মনসুর আলী
অসহযোগ আন্দোলন এর র্পূবেই আমরা খুলনাতে একটা আন্দোলন গড়ে তুলি এবং ৩রা মার্চ সভা শেষ করে একটা মিছিল বের করি। এ মিছিলে পাকবাহিনী গুলি চালায় এবং গুলিতে আজিজুল হক,খালেদসহ আরো কয়েকজন নিহত হয়। গুলির প্রতিবাদে ৫ই মার্চ মিছিল বের করি। পাকবাহিনী এ মিছিলেও গুলি চালায়। দুজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। ৭ই মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর আমরা অসহযোগ আন্দোলন শুরি করি। প্রত্যহ সকাল ১০টায় খুলনা পার্কে আমরা জমায়েত হতাম এবং বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিতাম। ১৪ই মার্চ তেরখাদায় একটি সভা করি এবং এখানে একটি হাসপাতাল স্থাপন করি। তাছাড়া এখানে গেরিলা ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করি। খুলনার অন্যান্য থানায়ও ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয়। থানার পুলিশরা ট্রেনিং প্রদান করতো, এভাবে প্রায় ১০,০০০ মুক্তিযোদ্ধা প্রস্তুত করা হয়।
২৬শে মার্চ থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রূপসাঘাট, সেনের বাজার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি করা হয়। এখানে পাক সৈন্যদের সাথে গুলি বিনিময় হয়। ১লা এপ্রিল আমি তেরখাদায় চলে আসি। এ সময় আমরা খুলনার সাথে যশোরের যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেই এবং লঞ্চ যোগাযোগ বন্ধকরি। ৬ই এপ্রিল সমস্ত ট্রেনিং ক্যাম্পের দায়িত্ব থানার ওসি সাহেবের কাছে প্রদান করে আমি ভারতের উদ্দেশ্য রওনা দেই। ৭ই এপ্রিল কলকাতায় অবস্থান করি এবং সেখানে আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে যোগাযোগ করি। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদান করি। ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশক্রমে নিজ এলাকায় ফিরে আসি। এ সময় পাক বাহিনী আমার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে। ১৩ই মে প্রথমে পাকসেনারা তেরখাদা আক্রমণ করে। ৪ঠা আগস্ট তেরখাদায় রাজাকার, পাঞ্জাবী পুলিশ ও পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের যুদ্ধ হয়। প্রায় ৫৭ জন লোককে পাকবাহিনী হত্যা করে। তবে ছাগলদা, ছাছিয়াদহ, চরকুরিয়া, চুকখোলা প্রভূতি ইউনিয়ন সমূহ যুদ্ধের সময় নিরাপদ ছিল।
৯ই আগস্ট আমি শেষবারের মত ভারত চলে যাই। টেট্যা যুব ক্যাম্পের ২০০ জন যুবকে গেরিলা ট্রেনিং এর জন্য চাকুলিয়া প্রেরণ করি। এ সময় তেরখাদা থানার ভিতরে পতলাতে একটি নতুন থানা স্থাপন এবং নিরঞ্জন সেন নামক একজনকে ওসি নিয়োগ করি এবং একটি স্টিমার নিমজ্জিত করা হয়। ডাকবাংলোতে শান্তি কমটির মিটিং চলাকালে গ্রেনেড চার্জ করা হয়। পাওয়ার হাউজেও আমরা একটি অভিযান চালাই এবং পাকসেনাদের একটি লঞ্চ ডুবিয়ে দেই। এ সমস্ত যুদ্ধ ছাড়াও ৭টি গেরিলাযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধে পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন সেলিমসহ ৫৫ জন পাকসেনা এবং প্রায় ১০০ রাজাকার ও আলবদর মারা যায়। ইদ্রিস ও কালু নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা এবং রতন, খোকন, মোহাম্মদ ও খোকাসহ আরো ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়।
পাকবাহিনী আমার এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। ছাচিয়াদহ বাজারে ১৩২টি তেরখাদায় ২০০টি সহ সম্পূর্ণ এলাকায় ৩০০০ বাড়িঘর তারা লুট করে এবং পুড়িয়ে দেয়। প্রায় ১৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। এদের মধ্য তেরখাদা কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি সরফরাজের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতেন। ১৪ই আগস্ট পাকবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায়।শোনা যায়, প্রথমে তাকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে বলে। এতে তিনি রাজী না হওয়ায় তার বাম হাতে গুলি করা হয়।এতেও তিনি পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে রাজী না হওয়ায় তার অন্য হাতে গুলি করা হয়। সবশেষে তাকে একেবারে হত্যা করা হয়।
আমার এলাকার বোরহান উদ্দিন, ফহম উদ্দিন, আব্দুল ওহাব, শামসুল হক শেখ সেকান্দার আলী, নূরুল হক, আবু তালেব, প্রফুল্ল কুমার প্রমুখ নেতারা স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষভাবে কাজ করেন।
-(ড:মনসুর আলী) সাবেক এম,পি,এ
খুলনা, ২৬ অক্টোবর, ১৯৭২