পাকিস্তান উত্তরকালে মওদুদী
বৃটিশ ভারত বিভাগের পর মওলানা মওদুদী যে পাকিস্তানে চলে আসবেন, তাঁর এরূপ কোন আগাম বাণী আমাদের দৃষ্টিগােচর হয়নি। স্বাধীনতা ঘােষণার প্রাক্কালে ১৯৪৭ সালের জুন মাসে তরজমানুল কোরআনের যে সংখ্যাটি বের হয়, সেটাই ছিলাে বৃটিশ ভারতে সাময়িকীটির শেষ সংস্করণ। আর এ সময় পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক ঘােষণা বাকি ছিলাে। ভারত যে বিভক্ত করে দেয়া হচ্ছে, একথা সবাই জানতাে। তরজমানুল কোরআনের উক্ত সংস্করণে মওলানা লিখেছেন, “আমি অধিকাংশ সময় আপনাদের একথা বলে আসছি, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি করা যেরূপ সম্ভব, অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায়ও প্রায় অনুরূপ সম্ভব। আমার একথাকে অনেকে কল্পনাতুর মানুষের স্বপ্ন মনে করেছে এবং কেউ কেউ ধারণা করে, এটা সুফীবাদের কোনাে রহস্য হবে যা আমাদের বুঝের উর্ধ্বে। মওলানার উল্লিখিত উক্তি থেকে বুঝা যায়, দীর্ঘদিন যাবৎ যে পাকিস্তান ও তার আন্দোলনকারীদের বিরােধিতা করেছিলেন, তাতে তিনি আসতে প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু বিভাগ ঘােষণার পর পরিস্থিতি এমন রূপ পরিগ্রহ করল যে, অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় ইসলামী বিপ্লব আনা দূরে থাক, সেখানে মওলানার জীবনে বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ালাে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মওলানা মওদুদী তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে পূর্ব পাঞ্জাবের পাঠানকোট থেকে লাহােরে চলে আসতে বাধ্য হন। স্বাধীনতা আন্দোলনে চরম বিরােধিতা করার পরও মওলানার কথিত ‘না-পাকিস্তানেই’ তাঁকে আশ্রয় নিতে হলাে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার বিন্দুমাত্রও প্রতিশােধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তখন তাঁর প্রতি সহানুভূতিসুলভ ব্যবহারই করা হয়েছিলাে। সে আমলে পাকিস্তান বেতার থেকে তাঁকে প্রােগ্রাম দেয়া হতাে। এমনকি মওলানার জামাতে ইসলামী গঠনেও কোন প্রকার বিধি-নিষেধ আরােপ করা হয়নি। কিন্তু মওলানা পাকিস্তান সরকারের এই উদার মনােভাবের পুরােপুরি সদ্ব্যবহার করেন। এই সুযােগে তাঁর দলের শক্তি অর্জনের প্রতি মনােযােগ দিলেন। তিনি নবগঠিত পাকিস্তান সরকারের কঠোর সমালােচনা আরম্ভ করলেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে প্রকাশিত তরজমানুল কোরআনের প্রথম পাকিস্তানী সংস্করণের দশটি প্রবন্ধের সাতটি ছিলাে পাকিস্তান বেতারে পরিবেশিত। অবশিষ্ট তিনটি প্রবন্ধের সবগুলােই ছিলাে মুসলিম লীগ সরকার ও তাঁর নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে কঠোর সমালােচনামূলক। তখন সবেমাত্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর সামনে হাজারাে সমস্যা। সরকারী অফিস-আদালতের সংস্থান করা, মুসলিম কর্মচারীর অপ্রতুলতা, সেনাবাহিনী গঠন, হিন্দুস্তানের সাথে অস্থাবর সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা, হিন্দুস্তান থেকে চলে আসা লাখ লাখ অন্নহীন বস্ত্রহীন শরণার্থীর মাথা গুজবার ব্যবস্থা করা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক আরাে বহু সমস্যা—সর্বোপরি অর্থাভাব। এসব কিছুর মােকাবেলা করে পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই ছিলাে তখন এক মহাভাবনার বিষয়। এতকিছু সত্ত্বেও প্রতিটি মহল নিজ নিজ সামর্থ্যানুযায়ী দেশের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছিলাে।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এ সময় মওলানা মওদুদীর ভূমিকা কী ছিলাে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মানুষ যদি দীর্ঘদিন পর্যন্ত কোনাে একটা বিষয় অভিনয় করে সেটা তার স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়। মওলানা মওদুদীর মধ্যেও মানুষ সে সময় এরূপ একটা অশুভ প্রবণতা প্রত্যক্ষ করেছিলাে। সূচনাকাল থেকেই তিনি পাকিস্তান দাবি ও আন্দোলনের বিরােধিতা করেছিলেন। ইংরেজ প্রীতি বা অন্য যেকোন কারণেই হােক না কেন, একথা সত্য যে, উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় রাজনৈতিক দলেরই বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সে সময় সাময়িক স্বার্থের মােহ কিংবা অন্য কোন কারণে এই বিরােধিতাটা তাঁর অভিনয় হয়ে থাকলেও এটা তাঁর স্বভাবে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাে। যার জন্য স্বাধীনতা উত্তরকালে জাতির মনােবল বাড়তে পারে এরূপ কোন ভূমিকা তিনি নিতে পারেননি। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর যে ঘৃণ্য ভূমিকা ছিলাে, সেজন্য তাঁর পাকিস্তানে না আসাই স্বাভাবিক ছিলাে। কিন্তু তিনি নিজেই পাকিস্তানে এসেছিলেন। পাকিস্তানে আসার পর পূর্ব ভূমিকার জন্য তাঁকে যে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, এ বিষয়টা হয়তাে তিনি নিজেও মনােস্থির করে রেখেছিলেন। আসার পর তাঁর এ ধারণা ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হলাে। এখানে তিনি শুধু আশ্রয়ই পেলেন না, অনক সুযােগ-সুবিধাও লাভ করলেন। কিন্তু তাঁর পূর্ব ভূমিকায় খুব একটা পরিবর্তন দেখা গেলাে না। তিনি শরণার্থীদের নানান অসুবিধাকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে পাকিস্তান ও তার নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা আরম্ভ করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “এসব যা কিছুসংঘটিত হয়েছে এগুলাে কি আকস্মিক ঘটনা ছিলাে? যারা বিগত তিরিশ বছর থেকে এদেশের নেতৃত্ব করছে এবং যাদের নেতৃত্বে এ বিপ্লব বাস্তবায়িত হয়েছে, এই বিরাট দাঙ্গার কারণ সম্পর্কিত আলােচনা তারা কথার দ্বারা দূর করার চেষ্টা করছে। এক কবিসুলভ ব্যাখ্যা আমাদের সামনে পেশ করছে যে, খুনখারাবি ও অত্যাচার-নির্যাতনের এই দৃশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়, যার জন্য চিন্তান্বিত হওয়া দরকার। এ তাে একটা স্বাধীন জাতির প্রসব-বেদনা যা এরূপ সময় হয়েই থাকে। সত্যি যদি প্রসব-বেদনাই ছিলাে তবে এটা দুনিয়াকে একটি হিংস্র জন্তু জন্মের শুভ সংবাদ দিচ্ছিলাে—মানুষ জন্মের নয়। আর এজন্যই বিগত বেদনাদায়ক ঘটনাবলীর কারণ। আলােচনাকে কথার মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কেননা, যারা বিগত একচতুর্থ শতাব্দী যাবৎ আমাদের দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব করেছে, এসব আলােচনা তাদের মুখ কলংকিত করে ফেলবে।”১” পাক-ভারতের স্বাধীনতার সময় লাখ লাখ মানুষের নির্মম হত্যা, তাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন, শেষ পর্যন্ত অগণ্য হিন্দু-মুসলমানের ভারত ও পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়া দেখে জাতি যাতে ভেঙ্গে না পড়ে এবং যারা নিজেদের ঘর-বাড়ি বিষয়-সম্পদ ছেড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে তারা যাতে ঘাবড়ে না যায় সেজন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ একাধিক ভাষণ , দিয়েছেন। এসব ভাষণে তাঁরা বলেছেন, যা কিছু হয়েছে বা হচ্ছে তা আকস্মিক ও সাময়িক ব্যাপার এবং এগুলাে অস্বাভাবিকও কিছু নয়। এজন্য ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। সাহস ও ধৈর্য সহকারে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু নেতৃবৃন্দের এসব অভয়বাণী। মওলানা মওদুদীর পছন্দ হয়নি। উল্লিখিত উদ্ধৃতিতে তিনি এই অভিমতই ব্যক্ত করেছেন। যে, এসব আকস্মিক বা স্বাভাবিক কিছু নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন ক্রটিপূর্ণ নেতৃত্বের জন্যই উপমহাদেশের অধিবাসীরা এ ধরনের নিদারুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। এমনকি নেতৃবৃন্দ নাকি এসব কিছু ঘটানাের জন্যে সচেষ্ট ছিলেন। মওলানার মত একজন লােক কি করে এরূপ উক্তি করলেন আমাদের ভাবতেও লজ্জা লাগে। আমাদের মনে হয়, সে সময় মওলানা একথাই ভাবছিলেন যে, এদেশবাসী যদি স্বাধীনতা সংগ্রাম না করতাে, ইংরেজ প্রভুরা এখানে বহাল তবিয়তে থাকতাে, তাহলে এগুলাে কিছুই ঘটতাে না। তাতে করে সমগ্র বৃটিশ ভারতে তিনি তাঁর বিশেষ ধ্যান-ধারণা প্রচার করতে পারতেন। ইংরেজ প্রভুরাও তাঁর প্রতি সদয় থাকতাে। সত্যি কি অদ্ভুত ও স্কুল ছিলাে মওলানার চিন্তাশক্তি। (1 আমরা যতটুকু জানি, বিশ্বের এমন কোন দেশ বা জাতি নেই যাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ ধরনের জানমাল কোরবান করা হয়নি। ইন্দোনেশিয়া, আলজিরিয়া প্রভৃতি মুসলিম দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস স্মরণ করুন। তারা কি কম ত্যাগ স্বীকার করেছে? আলজিরিয়ায় প্রতি দশজনে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামে শাহাদত বরণ করেছে। হাল আমলে।
প্যালেস্টাইনীদের ত্যাগ স্বীকারের কথাই ধরা যাক। তাদের তুলনায় উপমহাদেশের অধিবাসীদের ত্যাগ একেবারে অনুল্লেখ্য। ‘3; T. মওলানা আরাে বলেছেন, “একথা স্পষ্ট যে, এ যুগে যারা এখানকার বিভিন্ন জাতির নেতা ও নেতৃত্ব করছে, তারা এর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না….। তারা যদি জেনেশুনে এই খেলা করে থাকে তবে তারা মানবতা ও নিজের জাতির শত্রু। তাদের সঠিক স্থান নেতৃত্বের আসন নয়, আদালতের কাঠগড়া। সেখানে তাদের কর্মাবলীর হিসাবনিকাশ হওয়া উচিত।”২ চিন্তা করুন, মওলানা সে আমলে কিরূপ কঠোর ভাষায় স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃবৃন্দের। অহেতুক সমালােচনা করেছেন। অথচ জামাতে ইসলামী গঠনের এক বছর পর ১৯৪২ সালে তিনিই জনসাধারণের উদ্দেশে বলেছিলেন, “এই বিপ্লবের সংগ্রামে নিজের ধনসম্পদ উৎসর্গ করতে হবে, নিজেদের প্রিয় সময় ব্যয় করতে হবে, নিজের হৃদয়-মন ও শরীরের পুরাে শক্তির সাহায্য নিতে হবে। জেল, নির্বাসন, সম্পত্তি বাজেয়াফতি ও পরিবার-পরিজনদের ধ্বংসের আশংকাও সহ্য করতে হবে এবং দরকার হলে জীবনও দিতে হবে। এসব পথ অতিক্রম ছাড়া বিশ্বে কখনাে বিপ্লব আসেনি। এখনাে আসতে পারেনা।”৩
এ ছিলাে মওলানা মওদুদীর ১৯৪২ সালের অভিমত। তিনি জামাতে ইসলামীর মাধ্যমে বিপ্লব অনুষ্ঠানের জন্য মুসলমানদের প্রতি এই আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালে এসে পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দকে জনসাধারণ্যে হেয় করার জন্য মােহাজেরদের পরম দরদী সেজে গেলেন। আর তাঁর সেসব উক্তি বেমালুম ভুলে গেলেন। আসলে কথা হলাে কি, পাকিস্তান-উত্তরকালে কথার ফুলঝুড়ি দিয়ে তিনি নিজের স্থান করে নেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তাতে করে স্বাধীনতা সংগ্রামবিরােধী মওলানা প্রচারের ডামাডােলে নিজেকে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এই নীতি গ্রহণের ফলে আর যাই হােক তিনি তাঁর ‘আমিরিয়ত ও জামাতে ইসলামীকে ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নতুবা পাকিস্তানে মুসলিম লীগ বিরােধী ‘খাকসার’, আহরার প্রবৃতি রাজনৈতিক দলের যে পরিণাম ঘটেছিলাে, জামাতে ইসলামীর ভাগ্যেও তার ব্যতিক্রম হতাে না। » প্রাক-স্বাধীনতা আমলে মওলানা মওদুদী পাকিস্তান আন্দোলনের বিরােধিতা প্রসঙ্গে প্রায়ই বলতেন, “যদি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়, তবে তা হবে একটা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সুতরাং মুসলিম হিসেবে এর সমর্থন করার কোনাে যৌক্তিকতা নেই। এমনকি তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হতাে, অমুসলিম ধর্মনিরপেক্ষ আর মুসলিম ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মধ্যে কোন্টা অধিক সমর্থনযােগ্য। তিনি পরিষ্কার জওয়াব দিতেন, “খােদার নিকট মুসলিম ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র অধিক অভিশপ্ত।” পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বদিনটি পর্যন্ত তাঁর এই শ্লোগানের পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীনতা ঘােষণার একেবারে পূর্ব মুহূর্তে ১৯৪৬ সালে তরজমানুল কোরআনের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় মওলানা বলেছেন, “আহম্মকের স্বর্গে বসবাসকারীরা স্বপ্নে যত সবুজ বাগানই দেখুক না কেন, কিন্তু স্বাধীন পাকিস্তান (যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ও) নিশ্চয়ই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে। তাতে অমুসলিমরা মুসলমানদের সমঅধিকারী হবে। পাকিস্তানে তাদের সংখ্যা ও প্রতিনিধিত্বশক্তি এতাে নগণ্য ও দুর্বল হবে না যে, ইসলামী শরিয়তকে রাষ্ট্রের আইন এবং কোরআনকে এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির গঠনতন্ত্র বানানাে যাবে।
হিন্দু-ভারতের হাতে ক্ষমতা গেলে মুসলমানরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বলে তিনি সে যুগে কংগ্রেস সমর্থক মুসলিম নেতৃবর্গকে গালিগালাজ করতেন। এদিকে পাকিস্তানের অবস্থা। কিরূপ হবে, তাও তিনি উপরােক্ত উদ্ধৃতিতে পরিষ্কার ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তিনি কি করতে চেয়েছিলেন? আসলে ইংরেজরা এদেশে থাকলে তিন সবচাইতে বেশি খুশি হতেন। তাতে করে ইংরেজের অনুগ্রহ ও আনুকূল্যে তিনি এদেশে তাঁর বিশেষ ইসলাম প্রচার করতে সক্ষম হতেন। কিন্তু উপমহাদেশের কেউই তা বুঝলাে না, শুনলাে না। বৃটিশ আমলে এভাবেই মওলানা তাঁর বিশেষ ইসলাম প্রচারের ছদ্মাবরণে স্বাধীনতা আন্দোলন ও নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে তাঁর সুর অন্য ধারায় প্রবাহিত হলাে। অবশ্য স্বার্থসিদ্ধির প্রচারণার অস্ত্র হিসেবে তাঁর বিশেষ ইসলামই রইলাে। তিনি পাকিস্তানী জনসাধারণের উদ্দেশে বলতে আরম্ভ করলেন, “আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পাকিস্তান সংগ্রামকালে আপনাদের বুঝান হয়েছিলাে, পাকিস্তান। প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য এমন একটি রাষ্ট্র কায়েম করা যার শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হবে খােদার পাক কিতাব এবং আল্লাহর রাসুলের (সঃ) সুন্নত বা কর্মধারা। তাতে সকল মুসলমান ইসলামী বিধান মােতাবেক জীবন যাপন করতে পারবে। সে সময় নেতৃবৃন্দের মনে যাই থাকুক না। কেন অন্তত মুখে তারা প্রতিটি বক্তৃতামঞ্চে এবং প্রতিটি মিম্বরে এ কথাই বলেছিলেন। সাধারণ মুসলমানরা তাঁদের এসব প্রতিশ্রুতি ও প্রকাশিত ইচ্ছার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে পাকিস্তান আন্দোলনে যােগদান করেছিলাে।”
এ সময় মওলানা মওদুদী তাঁর স্বাধীনতা-পূর্বকালের ব্যাখ্যা-বিবৃতি বেমালুম ভুলে গেলেন। পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে তিনি নতুন করে ফ্রন্ট খুললেন। মওলানা তাঁর তরজমানুল কোরআনের প্রথম পাকিস্তানী সংস্করণে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে আক্রমণ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “….. মুসলমানদের বৃহৎ নেতৃত্বের চাইতে অধিক অযােগ্য ও জাতির জন্য ক্ষতিকর অন্য কোন জিনিস হতে পারে না!…. পুরাে দশ বছর সময় মধ্যে সে নিজের জাতির নৈতিক ও বৈষয়িক সুসংহত শক্তি তৈরি এবং তার মধ্যে নির্ভরযােগ্য চরিত্র গঠন করার কোন চেষ্টা করেনি। .. এবং তার কারণেই পাকিস্তানের ইমারত প্রথম দিন থেকেই ভীষণ টলটলায়মান বুনিয়াদের উপর গড়ে উঠেছে।… উপমহাদের রাজনৈতিক নাটকে সবচাইতে ব্যর্থ ভূমিকা ছিলাে মুসলিম লীগের।…” ১৯৪৮ সালে মওলানা মওদুদী মুসলিম লীগ ও তাঁর নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে এসব উক্তি করেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী সম্পর্কে আমাদের বলার অনেক কিছুই আছে। সেসব কথা এখানে আলােচনার বিষয় নয়। কিন্তু একথা কারাে পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিলাে। মুসলিম লীগের দাবীও ছিলাে ভারত বিভাগ। সুতরাংমওদুদী সাহেবের দাবী অনুযায়ী উপমহাদেশের রাজনীতিতে মুসলিম লীগ যদি চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে থাকে, তাহলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলাে কি করে? সত্যি কথা বলতে কি, মওদুদী সাহেবের অভ্যাসই ছিলাে ইসলামের মুখােশ পরে ভিত্তিহীন ও আজগুবি কথাবার্তা বলা। আর তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে এই অভ্যাসটি ধরে রেখেছে বাংলাদেশের জামাতিরা। সেই একই কায়দায় একই পদ্ধতিতে এরাও পবিত্র ধর্মের নামাবলী পরে এদেশের ধর্মপরায়ণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার তৎপরতায় মেতে উঠেছে। তথাকথিত ভারতীয় আগ্রাসনের ধুয়া তুলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির সমালােচনা করছে। তাতে করে, মওদুদী সাহেবের মত বাংলাদেশে জামাতিরা মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের ধর্ম ও মানবতাবিরােধী জঘন্য তৎপরতা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে।
Source: জামাতের আসল চেহারা–মওলানা আবদুল আউয়াল