একাত্তর, পাকিস্তানি উপন্যাসে
কামিলা শামসির উপন্যাস ‘কারটোগ্রাফি’ এক যুগ আগে লেখা, ২০০২ সালে, যখন কামিলার বয়স মাত্র ২৮। একাত্তরকে তিনি দেখেন নি, একাত্তরের রক্তক্ষরণ, তা কেবল শােনা কথা, তাও সম্ভবত তাদের কাছ থেকে যারা বড়জোর একচক্ষু বকের মতাে সে ইতিহাস দেখেছে বৈরী মানসিকতা নিয়ে। একাত্তরের ঘটনা বাঙালির মানসিক মানচিত্রে কী প্রভাব ফেলেছে, কামিলার তা না জানারই কথা, এই মনােভাব নিয়েই উপন্যাসটি আমি পড়তে শুরু করি। শেষ পাতাটি পড়ে বইটি মুড়ে রাখার পর আমার মনােভাব দাঁড়াল ভিন্ন। একটি কিশাের প্রেমের গল্পকে অবলম্বন করে যে ব্যাপকতর ন্যারেটিভটি কামিলা নির্মাণ করেছেন তার মুখ্য বিষয়, ইতিহাসের জটিল সন্ধিক্ষণে বিভক্ত নাগরিক আনুগত্য ব্যক্তি চৈতন্যে ও একই গােত্রভুক্ত মানব-মানবীর পারস্পরিক সম্পর্কে কী প্রভাব ফেলে। সবাই ইতিহাসের নির্মাতা নয়, সে ইতিহাসের প্রত্যক্ষদশীও নয়। অথচ সে ইতিহাসের ভার, তার ভেদ ফলাফল- এই বহির্গত মানুষদেরও বহন করতে হয়। হিসেবের জমা-খরচ নেওয়ার চেষ্টা করলে আমাদের পরিচিত ন্যারেটিভের বাইরে একটি ভিন্ন ইতিহাস আমাদের গােচরীভূত হয়। কারটোগ্রাফি তারই একটি চমৎকার উদাহরণ। বইটির নাম মানচিত্রকলা, ফলে দেশ ও আত্মপরিচয় তার কেন্দ্রে থাকবে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। মানচিত্রের এক অর্থ কাগজের ওপর কালির রেখা। এই যে কালির রেখা, তার ভিতরে ও বাইরে মানুষের বাস, অতএব মানচিত্রের আসল পরিচয় মেলে যে সব মানুষের জীবন সেই কালি-রেখার ফলে নির্ধারিত হয়, তাদের রক্ত, ঘাম ও দীর্ঘশ্বাসে মানচিত্রের অন্য পরিচয়, সে একটি সময়-ফলক। মানচিত্রের কালিরেখায় জাতি রাষ্ট্রের যে পরিচয় নির্ধারিত হয়, তা স্থায়ী কোননা। প্রকাশ নয়।
এক রেখা মিলিয়ে নতুন রেখার জন্ম হয়, সাথে ঘটে নতুন জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় যা এই রেখাচিত্র থেকে মােটেই স্পষ্ট হয়না তা হলাে, যাদের নিয়ে এই জাতি-রাষ্ট্র, তাদের জীবন কীভাবে এই কাটাকুটির খেলায় বদলে যায়। একাত্তরকে একটি সময়-ফলক বিবেচনা করে মানব-ভাগ্যের যে মানচিত্র শামসি এঁকেছেন, তাতে তিনি (পশ্চিম) পাকিস্তানে বসবাসরত একজন বাঙালির অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যা অনায়সেই একপেশে ও অবিবেচনাপ্রসূত একটি কল্পকাহিনীতে পরিণত হতে পারত। একাত্তরের পটভূমিতে কোনাে পাকিস্তানি লেখকের হাতে এই প্রথম কোনাে উপন্যাস রচিত হলাে তা নয়, কিন্তু এই প্রথম, অন্ততপক্ষে আমার পঠিত, কোনাে উপন্যাসে বাঙালির লড়াইকে বুঝবার চেষ্টা করা হয়েছে নৈতিক জবাবদিহিতার আয়নায়। সে জন্যই কারটোগ্রাফি’ উপন্যাসটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।
করাচীর অতি ধনাঢ্য চারটি পরিবারকে নিয়ে এই উপন্যাস। এর কেন্দ্রে রয়েছে রাহিন ও করিমের আশৈশব বন্ধুত্ব, প্রেম, বিরাগ ও প্রণয়। এর পাশাপাশি প্রায় সমান গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে তাদের পিতা-মাতার সম্পর্কের অন্তঃবিরােধপূর্ণ অভিজ্ঞতার বিবরণ। একাত্তরে, যখন রাহিন অথবা করিম কারােরই জন্ম হয়নি, রাহিনের পিতা জাফর ও করিমের মাতা মাহিন শুধু একে অপরের প্রণয়ী ছিলেন না, তাদের বিয়ের সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত ছিল। অন্যদিকে রাহিনের মা ইয়াসমিন ও করিমের বাবা আলী ছিলেন পরস্পরের প্রণয়ী। তাদের বিয়ের সিদ্ধান্তও কারাে অজ্ঞাত ছিল না। একাত্তরের একটি ঘটনা পারস্পরিক সম্পর্কের এই সমীকরণ সম্পূর্ণ বদলে দেয়। এই চারজনের মধ্যে একজন মাহিন, জন্মসূত্রে বাঙালি, যদিও (পশ্চিম) পাকিস্তানে তাঁর বসবাস দীর্ঘদিনের অতিউচ্চবিত্ত এই যুবক-যুবতীরা, যারা কেউ খুব রাজনীতি সচেতন নন, একাত্তরে পূর্ব রণাঙ্গনের খবরাখবর পেতেন লােক মুখে, অথবা সরকারি ভাষ্য থেকে। বাঙালির আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার বিষয়ে কোনাে জ্ঞান তাদের ছিল না, কোনাে সহানুভূতিও থাকার কথা নয়। বাঙালি মাহিন যুদ্ধের ঘটনায় উদ্বিগ্ন, একথা তারা জানতেন এবং তার প্রতি এক ধরনের সহমর্মিতা বােধ করতেন। জাফর, মাহিনের প্রেমিক, একদিন আকস্মিক ভাবে বাঙালিদের প্রতি কুৎসা পূর্ণ একটি মন্তব্য করে বসে, যার ভেতর দিয়ে বাঙালিদের প্রতি তার মনােভাব পরিষ্কার হয়ে যায়। মাহিন বুঝতে পারে, তার আপাত প্রগতিশীলতা সত্ত্বেও জাফর মাহিন ও তার বাঙালি সত্তার প্রতি কখনাে শ্রদ্ধাশীল হবে না।
ফলে ভেঙে যায় তাদের প্রণয়, পরিবর্তিত হয় বিয়ের সিদ্ধান্ত। এই চার বন্ধু একে ওপরের প্রেমিক বদলে নেয়, জাফর ও মাহিনের বদলে জাফর ও ইয়াসমিন এবং আলী ও ইয়াসমিনের বদলে আলী ও মাহিন বিয়ে করে। কারটোগ্রাফি উপন্যাসে যে দুটি কাহিনী-ধারা প্রবাহিত, এটি তার অন্তঃসলীল। বহিঃসলীলে আমরা দেখি এই ভেদপূর্ণ সম্পর্কের কারণে রাহিন ও করিমের সম্পর্কের টানাপড়েন। মধ্য শৈশবে করিম তার ও রাহিনের পিতা-মাতার পূর্ব প্রণয়ের ইতিহাস জানতে পারে। রাহিনের কাছেও সে গুপ্ত ঘটনা ক্রমশ প্রকাশিত হয়। এর ফলে যে দুই বন্ধু একে অপরকে প্রাণাধিক ভালােবাসত, তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, এক সময় যা প্রায়-বৈরিতায় দাঁড়ায়। এই দূরত্বের জন্য রাহিন তার পিতাকে দায়ী করে, পিতার প্রতি ক্রোধ ও বিবমিষার জন্ম হয়। একাত্তরের সেই ঘটনার জন্য মাহিনের প্রতি তাঁর ব্যবহারকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে প্রতীয়মান হয়। মাহিনকে যদি পাকিস্তানের পূর্বাংশের মানুষদের একজন প্রতীক প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা যায়, তাে জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা একা মাহিনের প্রতি নয়, পূর্বাংশের জাতিগােষ্ঠীর প্রতিও, রাহিনের এমন একটি বােধ গভীরভাবে আসনে গেড়ে বসে।
আত্মপরিচয় নিয়ে এই দ্বন্দ্বটি অনুসন্ধানের জন্য কামিলা একদিকে সম্মিলিত স্মৃতি, অন্যদিকে কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। ‘১৯৭১’ এই নামাঙ্কিত একটি অধ্যায়ে তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধের প্রতি (পশ্চিম) পাকিস্তানিদের মনােভাবের একটি দৃশ্যচিত্র এঁকেছেন, যা কাহিনীর সাথে জৈবভাবে সম্পৃক্ত না হলেও লেখকের রাজনৈতিক প্রয়ােজন মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একাত্তরে পাকিস্তানি মাত্রই বাংলাদেশ প্রশ্নে বৈরী ছিল না, একথা প্রতিষ্ঠার একটি অলক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি করাচি রেসকোর্স ময়দানে সে শহরের এলিটদের এক তপ্ত আড্ডার কাহিনি নিবেদন করেন। একাজে বাঙালি মাহিনকে তিনি ব্যবহার করেন রাজনৈতিক ব্যারােমিটার হিসেবে। বাঙালি হলেও মাহিন করাচিবাসী, হয় ইংরেজি নয় উর্দুতেই সেকথা বলে বাঙ্গালিয়ানার কোনাে প্রকাশই তার মধ্যে আমরা দেখি না, অথবা সে রাজনীতিমনস্ক অথবা আদর্শগত ভাবে ভিন্নমতাবলম্বী, একথা কাহিনির কোনাে পর্যায়েই। অনুভূত হয় না। কিন্তু অন্তর্গতভাবে সে বাঙালি ও বাংলাদেশের যুদ্ধরত মানুষদের নাগরিক চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সেকথাও আমাদের কছে গােপন থাকে না। রেসকোর্সের সে আড্ডাতেই সামরিক বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বাঙালিরা। পিছু হটবে, কারণ সাধ করে কেউ কচুকাটা হতে চায় না, এমন একটি মন্তব্যের জবাবে মাহিন অকস্মাৎ বলে ওঠে, “কেউ সাধ করে দাসত্বও মেনে নেয় না।
আসিফ, প্রথম মন্তব্যটি যার, সে মাথা নাড়ে, ‘মাহিন, দাসত্ব কথাটা কি খুব শক্ত হয়ে গেল না?’ আলি, তখন পর্যন্ত যে মাহিনের নিকটবন্ধু, কিন্তু প্রেমিক নয়, পাল্টা জবাব দেয়, “মােটই না, পরিসংখ্যানের দিকে একবার নজর দাও না কেন? কামিলা এরপর বাঙালি কেন স্বাধীকার দাবি করে, তার সপক্ষে আমাদের পরিচিত পরিসংখ্যানগুলাে তুলে ধরে : দেশের বৃহদাংশ হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ৩০ শতাংশ পায়; সরকারি চাকরি মাত্র ২০ শতাংশ তার ভাগে; সামরিক বাহিনীতে তার রয়েছে ১০ শতাংশেরও কম, শিক্ষা খাতেও তার জন্য বরাদ্দ বৈষম্যমূলক। অথচ রফতানির ৭০ শতাংশ আসে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। জাফর, মাহিন যার প্রণয়ী, ফোড়ন কাটে, সবচেয়ে ভালাে হয় যদি ভুট্টো ও মুজিবকে একে ওপরের সাথে ডুয়েল লড়তে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। আলী বলে, ‘জাফর, ব্যাপারটা অত সরল নয়। জাফরের পালটা জবাব, “তুমি যেভাবে পরিসংখ্যান তুলে ব্যাখ্যা করছ, ব্যাপারটা সে রকমও নয়।’ এবারে কথায় হস্তক্ষেপ করে মাহিন, তার বাগদত্তের ঘাড়ে হাত রেখে বলে, ‘জানু, আলী ঠিকই বলেছে। দেখ, আমিও চাই ব্যাপারটা সহজে মিটে যাক। কিন্তু তােমরা যদি ভেবে থাক বাঙালিরা তাদের দাবি সহজে ছেড়ে দেব, তাহলে বলব তােমরা নিজেদের ধোঁকা দিচ্ছ। এখন, স্বাধীনতার কথাটা তারা এমন প্রবলভাবে উচ্চারণ করেছে, সেই সময় কনফেডারেশনা বা অন্য কোনাে সমাধানের ধারণা তারা মেনে নেবে, আমার তা মনে হয় না। ফেডারেশনের চাইতে স্বাধীনতা শব্দটা বুকের মধ্যে অনেক প্রবল ভাবে দোলা দেয়। একই অধ্যায়ের অন্যত্র বাঙালি মাহিন আরাে পরিষ্কারভাবে তার পাকিস্তানি বন্ধুদের সাথে নিজের ফারাকটা ধরিয়ে দেয়। লায়লা কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিকদের কাছ থেকে শুনেছে ঢাকায় নাকি হাজার হাজার আমার মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে।’ সেকথা শুনে জাফরের প্রতিক্রীয়া, আমার মানুষ?
আসিফ ঠাট্টা করে বলে, ‘আমার কাছে খবর আছে ইয়াহিয়া ও মুজিব গােপনে চুক্তি করে ফেলেছেন। হায়, মাহিন, এখন তােমার বুকে সে দোলা তেমন। প্রবল ভাবে আর লাগবে বলে মনে হয় না। ইয়াসমিন বাধা দেয়, করছাে কি আসিফ? মাহিন সারা জীবন এই করাচিতে বাস করেছে। ও তাে আর ।’ তাকে থামিয়ে মাহিন বলে, কি, আমি ওদের একজন নই, সেকথাই তাে। বলছ? ঠিক এই সময় নিচে সামান্য শশারগােল শােনা যায়। একজন বাঙালি খানসামার হাত ছলকে হুইস্কি লায়লার শাড়িতে পড়ে গেলে তার স্বামী বাঙ্গালি খনসামাটির গালে সজোরে চপেটাঘাত করে। “নির্বোধ বিংগাে। যা, নিজের জঙ্গলে ফিরে যা। উপন্যাসের এই পর্যায়ে প্রথমবারের মতাে অপর ধারণাটির অবতারণা করা হয় আমরা বুঝে যাই, মাহিন অথবা সেই বাঙালি খানসামা, তারা যতদিন পাকিস্তানে থাকুক না কেন, (পশ্চিম) পাকিস্তানিদের কাছে তারা বরাবরই বহিরাগত’। অনুচ্চকণ্ঠে, যেন স্বাভাবিক একটি ব্যাপার, ঠিক এইভাবে কামিলা ‘অপর’ বা ‘দি আদার’ এই ধারণাটির অবতারণা করেন। এমন নয় যে কামিলা শামসি-ই প্রথম আমাদের বিভক্ত ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ‘অপর ধারণাটি বিবেচনা করেছেন লন্ডন প্রবাসী বাঙালি লেখক ম ইসলাম তাঁর ‘সং অব আওয়ার সােয়াম্পল্যান্ড’ গ্রন্থে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় সে চেষ্টা করেছেন। তাঁর গ্রন্থে একাত্তরে সমাজের অন্ত্যজ গােষ্ঠীসমূহ এই যুদ্ধে কী ভূমিকা পালন করে, তার একটি পর্যবেক্ষণ আছে। সাথে আছে একটি ‘বিহারী মেয়ের সাথে এক বাঙালি ছেলের প্রণয়ের বিবরণ। মেহেরজান’ চলচ্চিত্রেও আমরা দেখেছি একটি বাঙালি তরুণীর সাথে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসা একটি বালুচ সৈন্যের প্রণয় চিত্র। উভয় ক্ষেত্রেই যারা ‘অপর তাদের মনােজগৎ নির্ধারণের কোনাে চেষ্টা নেই, অভিজ্ঞতার পুরাে বিবরণটিই এসেছে বিভাজন রেখার অপর প্রান্তে, অর্থাৎ যারা মূলধারা (এই ক্ষেত্রে বাঙালি) তাদের আয়নায়। কামিলার উপন্যাসটি সেদিক দিয়ে ভিন্ন ও কিঞ্চিত জটিল। তার লক্ষ্য, একজন ‘অপর’ এর মনােজগৎ অবলােকন।
এই কাজটি করার জন্য সবচেয়ে বেশি যা প্রয়ােজন তা হলাে সহমর্মিতা । মূল গল্পের নিষ্ঠা, তার সংহতি ও বিশ্বাসযােগ্যতা, কিছুটা বিপদগ্রস্ত করেও কামিলা সে সহমর্মিতা অর্জনের চেষ্টা করেছেন, পাঠক হিসেবে আমার সেকথা মনে হয়েছে। একাত্তরের যে ইতিহাস, বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে, তা আবশ্যিকভাবেই যারা সংখ্যাগতভাবে গুরু ও রাজনৈতিকভাবে বলবান, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেই রচিত হয়েছে। সরকারি বিবরণে তাে বটেই, স্মৃতিকথামূলক যে গ্রন্থসমূহ আমরা পড়েছি, তাতেও মূলধারার অনুভূত ও উপলব্ধ ন্যারেটিভই পুনঃপুন রচিত। হয়েছে। ব্যাপক অর্থে এক দেশ বা অভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলেও ভাষা, ধর্ম বা অন্য জাতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণে নিজের আত্মপরিচয়ের স্বতন্ত্রতা দাবি করে, এমন সম্প্রদায়, অথবা সে সম্প্রদায়ের কোনাে কোনাে সদস্য, নিজ দেশেই ‘অপর’ হয়ে পড়ে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারিত্বে অথবা ভিন্নমতের প্রকাশের ভেতর দিয়ে যে আত্মপরিচয় নির্ণিত হয়, তাতে ‘অপরের অবস্থান বৃহদাংশের চোখে বৈরী ও শক্র এইভাবে। প্রকাশিত হতে বাধ্য। একাত্তরে ক্ষমতার শীর্ষে ছিল পাকিস্তানিরা, তারাও বাঙালিদের বরাবর ‘অপর’, এবং সেই কারণে শত্রু ভিন্ন অন্য কিছু ভাবে নি। উপরের প্রস্তাবনাটি যদি সঠিক বলে মেনে নেই, তাহলে স্বভাবতই প্রশ্নওঠে, একজন পাকিস্তানির পক্ষে কি সম্ভব যৌক্তিকভাবে বাঙালির স্বাতন্ত্রিকতা, অথবা তার ন্যয্য রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতি সহমর্মী হওয়া? এই প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক, অন্ততপক্ষে কারটোগ্রাফি উপন্যাসে। এই কাহিনির শেষ পর্যায়ে আমরা জাফর ও মাহিনের জবানীতে একাত্তরে যে ঘটনার কারণে তাদের সম্পর্কে ছেদ পড়ে, তার একটি ব্যাখ্যার সাথে পরিচিত হই। এই দুজনের বিবরণে তথ্যের প্রভেদ নেই, কিন্তু সে ঘটনার মূল্যায়নে ভিন্নতা রয়েছে। সময়ের ব্যবধানে মাহিনের কাছে ব্যাপারটি আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। আলীর সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটে ও একসময় সে পাকিস্তান ছেড়ে চলেও আসে। পাকিস্তানে তার জায়গা হয়নি, এ নিয়ে তার কোনাে ক্ষেদ নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশ নিয়ে তার কোনাে স্মৃতি নেই, একাত্তরের অভিজ্ঞতার কোনাে প্রভাব তার মনােজগতে বিন্দুমাত্র পড়ে। কিন্তু জাফরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ভিন্ন। একাত্তরের ঘটনা তার মনে এই বিষাদের জন্ম দেয় যে নিজ দেশের নাগরিকদের সাথে সে সময় পাকিস্তানিরা যে ব্যবহার করেছিল, তা ক্ষমার অযােগ্য।
সে এই ভেবে বিষাদগ্রস্ত হয় যে একাত্তরের রক্তক্ষরণ থেকে পাকিস্তানিরা কোনাে শিক্ষাই নেয়নি। করাচিতে এখন বিহারিদের প্রতি দেশের সামরিক বাহিনীর যে আগ্রাসী ব্যবহার, তা তাকে একাত্তরের কথাই মনে করিয়ে দেয়। মাহিনকে লেখা এক চিঠিতে জাফর নিজের মনােভাব এইভাবে ব্যক্ত করে :
‘বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে দুবছর হলাে, অথচ এরই মধ্যে আমরা সে
ঘটনা ভুলতে বসেছি। যখন কেউ এনিয়ে কথা বলে, তা হয়ে ওঠে
টুকরাে টুকরাে স্মৃতি, গল্প । ছাদের উপর বসে (ভারতীয়) বিমান হামলা
দেখা, তেল পরিশােধনাগারে ভারতীয় বিমান হামলার ফলে আগুন
আলােহীন শহর। আমরা সবাই একাত্তরের ঘটনা, সে ঘটনা থেকে শিক্ষা না নিয়ে, ভুলতেই অধিক ব্যস্ত। একাত্তরের সেই দগদগে ঘা ভুলবার জন্য আমরা যখন এত ব্যস্ত তখন আমরা ভুলেই যাই যে সে ঘটনাই আমরা ভুলে বসে আছি। কিন্তু সে ক্ষত তাে শুকায় না, ভেতরে ভেতরে তা কুরে কুরে খায়, নতুন এক ঘায়ে পরিণত হয়। এই শহর, যা তুমি আমি উভয়েই ভালােবাসি, তার জন্য সে ক্ষতের কি মানে? আমার চতুর্দিকে এখন যে নীরবতা, তা আমাকে ভীত করে হ্যা, মাহিন, এই দেশ দেখেছে কি (নিষ্ঠুরতায়) সে সক্ষম, কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নেবার জন্য একটু জিরিয়ে নেবার ফুরসত তার নেই। একই চিঠিতে জাফর একাত্তর-পরবর্তী পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবচ্ছেদ সম্পন্ন করে এই ভাবে : ‘পাকিস্তান কি করে আমাদের স্বপ্নের পাকিস্তান থাকবে যখন তার পূর্বাংশ, যা তাকে সম্পূর্ণতা দিয়েছিল, তা আর আমাদের অঙ্গীভূত নয়?
পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল এই বিশ্বাস থেকে যে এর ফলে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে। কিন্তু সেই পাকিস্তান আর কি করে টিকে থাকে যখন তার এই উদ্দেশ্য আমরা নিজেরাই উপড়ে ফেলেছি। প্রথমত, আমরা বাঙালিদের অধিকার সংকুচিত করেছি, তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার বানিয়েছি। দ্বিতীয়ত, বৃহত্তর অধিকার ও প্রতিনিধিত্বের জন্য তাদের দাবিকে আমরা বর্বরতার সাথে গুড়িয়ে দিয়েছি। পাকিস্তান আর সেই পাকিস্তান থাকে কি করে যখন তার বৃহদাংশই ছিটকে পড়েছে, রয়ে গেছে তার খণ্ডাংশ মাত্র? আমাদের উচিত একথা স্বীকার করা যে একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রেই আমাদের স্বপ্নের পাকিস্তানের সমাধি হয়ে গেছে।’ জাফরের এই স্বগতােক্তির সাথে ১৯৭৪ সালে ঢাকায় বেড়াতে এসে কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের মনােভাব তুলনীয়। তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে পাকিস্তানের সরকারি প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে ফয়েজ পাকিস্তানের পূর্বাংশের অনেকের কাছে শ্রদ্ধেয় ছিলেন, অনেকেই। ছিলেন তাঁর নিকট বন্ধু। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পুরােটা সময় এই বিপ্লবী কবির কাছ থেকে আমাদের সংগ্রামের প্রতি কোনাে সংহতির প্রকাশ দেখিনি। ঢাকা থেকে।
ফিরে ফয়েজ বাংলাদেশকে নিয়ে যে তিনটি কবিতা লেখেন, তার কোথাও বাঙালির রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি আদৌ কোনাে সহমর্মিতা নেই। তাঁর সকল দুঃখ, সকল মনস্তাপ নিজের ক্ষতিকে নিয়ে পাকিস্তান এক সময় অখণ্ড ছিল, এখন সে বিভক্ত এবং দুর্বল। এটাই তাঁর মনঃস্তাপের কারণ।
একসময়ের বন্ধু এখন তার প্রতি অমনযােগী, সেকারণে ক্ষেদোক্তি। নব গঠিত পূর্ব পাকিস্তানে এসে তাঁর চোখ ভেসে যায় জলে ও রক্তে। কারণ যারা একসময় বন্ধু ছিল, তারা এখন অপরিচিত তিক্ততা এখন এতই স্পষ্ট যে কান পেতে শুনতে হলাে বন্ধুদেরও রক্ত দিয়ে চোখ ধােয়ার পরামর্শ।’ তার এই মনঃস্তাপ হয়ত অকৃত্রিম, কিন্তু যে বন্ধুরা দুর্বিনীত হায়েনার বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা জিতেছে, তাদের সংগ্রামের প্রতি সহমর্মিতার অভাবের কারণে ফয়েজের মনস্তাপ স্বার্থপর ও উদ্দেশ্য প্রণােদিত বলে বােধ হয়। ফয়েজের তুলনায় জাফরের মনােভাব আমার কাছে অনেক সৎ এবং সেই হেতু নৈতিক মনে হয়েছে। জাফরের মতাে কতজন। পাকিস্তানি আছে আমি জানি না। সেকথা জানতে মন গুরুত্বপূর্ণও নয় কামিলার বয়ানিতে জাফরের বেদনাময় উচ্চারণে যে সংহতির প্রকাশ লক্ষ্য করি, কারাে কারাে কাছে তা বাগাড়ম্বরপূর্ণ ক্ষেদোক্তি বা চালাকি। মনে হতে পারে। একথা বলার কারণ পাকিস্তানের নাগরিক গােষ্ঠী বা তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনােই একাত্তরের নৃশংসতার জন্য ক্ষমা প্রার্থণা করেনি, তাদের কারাে মধ্যেই সেই রক্তযজ্ঞের জন্য কোননা মনঃস্তাপের প্রকাশ দেখিনি তা দেখিনি বলেই জাফরের বয়ানিতে এই ক্ষেদোক্তি আমাদের প্রশ্নের মুখােমুখি করে দেয়। ছিদ্রান্বেষীরা হয়ত বলবেন, লেখক হিসেবে, অথবা স্বদেশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে এই গ্রন্থ লেখা বলেই কামিলা একাত্তর-পরবর্তী একজন পাকিস্তানির মানসিক মানচিত্র আঁকতে নৈতিক কশাঘাতের দহনকেই আশ্রয় করেছেন। হতে পারে, কিন্তু এ কথাও তাে সত্যি, এই গ্রন্থে একাত্তরের খাণ্ডবদাহনের জন্য নৈতিক ব্যর্থতার দায়ভার সামান্য হলেও নিজের কাঁধে তুলে নেবার সাহস দেখিয়েছেন কামিলা। এর ফলে পাকিস্তানের ভেতরে একাত্তর অথবা বাংলাদেশের প্রতি কোনাে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি সূচিত হােক বা না হােক, লেখক হিসেবে কামিলা নিজ দায়িত্বটুকু পালন করেছেন, এমন কথা বললে তা বােধ হয় অতিশয়ােক্তি হবে না।
সূত্র : একাত্তর যেখান থেকে শুরু – হাসান ফেরদৌস, সময় প্রকাশনী,২০১৬