টাইম ম্যাগাজিন, এপ্রিল ১৯, ১৯৭১
কুষ্টিয়ার যুদ্ধ
গত সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানে দুর্বার প্রচণ্ড লড়াইয়ে বাঙ্গালী শহরের অধিবাসি ও কৃষকরা ৮০,০০০ পশ্চিম পাকিস্তানী “হানাদার বাহিনী”কে প্রতিরোধ করেছে। সংবাদে জানা যায় যে, প্রচন্ডভাবে সশস্ত্র পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের হাতে কমপক্ষে ২০০,০০০ বেসামরিক নিহত হয়েছে। কিন্তু সৈন্যরাও রাগাম্বিত কৃষকদের হাতে গুরুতরভাবে হতাহত হয়েছে। এই সৈন্যবাহিনী রাজধানী ঢাকা, গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম ও খুলনা বন্দর এবং অন্যান্য কয়েকটি শহর নিয়ন্ত্রন করছে। কিন্তু প্রাপ্ত খবর অনুয়ায়ী বাংলাদেশ মুক্তি ফৌজ (বেঙ্গল স্টেট লিবারেশন ফোর্সেস) নামক একটি দুর্বার প্রতিরোধ বাহিনী অনেক নগর ও শহর সহ পূর্ব পাকিস্তানের অন্তত এক-তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তান থেকে সব বিদেশী সাংবাদিকদের বহিষ্কার করে বহির্বিশ্ব থেকে যুদ্ধের প্রকৃত তথ্য আড়াল করতে প্রায় পুরোপুরি সফল হয়েছে। কিন্তু গত সপ্তাহে টাইম প্রতিবেদক ড্যান কগিংস ভারত থেকে সীমান্ত পার হয়ে পূর্ব পাকিস্তান যেতে সক্ষম হন, যেখানে তিনি কুষ্টিয়া শহর (লোকসংখ্যাঃ ৩৫,০০০) এর যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করেন। শহরের লোকজন এবং বন্দী পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের সাথে ব্যাপক সাক্ষাৎকারের পর, কগিংস গৃহযুদ্ধের প্রথম পক্ষকাল সময় এ কুষ্টিয়ায় সংঘটিত বর্বরতা এবং সাহসিকতার একটি প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে পেরেছিলেন।
পূর্ণ রিপোর্ট
কুষ্টিয়া, বিস্তৃত গঙ্গা কাছাকাছি চাল-উৎপাদনকারী জেলার একটি শান্ত শহর, ২৫ মার্চ রাতে একটি বিশ্রামহীন ঘুমে কাটল।সতর্কবাণী ছাড়াই, কুষ্টিয়া থানার বাইরে ১৩ টি জীপ আর ট্রাক থেমে যায়।সময় ছিল রাত ১০:৩০ যখন যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ৬০ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত যশোর সেনানিবাসের বেস থেকে ২৭ বেলুচ রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানি এসে পৌঁছায়। কোম্পানির ১৪৭ সদস্য কোনো প্রকার প্রতিরোধ ছাড়াই ৫০০ বাঙালি পুলিশকে দ্রুত নিরস্ত্র করে ফেলে এবং তারপর চারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এর দখল নেয়েঃ জেলা পুলিশ প্রধান কার্যালয়, সরকারি অফিস ভবন, ভি এইচ এফ বেতার ট্রান্সমিটার এবং ছেলেদের জিলা স্কুল। সকাল ৫:৩০ এর আগে ঘুমন্ত শহরের অধিবাসিগণ অধিকাংশই বুঝতে পারেনি কি ঘটেছিল, যখন সৈন্যদের জীপ ক্ষিপ্ত গতিতে খালি রাস্তায় দিয়ে যাচ্ছিল আর ঘোষনা করছিল যে কারফিউ ৩০ মিনিট পর থেকে শুরু হবে।
কারফিউ বলবৎকালীন সময় কুষ্টিয়া ৪৮ ঘন্টার জন্য শান্ত ছিল, যদিও সাতজন-বেশিরভাগই কৃষক যারা শহরে এসেছিল, কি ঘটেছিল ঐ বিষয়ে অজ্ঞাত ছিল, রাস্তায় দেখামাত্র গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কারফিউ ২৮ মার্চ সকালে প্রত্যাহার করা হয় এবং শহরের লোকজন দ্রুততার সাথে প্রতিরোধ করার জন্য সংগঠিত হতে শুরু করেছে ।
সেই রাতে, সৈন্যদের সামনে ৫৩ জন পূর্ব পাকিস্তানী পুলিশ কিছু করতে অক্ষম ছিল। তারপর, তারা সব ৩০৩ এনফিল্ড রাইফেল ও গোলাবারুদ যা বহন করতে পারে তা নিয়ে নিকটবর্তী গ্রামে চলে যায়। পুলিশরা ১০০ জন কলেজ ছাত্র যারা ইতিমধ্যে “বাংলাদেশের” জন্য কাজ করছিলেন ঐ বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। ছাত্ররা স্থানীয় কৃষকদের গেরিলা যুদ্ধের মূলকৌশল শিখাচ্ছিল যাদের হাতে অস্ত্র বলতে শুধুমাত্র হাতুড়ি, খামার সরঞ্জাম ও বাঁশের লাঠি ছিল। দুই দিনের মধ্যে, পুলিশ ও শিক্ষার্থীরা কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবক ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের যোদ্ধাদের সংগঠিত করেছিল এবং কুষ্টিয়ায় পাঁচ সেনা অবস্থানের উপর যুগপত হামলার জন্য পরিকল্পনা করছিল।
৩১ মার্চ ভোর ৪.৩০ টার সময়, প্রায় ৫০০০ কৃষক ও পুলিশ নিয়ে একটি গঠিত বাহিনী কুষ্টিয়া মুক্ত করার অভিযান শুরু করে। শহরের অধিবাসিগণ হাজার হাজার জনগণ “জয়বাংলা” (বাংলার জয় হোক) বলে রাস্তায় চিৎকার করছিল। দৃশ্যত সৈন্যরা অগ্নিশর্মা হাজার হাজার বাঙালিদের আক্রমনের ভয়ে চিন্তায় ব্যাকুল ছিল। মোহাম্মদ আইয়ুব নায়েক সুবেদার (সিনিয়র সার্জেন্ট) কে আটকের পরে, দুঃখ করে বললেন “আমরা খুবই আশ্চর্য হয়েছি”। “আমরা ভেবেছিলাম বাঙালি সৈন্যরা আকারে আমাদের মতই এক কোম্পানির মত হবে। আমরা জানতাম না যে সবাই আমাদের বিরুদ্ধে ছিল”।
তাৎক্ষনিক মৃত্যু
কুষ্টিয়ায় বাঙ্গালী যোদ্ধারা কোন আত্মঘাতী, জনস্রোতের আক্রমন করেনি, যা তারা কিছু জায়গায় করছিল।কিন্তু রাইফেলের শত শত অবিচলিত অনবরত গোলাবর্ষনে ডেল্টা কোম্পানির সৈন্যদের ওপর এক নিষ্করুণ প্রভাব ফেলেছিল।দুপুরে, সরকারি ভবন এবং জেলা সদর এর পতন ঘটে।পরের দিন ভোর হওয়ার অল্পক্ষণ আগেই, প্রায় ৭৫ জন সৈন্য তাদের জীপ ও ট্রাকের জন্য রাস্তা তৈরি এবং দূর পর্যন্ত প্রবল গোলাবর্ষন করতে থাকে। দুটি জিপ জনতার আক্রমন এর মুখে অবরুদ্ধ হয়ে পরে। ঘটনাস্থলেই পূর্ব পাকিস্তানিরা ডজন খানেক সৈন্যকে টেনে বের করে আনে এবং তাদের জবাই করে।
অন্যান্য গাড়িগুলো কালো টন শহরের বাইরে রাস্তাজুরে ফেলে রাখা গাছের ব্যারিকেড এবং খনন করে রাখা ৪ ফুটের পরিখাতে আটকা পরেছিল।সৈন্যরা কৃষকদের দ্বারা পরাজিত ও কুপিয়ে হত্যা করার আগে প্রায় ৫০ জন বাঙালিকে গুলি করে। কয়েকজন সৈন্য পালিয়ে গেলেও পরে বন্দী করে হত্যা করা হয়।
পরের দিন ভোর হওয়ার আগেই ,কুষ্টিয়ায় ১৩ জন সৈন্য রেডিও ভবন ছেড়ে পালায় এবং ১৪ মাইল পায়ে হেটে পাড়ি দেবার পর দুজন বাঙালি যোদ্ধা তাদের আটক করে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে কুষ্টিয়া জেলা কারাগারে ফেরত আনা হয়। জানা মতে তারা ডেল্টা কোম্পানির ১৪৭ জনের মধ্যে বেঁচে যাওয়া ১৩ জন। নিহত পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যে নাসিম ওয়াকার ছিল, ২৯ বছর বয়সী একজন পাঞ্জাবি যাকে গত জানুয়ারিতে কুষ্টিয়ার সহকারী উপ-কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। যখন একটি উত্তেজিত জনতার স্রোত তার লাশ পায়, তারা এটিকে শহরের রাস্তায় আধ মাইল মত এটি টেনে-হিচঁরে নিয়ে যায়।
স্বল্পমাত্রার প্রতিরোধের চেষ্টা
পরদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুষ্টিয়ায় পাল্টা আক্রমণ করার জন্য যশোর থেকে অন্য পদাতিক কোম্পানি প্রেরণ করে। ঐ নতুন কোম্পানি কুষ্টিয়া থেকে অর্ধেক দূরত্বে বিশাখালি গ্রামে বাংলাদেশী বাহিনীর পাতা ফাঁদ এ আটকা পড়ে। সেনা বহরের নয়টি গাড়ির দুইটি জিপ বাঁশ ও লতাপাতায় আবৃত একটি গভীর গর্তে ঢুকে আটকে যায়। তিয়াত্তর জন সৈন্য ঘটনাস্থলেই নিহত হয় এবং অন্যদের তাড়া করে হত্যা করা হয়।
গত সপ্তাহ জুরে, বাংলাদেশের সবুজ, লাল ও সোনালি পতাকা কুষ্টিয়ায় ছাদে, ট্রাকে এবং এমনকি রিকশায় ও উড়ছিল। এই অঞ্চলে স্থানীয় দলীয় নেতার অধীনে বাঙালি প্রশাসন চলমান ছিল, ডঃ আসহাবুল হক (৫০) একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক যিনি ওয়েবলি-স্কট রিভলবার এবং স্প্যানিশ স্বয়ংক্রিয় গ্রেনেড প্যাকেট করেন। এই সপ্তাহের শেষে, কুষ্টিয়া থেকে কয়েক মাইল দূরে দুইটি সেনা ব্যাটালিয়ন একটি ফাঁড়ি গড়েছে। তারা খবর পেয়েছে, যদিও দুর্বার প্রতিরোধের বিরুদ্ধে সামান্য অগ্রগতিই করতে পেরেছে। এমনকি যদি সৈন্যরা কুষ্টিয়ায় পৌঁছাতে পারেও, শহরের মানুষেরা আবারও যুদ্ধ করতে অনেক বেশী প্রস্তুত ছিল।