদেশ এখনাে ‘পার্টলি ফ্রি’। নাগরিক অধিকার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের এই নিমগামিতার ব্যাখ্যা হিসেবে ফ্রিডম হাউস মত প্রকাশের ক্ষেত্রে নতুন বাধা-নিষেধ আরােপ ও  বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি বর্ষণের কথা উল্লেখ করেছে। মানবাধিকারের ব্যাপারে বাংলাদেশে যে গুরুত্বপূর্ণ অবনতি ঘটেছে, সে কথা বলেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এই সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার উদারনৈতিক নীতি অনুসরণের | কথা মুখে বললেও কার্যক্ষেত্রে বাক স্বাধীনতা হ্রাস করেছে এবং যারাই সরকারের কার্যকলাপের সমালােচনা করে তারা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, এমন অভিযােগ তুলেছে। সংস্থাটি তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রত্যাহার ও বিরােধী দলসমূহের বয়কট সত্ত্বেও ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের সমালােচনা করেছে।

এত গেল গণতন্ত্রায়ণের প্রশ্নে আমাদের খামতি। আমাদের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি অর্থনৈতিক উন্নয়নে, এমন দাবি নানা মহলে হর-হামেশাই শুনতে পাই। বিশ্বব্যাঙ্ক তাদের সাম্প্রতিকতম যে “বিজনেস ইন্ডেক্স’ প্রকাশ করেছে, তাতে দেখছি ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার ক্ষেত্রে মােট ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১৭০, যা আগের বছরের তুলনায় ৩ ধাপ নিচে।  বিশ্বব্যাঙ্ক অবশ্য জানিয়েছে, ব্যবসার সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধির ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর বাইরে রয়েছে দুনীতি ইন্ডেক্স। সেই তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১৩৭। এই ক্ষেত্রে গত আট-দশ বছরে আমাদের অবস্থান মােটামুটি একই রকম। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এখন নতুন যে কথা বলেছে তা হলাে দুর্নীতির ফলে। শুধু যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যহত হয় তাই নয়, মানুষের জীবনও বিপন্ন হতে পারে। গার্মেন্টস খাতে পর পর কয়েকটি মারাত্মক দুর্ঘটনার পেছনে দূর্নীতি দায়ী, জানিয়েছে সংস্থাটি। আমাদের সবচেয়ে প্রধান বাণিজ্য খাত গার্মেন্টস। সম্প্রতি জানানাে হয়েছে এই খাতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে এখন দুই নম্বর। খুবই আশার কথা, কিন্তু একথা কোথাও পড়ি নি যে গার্মেন্টস খাতে দুর্নীতির ব্যাপারে দেশটি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের উপাত্ত অনুসারে প্রধান রফতানিকারক দেশগুলাের মধ্যে স্থান এক নম্বরে  ১০০ নম্বর যেখানে দুর্নীতিমুক্ত, সেখানে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬। এমনকী পাকিস্তানের স্থান আমাদের নিচে (অর্থাৎ তা আমাদের চেয়ে কম দুনীতিপূর্ণ)। আরাে আছে। বিশ্বের বসবাসযােগ্য শহরের যে তালিকা ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রস্তুত করেছে তাতে ঢাকা হলাে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাপেক্ষা কম বসবাসযােগ্য শহর।

সিরিয়ার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দামাস্ক শহরই শুধু ঢাকার নিচে পরিবেশগত দিক দিয়েও বাংলাদেশের পরিস্থিতি দুর্ভাগ্যজনক। ২০১৪ সালের ‘এনভারনমেন্ট পারফরমেন্স ইন্ডেক্স’ অনুসারে ১৭৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের নবম সর্বাপেক্ষা দূষিত দেশ। অর্থাৎ এর বাতাস ও পানি মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিদেশের প্রতিবেদন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আরাে নানা উপাত্ত হাজির করা সম্ভব, যা দিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানাে যায়, আমরা যতটা এগিয়েছি, সম্ভবত তার চেয়ে পিছিয়েছি দ্বিগুণ। কিন্তু আমার লক্ষ্য তা নয়। আমরা কতটুকু এগিয়েছি। বা কতটা পিছিয়েছি, তা আমাদের চেয়ে ভালাে আর কে জানে! এর জন্য বিদেশি সাটিফিকেটের প্রয়ােজন নেই। দেশ অগ্রসর হলে তার সুফল ভােগ করি আমরা, পিছালে তার মাসুল আমাদেরই গুণতে হয়। ভালাে ও মন্দের এই সূচকগুলাে মূল্যবান ও অর্থপূর্ণ হয় যদি তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি ও সে শিক্ষার ভিত্তিতে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নে আগ্রহী হই । কিন্তু সেই পাকিস্তান আমল থেকেই দেখে আসছি, বিদেশের কেউ সামান্য দুচার কথা ভালাে বললেই তার পুনরাবৃত্তি করতে আমাদের মুখে ফেনা উঠে আসে। অথচ যেই কেউ একটি সামান্য সমালােচনা করল, অমনি তাকে ভ্রান্ত বা উদ্দেশ্য প্রণােদিত বলে বাতিল করে দেই। এই দুই প্রবণতাই জাতি হিসেবে আমাদের অপরিকৃতার প্রমাণবহ।

সূত্র : একাত্তর যেখান থেকে শুরু – হাসান ফেরদৌস,  সময় প্রকাশনী,২০১৬