নিউ ইয়র্ক টাইমস
এই যুদ্ধে নারকীয় অবস্থা কেবল এক পক্ষেরই
আগরতলা, পূর্ব পাকিস্তান – লোকে বলে, যুদ্ধ নরকের সমান। কিন্তু, সেটা উভয় পক্ষের জন্যই।
পাকিস্তানী সৈন্য ও প্রায় নিরস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানী যোদ্ধাদের মাঝের মাত্র তিন সপ্তাহের পুরোনো এই যুদ্ধের এক মাত্র নরক ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ১০ হাজার সাধারন মানুষের জীবন, যেটি পাকিস্তানী সেনারা সন্ত্রাস ও সীমাহীন নিপিড়নে মাধ্যমে ধ্বংস করেছিল এবং সাথে গুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল বাঙ্গালীদের স্বাধিনতার স্বপ্ন।
বেশির ভাগ বড় শহর নিজেদের আয়ত্তে এসে যাওয়ায়, পাকিস্তানী আর্মি- যার সিংহভাগই পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা দিয়ে গড়া, তাদের অনেকের ভিতরেই পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি জাতিগত ঘৃণা ধারণ করে আছে। এই সেনাবাহিনী এখন আক্রমণ চালাতে শুরু করছে গ্রামের দিকে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই শুরু হবে প্রবল বর্ষা। এই ঘোর বর্ষায় নিয়মিত আর্মি চলাচল খুবই কঠিন, তার আগেই তারা চায় তাদের আয়ত্বের সীমানা আরো কিছুদূর এগিয়ে নিতে।
“তারা এই হাটু-পানিতে ভুল করবে ও মারা যাবে’’, বললেন এক বাঙ্গালী অফিসার। “ গ্রামের নৌকা ব্যবহার করে আমরা তাদের জীবন অসহ্য বানিয়ে দিব।’’
এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের পথে এই যুদ্ধ এগুচ্ছে।
বেশির ভাগ কূটনীতিক ও বিদেশী পর্যবেক্ষকরা ভাবছেন এই যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে বাঙ্গালীরা তাদের থেকে হাজারের বেশী মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানীদের জীবন দূর্বিষহ বানিয়ে তুলবে।
যদি না বিদেশী বানিজ্যিক সাহায্যের কমতি না ঘটে তবে যে শোষনের প্রতিবাদে এই স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু; সেই যুদ্ধে, পশ্চিম পাকিস্তানের কবল হতে নিজের দেশকে উদ্ধার করতে বছরের পর বছর পার হয়ে যাবে এই সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর, এটুকু স্বীকার করতেও বাধ্য হচ্ছেন পর্যবেক্ষকরা।
প্রতেক মূদ্রার যেমন দুটো পিঠ থাকে; তেমনি থাকে প্রত্যেক গল্পের, প্রত্যেক তর্কের, প্রতি সংঘর্ষের! কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে যা কিছু ঘটছে তা দেখার পর, পাকিস্তানী আর্মির এইসকল কার্যক্রমের ন্যাযতা দাবি করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্পষ্ট সব তথ্যপ্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে সেনাবাহিনীকে পাঠানোই হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের সকল নেতা ও রাজনৈতিক মাথাদের মেরে ফেলা ও দেশ অর্থনৈতিক ভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য।
“তারা চায় আমাদের এত নিচে টেনে আনতে যেন আমরা ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হই’’, বলছেন এক বাঙ্গালী যোদ্ধা। “তাদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার মত যেন কেউই না থাকে, তারা সেটা নিশ্চিত করতে চায়’’।
বাঙ্গালী ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, সেনা কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, ডাক্তার, কিংবা যে কোন ব্যক্তি, যাদের মধ্যে নেতৃত্ব দেবার মত এতটুকুও ক্ষমতা আছে, পাকিস্তানী সেনারা তাদেরকে হত্যা করছে
ট্যাঙ্ক, জেট যুদ্ধ বিমান, ভারী কামান, গানবোট যার বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, কম্যুনিস্ট চায়না থেকে পাওয়া, তাই দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীরা নির্বিচারে বাঙ্গালীদের খুন করে চলেছে একের পর এক হামলায় ধ্বংস করছে খাদ্য গুদাম, চা-বাগান, পাট কারখানা, প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্রকে, যাতে করে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া জয়ায়।
অফিসিয়াল রেডিও দিয়ে পাকিস্তান সরকার বারবার দুষছে তাদের পুরোনো শত্রু ভারতকে। তাদের অভিযোগ ভারত যুদ্ধের সব ক্ষেত্রেই সর্বাত্মক ভাবে সাহায্য করছে মুক্তিযোদ্ধাদের; অস্ত্র সরবরাহ, পাকিস্তানী নৌবহরকে আক্রমণ, অস্থায়ী চোরাগোপ্তা এমবুশ, লুকোনো রেডিও স্টেশন প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে তাদের এই গণহত্যার ব্যপারে অনাহূত, অতিরঞ্জিত বার্তা প্রকাশে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে অনুপ্রাণিত করা পর্যন্ত সকল ব্যপারেই।
যদিও ভারত সরকার এসকল অভিযোগই বারবার প্রত্যাখান করেছে, তবুও বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সংবাদমাধ্যম না থাকায়, তারাই বিশ্ব সংবাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
ভারত হয়তোবা মুক্তিযুদ্ধে গোলা-বারুদ পাঠাচ্ছে, তবে এখন পর্যন্ত এমন কোন কিছুই প্রমান করার মত তথ্য পাওয়া যায় নি।
“কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদীর” কাজ বলে এই মুক্তিযুদ্ধকে অভিহিত করে প্রতিদিন খবর জানাচ্ছে রেডিও পাকিস্তান ও নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম। “পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে”, পাটের পুনরায় রপ্তানিও চালু হয়েছে এমন সংবাদও দিচ্ছে। যার সবটাই এক ঢাহা নোংরা জালিয়াতি ছাড়া কিছু নয়।
সিডনি এইচ. শ্যানবার্গ