নিউইয়র্ক টাইম্স, ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাঙালি শরণার্থীরা বলেন, সৈন্যরা হত্যা, লুটতরাজ, এবং অগ্নিসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে
সিডনী এইচ. শ্যানবার্গ
কুঠিবাড়ী, ভারত। সেপ্টেম্বর ২১। পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক শরণার্থীরা জানান যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের অসামরিক সহযোগীরা হত্যা, লুটতরাজ, ও অগ্নিসংযোগ অব্যাহত রেখেছে; যদিও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা দেশে স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধার এবং বাঙালীদের আস্থা অর্জনে ইচ্ছুক।
এই প্রতিবেদক আজ বেশ কিছু শরণার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, যারা সবাই গত সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে এসেছেন। তাদের বর্ণনায় পাকিস্তানী সেনাসদস্য (যাদের অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানই) কর্তৃক অসামারিক গণহত্যা, ধর্ষণ, এবং অন্যান্য নির্যাতনের চিত্র উঠে আসে।
যখন সীমান্ত থেকে চার মাইল, আর কলকাতা থেকে ৬০ মাইল উত্তরপূর্বের এই গ্রামে জনাকীর্ণ, অর্ধ-প্লাবিত উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে শরণার্থীরা এসব কথা বলছিলেন, তখনো দিগন্ত থেকে বোমা বর্ষণের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। এটা বলা সম্ভব ছিল না যে, ঠিক কারা গোলাবর্ষণ করছে–পাকিস্তানী বাহিনী, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী, না কি তথাকথিত “বাংলাদেশ” এর মুক্তিবাহিনী। এই নামটি বাঙালী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পূর্ব পাকিস্তানকে দিয়েছে মার্চ মাস থেকে, যখন তাদের আন্দোলনকে রুদ্ধ করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল।
সাক্ষাৎকার নেয়া অধিকাংশ শরণার্থী এসেছেন ফরিদপুর অঞ্চল থেকে, যেখানে বাঙালীর কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবর রহমানের পারিবারিক নিবাস।
প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী
শরণার্থীরা বলেন, যদিও সব মিলিয়ে জীবনযাপন পূর্ব পাকিস্তানে বেশ কঠিন ছিল, গণহত্যা না হলে তারা সেখানেই থেকে যেতেন। সম্প্রতি আগমনকারী প্রায় সবাই হিন্দু। তারা জানান, সামরিক সরকার হিন্দু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত করেছে।
তারা আরও বলেন, তাদের এলাকায় গেরিলা যোদ্ধারা সক্রিয় ছিলেন, এবং প্রত্যেক গেরিলা হামলার পর সেনাবাহিনী অসামারিক লোকজনের উপর কঠিন প্রতিশোধ নিয়েছে।
নিরা পদ সাহা, ফরিদপুর জেলার একজন পাট ব্যবসায়ী, তার নিজের গ্রামের পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে নির্যাতনের বিবরণ দেন। গ্রামটি গেরিলা যোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাবার দিয়েছিল। পাঁচ দিন পূর্বে তিনি পালিয়ে আসার আগে আগে পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রামে হানা দেয়, প্রথমে গোলাবর্ষণ করে এবং পরে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।
“গ্রামের কিছু মানুষ যথেষ্ট তাড়াতাড়ি পালাতে পারেনি”, তিনি বলেন, “পাকিস্তানী সেনারা তাদের ধরে ফেলে, এবং হাত পা বেঁধে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে।”
জনাব সাহা জানান, গ্রামে প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষ ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু। এখন আর কোন ঘরবাড়ি অবশিষ্ট নেই।
নোংরা কাজগুলো করে অন্য কিছু মানুষ
শরণার্থীদের বর্ণনা অনুযায়ী, পাক সেনারা বেশিভাগ “নোংরা কাজ” ছেড়ে দিত তাদের অসামরিক দোসর রাজাকার (তথা, দেশরক্ষী)- যাদেরকে অস্ত্রও দেয়া হতো– এবং তাদের সমমনা ডানপন্থী ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যদের জন্য (যেমন, মুসলিম লীগ এবং জামায়াত-ই-ইসলামী, যারা সামরিক শাসন সমর্থন করেছিল)।
এসব সহযোগীরা গুপ্তচরবৃত্তি এবং সৈন্যদের নির্দেশ পালনে নিয়োজিত ছিল। শরণার্থীরা বলেন, এরা সৈন্যদের দেখিয়ে দিত যে কোন বাড়ি, গ্রাম, বা ব্যক্তি গেরিলা যোদ্ধাদের সহায়তা করেছে। অনেক সময়, শরণার্থীরা যোগ করেন, এই সহযোগীরা কোন কারণ ছাড়াই ইচ্ছেমত যাকে তাকে ধরে নিয়ে যেত।
দীপক কুমার বিশ্বাস, বরিশালের একজন বেতার মেরামতকারী, উল্লেখ করেন, “রাজাকার এবং অন্যরা একটা গ্রামে আসে, যেকোনো বাড়ি নির্বাচন করে, এবং সেখানকার সমর্থ যুবকদের ধরে পাক সেনাদের হাতে তুলে দেয়। এরপর সৈন্যরা তাদের কি করে জানিনা, তবে তারা আর কখনো ঘরে ফেরত আসেনা।”
শরণার্থীরা আরো জানান, নির্যাতন এবং গুপ্তচরদের ভয় থাকা সত্বেও স্থানীয় লোকজন গেরিলা যোদ্ধাদের খাবার, তথ্য, এবং আশ্রয় দেয়া অব্যাহত রেখেছে।
মাখন লাল তালুকদার, একজন ধানচাষি, জানালেন কিছুদিন পূর্বে তিনি পালিয়ে আসার আগে কয়েকজন রাজাকার একটি সাপ্তাহিক বাজারে জমায়েত মানুষের উপর হামলা করে এবং সরাসরি গুলিবর্ষণ করে। এতে ছয়জন মানুষ মারা যায় এবং অনেকে আহত হয়।
শরণার্থীদের আগমন থেমে নেই
জনাব তালুকদার তার আট সদস্যের পরিবার নিয়ে ভারত চলে এসেছেন, কিন্তু তার বাবাকে দেশে লুকিয়ে রেখে আসতে হয়েছে। দীর্ঘ পথ হাঁটার মতো বয়স তার নেই।
জনাব তালুকদার বলেন, বাজারের সেই ঘটনার পর তার এলাকা থেকে প্রায় পনের হাজার মানুষ ভারতে পালিয়ে আসেন। মোটামুটি বিশ থেকে ত্রিশ হাজার শরণার্থী প্রতিদিন ভারতে অনুপ্রবেশ করছেন এবং ইতিমধ্যে সেখানে অবস্থানকারী (সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী) ৮ দশমিক ৬ মিলিয়ন শরণার্থীদের সাথে যোগদান করছেন।
পাকিস্তানী রাষ্ট্রপতি, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, শরণার্থীদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে ফেরত যেতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গেরিলা যোদ্ধাদের সাধারণ ক্ষমা করারও প্রস্তাব দেন।
কিন্তু তার এই প্রতিশ্রুতি শরণার্থীদের কেবল তিক্ত হাস্যরসের উদ্রেক করে। “আমরা আমাদের জীবন বাঁচাতে পালিয়েছি,” বলেন রাজেন্দ্র দাস, আরেকজন কৃষক, “ওরা এখনো আমাদের হত্যা করে চলেছে। পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ না করা পর্যন্ত আমরা আর ফেরত যাচ্ছি না।”
উদ্বাস্তু এলাকায় যদিও চালের কিছুটা সংকট বিরাজমান যা এর ৪০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে, অন্যান্য খাবার অঢেল রয়েছে বলে বলা হচ্ছে। তথাপি শরণার্থীরা জানান, কাজ এবং অর্থের অভাবে অনেককে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।
পাক সেনাদের আক্রমণের শুরু থেকেই অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে কঠিন আঘাত করেছে কৃষি শ্রমিক এবং সরকারি গণপূর্ত প্রকল্পের অধীন মজুরদের। এসব প্রকল্পের অধিকাংশই থমকে গিয়েছে।