You dont have javascript enabled! Please enable it! জামাতের আসল চেহারা (ধারাবাহিক পর্ব) - সংগ্রামের নোটবুক

জামাতের আসল চেহারা (ধারাবাহিক পর্ব)

 

মওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর হেজবুল্লাহপার্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটির নাম দিয়েছেন রােগ ও প্রতিকার’ (আদ্দাউ ওয়াদ্দাওয়াউ)। মওলানা মওদুদী একটি সত্যবাদী দলের প্রয়ােজনশীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। মওলানা আজাদের লেখাটি সর্বপ্রথম ১৯১২ সালে আল-হেলালে বের হয়। মওলানা মওদুদীর প্রবন্ধটি তরজমানুল কোরআনে বের হয় ১৯৪১ সালে। মওলানা আজাদের প্রবন্ধে তাঁর কংগ্রেসে যােগদানপূর্বকালীন রাজনৈতিক চিন্তাধারা চমৎকার আলােচিত হয়েছে। মওলানা মওদুদীও তাঁর প্রবন্ধে অনুরূপ আলােচনা করেছেন। প্রবন্ধ দুটো পড়লে যে কেউ একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন, পরবর্তীকালে লেখা প্রবন্ধটিতে প্রথমটির প্রতিধ্বনি করা হয়েছে।| মওলানা আজাদ তাঁর প্রবন্ধে দীর্ঘ আলােচনার পর বলেছেন, “আজ আমাদের সামনেই আমাদের অধঃপতন উপস্থিতনিজেদের কাফন-দাফনের সামানা আমরা নিজেদের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। বার বার ব্যবস্থাপত্র পরীক্ষা করা ও একাধিক চিকিৎসকের নিকট যাওয়ার এখন আর আমাদের সময় নেই। এখন শুধু আমাদের একটি ব্যবস্থাপত্র ও একজন ডাক্তারেরই প্রয়ােজন। ••••সুতরাং এখন ইসলামকে আর একবার তার সেই কর্তব্য পালনের সময় এসে গেছে যা সে একবার সম্পাদন করেছিলাে। মুসলমানকে তাদের সংশােধন নিজের জন্যই নয়, বরং অন্যদের জন্যও করতে হবে। তাতে করে তাদের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব সংশােধিত হবে।••••.” 

মওলানা মওদুদী তাঁর একটি সত্যবাদী দলের প্রয়ােজন” শীর্ষক প্রবন্ধের একস্থানে লিখেছেন, “একথা ন্যায়তঃই বলা যায় যে মানবতার ভবিষ্যৎ এখন ইসলামের উপর নির্ভরশীল। মানুষের গড় চিন্তাধারা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তাদের কারাের জন্যই সফলতার কোনাে সুযােগ নেই। পুনরায় কোনাে চিন্তাধারা প্রণয়ন করা এবং তা পরীক্ষার  উপর নিজেদের ভাগ্য জড়িত করার মত ধৈর্যটুকু এখন মানুষের মধ্যে নেই। এমতাবস্থায় কেবলমাত্র ইসলামই এমন এক আদর্শ যা থেকে মানুষ কল্যাণের আশা-ভরসা করতে পারে।••••• মওলানা আজাদ ও মওদুদীর উল্লিখিত প্রবন্ধ দুটোর উদ্ধৃত অংশ থেকে একথা স্বভাবতই প্রতিভাত হয় যে, দ্বিতীয়টি প্রথমটির অনুসরণে লেখা হয়েছে। মূলত গােটা প্রবন্ধ দুটোই এ ধরনের। শব্দগত পার্থক্য যতই করা হােক না কেন, এর দ্বারা ভাবের অভিন্নতা কিছুতেই ধামাচাপা দেয়া যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, মওলানা আজাদ ১৯১২ সাল থেকে প্রথম মহাযুদ্ধের শেষ নাগাদ অর্থাৎ কংগ্রেসে যােগদানের পূর্ব পর্যন্ত হেজবুল্লাহ বা আল্লাহর দল সম্পর্কে যে ধরনের কথাবার্তা বলেছেন, ‘আল-হেলালআল-বালাগপত্রিকার মাধ্যেমে যেরূপ প্রচার অভিযান চালিয়েছেন, মওলানা মওদুদী তাঁর বড় বিশেষ কিছু বাদ দেননি। মওলানা মওদুদীর সত্যবাদী জামায়াতের পরিকল্পনা হেজবুলাহর প্রতিচ্ছবি বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। 

উপর নিজেদের ভাগ্য জড়িত করার মত ধৈর্যটুকু এখন মানুষের মধ্যে নেই। এমতাবস্থায় কেবলমাত্র ইসলামই এমন এক আদর্শ যা থেকে মানুষ কল্যাণের আশা-ভরসা করতে পারে।••••• মওলানা আজাদ ও মওদুদীর উল্লিখিত প্রবন্ধ দুটোর উদ্ধৃত অংশ থেকে একথা স্বভাবতই প্রতিভাত হয় যে, দ্বিতীয়টি প্রথমটির অনুসরণে লেখা হয়েছে। মূলত গােটা প্রবন্ধ দুটোই এ ধরনের। শব্দগত পার্থক্য যতই করা হােক না কেন, এর দ্বারা ভাবের অভিন্নতা কিছুতেই ধামাচাপা দেয়া যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, মওলানা আজাদ ১৯১২ সাল থেকে প্রথম মহাযুদ্ধের শেষ নাগাদ অর্থাৎকংগ্রেসে যােগদানের পূর্ব পর্যন্ত হেজবুল্লাহ বা আল্লাহর দল সম্পর্কে যে ধরনের কথাবার্তা বলেছেন, ‘আল-হেলালআল-বালাগপত্রিকার মাধ্যেমে যেরূপ প্রচার অভিযান চালিয়েছেন, মওলানা মওদুদী তাঁর বড় বিশেষ কিছু বাদ দেননি। মওলানা মওদুদীর সত্যবাদী জামায়াতের পরিকল্পনা হেজবুলাহর প্রতিচ্ছবি বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। 

এ ধরনের সাযুজ্য আমরা শেখ হাসান বান্না ও মওলানা মওদুদীর মধ্যেও দেখতে পাই। শেখ হাসান বান্না ছিলেন মিসরে ইসলামিক ভ্রাতৃসংঘের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে বান্না তাঁর ইসমাইলিয়াস্থ বাসভবনে মাত্র ছজন অনুসারী নিয়ে সর্বপ্রথম এই পার্টি গঠন করেন। শেখ বান্নার পার্টির গঠনপদ্ধতি, এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতির সাথে মওলানা মওদুদীর জামাতের গঠন-পদ্ধতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলনা করলে প্রায় একরূপ বলে মনে হয়। অথচ উভয়ের মধ্যে সময়েরও বেশ ব্যবধান রয়েছে। * শেখ হাসান বান্না তাঁর পার্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, “ইসলামিক ভ্রাতৃসংঘের চিন্তা, উদ্দেশ্য ও উপায় সবই ইসলামিক, কেবলমাত্র ইসলামিক । ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুর সাথে এর বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই।”  মওলানা মওদুদী তাঁর দল জামাতে ইসলামী গঠনের পর প্রথম ভাষণে বলেছেন, “আমরা খাটি এবং আসল ইসলাম নিয়ে যাত্রা করছি। পুরােপুরি ইসলামই আমাদের আন্দোলন।” |শেখ হাসান বান্না ১৯৩৮ সালে পার্টির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেছেন, “•••• বস্তুত বিশ্বাস, ইবাদত, ওয়াতন, বংশ বা জাতি, ধর্ম, সরকার, অধ্যাত্ম, তরবারিএ সবকিছুই ইসলাম। •••• ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের আওয়াজ হলাে, মর্তের যেকোন অংশে একজন মুসলমানও লা। ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহবলিয়ে থাকবে, সেটা তাদের ওয়াতন।••••• ইসলামের রাজনৈতিক বিশ্বজনীনতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মওলানা মওদুদীও এ কথারই প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, “ইসলাম যেমন বিশ্বাস ও ইবাদত তেমনি দেশ ও জাতিও। সে মানুষের মধ্যকার অন্য সব পার্থক্য ও সম্পর্ক মিটিয়ে দিয়েছে। ••••ইসলাম ভৌগােলিক সীমা-সরহদ এবং রক্ত ও বংশ বা জাতিগত পার্থক্য স্বীকার করে না, সকল মুসলমানকে এক উম্মত বা জাতি বলে মেনে নেয় এবং সকল ইসলামিক রাষ্ট্রকে এক দেশ হিসেবে গণ্য করে।” শেখ হাসান বান্না তাঁর ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের আন্দোলন তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। মওলানা মওদুদীও তাঁর আন্দোলন অনুরূপ তিন পর্যায়ে ভাগ করেছেন।

শেখ হাসান বান্না তাঁর ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের আন্দোলন তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। মওলানা মওদুদীও তাঁর আন্দোলন অনুরূপ তিন পর্যায়ে ভাগ করেছেন।এ সম্পর্কে হাসান বান্না বলেন, “ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ এরূপ বিশ্বাস পােষণ করে যে, প্রতিটি আহবানের তিনটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। প্রথম : আবেদন পর্যায়। তাতে আহবানের চিন্তাধারা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে পরিচয় করান হয়। অধিকাংশ জনতার নিকট এর আবেদন পৌঁছান হয়। দ্বিতীয় : সংগঠন পর্যায়। এ পর্যায়ে আহবান তাঁর সাহায্যকারী বেছে নেয় এবং মানুষের মধ্য থেকে তার উদ্দেশ্য ও লক্ষের সৈনিক সংগ্রহ করে তাদের সুসংহত করে। তৃতীয় ও শেষ: বাস্তবায়ন পর্যায়। এটি হলাে আহবানের শক্তি অর্জন ও ফলশ্রুতির সময়।•••••”১৯৩৮ সালের ভাষণে শেখ হাসান বান্না তাঁর আন্দোলনের প্রথম দুপর্যায়ের কর্মবিবরণীর বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। তৃতীয় পর্যায় সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “… ইনশা-আল্লাহ আমরা তৃতীয় পর্যায়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করবাে আর এ হবে বাস্তবায়ন পদক্ষেপ।” অনুরূপ রূপরেখা মওলানা মওদূদীও তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে এঁকেছেন। তিনি লিখেছেন,  জামাতে ইসলামী যে আন্দোলন নিয়ে যাত্রা করেছে, গত আঠার বছরে তার দুটি পর্যায় শেষ হয়েছে। এখন তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে। প্রথম পর্যায় ছিলাে নিছক আহবান ও প্রচারের। এ ধারা আনুমানিক নয় বছর পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায় ছিলােসংগঠন ও শিক্ষাদীক্ষার। তাতে আনুমানিক ছবছর অতিবাহিত হয়েছে। তৃতীয় পর্যায় হলাে সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়ন পদক্ষেপ। আর এটা তিন বছর পূর্বে শুরু হয়েছে।৫

শেখ হাসান বান্না আইন পরিষদে একাধিক রাজনৈতিক পার্টির বিরােধিতা করেছেন। মওলানা মওদুদীও এক্ষেত্রে বান্নার অনুসরণ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আইন পরিষদে একাধিক দল গঠন করা শাসনতন্ত্রের মাধমে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। ৬ দেশের পরিষদগুলােতে মহিলাদের সদস্যপদ দানে বিরােধিতার ব্যাপারেও মওলানা মওদুদী শেখ হাসান বান্নার প্রতিধ্বনি করেছেন। শেখ হাসান বান্না ও ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের বইপুস্তক আমাদের দেশে, এমনকি মিসরেও আজকাল বড় বিশেষ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন উপায়ে যতটুকু জানা গেছে, তাতে দেখা যায়, শেখ বান্নার মতাদর্শ ও পার্টির গঠন সম্পর্কিত নানান বিষয়ের অনেক কিছু মওলানা মওদুদীর মধ্যে রয়েছে। মওলানা মওদুদীর জনৈক অনুসারীর উদ্ধৃতিতে দেখা যায়, তিনি মলানাকে একজন উচুদরের লেখক, সাহিত্যিক, ইসলামিক চিন্তাবিদ, সংগঠনবিদ, বিপ্লবী রাজনীতিক ইত্যাকার বলে প্রশংসা করেছেন। তাঁর মধ্যে এসব গুরে কোনটিই যে নেই,এরূপ উক্তি কেউ করবে না। মওলানার মতাদর্শ সম্পর্কে অনেকেরই দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী যাবৎ সুদীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অনেক কিছুই করেছেন, একথা হয়তাে অনেকেই স্বীকার করবেন। তা সত্ত্বেও মওলানার চিন্তাধারার মৌলিকতা এবং প্রকাশভঙ্গির স্বকীয়তা সম্পর্কে আমাদের মনে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাঁর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, তিনি ইসলামের আলােকে নানান বিষয়ের বিচার-বিবেচনা করতে গিয়ে অসংখ্য স্ববিরােধী উক্তি করেছেন। তাঁর লেখা,ধ্যান-ধারণা ও সংগঠন পদ্ধতিতে এমন অনেক কিছু রয়েছে যা হুবহু তাঁর পূর্ববর্তী ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে পাওয়া যায় । একথা আমরা পূর্বেও উল্লেখ করেছি।

অথচ অন্যদের থেকে এসব যে নেয়া হয়েছে তিনি তা এড়িয়ে গেছেন। এ দুটো বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাঁর সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, বিভিন্ন যুগের ইসলামী চিন্তাবিদদের চিন্তাধারা ও মতামতকে নিজের মত করে নিজের ভাষায় প্রকাশ করার প্রবণতার দরুনই মওলানা মওদুদী ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে স্ববিরােধিতার দোষমুক্ত হতে পারেননি। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থসিদ্ধির জন্যও তিনি এধরনের প্রবণতার আশ্রয় নিয়েছেন।  পরবর্তীকালে দেখা গেছে,নিজের এবং তাঁর অনুসারী ও দেশী-বিদেশী কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থরক্ষার জন্যই পবিত্র ইসলামের নামেইসলামের মুখােশ পরে তিনি এসব স্ববিরােধী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তাঁর এসব উদ্ভট ধ্যান-ধারণার বাস্তব রূপ হচ্ছে জামাতে ইসলামী। এ সম্পর্কে সামনের অধ্যায়গুলােতে আরাে বিস্তারিত আলােচনা করা হবে।

Source: জামাতের আসল চেহারা–মওলানা আবদুল আউয়াল