You dont have javascript enabled! Please enable it! মুজিবনগর প্রতিরক্ষা - বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস - সংগ্রামের নোটবুক
মুজিবনগর প্রতিরক্ষা
পূর্বেই বলা হয়েছে লালবাজার সাব-সেক্টরের অধীন মুজিবনগরে ৪৫ জন মুক্তিযােদ্ধার এক পাটুন সহকারে নায়েব সুবেদার আবদুল মতিন পাটোয়ারি অবস্থান করছিলেন। ঐ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাটি ছিল মেহেরপুর। মুজিবনগর সম্বন্ধে তাদের ছিল ব্যাপক কৌতূহল। তাই মুজিবনগর দখল করার জন্য তারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা শুরু করে। ৩রা জুন বিকেল ৪টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর এক ব্যাটালিয়ন তাদের কিছু সংখ্যক সৈন্য বাগুয়ান নামক স্থানে মূল ডিফেন্স (প্রতিরক্ষা) রেখে অবশিষ্টদের নিয়ে মুজিবনগর আম্রকুঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ইনফরমার মারফত নায়েব সুবেদার পাটোয়ারি পাকিস্তানি সেনাদের মুভমেন্টের খবর পূর্বেই জানতে পেরে তার প্লাটুনকে ২ ভাগ করে একটিতে নিজে এবং অপর ভাগে নায়েব সুবেদার তােফাজ্জল হােসেনকে রেখে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। ঐতিহাসিক আম্রকাননের নিকটবর্তী হবার সাথে সাথে মুক্তিবাহিনীর সবগুলাে গান একসঙ্গেই গর্জে ওঠে। পাকিস্তানি সেনারা ছিল খােলা মাঠে। ফলে মুক্তিবাহিনীর গুলিতে বহু পাকিস্তানি সেনা ধরাশায়ী হয়। কিন্তু মুজিবনগর রহস্যকে উদঘাটনের উদ্দেশে পাকিস্তানি বাহিনী মরিয়া হয়ে তীব্র গতিতে অগ্রসর হয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর এই তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনীর টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। নায়েব সুবেদার পাটোয়ারি তৎক্ষনাৎ পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। মুজিবনগরে পাকিস্তানি বাহিনী ঘরদোর জ্বালিয়ে দেয় এবং মুজিবনগর বিজয়ের আনন্দে ইতস্তত ও বিক্ষিপ্তভাবে নৃত্য শুরু করে। নায়েব সুবেদার পাটোয়ারি এমন দুর্যোগেও মনােবল হারালেন না, বরং ঐ পরিস্থিতিকে কাজে লাগাবেন বলে ঠিক করলেন। তার নির্দেশে মুক্তিবাহিনী নিরবে পিছনে এসে একত্রিত হন আম্রকাননের পিছনে অবস্থিত ইক্ষুক্ষেতে। তিনি মুক্তিবাহিনীর ঐ স্বল্পসংখ্যক যােদ্ধাকেই ছড়িয়ে দিলেন বিস্তীর্ণ এলাকায়। তারপর তিনি পাকিস্তানি সামরিক কায়দায় বকণ্ঠে হুকুম করলেন, “আলফা-ব্রভাে রাইট, চার্লি-ডেল্টা লেট, ইকো এহাসে এডভান্স আওর সালে লােকো জিন্দা পাকাড়লে আও!” হুকুমের সাথে সাথেই পরিকল্পনানুযায়ী বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে মুক্তিবাহিনী গুলি চালাতে শুরু করে।
একই সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে গুলি খেয়ে এবং কমান্ডে অমন দৃঢ়তা শুনতে পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা একটু বিচলিত হয়ে পড়ে এবং মুক্তিবাহিনীর ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণ মনে করে ঘেরাও হয়ে যাবার ভয়ে তারা শেষ পর্যন্ত পিছনে সরে যায়। ইক্ষুক্ষেত থেকে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের পরিষ্কারভাবেই দেখছিল। কাজেই তাদের অব্যথ বুলেট পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপকভাবে ধরাশায়ী করে। এই প্রতিরােধ সংঘর্ষে ২৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও ২০ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর কেউ হতাহত হয়নি। মুক্তিযােদ্ধারা পুনরায় তাদের মুজিবনগর ঘাঁটি পুনরুদ্ধার করে। মুক্তিবাহিনীর এই গ্রুপটি ১৪ই জুন মানিকনগর, ২০ ও ২১শে জুন মুজিবনগর বি ও পি ইত্যাদি স্থানেও বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় রাখে। 
এই সেক্টরের গণবাহিনীর তৎপরতাও ছিল উল্লেখযােগ্য। ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলারা সেক্টর এলাকায় দেশের বহু অভ্যন্তরে অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তানি। বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ফেলে। গেরিলা মাে, সারী, মফিজউদ্দিন, রবীন মণ্ডল, বরকত আলী, রওশন আলী, জার্মান আলী, জামাত আলী, প্রমুখ পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন অবস্থানের উপর বহু দূর্ধর্ষ অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের রীতিমত ভীত-সন্ত্রস্ত করে দেয়। মেজর এ, আর, আযম চৌধুরীর সুযােগ্য নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতার মুখে ৩রা আগস্টই পাকিস্তানি বাহিনী মানিকনগর ছেড়ে মােনাখালীতে চলে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিবাহিনী মানিকনগর অধিকার করে মজবুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ২৪শে আগস্ট এক কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা নাটোদা থেকে। মুজিবনগরের দিকে অগ্রসর হয়। মেজর আযম চৌধুরী এখবর পেলেন। তার নির্দেশে। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক কোম্পানি এসে বাণ্ডয়ান এবং মানিকনগর প্রতিরক্ষা। আরাে মজবুত করে। ২৪শে আগস্ট সকাল ১০টার সময় পাকিস্তানি সেনারা। মুক্তিবাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জে আসার সাথে সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়। আড়াই ঘণ্টা স্থায়ী এই সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনী চরমভাবে মার খেয়ে পেছনে সরে যায়। ৯ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও ১২ জন আহত হয় বলে জানা যায়। মুক্তিবাহিনীর শুধু একজন এল, এম, জি ম্যান গুরুতরভাবে আহত হয়।

সূত্রঃ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী