নিউইয়র্ক টাইমস, ৭ এপ্রিল, ১৯৭১
দেশত্যাগীদের মতে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলছে
- সিডনী এইচ শ্যানবার্গ
একশোরও বেশি বিদেশি উদ্বাস্তু আজকে চট্টগ্রাম থেকে ৩৪ ঘন্টার সমুদ্রযাত্রা করে কলকাতা পৌঁছেছে, সেইসাথে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান এই বন্দর থেকে পাকিস্তানি আর্মির স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার ব্যাপারে সর্বশেষ প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট সংগ্রহ করা গেছে।
ডাচ ছাত্র জন মার্টিনুসেন বলেছে, “এটা একটা অবৈধ হত্যাকান্ড”।
আমেরিকার নিউইয়র্কের নিউ রোচেলের বাসিন্দা নিল ওটুল বলেন, “আমরা আর্মিদেরকে সাধারণ জনগণের উপর গুলি চালাতে দেখেছি। আমি বেশি কিছু বলতে চাইনা কারন তাহলে হয়তো আমাদের সংগঠন প্রতিহিংসার শিকার হতে পারে”। তার সংগঠনের নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেছেন তিনি।
যুদ্ধের কারনে চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে থাকা একটি ব্রিটিশ জাহাজ আজ বিকেলে কলকাতা বন্দরে ১১৯ জন বিদেশি নিয়ে পৌঁছেছে, যেখানে প্রায় ১৭ টি ভিন্ন দেশের মানুষ ছিল। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ছিল ৩৭ জন আমেরিকান এবন ৩৩ জন ব্রিটিশ।
ক্ল্যান ম্যাক নায়ার জাহাজটি থেকে যখন তারা নেমে আসে তখন তাদের সাথে দেখা করতে আসে
তাদের দেশের কূটনৈতিক কর্মকর্তারা এবং কিছু ভারতীয় ও বিদেশি সাংবাদিক।
যদিও কিছু উদ্বাস্তু কথা বলতে নারাজ ছিল তবে বাকিরা পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামের এক ভয়ানক চেহারা তুলে ধরে। এখন পর্যন্ত খুব কমই জানা গেছে যে কিভাবে ৪ লক্ষ জনগণের সেই শহরে যুদ্ধ চলছে।
বিদেশিরা বলে যে, যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের সকল প্রতিরোধ শক্তি শহর থেকে বের করে দেয়।
কিন্তু তারা এও বলেছে যে, আর্মির ক্ষমতা শহরের বাইরে কর্ণফুলী নদীর তীরে ৫ মাইল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
নদীর দক্ষিণে সব ধরণের ক্ষমতা স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেয়া মুক্তিবাহিনীর হাতে যা সাধারণ জনগণ, পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত।
বিদেশিরা বলে যে, গতকাল সকালে যখন তারা কলকাতার উদ্দেশ্যে আসছিল তখনও তারা শহরের আশেপাশে গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছে। তারা বলে যে, শহরের বেশিরভাগ বাসিন্দাই শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলের দিকে পালিয়ে গেছে।
আর্মীরা বস্তি পুড়িয়ে দিয়েছে
বিদেশিরা বলে, ২৬ মার্চ শুক্রবার ভোরের দিকে সহসা যখন শহরে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছিল, তখন আর্মিরা স্বাধীনতাকামী হতদরিদ্রদের বস্তিগুলো পুড়িয়ে দেয়। তারা বলে যে, গতকাল সকালে যখন তাদেরকে মিলিটারি পাহারায় বন্দরে নিয়ে আসা হচ্ছিল, তখনও তারা ওইসব এলাকায় বাঁশের কুঁড়েঘরগুলো থেকে আগুন জ্বলতে দেখেছে।
পাকিস্তান সরকারের পক্ষে কথা বলা, পাকিস্তান রেডিও দাবী করে যে, পূর্ব পাকিস্তান শান্ত আছে এবং জীবনযাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে আছে।
ডেনমার্কের আরহুস ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত মিঃ মার্টিনুসেন তার স্ত্রী কারেনকে সহ পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে পড়াশুনা করতে ৭ মাস আগে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। তিনি বলেন যে, “কোনকিছুই ঠিক নেই এবং কোনকিছুই আর আগের মতো ফিরে আসেনি। তারা পরিকল্পিতভাবে দরিদ্রদের এলাকাগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে কারন তারা হয়তো ভেবেছে তাদেরকে একসাথে সবাইকে খুঁজে বের করা কঠিন হবে। তাদেরকে এই হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ উপভোগ করতে দেখা গেছে”।
২৩ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী জানায়, “অনেক বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। মাত্র ৪ দিন আগেই নদীতে প্রায় ৪০০ মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে”।
মিঃ মার্টিনুসেন যিনি বাংলার রাস্তায়, দোকানে অসংখ্য মানুষকে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছেন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বিজয়ের ব্যাপারে ভবিষ্যৎবাণী করেন, যারা অনেকদিন ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছিল।
স্বাধীনতা আন্দোলন
পাতলা গড়নের এই ছাত্রটি বলে, “অসংখ্য বাঙালি তাদের বাংলাদেশ চায় এবং আমি নিশ্চিত যে তারা এটা পাবেই”।
বাঙালি জাতির জন্য বাংলাদেশ হল বাঙলা। এটা তাদের পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের নাম।
২৬ বছর বয়সী মিঃ ওটুল এর মুখেও একই কথা শোনা যায়। তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম এখন পাকিস্তান আর্মির দখলে। এটা এখন বর্বর নরপশু ও সন্ত্রাসীদের দখলে। আর্মিদের সংখ্যা আরও বেড়েই চলেছে। তারা সাধারণ জনগণের উপর গুলি চালাচ্ছে। আমরা অনেক মৃতদেহ দেখেছি। আমরা লাশের গন্ধ পেয়েছি। তারা সবাইকে অনেক হয়রানি ও মারধর করছিল। বহিরাগতরা নির্বিচারে লুটপাট করছিল এবং আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিল।
প্রতিশোধের রিপোর্ট
“বহিরাগত” বলতে কি বুঝিয়েছেন সেটা খুলে বলেননি মিঃ ওটুল কিন্তু নিঃসন্দেহে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানিদেরকেই বুঝিয়েছেন।
অন্যান্য শরণার্থীরা জানিয়েছে যে, কিছু কিছু বাঙালি অবাঙালি ব্যবসায়ীদেরকে হত্যা করে প্রতিশোধ
নিয়েছে।
বিদেশিরা জানিয়েছে যে, চট্টগ্রামে সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ভোর ৫ টা পর্যন্ত কার্ফিউ জারি হয়েছে, ৩ দিনের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে তবে শহরের কিছু এলাকায় পুনরায় সংযোগ দেয়া হয়েছে এবং বন্দরে কোন বাঙালি কর্মচারি না থাকায় সেটি আপাতত বন্ধ আছে।
দুর্বিষহ যুদ্ধের কারনে কিছু উদ্বাস্তু তাদের বাড়িঘর ছেড়ে মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে হোটেল আগ্রাবাদে আশ্রয় নিয়েছে।
তারা জানিয়েছে যে, তারা বাইরে থাকা অবস্থায় সৈন্যরা তাদের বাড়িতে হানা দিয়েছিল।
আমেরিকার নিউইয়র্কের মন্ট্রোসের ইঞ্জিনিয়ার এডওয়ার্ড জে. ম্যাকমানুস ব্যঙ্গ করে বলেন, পাকিস্তানি সেনারা খুবই ভদ্র। তারা আমার সব হুইস্কি শেষ করে ফেলেছে, কিন্তু আমার গ্লাসগুলো তারা ফেরত দিয়েছে, বেশ ভদ্র”।