মুক্তিযুদ্ধ, পরাশক্তি ও জাতিসংঘের ব্যর্থতা
একাত্তরে জাতিসংঘের মহাসচিব ছিলেন তৎকালীন বার্মার উ থান্ট। আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ভিউ ফ্রম দি ইউ এন-এ তিনি খােলামেলাভাবেই স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের সংকট মােকাবিলায় জাতিসংঘ সম্পূর্ণ ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। এই ব্যর্থতার জন্য সব দায়ভার অবশ্য তিনি চাপিয়েছেন একদিকে ভারত ও পাকিস্তানের ওপর, অন্যদিকে বৃহৎ শক্তিগুলাের ওপর । এই সংকটকালের কোনাে পর্যায়েই জাতিসংঘ কোনাে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে সক্ষম হয়নি। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের কাছে আমার আবেদন-নিবেদনে কেউ-ই কর্ণপাত করেনি। দুই কারণে নিরাপত্তা পরিষদ সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে : একদিকে সংকটের কেন্দ্রে অবস্থিত দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের প্রত্যাখ্যান, অন্যদিকে জাতিসংঘ সনদে তাদের ওপর প্রদত্ত দায়িত্ব পালনে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের অক্ষমতা। জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে সংকটের আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতটি উ থান্ট খুব ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করার সুযােগ পান। নীতিপরায়ণ ও নিজের নিরপেক্ষ অবস্থানের প্রতি অবিচল নিষ্ঠার কারণে বাংলাদেশের প্রশ্নে তাঁর ব্যক্তিগত ভূমিকা ছিল অতি-সাবধানি ও সতর্ক। পাকিস্তানি সামরিক হামলার কারণে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছে, এ কথা জানা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হবে, এই ধাণার বশবর্তী হয়ে পাকিস্তান বা ভারত অখুশি হয়, এমন কোনাে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণে তিনি অনাগ্রহী ছিলেন। ইসলামি সম্মেলনের মহাসচিব মালয়েশিয়ার টুংকু আবদুল রহমানের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আপস মধ্যস্থতার একটা গােপন উদ্যোগ নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে কোনাে সমর্থন না পাওয়ায় ও পথে খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি। জাতিসংঘ সনদের ৯৯ নম্বর ধারায় তাকে আন্তর্জাতিক শান্তির প্রতি হুমকি এমন যেকোনাে প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণের অধিকার দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু তিনি সে পথও অনুসরণ করেননি। কারণ, উ থান্টের ব্যাখ্যানুসারে, ভারত ও পাকিস্তান কেউই ব্যাপারটিতে কোনাে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ বরদাশত করত না। বাংলাদেশের প্রশ্নটি একদম গােড়া থেকেই পরাশক্তির ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের চিরাচরিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাে ছিলই, তার সঙ্গে যুক্ত হয় আণবিক ক্লাবের সর্বশেষ সদস্য চীনের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ। ভারত গােড়া থেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানায়। তার এই ঐতিহ্যিক মিত্রটির প্রতি আনুগত্য থেকেই সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরােপীয় ব্লকের অন্যান্য দেশ এই সময় বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায়। সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগাের্নি ছিলেন প্রথম বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি এই গণহত্যার নিন্দা করে ইয়াহিয়ার কাছে বার্তা প্রেরণ করেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রশ্নে যে বিতর্ক হয়, তাতে সােভিয়েত ইউনিয়ন বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দাবির প্রতি স্পষ্ট সমর্থন জানায়। বাংলাদেশ প্রশ্নে এর ঠিক বিপরীত অবস্থান ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের।
সারা পৃথিবীর মানুষ যখন পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছে, তখন বিশ্ব জনমত উপেক্ষা করে এই দুই দেশ সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নেয়। একাত্তরেই এই দুই দেশ নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের এক গােপন উদ্যোগ গ্রহণ করে। মূল লক্ষ্য: চির প্রতিদ্বন্দ্বী সােভিয়েত ইউনিয়নকে কাবু করা। চূড়ান্ত গােপনীয়তায় সে কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার। পাকিস্তানের সামরিক প্রধান ইয়াহিয়া খানের ওপর বর্তায় এই গােপন কূটনৈতিক উদ্যোগে মধ্যস্থতা করার। তিনি কিসিঞ্জারকে ইসলামাবাদ হয়ে গােপনে পিকিং উড়ে যেতে সাহায্য করেন। এই ভূমিকার কারণে ইয়াহিয়া চীন ও আমেরিকার কৃতজ্ঞভাজন হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে ভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের সম্পর্ক ছিল বেশ জটিল। নিক্সন মিসেস গান্ধীকে ব্যক্তিগতভাবে ঘৃণা করতেন। ইন্দিরার উচ্চম্মন্যতার সামনে তিনি ক্ষুদ্র বােধ করতেন। অন্যদিকে কিসিঞ্জার- যার দূতিয়ালিতে চীনের সঙ্গে গােপন সমঝােতা সম্ভব হয়- স্থির নিশ্চিত ছিলেন যে মিসেস গান্ধী পাকিস্তান ভাঙতে ও কাশ্মীর দখল করতে বদ্ধপরিকর।
তেমন কিছু যাতে না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে নিক্সন ও কিসিঞ্জার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় এই গণহত্যা উপেক্ষা করতেও প্রস্তুত ছিলেন। একাত্তরে সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল চীনের ভূমিকা। তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র বলে পরিচিত চীন ১৯৭১-এ বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সমর্থনের বদলে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনের পক্ষাবলম্বন করে মূলত সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সঙ্গে তার আদর্শগত ও ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিপ্রেক্ষিতে। সীমান্ত প্রশ্নে ১৯৬২ সালে এক যুদ্ধের পর ভারত ও চীন একে অন্যের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ১৯৫৪ সালে সােভিয়েত নেতা স্তালিনের মৃত্যুর পর থেকে চীন ও সােভিয়েত ইউনিয়ন ভিন্ন পথ বেছে নেয়। তাদের বৈরী ভাব ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠে। ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেওয়ায় তার বিরােধিতা করা চীনের সরকারি নীতি হয়ে ওঠে। পাকিস্তান আশা করেছিল, চীন তাদের পক্ষ নিয়ে সরাসরি ভারত আক্রমণ করে বসবে। পিকিংয়ে গিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো চীনা নেতাদের সঙ্গে এই প্রশ্নে দেনদরবারও করে আসেন। অবরুদ্ধ ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান। জেনারেল নিয়াজি ইসলামাবাদ থেকে আশ্বাস পেয়েছিলেন, উত্তর দিক থেকে হলদেরা (অর্থাৎ চীনারা) এবং দক্ষিণ দিক থেকে সাদারা (অর্থাৎ মার্কিনরা) আসছে।
নিক্সন ও কিসিঞ্জার চেয়েছিলেন, লােক দেখানাে হলেও পাকিস্তানের পক্ষে চীন ভারতীয় সীমান্তে সেনা মােতায়েন করুক। ভারতের উত্তর সীমান্ত অঞ্চলে চীন কিছু সেনা মােতায়েন করেও ছিল, কিন্তু মস্কো চীন-সােভিয়েত সীমান্তে বড় ধরনের সেনা জমায়েত করলে নিজেদের নিরাপত্তার প্রশ্নে তারা নিজেরাই ভীত হয়ে পড়ে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি উ থান্ট বাঙালি উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে, একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রবল বিতর্কিত হয়ে ওঠেন। তিনি প্রস্তাব করেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ভারত পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর কয়েকটি উদ্বাস্তু সংগ্রহকেন্দ্র নির্মাণ করা হােক। এসব কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকবেন আন্তর্জাতিক বেসামরিক পর্যবেক্ষকেরা। উদ্বাস্তুরা স্বেচ্ছায় ফিরে এলে এই কেন্দ্রে তাদের গ্রহণ করা হবে এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরে এই পরিকল্পনা কিছুটা বদলে উ থান্ট প্রস্তাব রাখেন, কাশ্মীরে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল উত্তেজনা প্রশমনে ভূমিকা রাখছে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর সে রকম কোনাে ব্যবস্থা নেই। এমন ব্যবস্থা করা গেলে তা যুদ্ধ। এড়াতে সাহায্য করবে।
পাকিস্তান উভয় প্রস্তাবেই রাজি, কিন্তু বাধ সাধল ভারত সরকার। মুক্তিবাহিনী তত দিনে সুসংগঠিত হয়ে উঠেছে, পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর ক্রমাগত আক্রমণও চলছে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মােতায়েন করা হলে ভারতের পক্ষে মুক্তিবাহিনীকে কোনাে কার্যকর সাহায্য প্রদান কঠিন হয়ে পড়বে। মহাসচিবের কাছে এক চিঠিতে ভারত স্পষ্ট জানিয়ে দিল, তারা এই ব্যবস্থা মেনে। নেবে না। মুজিবনগর সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল আরও তীব্র। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর। সেদিন। ভারতের বিভিন্ন শহরে পাকিস্তানি বিমানবহর হামলা চালায়। সে খবর জাতিসংঘ সদর দপ্তরে পৌছামাত্রই নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভা বসল। বাংলাদেশ প্রশ্নে। সেটাই ছিল নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম বৈঠক। ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দাবি তােলা হয়, বাংলাদেশের পক্ষে তার বিশেষ দূত বিচারপতি আৰু সায়িদ চৌধুরীকে পরিষদের সামনে বক্তব্যের সুযােগ দেওয়া হােক। ছােট-বড় অনেক দেশ সে প্রস্তাবে শর্ত সাপেক্ষে সমর্থন জানালেও তীব্র বিরােধিতা আসে চীনের কাছ থেকে। চীনের প্রতিবাদের কারণে এ দাবি বাতিল হয়ে যায়। ৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বর- এই সময়ে পরিষদ বাংলাদেশ প্রশ্নে দফায় দফায়। জরুরি বৈঠকে মিলিত হলেও কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয়। দুই পরাশক্তিমার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি তােলে। সােভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের। দাবিসংবলিত সােভিয়েত প্রস্তাবও অগ্রাহ্য হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভেটোর। কারণে। পরিস্থিতি এক নাটকীয় মােড় নেয় ৬ ডিসেম্বর, যেদিন ভারত। বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
নিরাপত্তা পরিষদ কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম, এই বিবেচনা থেকে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি সিয়েরা লিওনের রাষ্ট্রদূত টেইলর কামারার প্রস্তাব অনুসারে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিতর্কটি স্থানান্তরিত হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। | ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সেই বিতর্কে যেসব দেশ অংশ নেয়, তাদের অধিকাংশেরই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভারতের প্রতি সমালােচনাপূর্ণ। মাত্র দুটি আরব | দেশ- সিরিয়া ও লেবানন সে বিতর্কে অংশ নেয়, তারাও ছিল সমালােচনামুখর। ভারতের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং সংকটের ঐতিহাসিক পটভূমি তুলে ধরে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া এই সংকট মিটবে না। বিতর্কের অন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটি দেন চীনের রাষ্ট্রদূত চিয়াও। তিনি বাঙালিদের রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পুরাে সমস্যাটি ভারত ও তার প্রভু সােভিয়েত ইউনিয়নের সৃষ্টি বলে ব্যাখ্যা করেন।
বিতর্ক শেষে বিপুল ভােটাধিক্য যুদ্ধবিরতি এবং ভারত ও পাকিস্তানকে যার যার। সেনা নিজস্ব সীমান্তের ভেতরে ফিরিয়ে আনার দাবি-সংবলিত এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। স্বভাবতই পাকিস্তান এই প্রস্তাবে সমর্থন জানায়, কিন্তু ভারত এই কাগুজে প্রস্তাব বাস্তবায়নে মােটেই আগ্রহী ছিল না। তা ছাড়া তত দিনে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাকিস্তানি বাহিনী, তাদের আত্মসমর্পণ মাত্র কয়েক দিনের ব্যাপার। শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রেসিডেন্ট নিক্সন দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে সরিয়ে সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে প্রেরণের নির্দেশ দেন। এই বহরের অন্তর্ভুক্ত ছিল বিশ্বের বৃহত্তম আণবিক যুদ্ধজাহাজ এন্টারপ্রাইজ। ঠিক একই সময়ে ম্লাদিভস্তক সমুদ্র এলাকা থেকে একটি সােভিয়েত বিমানবিধ্বংসী নৌবহর বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হয়। এর ফলে দুই পরাশক্তির মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু তেমন কোনাে দুর্ঘটনার আগেই শেষ হয়ে যায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। ১২ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাদল ও মুক্তিবাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে এসে পৌছায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরােধে সেদিনই নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক বসল তাতে যােগ দেওয়ার জন্য ইসলামাবাদ থেকে এসে পৌছান পাকিস্তানের নবনিযুক্ত উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। পরিষদের মুখ্য কুশীলব যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সােভিয়েত ইউনিয়ন তখনাে একের পর এক খসড়া প্রস্তাব তুলছে। মতৈক্যের অভাবে তার কোনােটাই গৃহীত হয়নি।
১৫ ডিসেম্বর পরিষদের সামনে এক নাটকীয় ভাষণে ভুট্টো যুদ্ধবিরতির এক প্রস্তাব টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে বেরিয়ে গেলেন। বলে গেলেন, তার দেশ আগুনে পুড়ছে, এখন দেশে ফিরে যাওয়াই সমীচীন। এর দুই দিন পর, ১৬ ডিসেম্বর, ভারত নিরাপত্তা পরিষদকে জানিয়ে দেয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। এরপর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন। তাই ভারত এককভাবে যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করেছে। পরদিন, ১৭ ডিসেম্বর, ইয়াহিয়া খান কোনাে নাটক ছাড়াই সে যুদ্ধবিরতি মেনে নেন। কূটনৈতিক হস্তক্ষেপে নয়, যুদ্ধের মাঠেই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রশ্নে বিতর্কের শেষ হয়। দীর্ঘ নয় মাস সময় পেলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংকটে কার্যকরভাবে হস্তক্ষেপে যে ব্যর্থ হয়, তার এক কারণ বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে অসহযােগিতা। অন্য কারণ, আর সম্ভবত সেটাই আসল কারণ, অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে সৃষ্ট দুর্যোগ-অবস্থা মােকাবিলায় জাতিসংঘের অক্ষমতা।
সূত্র : একাত্তর যেখান থেকে শুরু – হাসান ফেরদৌস, সময় প্রকাশনী,২০১৬