নিউ ইয়র্ক টাইমস, রবিবার, এপ্রিল ৪, ১৯৭১
পাকিস্তানঃ ‘সবই খেলার অংশ’- ভয়ঙ্কর এবং প্রাণঘাতী খেলা
নয়া দিল্লি- পাকিস্তানী আর্মির পূর্ব পাকিস্তানিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমনের জন্য আগ্রাসী ভূমিকার বিষয়ে- পাকিস্তান হতে এক্সপেল্ডকৃত বিদেশী সাংবাদিকদের প্রতি একজন পাকিস্তানী বিমানবালা এই বলে লেকচার দেন যে ‘এর সবকিছুই প্রয়োজনীয়, অবশ্যই প্রয়োজনীয়’। ‘এমনটা যদি তোমাদের দেশে হত তাহলে তোমরাও এমন করতে। এভাবেই খেলতে হয়।‘
খেলা? একজন বিদেশী সাংবাদিকের কাছে এটা অবিশ্বাস্য দেখাচ্ছিল। ট্যাংক আর্টিলারি এবং ভারী মেশিনগান নিয়ে দৃশ্যত নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর হামলা করা হয়। সেই সব মানুষের উপর হামলা করা হয় যারাকিনা বস্তুত অহিংস আন্দোলন করছিল যেমন অসহযোগ আন্দোলন এবং হর্তাল। আর এসব তারা গত নির্বাচনে বিজয়ের বাধ্যমে প্রাপ্ত রাজনৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠার জন্য করছিল। এবং এ সপ্তাহে নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের আরও যথেষ্ট রিপোর্ট বেরিয়ে এসেছে যা সকল সন্দেহ দূর করে দিয়েছে এমনকি তা অনেক ভারতীয় এবং পশ্চিমা কূটনীতিকের মাথা ব্যাথার কারণে পরিণত হয়েছে। তারা ধারণা করছেন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সায়ত্ব শাসনের ভাবনা দমনে পাক আর্মিকে নুন্যতম পিছপা হবার নির্দেশ দেওয়া ছিলনা।
আক্রমণ শুরু করা হয়েছিল ২৫ মার্চ রাত থেকে, এর আগে ১০ দিন ব্যাপি সংলাপে পাকিস্তান আর্মি এবং ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের মিথ্যা আশা এবং আশ্বাসের মাঝে রেখেছিল যে তাদের বৃহত্বর সায়ত্বশাসনের দাবী পূরণ হবে।
এখন এটা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা কখনই সংলাপের সাফল্য চায়নি, তারা এই বিষয়টি দিয়ে শুধু সময় ক্ষেপণ করছিল যেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এই সময়ের মাঝে আক্রমণ সংগঠনের জন্য যথেষ্ঠ পরিমাণে সৈন্য নিয়ে আসা যায়। কিন্তু যখন সংলাপ চলছিল তখন সাংবাদিক থেকে শুরু করে কূটনীতিক সহ সকল পর্যবেক্ষকরা এমন কুৎসিত ধারণা সত্য হতেপারে বলে মনে করেননি। এমন ঘটার সকল পূর্বাভাস আগে থেকেই ছিল- সৈন্যরা আকশ এবং পানি পথে আসছিল, একজন সদয় আইন প্রশাসককে বরখাস্ত করা হয় এবং আর্মর স্বভাব বহির্ভূত নীরবতা পালন করছিল যখন পূর্বপাকিস্তানিরা সেনাশাসন প্রত্যাক্ষান করে তাঁদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে মেনে চলছিল।
সংবাদ কর্মিরা এসবকিছুই রিপোর্ট করছিলেন কিন্তু যখন সংলাপের কক্ষ থেকে ‘কিছু উন্নতি হয়েছে’ এমন কথা বেরিয়ে আসছিল তারা তখন সেটাই মুখ্য ধরে নিচ্ছিলেন কারণ এমনটাই হওয়া উচিৎ ছিল। তারা ভুল ছিলেন। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের বদলে সামরিক দমন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
কিন্তু দমনের পথে নামার সময় খুব সম্ভব পশ্চিম পাকিস্তানের মৃত নেতারা আর্মির সক্ষমতা এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অনুভূতির গভীরতা দুটোই পরিপাম করতে ভুল করেছিলেন।
তারা ধারণা করেছিল কিছু গোলাগুলি করলেই মানুষ ভয় পেয়ে যাবে, এমনটাই বলেন সীমান্তের ওপারে ভারতের কলকাতার পুলিশ কমিশনার, রণজিৎ গুপ্ত। পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব-পাকিস্তানিদের সম্পর্কে কতটা কম জানে তা এই বোকার মত চিন্তা থেকেই ধারণা করা যায়।
মানুষ গোলাগুলিতে আতঙ্কিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করার বদলে এখন মনেহচ্ছে- যদি পাক আর্মি বড় শহর এবং গুরুত্বপূর্ন শহর গুলোর নিয়ন্ত্রণ কখনও নেয়ও তবুও তারা অনুন্নত নদীমাতৃক গ্রাম এলাকায় ব্যাপক গেরিলা প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে। এমন প্রতিরোধ যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের চলাচল এবং রসদের যোগান বাঁধাগ্রস্ত করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফল করতে পারে।
ভারতে, পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ্যের ব্যাপারে সহমর্মি অনেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের এই মিলিটারি আগ্রাসনকে হিটলারের আগ্রাসনের সাথে তুলনা করেছেন। ‘পাক আর্মির অমানবিক অত্যাচার’ এমন হেডলাইন ছিল কলকাতার একটি পত্রিকার। আরেকটি পত্রিকা লিখেছে ‘কশাইখানা’ সাথে যোগ করেছেঃ দখলদার পাকিস্তানী আর্মি বাংলাদেশে যে গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে তা নাজি বাহিনীর অন্ধকারতম আতঙ্কের অধ্যায়কেও হার মানাবে। ভারতীয় সংসদ একে নিরস্ত্র মানুষের নির্বিচার হত্যা বলে অভিহিত করেছে যা গণহত্যার সমান।
সরকার সমূহ নীরব
বিশ্বের অন্যান্য সরকার সমূহের অধিকাংশ নীরব রয়েছে। ‘তোমার সরকার এই ভয়াবহতা কেন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেনা?’ কলাতায় একজন কর্মকর্তা প্রশ্নকরেন একজন আমেরিকানক। ‘এটা কোন জলোচ্ছ্বাস নয় এটা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়- এখানে মানুষ মানুষকে জবায় করছে।‘
বাঙালিরা, এইনামেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের ডাকা হয়, এখন একটা কোঠিন প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে যা নিপীড়নের অভিযোগ জানানো এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মাঝামাঝি। হয়ত এই প্রান্ত তাঁরা ২৫মার্চ আক্রমণের রাতেই পার করে ফেলেছে। অথবা হয়ত তা মার্চের ১ তারিখেই পার করা হয়েছে যখন ইয়াহিয়া খান প্রধান সামরিক আইন কর্মকর্তা জাতীয় অধিবেশনের একটা সেশন বাতিল করে দেন যা পরের দুই দিনের মধ্যে শুরু হয়ে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যদিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যাবস্থায় ফেরার কথা ছিল। ঐ অধিবেশনের জন্য গত ডিসেম্বরে নির্বাচন হয়- সে নির্বাচনে শেখ মুজিব এবং তার আওয়ামীলীগ পার্টি ডোমিনেট করে। আওয়ামীলীগ বিশাল আকারে প্রাদেশিক সায়ত্ব শাসনের দাবী করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে সামরিক, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক সাহায্যের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চায়।
এ সকল শর্ত পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠি, আর্মি এবং বড় ব্যাবসায়ী ও রাজনৈতিকদের ঘৃণার বিষয় হয়েছিল। এই সমস্যার উপর রাজনৈতিক সংলাপের সময়, প্রথমে তারা স্বাভাবিক ভাবে আলোচনা শুরু করে এবং পরে নিয়ে আসে জুলফিকার আলি ভুট্টকে, সে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাবশালী নেতা। যখন সে অভিযোগ করে যে আওয়ামীলীগ অনেক বেশী সায়ত্ব শাসন চাচ্ছে যা প্রায় সার্বভৌম ক্ষমতার সীমানায় পড়ে তখন আলোচনা স্তব্ধ হয়ে যায়। এরপর হঠাৎ করেই আর্মি আক্রমণে চলে আসে।
আক্রমণের পরদিন সকালে, মি. ভূট্টো এবং তার সফর সঙ্গীরা কোঠর মিলিটারি পাহারার মাঝে পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপদ সীমানায় উড়ে যান যেখানে এই রাজনৈতিক নেতা দরাজ গলায় ঘোষণা করেন- ‘সৃষ্টিকর্তার কৃপায় পাকিস্তান বেঁচে গেছে’।
কিন্তু ঐক্যবদ্ধ মুসলিম দেশ হিসেবে টিকে থাকার জন্য শুধু ব্যাক্তিগত ধর্মীয় বুলির থেকেও বেশী কিছু প্রয়োজন হবে। ধর্ম একটা সামাজিক বন্ধনের মত ছিল যা দুই প্রদেশকে এক করে রেখেছিল কিন্তু তা কখনই যথেষ্ট ছিলনা।
হয়ত অনেক সময় প্রয়োজন হবে, কিন্তু যারা বর্তমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ার এবং আর্মি আক্রমণের বীভৎসতা দেখেছে তাঁদের এ বিষয়ে সন্দেহ আছে। এদিকে শেখ মুজিব তাঁর বর্তমানে প্রতিহিংসার মুখে পড়া বাড়ির সামনে জড় হওয়া অনুসারীদের সাথে আগে এই বলে শ্লোগান দিতে পছন্দ করতেন- ‘সংগ্রাম সংগ্রাম। চলবেই চলবেই’। ‘দ্যা ফাইট উইল গো অন। দ্যা ফাইট উইল গো অন’।
-সিডনী এইচ শেনবার্গ।