সার্বভৌমত্বের প্রান্তসীমা
বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় প্রায়ই সার্বভৌমত্ব বিপন্ন’ বলে একটি আওয়াজ শােনা যায়। সার্বভৌমত্ব-সার্বভৌমত্ব বলে না চেঁচিয়ে সার্বভৌমত্বের সঙ্গে দায়বদ্ধতার সম্পর্ক কোথায়, সেটা সবাই মনে রাখলে তা সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে। কোনাে কোনাে রাজনীতিক ও ভাষ্যকারের কথায় মনে হয়, বিদেশিরা সব বাংলাদেশকে গিলে খাবার জন্য মুখিয়ে আছে। কেউ গ্যাস চায়, কেউ সেন্টমার্টিনস দ্বীপ চায়। একদিকে এফবিআই, ইন্টারপোল ইত্যাদি আমাদের খুনােখুনি তদন্তের নামে ফাল হয়ে ঢুকছে। অন্যদিকে ভারতীয় পত্র-পত্রিকা সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপের হুমকি দিচ্ছে। সন্ত্রাসের নাম করে আমেরিকা তাে মাদ্রাসা পর্যন্ত সফর করা শুরু করেছে। ভাষ্যকাররা বলছেন, এসবই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র । বিদেশেও কারা কারা সব বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। সব মিলে সার্বভৌমত্ব গেল আর কি!
বাংলাদেশের ভেতরের ব্যাপার নিয়ে বিদেশিদের নাক গলানাে নতুন কোনাে ব্যাপার নয়। আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও অর্থ বরাদ্দ থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি তাবৎ বিষয়ে বিদেশি সরকার এবং সংবাদপত্রের মাথাব্যথার শেষ নেই। সবারই যেন আমাদের ব্যাপারে কিছু না কিছু পরামর্শ দেওয়ার আছে। আমরা নিজেরা সামলাতে না পারলে বড় ভাই ভেবে বিদেশিদের দ্বারস্থ হই, তা সে জাতিসংঘের তারানকো সাহেব বা ইউরােপীয় ইউনিয়ন যাই হােক না কেন। নিজেদের সরকার, বিচার ব্যবস্থা বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কোনাে কিছুর ওপর আমাদের নিজেদেরই কোনাে আস্থা নেই। বিদেশিরা আমাদের সম্পর্কে একটি ভালাে কথা বললে আমাদের খুশির অন্ত থাকে না। অমনি তা পত্রিকার শিরােনাম হয়ে যায়, সরকারি মুখপাত্র তার পুনরাবৃত্তি করতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। কিন্তু যেই না কোনাে মন্দ কিছু বলা হলাে, অমনি সরকার ও সরকারি বুদ্ধিজীবীদের মুখ ফুলে ঢােল। চোখের পলক পড়তে না পড়তেই বিদেশি হস্তক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ঢােলক শুরু হয়ে যায়। অন্যদিকে বিরােধী দলগুলাে এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবীরা বিদেশিদের সে কথা যেন ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি, এই ভাব নিয়ে মঞ্চে নেমে বসেন। নিজের লাইনে কথা না বললে বাম-ডান দুপক্ষ থেকেই সার্বভৌমত্ব বিপন্ন বলে চেঁচানাে বাংলাদেশের এক পুরনাে খেলা তাদের যুক্তি, আমাদের ভেতরের ব্যাপারে নাক গলানাে আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আক্রমণ ছাড়া আর কিছু নয়। এ কথা বলার সময় এরা অবশ্য সবাই ভুলে যান যে, আমাদের ভেতরের। অন্তর্বাসটি পর্যন্ত বিদেশের। তাদের যত মাথাব্যথা গায়ের গিলে করা পাঞ্জাবিটি। নিয়ে।
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন নয় বা আগামীতে হবে না, সে কথা আমি। বলি না। রাষ্ট্রকাঠামােয় পচন ধরলে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে বৈকি। অনেকেই বলছেন, পচনের নানা লক্ষণ এখন বাংলাদেশের মাথা থেকে পা পর্যন্ত। সার্বভৌমত্বের মােদ্দা কথা হলাে, রাষ্ট্র নিজের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে। এ ব্যাপারে অন্য কেউ নাক গলাবে না। তার সীমানা অতিক্রম করে কোনােরকম অনুপ্রবেশও চলবে না। অন্ততপক্ষে সার্বভৌমত্বের যে ‘ওয়েস্টফালিয়ান কনসেপ্ট’। সতেরাে শতক থেকে চলে আসছে, সেখানে সে কথাই পাই। ১৬৪৮ সালে স্বাক্ষরিত ওয়েস্টফালিয়া চুক্তি, যার ফলে ভ্যাটিকানভিত্তিক রােমান সামাজ্যের। বিরুদ্ধে পরিচালিত ৩০ বছরের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ও নির্ধারিত সীমানাভিত্তিক আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব, তাতে মেনে নেওয়া হয় যে সার্বভৌমত্বই হলাে। রাষ্ট্রের প্রধান আইনগত ভিত্তি। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, সার্বভৌমত্ব শুধু কাগজেকলমে থাকলেই হবে না, তাকে রক্ষা করার ক্ষমতাও থাকতে হবে। যে রাষ্ট্র দুর্বল, যার অর্থনীতি পরমুখাপেক্ষী, যার গণতান্ত্রিক কাঠামাে নড়বড়ে, যেখানে সরকার ও নাগরিকের মধ্যে যােজন দূরত্ব সে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বও দুর্বল হতে বাধ্য। এ ধরনের অনেক রাষ্ট্রে সরকার নিজেদের টিকে থাকার জন্য নিজেরাই সাধ করে বিদেশিদের ডেকে আনে। সার্বভৌমত্বের আধুনিক যে ধারণা, তাতে নিরঙ্কুশ ও সকল বিদেশি প্রভাব। বহির্ভূত সার্বভৌমত্ব বলেও কিছু নেই। আমরা যে যুগে বাস করি, যে সময় এক রাষ্ট্র অন্য অনেক রাষ্ট্রের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত, তাদের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয়। দেশীয় আইন দিয়ে নয়, আন্তর্জাতিক আইন দিয়ে। যখনই কোনাে দেশ কোনাে আন্তর্জাতিক চুক্তির অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সে চুক্তি মেনে চলতে সম্মত হয়, তার সঙ্গে। খানিকটা সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিতেও সে সম্মত হয়। পরমাণু অস্ত্র বিস্তারবিরােধী। চুক্তি স্বাক্ষর করা মানে শুধু আণবিক বােমা না বানাতে রাজি হওয়া নয়।
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থা মাঝে মধ্যে বলে না বলে দেখে যাবে গােপনে কিছু করা হচ্ছে কি না, সে শর্তও মেনে নেওয়া। এটা এক ধরনের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা বলতে পারেন কিন্তু আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই হামলায় রাষ্ট্র নিজ থেকেই সম্মত হয়। এটি তার দুর্বলতার লক্ষণ নয়, বরং তার সবলতার প্রমাণ। যে রাষ্ট্র সার্বভৌম নয়, তার সে চুক্তি স্বাক্ষরের প্রশ্নই ওঠে না। তবে রাষ্ট্র দুর্বল হলে বিদেশি চাপের কারণেও তাকে তেমন চুক্তি স্বাক্ষর করতে হতে পারে। দোষটা সার্বভৌমত্বের নয়, রাষ্ট্রের কাঠামােগত দুর্বলতার আন্তর্জাতিক আইন ও বহুপাক্ষিক চুক্তিভিত্তিক যে বিশ্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখন। গড়ে উঠেছে, তাতে নিজ থেকেই সার্বভৌমত্বের একটি সীমানা, তার প্রান্তসীমা নির্ধারণ করা হয়ে যাচ্ছে। এমন অনেক চুক্তি রয়েছে যার শর্ত না মেনে চললে বা তার লঙ্ন হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নীতিমালা নির্ধারিত আছে। অনেক রাষ্ট্র এখন একা বা একজোট হয়ে কোনাে একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবরােধ- যেমন সামরিক বা অর্থনৈতিক অবরােধ-আরােপ করতে পারে ইরাক, লিবিয়া বা দক্ষিণ। আফ্রিকার বিরুদ্ধে সে ধরনের অবরােধের সাম্প্রতিক উদাহরণ আমরা জানি। এ ধরনের অবরােধ আরােপের জন্য ‘অপরাধী’ দেশের সম্মতির প্রয়ােজন নেই। এ ধরনের ব্যবস্থার ফলে যেসব দেশের ওপর অবরােধ আরােপ হলাে, তার সার্বভৌমত্ব সংকুচিত হলাে, তা বলাই বাহুল্য। এ তাে গেল আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির কাঠামাের ভেতর সার্বভৌমত্বের সংকোচন।
আজকের বিশ্বায়নের যুগে, প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্ব লজ্জিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত সব আইনকে বুড়াে আঙুল দেখিয়ে। সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে নিজ দেশের ভেতর তথ্য প্রবাহের ওপর কোনাে সরকার যদি নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চায় তাে তাকে আমরা সেন্সরশিপ বলি। ইন্টারনেটের এই যুগে নিজ দেশের নাগরিক অধিকার সংকুচিত না করে তেমন সেন্সরশিপ জারি করতে পারে এমন কোনাে সরকার আছে বলে আমার জানা নেই এ তাে গেল টেকনোেলজির ব্যাপার। রাষ্ট্র চাক বা না চাক, সীমান্ত অতিক্রম করে অর্থ আসছে, পণ্য আসছে, শ্রমিক আসছে, সঙ্গে সঙ্গে আসছে এইডস ও অন্যান্য মহামারী, আসছে এসিড বৃষ্টি ও বন্যার জল। তাতেও সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হচ্ছে হরহামেশা। নব্বইয়ের। দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে আর্থিক সংকট দেখা দেয়, তার প্রভাবে একাধিক সরকারের পতন হয়েছে, সুহার্তোর মতাে পরাক্রমশালী নেতা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, পূর্ব তিমুরে বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে। পৃথিবীর অনেক বহুজাতিক করপােরেশন আজ এতটা ক্ষমতাধর, যেকোনাে সরকারকে ওঠানাে-নামানাের ক্ষমতা রাখে তারা। সার্বভৌমত্বের নামে কে ঠেকাতে পেরেছে তাদের অর্থের আগমন ও নির্গমন? মােদ্দা যে কথাটা আমি বলতে চাইছি তা হলাে, সার্বভৌমত্ব এমন কোনাে স্পর্শাতীত গাে-মাতা নন যে তার লঙ্ঘন ঘটবে না। দি এজ অব সভারেনিটি ইজ ওভার’ এমন আপ্তবাক্য এখন হরহামেশাই শােনা যায় । রাষ্ট্রের সম্মতি বা অসম্মতিতে সার্বভৌমত্বের লক্ষ্মন ঘটছে অহরহ। আজ নয়, দীর্ঘদিন থেকে। আর এক রাষ্ট্রের ভেতরের ব্যাপার নিয়ে অন্য রাষ্ট্রের সমালােচনা? চীনের নাগরিক অধিকার ও রাশিয়ার চেচনিয়া নিয়ে বাড়াবাড়ি, সে প্রসঙ্গ আমেরিকার কংগ্রেসে ও ইউরােপীয় পার্লামেন্টে উঠেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বা তাদের নেতৃত্ব নিয়ে কঠোর সমালােচনা শুধু পত্রপত্রিকায় নয়, বিদেশি নেতানেত্রীরাও করেছেন। সে মন্তব্যে তাদের গায়ে ফোস্কা পড়তে পারে কিন্তু তাই বলে সার্বভৌমত্ব চলে গেল, সে কথা কেউ বলেছে বলে শুনিনি। মানছি, সার্বভৌমত্ব যেকোনাে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ উপাদান। আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করে সার্বভৌমত্বের ওপর যেকোনাে রকম হামলা, বিশেষত সামরিক হামলা, কিছুতেই গ্রহণযােগ্য নয়। কোনাে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রকাশিত হয় সে দেশের সরকারের মাধ্যমে। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে, ক্ষমতায় বসে যে সরকার সে একের পর এক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে চলেছে, তার ব্যবহারের ফলে আঞ্চলিক এমনকি বিশ্ব শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে কী করণীয় হবে? অথবা যদি এমন দেখা যায় যে, ক্ষমতাসীন সরকার তার নিজ জনগণের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষায় শুধু ব্যর্থ নয়, সে নিজেই তার দেশের মানুষের একাংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে বসে আছে, তাহলে? উদাহরণ হিসেবে ১৯৭১-এর বাংলাদেশের কথা ভাবুন, সত্তর দশকের কম্বােডিয়ার বা নব্বই দশকের রুয়ান্ডা ও বসনিয়ার কথা ভাবুন। এসব দেশের সরকার তাে দাবি করতেই পারত, তার দেশের ভেতর যা ঘটছে তা তার নিজস্ব ব্যাপার, এ নিয়ে কারাে নাক গলানাের অধিকার নেই। কারণ নাক গলানাে মানে হবে তার সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা।
কিন্তু সত্যিই যদি বাইরে থেকে নাক না গলানাে হতাে, এমনকি সেসব দেশের সার্বভৌমত্ব লংঘন করে হলেও, এসব দেশের মানুষের কী হাল হতাে? সাম্প্রতিক সময়ের সুদানের দারফুরের কথা ভাবুন। সরকার নিজেই একদল মিলিশিয়াকে উসকে দিয়েছে দেশের ভেতর তার নিজেরই জনগণের একাংশের বিরুদ্ধে। কম করে হলেও ৩০ লাখ সুদানি নাগরিক নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে আত্মরক্ষার জন্য সমালােচনা হচ্ছে, জাতিসংঘে প্রস্তাব নেওয়া হচ্ছে, আফ্রিকান ইউনিয়ন থেকে সেনা পরিদর্শক পাঠানাে হচ্ছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখছি সিরিয়াতে। পৃথিবীর মানুষ এবং তাদের সরকার কি সিরিয়া বা সুদানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে কোনােরকম হস্তক্ষেপ না করে হাত গুটিয়ে বসে আরেক গণহত্যা চেয়ে চেয়ে দেখবে?
রুয়ান্ডা বা দারফুরের মতাে মানবিক বিপর্যয় আমাদের বাধ্য করছে সার্বভৌমত্বের ধারণাটি নতুন করে বিবেচনা করতে। জাতিসংঘের ৫৪তম । অধিবেশনের সময় মহাসচিব কফি আনান প্রথমবারের মতাে এ কথা উচ্চারণ করেন যে, চিহ্নিত সীমানার বাইরে (অর্থাৎ কোনাে দেশের অভ্যন্তরে) মানবিক। কারণে হস্তক্ষেপের অধিকার জাতিসংঘের রয়েছে। তিনি যুক্তি দেখান যে, একুশ শতকে আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলাে, পৃথিবীর যেকোনাে স্থানে যখনই কোনাে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটবে, তা রােধ করা। সার্বভৌমত্বের অজুহাতের সে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তার কথায়, ‘সার্বভৌমত্বকে মানতে গিয়ে মানবিক হস্তক্ষেপ থেকে আমরা যদি বিরত থাকি, তাহলে রুয়ান্ডা বা স্লেব্রিনিসার মতাে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত ভয়াবহ অপরাধ আমরা ঠেকাব কী করে? কোনাে আইনি আদর্শ, এমনকি সার্বভৌমত্বের দাবিও মানবতার বিরুদ্ধে তেমন অপরাধকে চাপা দিয়ে রাখতে পারে না।’ বলা বাহুল্য, ছােট ছােট অনেক দেশ, বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্নের। জন্য যাদের নাম ইতিমধ্যে খাতায় লেখা আছে, তারা মহাসচিবের সে কথায় খুশি হননি। যেমন- আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান পালটা জবাব দিয়ে বললেন, অসম্ভব, সার্বভৌমত্ব হলাে আমাদের শেষ অবলম্বন। তা লঙ্ঘিত হতে দেওয়া যাবে না। ব্যাপারটা নিয়ে গত কয়েক বছরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানারকম ভাবনা-চিন্তা হয়েছে, হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছে কানাডা সরকার কর্তৃক স্থাপিত ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন ইন্টারভেনশন অ্যান্ড সভরেনিটি। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কমিশন সম্প্রতি তাদের বিশ্লেষণভিত্তিক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের মােদ্দা বক্তব্য, সার্বভৌমত্বের মূল কথা রাষ্ট্রের অধিকার নয়, রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
যেকোনাে রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্বের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও সকল আন্তর্জাতিক আইন-কানুন মেনে চলতে
অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। এসব আইন-কানুনের মধ্যে রয়েছে মানবাধিকার সংক্রান্ত নীতিমালা সেসবের কোনােটা লিখিত, কোনােটা প্রচলিত নিয়ম। দেশের ভেতর আইন ভাঙলে যেকোনাে নাগরিক বিচারের সম্মুখীন হয়, তার সাজা হয়। কোনাে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন ভাঙলে, তারও শাস্তি হতে পারে। সম্মতির ভিত্তিতে সংশােধন না হলে প্রশ্ন উঠবে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সার্বভৌমত্বকে যদি দায়িত্ব ভাবি, তাহলে তার তিন ধরনের ব্যাখ্যা হতে পারে বলে কমিশন মত দিয়েছে। প্রথমত, সরকার দেশের ভেতরে প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ; দ্বিতীয়ত, সরকার একদিকে দেশের মানুষের কাছে যেমন দায়বদ্ধ, তেমনি দায়বদ্ধ জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গােষ্ঠীর কাছে এবং তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে। সরকার তার সকল কার্যাবলির জন্য দায়বদ্ধ। কোনােরকম লঙ্ঘন হলে তাকে এ জন্য জবাবদিহি করতে হতে পারে।
বলাইবাহুল্য চীন, মালয়েশিয়া বা ইরানের মতাে দেশ আন্তর্জাতিক আইনের এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তাদের যুক্তি, মানবিক বিপর্যয়ের অজুহাতে বহিরাগত হস্তক্ষেপ জায়েজ হয়ে গেলে বড় দেশগুলাে তাদের স্বার্থের জন্য বাধা মনে করে এমন যেকোনাে দেশের বিরুদ্ধে জোট বেঁধে হস্তক্ষেপ করবে এবং জাতিসংঘকে দিয়ে তা জায়েজ করিয়ে নেবে। তেমন বিপদ যে নেই, তা নয়। কিন্তু ইরাকের ঘটনা থেকে আমরা জানি, বড় দেশগুলাে জোট বাঁধলেও সব সময় জাতিসংঘের তরফ থেকে তেমন আইনি সাফাই আদায় করা সহজ নয়। ইরাকের বেলায় আমেরিকা তা পায়নি। তা ছাড়া হস্তক্ষেপের জন্য শুধু আইনি সমর্থন থাকলেই চলবে না, তার জন্য আন্তর্জাতিক নাগরিক সমর্থন চাই সেটা না থাকলে কি হয়, ইরাক বিপর্যয় থেকে আমেরিকা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। সার্বভৌমত্বের চেহারা-চরিত্র নিয়ে এই তর্ক-বির্তক এখনাে চলছে। তবে এ কথা সবাই ক্রমশ মেনে নিচ্ছে যে, সার্বভৌমত্বের অজুহাতের কোনাে সরকার দেশের ভেতর যা খুশি করবে, আর পৃথিবীর মানুষ তা মেনে নেবে, তেমন বােম্বেটেপনার যুগ চলে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী গ্যারেথ ইভানসের কথায়, পৃথিবী ক্রমশই ‘Culture of sovereign impunity calce Culture of national and international accountability-> দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই অগ্রগতির একটা প্রধান কারণ সব আন্তর্জাতিক। সম্পর্কের কেন্দ্রে ক্রমশই মানবাধিকারের সংস্কৃতি আশ্রয় নিচ্ছে।
বাংলাদেশের নিজের জন্মের পেছনে মানবিক যুক্তিতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময় পাকিস্তানের সরকার তার নিজ দেশের একাংশের নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তারা নিজেরাই দেশের অর্ধেক মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে বসেছিল। কেউ কেউ বলছেন, আজকের যে বাংলাদেশ, তাতে ক্ষমতাসীন সরকার কেবল নিজের দলের ও মতের লােকদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। অন্যরা তার আক্রমণের শিকার। এই অভিযােগ কতটা সত্য তা তলিয়ে দেখা দরকার। সত্য হলে পরিস্থিতি পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার সার্বভৌমত্ব-সার্বভৌমত্ব বলে না চেঁচিয়ে সার্বভৌমত্বের সঙ্গে দায়বদ্ধতার সম্পর্ক কোথায়, সেটাও সরকারকে মনে করিয়ে দেওয়া ভালাে।
সূত্র : একাত্তর যেখান থেকে শুরু – হাসান ফেরদৌস, সময় প্রকাশনী,২০১৬