You dont have javascript enabled! Please enable it! রাজশাহী- বগুড়া - বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস - সংগ্রামের নোটবুক
রাজশাহী/ বগুড়া
নিজ শক্তি ও শুক্র শক্তির পরিসংখ্যান ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর ৪নং সেক্টর সদর দপ্তরের অবস্থান ছিল রাজশাহী শহরে। এবং সেক্টরাধীন দুটি উইং তথা ৬নং ছিল চাঁপাই নবাবগঞ্জে এবং ৭নং উইং এর অবস্থান ছিল নওগাঁয় । সেক্টর সদরে সেক্টর অধিনায়ক, উপ-অধিনায়ক, এ্যাডজুটেন্ট এবং সুবেদার মেজর এরা সবাই ছিলেন অবাঙালি। সেক্টরের সৈনিক বলতে উইং থেকে এনে নিয়ােজিত ২ প্লাটুন সৈন্য আর একটি সাপাের্ট প্লাটুন, আর ছিল অফিসে। নিয়ােজিত এবং উইং থেকে বিভিন্ন কাজে আগত কিছু সংখ্যক ই.পি, আর সৈন্য। রাজশাহীর উপকণ্ঠে অবাঙালি কলােনি এলাকায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছাওনি বা সেনানিবাস। এই সেনানিবাসে অবস্থান করছিল ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি লে. কর্নেল শাফকাত বেলুচ যিনি হজ্ব করে নিজ দেশে ছুটিতে ছিলেন। ঢাকায় ফিরবার পর ২৫শে মার্চ হেলিকপ্টারে করে তাকে রাজশাহীতে পৌছে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য তাকে বাঙালি নিধনে অসহযােগিতার অপরাধে সেনাবাহিনী থেকে অপসারণ করা হয়েছে বলে জানা যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর তৎপরতা সেক্টর সদরে সে সময় অবস্থানরত সৈনিকদের প্রদত্ত তথ্যানুসারে দেখা যায় যে মার্চ। মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই কোয়ার্টার গার্ড ও অন্যান্য স্থানে বাঙালিদের পরিবর্তে অবাঙালি সৈনিকদের নিয়ােগ করে বাঙালিদের কার্যত নিরস্ত্র অবস্থায় রাখা হয়। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল সেনানিবাস থেকে বের হয়ে শহরে ছড়িয়ে পড়ে এবং সারা রাত রাজশাহী শহর টহল দিতে থাকে। অবশ্য  শেষরাতেই তারা সেনানিবাসে ফিরে যায়। সে রাতে কোনাে অঘটন ঘটেনি। ২৬শে | মার্চ পুলিশ, ছাত্র-জনতা মিলে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড লাগাতে শুরু করে। ই.পি, আর সৈনিকরাও বেসামরিক পােশাকে তাদের সাহায্য করতে থাকে। ঐ দিনই সন্ধ্যায় কয়েকটি পাকিস্তানি সেনা-ভর্তি গাড়ি শহরের পুলিশ লাইনের পাশে গিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। পুলিশ বাহিনীও প্রস্তুত ছিল এবং তারাও পাল্টা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। বিক্ষিপ্তভাবে সারারাত গােলাগুলি চলে। পাকিস্তানি বাহিনী অবশ্য ঐ রাতে আর অগ্রসর না হয়েই সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ ও বাঙালিদের প্রতিরােধ
২৭শে মার্চ সকালে পাকিস্তান বাহিনী অফিসারদের নের্তৃত্বে পূর্ণ সামরিক সম্ভারে সজ্জিত হয়ে শহর টহল দিতে শুরু করে এবং ই.পি. আঁর সেক্টরের বিভিন্ন স্থান ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ লাইনকে সামনে রেখে তাদেরকে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করতেও দেখা যায়। ঘটনাদৃষ্টে পুলিশ লাইনে পুলিশ বাহিনীও আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। উত্তেজনাকে প্রশমিত করার লক্ষ্যে পুলিশের ও সামরিক বাহিনীর উর্ধতন কর্তৃপক্ষ আপােষমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা সেই চুক্তি লঙ্ঘন করে দুপুরে পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। বাধ্য। হয়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক, জেলা এস, পি, ও অন্যান্য উর্ধতন পুলিশ কর্মচারীরা। বেতারে নওগঁার ৭নং ই,পি, আর উইং-এর সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিনের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে। কিন্তু সময়ের স্বল্পতা ও রাস্তার দূরত্বের কারণে ক্যাপ্টেন গিয়াসের পক্ষে রাজশাহীর পুলিশের সাহায্যে ফোর্স প্রেরণ করা সম্ভব। হয়নি। পুলিশের সাথে পাকিস্তানি সেনাদের সংঘর্ষ তিন ঘণ্টা স্থায়ী হয়। সংঘর্ষে বেশ। কিছু পুলিশ হতাহত হয় এবং অবশিষ্টরা নানাস্থানে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ লাইন পাকিস্তানি বাহিনীর করতলগত হয় ।
২৭শে মার্চ সন্ধ্যার পর ই.পি, আর সেক্টর সদরের অবাঙালি সৈনিকরা তাদের বিছানাপত্র সহকারে সেনানিবাসে চলে যায়। যাবার সময় তারা অস্ত্রাগার থেকে কিছু অস্ত্রও নিয়ে যায়। তাদের অনুপস্থিতিতে বাঙালি ই.পি.আর সৈনিকরা নায়েব সুবেদার আমিরুজ্জামানের নের্তৃত্বে অস্ত্রাগার ভেঙে অবশিষ্ট অস্ত্র ও গােলা বারুদ হস্তগত করে। এমনি সময়ে সেক্টরের অবাঙালি সুবেদার মেজর তার দলবল সহকারে সেক্টর সদরে এসে দূর থেকেই বাঙালিদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। বাঙালিরা পাল্টা কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ঐ তারিখেই পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী বেতারকেন্দ্র ও সেক্টরসদর এলাকা অধিকার করে নেয়। ২৯শে মার্চ পাবনা থেকে ২৫তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের প্রায় এক কোম্পানি সৈন্য মেজর আসলাম ও ক্যাপ্টেন ইসহাকের নের্তৃত্বে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। গােপালপুর নামক স্থানে এসে তারা মুক্তিযােদ্ধাদের মুখােমুখি হয়ে পড়ে। সারদা থেকে আগত ক্যাপ্টেন রশিদের বাহিনী এবং নওগাঁ থেকে অগ্রসরমান কিছুসংখ্যক ই,পি, আর সৈনিক তখন গােপালপুরে একত্রিত হয়েছিল। তারা সর্বশক্তি দিয়ে পাকিস্তানিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধাদের এই আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী দারুণভাবে মার খায়। মেজর আসলাম ও ক্যাপ্টেন ইসহাক সহ প্রায় ৪০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে মুক্তিযােদ্ধাদের ১২জন শহীদ হয়। পাকিস্তানিরা বিচ্ছিন্নভাবে পালিয়ে যায় !

সূত্রঃ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী