You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.04 | ইয়াহিয়ার হাত শক্ত করতে মুজিব-ভাসানী বিরােধ সৃষ্টির চক্রান্ত | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

ইয়াহিয়ার হাত শক্ত করতে মুজিব-ভাসানী বিরােধ সৃষ্টির চক্রান্ত
[বিশেষ প্রতিনিধি]

বাঙলাদেশের মানুষ যখন জাতি, ধর্ম ও দলের সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে জীবন বিসর্জন দিচ্ছে, রক্তের স্রোতে পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরীর জলকে রাঙা করে দিচ্ছে ; যখন সর্বহারা মানুষের দল সীমান্ত পেরিয়ে এপার এসে জাতিধর্ম ভুলে এক তাঁবুর নিচে আশ্রয় নিয়ে একই রসুইখানার শাকান্ন ভাগ করে খাচ্ছে তখন পশ্চিম বাঙলার ইয়াহিয়া হাতকে শক্ত করতে, পাক রেডিয়াের অপপ্রচার রসদ যােগাতে, কোনাে কোনাে পত্র-পত্রিকা মুজিবুর সম্পর্কে মিথ্যা অপপ্রচার ও মুজিব-ভাসানীর অনুগামীদের মধ্যে ভাঙন ও বিরােধ সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে।
একটি সাপ্তাহিকের (বর্ষ ১। সংখ্যা ৩) রাজনৈতিক সংবাদদাতার “শেখ মুজিবর কি ধরা দিয়েছেন এই শিরােনামায় জনৈক প্রভাবশালী’ ন্যাপ (ভাসানী-পন্থী) নেতার সঙ্গে কথােপকথনের যে বিবরণী প্রকাশিত হয়েছে তাতে ন্যাপ নেতার জবানিতে শেখ মুজিবর রহমান সম্বন্ধে আপত্তিকর মন্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর ‘নিজেই ধরা দিয়েছেন’ কারণ “শেখ মুজিবর হয়তাে এই কথাও ভেবেছিলেন যে তিনি মুক্ত থাকলে আন্দোলন যদি হঠাৎ কোনও সাংঘাতিক চেহারা নেয় তিনি তখন তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তার চেয়ে ধরা দেওয়া শ্রেয়”। শুধু এই নয়, “ন্যাপ নেতাটি বলেন যে একজন মধ্যপন্থী এবং প্রকৃত পক্ষে আপস কামী নেতা হিসাবেই মুজিবুর এই রকম কাজ করেছেন বলে তার ধারণা।
এই ধারণা মনে মনে পোেষণ ঘােষণা।” করাই তাে ভালাে, এবং ধারণাকে ঐতিহাসিক সত্য কথা মনে করে সংবাদ প্রকাশ না করাই তাে ভালাে। বিশেষ করে যখন এই আপসকামী’ নেতা ও তার দলকেই বাঙলাদেশের মানুষ নির্বাচনে জয়ী করেছে (শতকরা ৯৮.৭ ভােট), তাঁর নির্দেশে বাঙলাদেশে তিন সপ্তাহ হরতাল পালন এবং চূড়ান্ত জয়লাভের জন্য ‘শেষ সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আর-একজন বিশেষ সংবাদদাতাও (ঐ পত্রিকাতেই) আওয়ামী লীগের একজন নেতার প্রতি কটাক্ষ করে বলেছেন, “তার প্রচারে ন্যাপ ও ন্যাশনাল লীগ কর্মীরা পশ্চিম বাঙলায় আশ্রয় না পেয়ে বাঙলাদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, বিশেষ করে জনসাধারণের অসহযােগিতার জন্যই তারা এপারে ঠাই পাচ্ছেন না, এবং বাঙলাদেশে গিয়ে খান-সেনাদের হাতে প্রাণ হারাচ্ছেন। আমাদের জিজ্ঞাসা : কে কোন দল করতেন সেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে উত্তর জেনে নিয়ে তবেই কি জনসাধারণ সহযােগিতা বা অসহযােগিতা করছেন? তাহলে যারা লাখে লাখে সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছেন তারা আশ্রয় পেলেন কী করে?
সীমান্তে যারা আশ্রয় পেয়েছেন তারা কি সবাই আওয়ামী লীগ সদস্য?
তাহলে কি ন্যাপ-সমর্থক শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছিল? এপারের জনসাধারণ ও শাসনবিভাগের ওপর আওয়ামী লীগের হঠাৎ এই প্রভাব, এও কি সম্ভব? এ কী আজগুবি এবং জঘন্য অপপ্রচার।
এই রাজনৈতিক সংবাদদাতার অবগতির জন্য দৈনিক ইত্তেফাকের ১০ মার্চ সংখ্যা থেকে কয়েকটি পঙক্তি তুলে ধরছি। ইত্তেফাকের প্রধান শিরােনামা :
লা কুমদ্বী’ নুকুম আল্ ইয়াদ্বীন।
“পঁচিশে মার্চের পর শেখ মুজিবের সহিত মিলিয়া আন্দোলন করিব। পল্টনের জনসভায় মৌলানা ভাসানীর ঘােষণা।”
“গতকল্য মঙ্গলবার পল্টনের এক বিরাট জনসভায় তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে অশীতিপর বৃদ্ধ ন্যাপ-নেতা মৌলানা ভাসানী ঘােষণা করেন: শেখ মুজিবের নির্দেশিত ২৫ মার্চের মধ্যে কোন কিছু না করা হইলে আমি শেখ মুজিবের সহিত মিলিয়া ১৯৫২ সালের ন্যায় তুমুল গণ-আন্দোলন শুরু করিব।”
বুর রহমানের সংগ্রামী ও আপসবিরােধী চরিত্রের উল্লেখ করে সমস্ত অপপ্রচারের জবাব ভাসানী। সাহেব বলেন “খামাকা কেহ মুজিবকে অবিশ্বাস করিবেন না। মুজিবকে আমি ভালাে করিয়া চিনি।… আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে আমার তিন পুত্রের চেয়ে ভালােবাসি।” অতীতের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “সেদিন এত লাল টুপী ছিল না, সেদিন আমার হাতে এক টাকা বা বার আনা পয়সা ছিল না। সেই বিপদের দিনে আমরা একত্রে কাজ করিয়াছি।”
এই জনসমাবেশে আতাউর রহমান খানও শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে বলেন “স্বাধীন বাংলার জাতীয় সরকার ঘােষণা করুন। বাঙলার সকলে জাতীয় সরকারের হুকুম মানিয়া চলিবেন।”
(দৈনিক ইত্তেফাক। ১০ মার্চ শেষ পৃষ্ঠা)
ন্যাপ-নেতার জবানিতে রাজনৈতিক সংবাদদাতা যাকে আপনি **** কামী বলেছেন স্বয়ং মৌলানা ভাসানী ১১ মার্চ টাঙ্গাইল বিন্দু বাসিনী হাই স্কুল ময়দানে এক জনসভায় তাঁকে সাত কোটি বাঙালির নেতা বলে ঘােষণা করেন এবং শেখ মুজিবের নির্দেশ পালন করুন” জনসাধারণকে এই অনুরােধ জানান।
(দৈনিক ইত্তেফাক ১২ মার্চ প্রথম পৃষ্ঠা)
তথাকথিত ন্যাফ-নেতা, রাজনৈতিক সংবাদদাতা ও বিশেষ সংবাদদাতাদের সম্বন্ধে কোন মন্তব্য না করে আমরা শুধু এইটুকু বলতে চাই যে এই ধরণের মন্তব্য, সংবাদ ফিচার প্রকাশ করে প্রকৃতপক্ষে তারা ইয়াহিয়ার হাতকেই শক্ত করছেন বস্তুত কায়েমি প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতকে শক্ত করা; মুক্তিসংগ্রামে বাধা সৃষ্টি; মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝির সম্ভাবনা ও জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ব্যতীত আর কি কল্যাণ সাধন তারা করছেন, ভেবে দেখবেন কি?

সূত্র: সপ্তাহ, ৪ জুন ১৯৭১