বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৮ এপ্রিল বুধবার, ৫ই বৈশাখ, ১৩৮০
মূর্খের স্বর্গবাস!
মূর্খ নাকি স্বর্গের স্বপ্ন দেখতে সদা ব্যস্ত থাকে। যা তা স্বপ্ন নয় একবারে অলৌকিক স্বপ্ন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা বর্তমানে অলীক স্বপ্ন দেখতেই ব্যস্ত। ব্যস্ত বলেই ঘটনার পরিণতির কথা না ভেবে এখনো বাংলাদেশকে বা পাকিস্তানের অংশ রূপে চিহ্নিত করে শাসনতন্ত্র রচনার করেছেন। ভুট্টো সাহেব সাত কান্ড রামায়ন পড়ার পর যেন সকাল বেলায় উঠে জিজ্ঞেস করেছেন সীতা কার বাপ ছিলেন? যদি তাই না হবে তাহলে একটা রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কি করে পাকিস্তানি শাসনতন্ত্রে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেছেন এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে উল্লেখ করে তারা (পাকিস্তানি শাসকবর্গ) এখনও বাংলাদেশের প্রতি তাদের বৈরী মনোভাব অব্যাহত রেখেছেন।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতাকে স্বীকার না করে পাকিস্তান উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ও ভারতের যুক্ত উদ্যোগকে নস্যাৎ করে সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলছে।
পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জনাব ভুট্টো ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের উদ্দেশ্যে যে মহৎ নয় তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। ভুট্টো সাহেব গত বছর সিমলা বৈঠক অনুষ্ঠিত হবার আগে বলেছিলেন বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে না নিলে বিশ্বের দরবারে পাকিস্তান ‘একঘরে’ হয়ে যাবে। সেই একই ভুট্টো সাহেব বলেছিলেন, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গৃহীত হবার পরই বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল শাসনতন্ত্র রচিত ও গৃহীত হয়েছে বটে তবে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেয়া দূরে থাকুক বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পাকিস্তানের ভুট্টো সাহেব ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা যে আজকের দিনে পুতুলের মতই অদৃশ্য সুতোর টানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাতে আর আর কারও সন্দেহ নেই। আর তাই পেছন থেকে সুতোর টান পড়লেই একেক সময় একেক রকমের কথা বলে থাকেন।
এ কথা তো বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল। ভুট্টো সাহেব যদি সহজ ও সাদামাটা কথাটা বুঝেও না বোঝার ভান করেন তাহলে তাকে বোঝাবে কে। ভুট্টো সাহেব কে বোঝাতে পারে একমাত্র বাস্তব ঘটনাবলি। যে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে একদিন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল ঠিক একই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে। সে দিন বেশি দূরে নয়। আমরা একথা বিশ্বাস করি যে, মূর্খের স্বর্গবাসের স্বপ্ন একদিন না একদিন ভঙ্গ হবে।
আঞ্চলিকতাকে প্রতিরোধ করতে হবে
কল-কারখানাগুলো দেশের বিভিন্নাঞ্চলের শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ পরিশ্রমের মাধ্যমে চালু থাকে। কিন্তু সেখানে যদি এক অঞ্চলের শ্রমিকদের সঙ্গে অপর অঞ্চলের শ্রমিকদের বিরোধ এবং বিভেদ শুধুমাত্র আঞ্চলিকতার কারণে দিন দিন প্রকটতর রূপে প্রকাশ পায়, তাহলে শ্রমিকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী হানাহানি ও সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বেশ কিছুদিন ধরেই আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে আঞ্চলিকতার নগ্ন প্রকাশের ফলে উদ্ভুত অচলাবস্থা এবং জীবনহানির উদ্বেগজনক খবর পেয়ে আসছি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আব্দুল মালেক উকিল সম্প্রতি ঢাকাস্থ নোয়াখালী সমিতি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, দেশের যেখানেই হোক না কেন আঞ্চলিকতার সমস্ত নগ্ন প্রকাশ কে দমন করতে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। তিনি আরো বলেছেন যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এবং জানমালের কঠিনতম মূল্যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় চারটি মৌলনীতির একটি হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। কাজেই জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কাজ করতে দেয়া হবে না বলেও মন্ত্রী মহোদয় অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সবার মনেই একটি মূলমন্ত্র ছিল যে, আমরা যেকোন জেলা, যে কোন অঞ্চলের বাসিন্দাই হই না কেন, মূলত আমরা সবাই বাঙ্গালী। জাতীয়তাবাদের এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই আমরা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছি এবং বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের বুকে গর্বে শির উন্নত করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু অত্যন্ত বেদনার বিষয় এই যে, স্বাধীনতার পর স্বার্থতাড়িত হয়েই হোক কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই হোক আমরা রাতারাতি জাতীয়তাবাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছি। বিশেষ করে দেশের শ্রমিকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের আদর্শ বহির্ভূত কার্যকলাপের উলঙ্গ বহিঃপ্রকাশ সমগ্র দেশবাসীকে উদ্বেগাকুল করে তুলেছে। দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আঞ্চলিকতাবাদের প্রকট প্রকাশ আমাদের না ভাবিয়া পারে না। এই আঞ্চলিকতা অনেক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার মত উগ্র এবং ভ্রাতৃহন্তা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই আঞ্চলিকতার ধূম্রজাল সৃষ্টিকারীরা জাতীয়তাবাদের আদর্শকে নস্যাৎ করে চলেছে। অথচ আঞ্চলিকতার বিযকে শিল্পাঞ্চল থেকে ঝোটিয়ে বিদেয় করতে না পারলে শ্রমিকদের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কোনক্রমেই সম্ভব হবে না।
আমরা আশা করি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আব্দুল মালেক উকিল আঞ্চলিকতাবাদের নির্মূল করার জন্য যে সরকারই দৃঢ়তা কথা ঘোষণা করেছেন, তা যেকোন মূল্যেই হোক না কেন কার্যে পরিণত করতে হবে। শিল্পাঞ্চলে আঞ্চলিকতাবাদের মূলৎপাটিত না হলে শ্রমিকদের জীবনকে শান্তিময় এবং নির্বিঘ্ন করা যাবে না। এবং শ্রমিক বিভেদের অবসান না হলে কল-কারখানায় উৎপাদন বাড়বে না। অতএব শুধু কথায় কথায় নয়, কার্যকরীভাবে শ্রমিকদের মধ্যে থেকে আঞ্চলিকতার নগ্ন প্রকাশ কঠোর হস্তে প্রতিরোধ করতে হবে।
আমলাতন্ত্রের মৃত্যুঘন্টা
বাংলাদেশ আমলাতন্ত্রের মৃত্যু ঘন্টা বেজে গেছে। সরকারি আমলারা সুদীর্ঘ দিন থেকেই সমাজ এবং প্রশাসনতন্ত্রে দোর্দণ্ড প্রতাপ প্রতিষ্ঠা করে জাঁকিয়ে বসে ছিল। ব্রিটিশ আমলে যেমন উপনিবেশিক পাকিস্তানি আমলেও তেমনি আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরাত্ম্য সমান গতিতে অব্যাহত ছিল। এখনো আছে। বাংলাদেশ একটি রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্মলাভের পর আমাদের প্রশাসনযন্ত্রকে আমলাতন্ত্র অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রেখেছে। ব্রিটিশ গেছে, পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের ও পরাজয় ঘটেছে, এবং বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছে বাংলাদেশের। কিন্তু সরকারি আমলাদের কর্তব্যকর্মে ও মানসিকতায় কোনো পরিবর্তনের ঢেউ জাগেনি। মোদ্দা কথা, আমলাতন্ত্রের হাতবদল হয়েছে মাত্র, জাত বদল হয়নি। আমলারা যেমন ছিলেন তেমনি আছেন।
প্রশাসন ব্যবস্থা কে নিষ্কলুষ করার জন্য গত সাধারণ নির্বাচনের আগের দুর্নীতিপরায়ণ, অসাধু ও পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন আমলাদের অপসারিত করার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। এবং দেশবাসী আশা করেছিল যে, প্রশাসন ব্যবস্থা কে নিষ্কণ্টক করতে হলে আমাদের আমলাতন্ত্রের পুনঃবিন্যাস অত্যাবশ্যক। সরকারও এ ব্যাপারে সুদৃঢ় ও মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন। সম্ভবত এই মনোভাবের পরিচয় আমরা ধীরে ধীরে অবগত হচ্ছি। সম্প্রতি ক্লিনিং বোর্ডের সুপারিশ ক্রমে সরকার চারজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে চাকুরিচ্যুত করেছেন। এদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, পাকিস্তানি আদর্শে বিশ্বাস পোষণ ও আয়ের তুলনায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পত্তি রাখার অভিযোগ আনীত হয়েছে।
হোকনা এরা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, হোকনা ডাকসাইটে আমলা, তাতে কি এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সুস্পষ্ট। তাই এদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করে সরকার সমুচিত শাস্তি প্রদান করেছেন বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
সন্দেহ নেই, প্রশাসনযন্ত্রে বিপুলসংখ্যক দুর্নীতিবাজ আমলার রয়েছে, যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করে না। এবং সরকার যে নীতিতে চলে, সে নীতির ছায়াও তারা মাড়ায় না। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এই সব আমলারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
আমরা চাই প্রশাসনযন্ত্র দুর্নীতি মুক্ত হোক। আমলাদের পুরানো মানসিকতা নিয়ে দিয়ে আর যাই হোক শোষনহীন সোনার বাংলা গড়ে তোলা যাবে না। কাজেই আমরা আশা করি, বঙ্গবন্ধু সরকার দুর্নীতিপরায়ণ আমলাদের নির্মূল করে একটি মজবুত প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করবেন, যেখানে আমলাতন্ত্রের ফাঁসের কোন নগ্ন গন্ধও থাকবে না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক