আমাদের বিজয় দিবস : পাকিস্তানিরা কী ভাবে
বিজয় দিবস আমাদের জন্য গভীর আনন্দের ও গর্বের, কিন্তু পাকিস্তানের কাছে তা এক মহাবিপর্যয়, এ হলাে তাদের নাকবা’। একটি পাকিস্তানি ওয়েব পত্রিকায় যােলই ডিসেম্বর উপলক্ষে একটি সংক্ষিপ্ত লেখায় আমি মন্তব্য করেছিলাম, বাঙালির এই বিজয়ের সঙ্গে আপনারা যত দিন সংহতি বােধ না করবেন এবং একাত্তরের গণহত্যায় আপনাদের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না অর্জন করবেন, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে পুরােপুরি সমঝােতা কখনােই অর্জিত হবে না। আমরা দুঃখিত’ বলে শুকনাে মুখে দুই কথা বললেন আর ক্ষমা হয়ে গেল, মােটেই নয়। ক্ষমা যাদের করার কথা, তাদের কাছ থেকে সে ক্ষমা অর্জন করতে হবে। সে লেখায় দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। একদল পাঠকের বক্তব্য ছিল, একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে আমরা কেউ জড়িত ছিলাম না। যে রাজনীতিবিদেরা সেই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের অধিকাংশ আর বেঁচে নেই তাদের জীবদ্দশায়ই পাকিস্তানিরা তাদের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এখন তাদের কৃতকর্মের জন্য কোনাে দায়ভার আমরা কেন বহন করব? অন্য আরেক দল পাঠক স্বীকার করেছিল, একাত্তরের গণহত্যা এক নির্মম ঘটনা। পাকিস্তানি হিসেবে তারা প্রত্যেকে সে গণহত্যা ঠেকাতে না পারার জন্য কমবেশি দায়ী। একাধিক পাঠক ব্যক্তিগত ভাবে ক্ষমা চেয়েছিল। তাদের কেউ কেউ সরাসরি ই-মেইল পাঠিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিল, বন্ধুত্বের অনুরােধও জানিয়েছিল।
একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তান ক্ষমা প্রার্থনা করুক, বাংলাদেশে অনেকেই এমন দাবি তুলে থাকেন। আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারটা তারা প্রায় এক কূটনৈতিক যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে আসে আমি নিজে বাংলাদেশের তরফ থেকে বারবার সে দাবি তােলার কোনাে কারণ দেখি না। যাদের হাতে রক্ত, জামায় রক্ত, বুকের ভেতর রক্ত, ক্ষমা প্রার্থনার দায়ভার তাদের তাদের নিজেদের চৈতন্যের শুদ্ধির জন্যই প্রয়ােজন ক্ষমাপ্রার্থনা। ২০০২ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মােশাররফ ঢাকায় এক সরকারি সফরে এসে একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য মৌখিক দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। সাভার স্মৃতিস্তম্ভে নিজ হাতে লিখেছিলেন, ‘আপনাদের পাকিস্তানি ভাই ও বােনেরা একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য আপনাদের সঙ্গে একাত্মতা বােধ করে। সেই দুর্ভাগ্যজনক সময়ে যে মাত্রাতিরিক্ত ঘটনা ঘটে, তা দুঃখজনক।’ লক্ষ্য করুন, দ্রলোক কোথাও গণহত্যা শব্দটি ব্যবহার করেননি। মানবতার বিরুদ্ধে এমন এক ভয়াবহ অপরাধকে বড় জোর দুর্ভাগ্যজনক ও মাত্রাতিরিক্ত বলে শাক। দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেছেন। খালেদা জিয়া তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তিনি অবশ্য জেনারেল সাহেব ‘সরি’ বললেন, আর তাতেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন সরকারি ভােজসভায় মােশাররফের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, ‘একাত্তরের ঘটনাবলি সম্পর্কে এমন ভােলামেলা বক্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
এই বক্তব্য পুরােনাে ক্ষত মেটাতে সাহায্য করবে। আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাই এবং ভাইয়ের একযােগে কাজ করতে চাই।’ একাত্তরের গণহত্যার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত, এমন পাকিস্তানির অভাব নেই। পাকিস্তানের মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তিনি একাত্তরের পাকিস্তানি সেনা আক্রমণের প্রবল সমালােচক তার বাবা মালিক গােলাম জিলানি পাকিস্তানি সেনা হামলার প্রতিবাদ করায় জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। বিখ্যাত পাকিস্তানি কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ একাত্তরে কোনাে স্পষ্ট প্রতিবাদ না জানালেও পরে এ নিয়ে তার মনস্তাপের কথা লিখেছেন। বাংলাদেশ সৃষ্টির ফলে তাঁর নিজের শরীরের একটি অংশ ছিড়ে গেছে, একাত্তর নিয়ে লেখা তিনটি কবিতায় এমন সন্তাপ বিবৃত করেছেন। মােশাররফের ঢাকা সফরের পর পাকিস্তানের ৫১টি সুশীল সমাজভুক্ত সংগঠন এক যৌথ বিবৃতিতে জানায়, মােশাররফের দুঃখ প্রকাশের ভেতর দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনার অনুভূতি প্রকাশিত হলেও তা যথেষ্ট নয়। পাকিস্তান এখনাে পুরােপুরি ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। ক্ষমা প্রার্থনার দাবি তুলে পরে এক নাগরিক মিছিল বের করা হয়। সে মিছিলের অগ্রভাগে ব্যানারে লেখা ছিল, ‘একাত্তরের গণহত্যার জন্য আমরা তােমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। এদের কারাের আন্তরিকতা নিয়ে আমার কোনাে সন্দেহ নেই।
কিন্তু এ কথাতেও আমার কোনাে সন্দেহ নেই যে একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য তারা আদৌ বােঝে না। তার সঙ্গে তারা কেউই কোনাে রকম সংহতি বােধ করেন নি। একাত্তর কেবল একটি গণহত্যার ঘটনা নয়, এক বিশাল মানব গােষ্ঠীর নিরন্তর মুক্তি আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রকাশ। এ কথাটি তারা আগে যেমন বােঝেননি, এখনাে বােঝেন না। একাত্তরের ওপর যেকোনাে পাকিস্তানির লেখা বই পড়ে দেখুন। একাত্তরের পুরাে ঘটনাটি তাদের চোখে একটি ভারতীয় চক্রান্ত। ভারত আগাগােড়া চেয়েছে পাকিস্তানকে ভাঙতে, তাকে দুর্বল করতে। বাংলাদেশ সৃষ্টির ভেতর দিয়ে সেই চক্রান্তেরই বিজয় হলাে। পাকিস্তানের কোনাে পাঠ্যপুস্তকে আজ পর্যন্ত একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি নেই। গত বছর করাচির ডন পত্রিকায় হুমা ইমতিয়াজ পাকিস্তানি পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস পাঠের বিবরণ দিয়ে লিখেছিলেন, বাংলাদেশের স্কুলে হিন্দু শিক্ষকদের প্রভাবে সে দেশের ছাত্রছাত্রীদের মনে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিরূপ মনােভাবের সৃষ্টি হয়। সেই থেকেই। বাংলাদেশের দাবি অন্যদিকে ভারত আগাগােড়া চেষ্টা করেছে সেখানকার হিন্দুদের স্বার্থ তুলে ধরতে পূর্ব পাকিস্তানে যে এক কোটির মতাে হিন্দুর বাস, তাদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যেই ভারত আওয়ামী লীগের ভারতপন্থী নেতাদের সঙ্গে চক্রান্ত করে দেশটা ভেঙে ফেলে। পাকিস্তানি পাঠ্যপুস্তকের এই যে ন্যারেটিভ, বাম-ডান সব ধরনের পাকিস্তানিই তাতে আমুণ্ডু বিশ্বাসী একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভূমিকায় ক্রুদ্ধ, এমন কোনাে কোনাে বুদ্ধিজীবীর লেখাতে দেখেছি, তারা ভাবেন সমস্যাটি কিছু বিভ্রান্ত রাজনীতিকের ভুলের কারণে সৃষ্ট। দুচারজন আছেন, যাদের বাঙালিদের জন্য কপট ভালােবাসার শেষ নেই। যেমন হাসান জহির, যিনি ষাটের দশকে ও একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে কিছুদিন কাটিয়েছেন। তার ধারণা, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের সৃষ্টি আসলে ১৯৪০ সালে লাহােরে গৃহীত পাকিস্তান প্রস্তাবের প্রকৃত বাস্তবায়ন। ভারতের মাটিতে মুসলমানদের জন্য মুক্ত স্বদেশভূমির নির্মাণ ছিল সে প্রস্তাবের লক্ষ্য। বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে ভারতের মাটিতে দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্রের উদ্ভব সেই স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন।
এই থিসিস মাথায় রেখে ভদ্রলােক তার বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘দি সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান : দি রাইজ অ্যান্ড রিয়ালাইজেশন অব বেঙ্গলি মুসলিম ন্যাশনালিজম’। আরেক নামজাদা বুদ্ধিজীবী আকবর এস আহমদ, একাত্তরের আগে তিনিও বাংলাদেশে কয়েক বছর কাটিয়েছেন জেলা প্রশাসক হিসেবে। সেই যুক্তিতে বাঙালিদের মন-মানসিকতা বিষয়ে তাঁর মহাপাণ্ডিত্য। আকবর আহমদের বিখ্যাত বই, জিন্নাহ, পাকিস্তান অ্যান্ড ইসলামিক আইডেন্টিটি। তাতে দ্রলােক বাঙালিদের একহাত নিয়ে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হামলা গভীর শােকাবহ ঘটনা, কিন্তু আলাদা দেশের দাবি করে বাঙালিরা মােটেই। বুদ্ধিমানের মতাে কাজ করে নি। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের এখন যে অবস্থা, তাতে দেশের মানুষ দেশ ভাঙার জন্য নিজের হাত নিজেই কামড়াচ্ছে। গল্প-উপন্যাসে পাকিস্তান বিভক্ত নিয়ে তেমন লেখা চোখে পড়েনি। যে দুচারটি দেখেছি, তাতে বিহারিদের জন্য কুম্ভিরাই বেশি। একমাত্র যে উপন্যাস পড়েছি ইংরেজি অনুবাদে তার নাম ব্রেকিং লিংকস। রাজিয়া ফাসিহ আহমদের লেখা সে উপন্যাস পড়ে মনে হয়েছে, পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষের মধ্যে যদি আরও বেশি সংখ্যায় বিয়ে-শাদি দেওয়া যেত, তাহলে দেশভাগটা ঠেকানাে যেত। ভদ্র মহিলার উর্বর মস্তিষ্কে এমন এক উদ্ভট কল্পকাহিনি ফাঁদা হয়েছে, যার শুরু বখতিয়ার খিলজির বাংলা আক্রমণ দিয়ে। সে সময় খিলজির সেনাদলের এক তুর্কি সেনা কাসিম বঙ্গদেশ বিজয়ের পর প্রেমে পড়ে মুকুল নামের এক বাঙালি ললনার। তাদের বিয়ে হয়, ছেলেমেয়েও হয়। বঙ্গদেশের আবহাওয়ায় টিকতে না পেরে কাসিম সেখানে স্থায়ীভাবে বসতি না গড়ে পাড়ি জমায় আজকের পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে সে আরেক বিয়ে করে। এই কাসিমের দুই বউয়ের সন্তানসন্ততি দিয়েই পরবর্তী সময়ে ভরে যায় ভারতের পুবে আর পশ্চিমে। এরাই শেষ পর্যন্ত লড়কে নেয় পাকিস্তান। কাসিমের এই সব নাতি-পুতিরা যদি তাদের বড় দাদার উদাহরণ মাথায় রেখে বিয়ে-শাদি করত, তাহলে সব মুশকিলেরই আসান হতাে। হায়, এই গল্প যদি দুই পাকিস্তানের মানুষেরা সময়মতাে জানত, তাহলে কী। আর পাকিস্তান নামের এমন মহান এক দেশ ভেঙে দুই টুকরাে হয়!
সূত্র : একাত্তর যেখান থেকে শুরু – হাসান ফেরদৌস, সময় প্রকাশনী,২০১৬