নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা
১ নম্বর সেক্টর
এই সেক্টরের অধীন উদয়পুরে ৩রা নভেম্বর একটা বড় ধরনের সভা হয়। সভায় সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক, সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহফুজ এবং ২ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, মিত্র বাহিনীর কোর কমান্ডার লে. জেনারেল সগত সিং, মেজর। জেনারেল হীরা, ব্রিগেডিয়ার সান্দু, ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং এবং আরাে অনেকে উপস্থিত ছিলেন। সভায় যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলােচনা করা হয়। এই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্যাপ্টেন মাহফুজকে মুহুরি নদীর পূর্ব দিক এবং ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে মুহুরি নদীর পশ্চিম দিকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে ক্যাপ্টেন মাহফুজ ও লে, মনসুর ৬ই নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর ৬টি কোম্পানিসহ অগ্রসর হয়ে সলিয়াদীঘি পর্যন্ত তার প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর ১১ তম পাঞ্জাব। রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ৭ই নভেম্বর ভাের ৫টায় মুক্তিবাহিনীর সলিয়াদীঘি অবস্থানে হামলা চালায়। পাকিস্তানিদের এই আকস্মিক আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে প্লাটুন কমান্ডার হাবিলদার শহীদ হয় এবং বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হয়ে যায়। পরে সেদিনই মুক্তিবাহিনীর একটি দল অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালালে পাকিস্তানি সেনারা ৩০ জনের মৃতদেহ রেখে পালিয়ে যায় ।
বিলােনিয়া আক্রমণ সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক বিলােনিয়া আক্রমণের তারিখ নির্দিষ্ট করেন ৫ই নভেম্বর ।। এ সম্পর্কে তিনি তার বইতে লিখেছেন : “Pakistan’s total strength in Belonia was two Battalion of infantry and milita. One battalion was deployed in the northern half and the other in the southern half. They were well dugin with protective minefield. Any conventional attack would be suicidal and extremely costly in terms of human lives. The plan was to penetrate somewhere through a gap in enemy-defense at night and get welldugin before daylight. The enemy at the northern portion would be isolated and cut off from receiving any supplies or reinforcement. They would thus be forced either to surrender or be gradually annihilated in a few days. The night was dark and cold. It started raining. With that came a strong wind making us shiver to the bones. Biting our lips we moved from East to West through the buldge. Bad weather came as a blessing in disguise.
There were no enemy patrols anywhere nor did the enemy expect an attack that night. The noise of our movement as well as of digging the trenches was covered by the crying of the wind. By next morning all the companies had reached their positions and were well-dugin in the despondence. We were almost frozen. Rains stopped and like a gift from God, a blazing sun came up the sky, manpower was immediately mobilised from nearby refugee camps and villages to carry our defense stores, ammunition, food and other supplies. A 4 mile road had to be made through the hills and the paddy fields to enable our vehicles to move forward. Thousands of people voluntarily worked day and night. On the 3rd day, most of our vehicles could pass through. Response from the civilians was unique: A college professor carried a head-load of C. I, sheets from our bunkers from a distance of 4 miles. Then he literally ran back to bring more. A boy of 6 years burst into tears when he was told that he was too young to carry any load. The reaction of the enemy was slow. At first he took it for another ambush laid by the Muktifouj. A company was sent to cear the area we had occupied. The mistake cost him 29 lives. The rest of them withdrew, leaving the dead behind. Next day, Nov 7, two Sabre jets strafed our defenses for the whole day, only one civilian carrying some C. I. sheets for us. was killed owing to strafing. Surprisingly the enemy did not launch any determined counter attack. It was clear, he was on the defensive. There was no attempt to extricate encircled troops in the northern hall. An interrupted wireless message read like this: :Make your own arrangements to escape from Belonia. A few tried to escape through our defense.
They were killed. The rest were eliminated by Nov 11.” পাকিস্তানি বাহিনী ও মিলিশিয়া সহকারে বিলােনিয়াতে পাকিস্তানিদের সৈন্যদল ছিল দুই ব্যাটালিয়ন। এক ব্যাটালিয়ন উত্তর অর্ধাংশ ও অন্য ব্যাটালিয়ন দক্ষিণ অর্ধাংশে নিয়ােজিত ছিল। আত্মরক্ষামূলক মাইন ফিল্ড সহ তারা ছিল ভালােভাবে পরিখাকৃত । তাই কোনােপ্রকার রীতিসিদ্ধ আক্রমণ হবে আত্মহত্যামূলক এবং মানবজীবন ব্যয়সাপেক্ষ। পরিকল্পনা করা হলাে রাতে শক্র প্রতিরক্ষার কোনাে ফঁাকের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে ভােরের পূর্বেই গভীর পরিখায় আশ্রয় গ্রহণ। উত্তরাংশের শত্রু তাহলে রসদ ও সৈন্য সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। সুতরাং তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে অথবা কয়েক দিনের মধ্যেই ধীরে ধীরে নির্মূল হয়ে যাবে। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা । একটা বড় সৈন্যবহর অগ্রসর হতেই বৃষ্টি শুরু হল । তার সাথে প্রবল বাতাস মিলে আমরা হাড়-কাঁপানাে শীত অনুভব করলাম, ঠোট কামড়ে আমরা শত্রু অবস্থানের ফাকের মধ্য দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেলাম, বৈরী আবহাওয়া আমাদের জন্য ছদ্মবেশি আশীর্বাদে পরিণত হল। শক্রর। পা ছিল কোনাে টহল প্রহরী, না করেছিল তারা ঐ রাতে কোনাে আক্রমণের আশংকা । আমাদের চলাচল বা পরিখা খননের শব্দ বাতাসের শব্দে ডুবে। গিয়েছিল। ভাের পর্যন্ত আমাদের সেনা বহরের সবগুলাে কোম্পানি নিজ নিজ গন্তব্যে পৌছে পরিখা খনন পূর্বক তাদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করে ফেলেছিল।
শীতে আমাদের প্রায় জমে যাবার অবস্থা। বৃষ্টি বন্ধ হবার পর আল্লাহর আশীবাদস্বরূপ আকাশে উজ্জ্বল সূর্য দেখা দিল। তার ক্ষণিক বাদেই নিকটবর্তী শরণার্থী শিবির ও গ্রাম থেকে আমাদের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, গােলাবারুদ, খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যাদি বহন করবার জন্য লােকবল নিয়ােগ করা হয়। পাহাড় কি ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে তৈরি ৪ মাইল লম্বা রাস্তা আমাদের গাড়িগুলাে অগ্রবর্তী স্থানে নিয়ে আসতে সাহায্য করে। হাজার হাজার লােক স্বেচ্ছায় দিবারাত কাজ করেছে। তৃতীয় দিনে আমাদের প্রায় সবগুলাে গাড়িই পৌছে যায়। বেসামরিক লােকদের সহযােগিতা ছিল অপূর্ব। কলেজের একজন প্রফেসর আমাদের ৪ মাইল দূরের বাংকার থেকে টিনের বোঝা মাথায় বহন করে নিয়ে আসে। তারপর আরও আনবার জন্য দৌড়ে ফিরে যায়। ৬ বছরের একটা শিশুকে যখন বলা হলাে যে সে কিছু বহন করতে পারবে না, তখন সে কেঁদে দেয়। শক্রর প্রতিক্রিয়া ছিল শ্লথ প্রথমে সে এটাকে মুক্তিফৌজ কর্তৃক তৈরি আরেকটি এমবুশ হিসেবে মনে করে। আমাদের অধিকৃত এলাকা মুক্ত করবার জন্য তাহ তারা এক কোম্পানি সৈন্য প্রেরণ করে। তাদের এই ভুলের মাশুল ছিল ২৯টি জীবন। বাকীরা লাশ ফেলেই পশ্চাদপসরণ করে। পরদিন ৭ নভেম্বর সারা দিনই ২টা স্যাবর জেট আমাদের উপর গােলাবর্ষণ করতে থাকে। এই গােলাবর্ষণে
আমাদের জন্য টিনের বােঝা বহনকারী একজন মাত্র বেসামরিক ব্যক্তি শহীদ হয় ।
——–
* Major Raflqul Islam. A Tale of Millions, page 215:216.
অবাক ব্যাপার যে শক্র সুদৃঢ় কোনাে প্রতিআক্রমণ চালায়নি। এটা পরিষ্কার দেখা যায় যে তাদের ভূমিকা প্রতিরক্ষামূলক। উত্তরাংশের ঘেরাওকৃত সৈন্যদের মুক্ত করার জন্য তারা কোনাে ব্যবস্থাই নেয়নি। শক্রর অয়্যারলেস থেকে ধারণ কৃত বেতার ‘সংবাদ ছিল-বিলােনিয়া থেকে পলায়নের ব্যবস্থা নিজেরাই কর।’ কিছু সৈন্য আমাদের প্রতিরক্ষার মধ্য দিয়ে পালাতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাকীদের নভেম্বরের ১১ তারিখের মধ্যেই নির্মূল করা হয়।
সূত্রঃ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী