কাজী জাফর আহমেদ
১৯৭১ সালে প্রকাশ্য রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)’ ও ‘কৃষক সমিতি’ এবং আমাদের সরাসরি নেতৃত্বে পরিচালিত ‘বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন’ ও ‘পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন’-এর সাথে জড়িত ছিলাম। আমি ছিলাম ‘বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি’। আমাদের মূল সংগঠন ছিল ‘’কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’’। স্বাধীন জনগনতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার প্রতিষ্ঠার লক্ষকে সামনে রেখে ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী আমরা এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি। সে বৎসরেরই এপ্রিলে আমরা স্বাধীন জনগনতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার কর্মসূচী পেশ করি। এতে পরিকল্পিত রাষ্ট্রকে ‘পূর্ব বাংলা জনগনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ আখ্যা দেয়া হয়। ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী ঢাকার পল্টন ময়দানে পূর্ব পাকিস্থান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) আয়োজিত এক সভায় অতিথি বক্তা হিসেবে আমরা এই কর্মসূচীর ভিত্তিতে রচিত ১১ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করি। এই অভিযোগে পাকিস্থানের সামরিক আইনের অধীনে আমাকে এবং রাশেদ খান মেননকে সাত বতসরের সশ্রম কারাদণ্ড ও সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আদেশ দেয়া হয়, মোস্তফা জামাল হায়দার ও মাহবুব উল্লাহকে দেয়া হয় এক বৎসরের কারাদন্ডাদেশ। আমরা আত্মগোপনে চলে যাই, অবশ্য মাহবুব উল্লাহ পরবর্তিকালে গ্রেফতার হন।
১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আমরা বিরোধিতা করি। এর কারণ আমরা তখন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্থানে আর বিশ্বাস করতাম না, তদুপরি লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের জীবননাশী নভেম্বরের জলোচ্ছ্বাস এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্থানী শাসকদের ক্ষমার অযোগ্য উপেক্ষায় আমরা ছিলাম বিক্ষুব্ধ। অন্যদিকে ইয়াহিয়া ঘোষিত ‘‘লীগ্যাল ফ্রমওয়ার্ক অর্ডারে’র’ অধীনে নির্বাচন এবং এতে বিজয় পূর্ব বাংলার জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করতাম না। তাই আমরা নির্বাচন বর্জনের আহবান জানাই এবং পাশাপাশি শ্লোগান তুলে ধরিঃ ‘শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা অস্ত্রো ধরো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’। মাওলানা ভাসানীও নির্বাচন বর্জন করেন এবং ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় স্বাধীনতার আহবান জানান। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়ে অনেকে আশাবাদী হলেও আমরা বলেছিলাম পাকিস্থানী বিজাতীয় শাসক গোষ্ঠী যে কোন আজুহাতে পূর্ব বাংলার জনগনকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে দেবে না। এজন্যই আমরা সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য স্বাধীনতার আহবান জানাতে থাকি।
’৭১ এর মার্চে আসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে আমাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। ৭ই মার্চ প্রচারিত এক প্রচারপত্রে আমাদের আহবান ছিল, “‘আঘাত হানো, সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করো, জনতার স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েম করো।“
মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের খুব আশান্বিত করতে পারেনি- সেদিনই তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে এত বিপুল রক্তক্ষয়কে এড়ানো যেতো। কয়েকজন সহকর্মীসহ আমি তার সাথে দেখা করে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষনা এবং সশস্ত্র সংগ্রামের প্রশ্নে কথা বলি। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক আমাদের খারাপ ছিল না। তিনি বলেন ‘তোমাদের গেরিলা যুদ্ধের দরকার নেই,, আমি সব ঠিক করে দেবো। ওখানে আমি, এখানে তাজউদ্দীন, তারপর দেখবে কি হয়’। এই কথায় স্বাধীনতার প্রশ্নে তাকে খুব সিরিয়াস মনে হয় নি- আদৌ তিনি স্বাধীনতার কথা, সশস্ত্র সংরামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার কথা চিন্তা করছিলেন কি না সে ব্যাপারে আমাদের সংশয় ছিল। অথবা এমনও হতে পারে যে তিনি তখন ভাবছিলেন বিচ্ছিন্নতার কথা- ক্ষমতায় যাবার পর দাবি করতে না পারলে তিনি হয়ত পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে মুজিবের আলোচনায় আমরা বিরোধীতা করেছিলাম, কারণ সারা পূর্ব বাংলা তখন জ্বলছে একটি মাত্র দাবিতেঃ স্বাধীনতা।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের (বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন)-এর উদ্যোগে ২৫ মার্চ বিকালে পল্টন ময়দানে আয়োজিত জনসভায় সভাপতির ভাষণে আমি স্বাধীনতা সংগ্রামের ১৩ দফা কর্মসূচী তুলে ধরি। এই সভায় আমরা বলেছিলাম, আলোচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য, আর তাই সারাদেশে অবিলম্বে গেরিলা বাহিনী গঠন করে পাকিস্থানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে হবে। এটাই ছিল তৎকালীন “পূর্ব পাকিস্থানের” পল্টন ময়দানের শেষ জনসভা। সভা শেষে এক প্রকান্ড মিছিলযোগে আমরা শহীদ মিনারে যাই এবং সেখানে শপথ গ্রহণ করি। কর্মীদের পাঠিয়ে দেই তাদের নিজ নিজ এলাকায়।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্থানের সেনাবাহিনী তাদের পৈশাচিক হত্যাকান্ড শুরু করলে আমি আশ্রয় নেই এদেশের প্রগতিশীল সিনেমা আন্দোলনের পথিকৃত শহীদ জহির রায়হানের বাসায়। তিনি এবং তার স্ত্রী নিজেদের জীবনের ঝুকি নিয়ে আমাকে তিন দিনের আশ্রয় দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, জহির রায়হানের গাড়িটিও আমাদের দিয়েছিলেন ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্যে। এই গাড়ী নিয়েই আমি ঢাকা জেলার শিবপুর চলে যাই সেখানে আমাদের সংগঠনের নেতা মান্নান ভূঁইয়া গড়ে তুলেছিলেন এক বিরাট গেরিলা বাহিনী। উল্লেখ করা দরকার যে জহির রায়হানের গাড়িটি যুদ্ধের গোটা সময়টাতেই শিবপুরে ছিল এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা এটাকে বিভিন্ন কাজে লাগিয়েছিলেন।
শিবপুরে আমরা নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন করে নেই। হায়দার আকবর খান রনো এবং রাশেদ খান মেননকে মাওলানা ভাসানীর সংগে যোগাযোগের জন্যে টাংগাইল পাঠানো হয়। তারা দেখা করতে পারলেও বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ পাননি, কেননা, ৩ এপ্রিলের মধ্যে পাকবাহিনী মাওলানা ভাসানীর সন্তোষ এবং বিন্নাফৈরের দুটি বাড়িই জ্বালিয়ে দেয়। মাওলানা ভাসানী আত্মগোপনে চলে যান।
এদিকে আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল নিজ এলাকা কুমিল্লার চিত্তারায় গিয়ে বাম এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে। চিত্তরা ভারত সীমান্তের কাছাকাছি ছিলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারি যে, আওয়ামী লীগের নাতৃবৃন্দ ইতিমধ্যেই সীমান্ত অতিক্রম করে গেছেন।
২৫ বা ২৬ এপ্রিল আমি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা দেবেন সিকদারের আগরতলা থেকে লেখা একটি চিঠি পাই। ওতে জানানো হয়েছিল যে, ৩০ এপ্রিল ভারতের জলপাইগুড়িতে মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে বামপন্থিদের এক নীতিনির্ধারনী সভা হবে, আমি যেন অন্য সকলকে জানিয়ে নিজেও চলে আসি। সভা নির্দিষ্ট ৩০ এপ্রিল অনুষ্টিত হলেও সেখানে আমাদের আকাংক্ষিত নেতা মাওলানা ভাষানী উপস্থিত ছিলেন না। জানানো হয় যে, মাওলানা ভাসানীকে ভারত সরকার সীমান্ত থেকে নিয়ে গেছেন। গ্রেফতার কিনা জানা যায়নি। ফলে সভায় উৎসাহ সঞ্চারিত হতে পারেনি। একটি মাত্র সিদ্ধান্ত সেখানে গৃহীত হয় যে, আমরা বাম্পন্থীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করবো। পরবর্তি সভার তারিখ নির্ধারিত হয় ২১ ও ৩০ মে এবং এর স্থান নির্বাচন ও আয়োজনের দায়িত্ব অর্পিত হয় দেবেন সিকদার ও ন্যাপ সম্পাদক মশিউর রহমানের ওপর। এই সভায় আমি ছাড়া উপস্থিত অন্যরা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ, অমল সেন, মশিউর রহমান, দেবেন সিকদার, আবুল বাশার, ডাঃ মারুফ হোসেন, ডাঃ সাইফ-উল-দাহার এবং নজরুল ইসলাম। আমরা ফিরে আসি দেশের অভ্যন্তরে।
পরবর্তী সভা অনুষ্টিত হয় কলকাতায় কিন্ত এতে মাওলানা ভাসানী উপস্থিত ছিলেন না। তার লেখা একটি চিঠি পড়ে শোনানো হয় যাতে তিনি লিখেছিলেন যে, বাইরে বেরোনোর ব্যাপারে তার অসুবিধা আছে, তিনি ভাল আছেন।
মাওলানা ভাসানী আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে বলেছিলেন, তার নির্দেশ ছিল আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্যে। চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন যে গনচীনসহ কয়েকটি রাষ্ট্রের প্রধানদের কাছে তিনি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন সমর্থন চেয়ে। এ প্রসংগে বলা দরকার যে কাগজে-কলমে না হলেও পরোক্ষভাবে সুকৌশলে মাওলানা ভাসানীকে বন্দী দশায় রাখা হয়েছিল।
এ সভায় সভাপতিত্ব করেন দিনাজপুরের কৃষক নেতা শ্রবরোদা ভূষণ চক্রবর্তী। বিস্তারিত আলোচনা শেষে মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়। কমিটিতে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন দেবেন সিকদার (পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি) নাসিম আলি (বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি-হাতিয়ার) অমল সেন (কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র) ডাঃ সাইফ-উদ-দাহার (কমিউনিস্ট কর্মী সঙ্ঘ) এবং আমি (কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি) । সভায় গৃহীত স্বিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের প্রতি ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবান জানানো হয় এবং এ ব্যাপারে যোগাযোগের দায়িত্ব লাভ করি আমরা। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় ঘোষণাটি ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকার মাধ্যমে যথেষ্ট প্রচার লাভ করেছিলো। এতে বিভেদের নীতি পরিহার করে সকল বামপন্থী ও দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহকে আওয়ামী লীগের সাথে একযোগে পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই-এ অংশগ্রহনের আহবান জানানো হয়েছিল।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ জুন আমি, রাশেদ খান মেনন এবং হায়দার আকবর খান রনো কলকাতায় অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে সাক্ষাৎ করে স্বাধীনতাযুদ্ধে বামপন্থীদের অংশগ্রহণের প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করি। ধৈর্য ও সহানুভূতির সাথে বক্তব্য শুনলেও তিনি আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের মুক্তিবাহিনীতে আমাদের কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকার করেন। কারণ হিসেবে তিনি হক-তোয়াহার নেতৃত্বাধীনে কমিউনিস্টদের শ্রেণী সংগ্রামের এবং স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা উল্লেখ করেন, তাদের প্রচারপত্রের প্রসংগও টেনে আনেন। আমরা বলি হক-তোয়াহারা যা করেছেন তা নিজের দায়িত্বেই করেছেন, এর সংগে বামপন্থীদের বিরাট অংশটি আদৌ জড়িত নয়। আপনি কেবল আওয়ামী লীগের সম্পাদকই নন, দেশেরও প্রধানমন্ত্রী এবং এজন্যেই জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামে যে কাউকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া আপনার কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে জনাব তাজউদ্দীন জানান যে তাকে সিদ্ধান্তের আগে গোয়েন্দা রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে এবং আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার অনুপস্থিতিতে নির্ভর করতে হবে ভারত সরকারের গোয়েন্দা রিপোর্টের ওপর। এই পর্যায়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায়, এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদের উপস্থিতি সে অপ্রিয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে। আমরা মর্মাহত হয়ে ফিরে আসি।
দেশে ফেরার পথে জুনের মাঝামাঝি আগরতলায় আমাকে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ আটক করে নিয়ে যায় শিলং- এর একটি ডাক বাংলোয়। সেখানে আমাকে সাত দিন রাখা হয়। ঘটনাটিকে আমি গ্রেফতার বলবো না, কেননা, কোন খারাপ আচরণ আমার সাথে করা হয়নি। কিন্তু সাত দিনব্যাপী আমাকে অবিরাম প্রশ্নের মাধ্যমে ব্যতিব্যস্থ রাখা হয়। আমাকে প্রশ্ন করছিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান মিঃ সুব্রামনিয়াম। তিনি অবশ্য সমগ্র ব্যাপারটিকে ‘নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা’ হিসাবে বোঝাতে চাচ্ছিলেন। এই আলোচনায় দেশের অতীত ও বর্তমান রাজনীতিতে বামপন্থিদের ভূমিকা সহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ এসেছিলো। তিনি বারবার আওয়ামী লীগ ও ভারতের প্রতি বামপন্থিদের মনোভাব সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন। আমি বলেছিলামঃ এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান সমস্যা পাকিস্থানের সেনাবাহিনী; এর বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে চাই, আওয়ামী লীগের সাথে মতপার্থক্যসমূহ এখন আমরা তুলে ধরবো না- তাদের সাথে আমাদের সমস্যা সমূহের মীমাংসা আমরা স্বাধীন দেশের মাটিতে করবো, যুদ্ধের মধ্যে কিংবা ভারতের অভ্যন্তরে নয়। ভারতের সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বা সম্ভাবনার প্রসঙ্গে আমি বলেছিলামঃ ভারতের পক্ষে সেটা উচিত হবে না, আমরা বাংলার মাটিতেই শত্রুদের খতম করবো। স্বাধীনতাকে আমরা ছিনিয়ে আনতে চাই কারো অনুগ্রহে পেতে চাই না।
অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে ব্যর্থ আলোচনার পর আমরা নিজেদের উদ্যোগে যেখানে যতটুকু শক্তি নিয়ে যেভাবে সম্ভব স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখি। মুজিবনগর সরকারকে আমরা অস্বীকার করিনি, কিন্ত তাই বলে প্রত্যক্ষ কোন যোগাযোগও রাখিনি, সহযোগিতাও পাইনি। সরকার সম্পর্কে আমাদের প্রশ্ন ছিল, সমালোচনা ছিল, কেননা তারা আওয়ামী লীগের বাইরে বিশেষ করে বামপন্থীদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রশ্নে অযৌক্তিক সংকীর্ণ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এই নীতি আমাদের হতাশ করেছিল। এজন্যেই আমরা নিজেদের উদ্যোগে লড়াই চালিয়েছিলাম।
স্বাধীনতাযুদ্ধকালে আমাদের নীতি ছিল দুটিঃ
১। যেখানে সম্ভব বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই পি আর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারি মুক্তিবাহিনীতে যোগদিয়ে তাদের নির্দেশ মান্য করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এবং (২) কোথাও তেমন বাহিনী না থাকলে কিংবা দলীয় সংকীর্ণতার কারণে যোগদান সম্ভব না হলে আলাদাভাবে ‘গেরিলা ফৌজ’ গঠন করে যুদ্ধ পরিচালনা করা। উল্লেখ্য যে, আমাদের আমাদের সংগঠনের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর নাম ছিল ‘গেরিলা ফৌজ’। এর গঠন প্রণালী ছিল- পাঁচ থেকে সাতজন নিয়ে একটি গ্রুপ, কয়েকটি গ্রুপ নিয়ে একটি স্কোয়াড এবং কয়েকটি স্কোয়াড নিয়ে হত একটি আঞ্চলিক ইউনিট। এ ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ ২৫ মার্চের জনসভাতেই ঘোষণা করা হয়েছিল।
দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই আমাদের কর্মীরা মুক্তিবাহিনীর সাথে একযোগে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সেটা সম্ভব না হওয়ার বিশেষ কয়েকটি এলাকায় গেরিলা ফৌজ গঠন করতে হয়। এই এলাকাগুলো ছিল নিন্মরূপঃ
১। ঢাকা জেলার শিবপুর, মনোহরদি, রায়পুর ও কলিগঞ্জ নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মান্নান ভুঁইয়ার নেতৃত্বে গেরিলা ফৌজের সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। এই এলাকায় যুদ্ধকালে অন্য কোন বাহিনী গঠিত হয় নি, এমনকি রাজাকার বা বদর বাহিনী ও গঠিত হতে পারেনি। প্রসংগত একটি দুঃখজনক ঘটনা ছিলঃ মাঝে মাঝে মিথ্যে রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে এখানে মুক্তি বা মুজিব বাহিনীকে পাঠানো হত আমাদের যোদ্ধাদের নিরস্ত্র করার জন্য। প্রায় ক্ষেত্রেই উল্টোটি ঘটতো, কিংবা গেরিলা তৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে আগত যোদ্ধারাও দলভূক্ত হয়ে যেতেন। এই এলাকায় আমাদের বিখ্যাত কমান্ডার ছিলেন পাকিস্থানের নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য নেভল সিরাজ। উল্লেখ্য যে, যুদ্ধকালে এই এলাকাটি আমাদের হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
২। কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ অঞ্চল। এখানে গেরিলা ফোউজের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার।
৩। টাংগাইলে প্রথমদিকে গেরিলা নেতা কাদের সিদ্দিকীর সাথে ভুল বোঝাবুঝি হলেও পরে মতৈক্যের আমাদের প্রায় পাঁচ হাজার যোদ্ধা অংশ নেন। কাদের সিদ্দিকি দলীয় সংকীর্ণতায় থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের কর্মীরা তার নেতৃত্বে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
৪। খুলনা জেলার সাতক্ষীরায় সৈয়দ কামেল বখতের নেতৃত্বে প্রায় দু’হাজার সদস্যের গেরিলা ফৌজ গড়ে ওঠে। এখানে যুদ্ধের একপর্যায়ে মুজিব বলে কথিত একদল লোকের হাতে বীরযোদ্ধা কামেল মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া বাগেরহাট সদর, বিষ্ণুপুর, রঘুনাপুর প্রভৃতি এলাকায় গেরিলা ফৌজের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ হাজার। এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা খুব কম ছিল।
৫। রাজশাহী জেলার আত্রাই অঞ্চলে আফতাব মোল্লার নেতৃত্বে প্রায় দু’হাজার সদস্যের গেরিলা ফৌজ গড়ে ওঠে। সেখানে আমাদের গেরিলারা স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অন্য এক বামপন্থী নেতা অহিদুর রহমানের সাথে তাদের সংগাত হয়।
৬। ফরিদপুরের বোয়ালমারী এবং মাদারীপুরের একটি অঞ্চলে নিয়ে সাদেকুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকশত সদস্যের গেরিলা ফৌজ গড়ে উঠেছিল।
৭। চট্রগ্রাম শহর ও রাইজান এলাকায় শামসুল আলমের নেতৃত্বে কয়েকশত গেরিলা ফৌজ গড়ে ওঠে। এখানে মুক্তিবাহিনী বা নিয়মিত সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় নি। এখানে আমাদের যোদ্ধারা প্রধানতঃ চট্রগ্রাম শহর এলাকায় গেরিলা তৎপরতা পরিচালনা করছিলেন।
৮। নোয়াখালীর ফেনী অঞ্চলে গড়ে ওঠেছিল কয়েকশত সদস্যের গেরিলা ফৌজ।
আগেই বলেছিঃ কেবল সেই সব অঞ্চলেই গেরিলা ফৌজ গঠিত হয়েছিল যেখানে সরকারি মুক্তিবাহিনী (বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআরসহ) ছিল না কিংবা থাকলেও সংকীর্ণতার কারণে ওতে আমাদের কর্মিরা যোগ দিতে পারেনি। দেশের অন্যসকল এলাকায় কর্মীরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে অধিনায়কের নির্দেশে যুদ্ধ করেছেন- কোন প্রকার দলীয় বিভেদাত্মক কার্যকলাপ তারা চালান নি। সেই প্রেক্ষিতে যুদ্ধ শেষে হিসেব অনুযায়ী যুদ্ধশেষে আমাদের সংগঠনের কর্মী সব মিলিয়ে ছিল প্রায় ত্রিশ হাজার। দেশের অভ্যন্তরে একমাত্র শিবপুর এলাকায় আমাদের নিজস্ব প্রশিক্ষণ শিবির ছিল। প্রশিক্ষণের ব্যাপারে যুদ্ধকালে যে ক’জন সামরিক অফিসার সহযোগিতা করেছিলেন তারা হলেনঃ মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর আবুল মঞ্জুর, মেজর খালেদ মোশারফ, মেজর এম এ জলিল। এছাড়াও মেজর হায়দার, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন এনাম, ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নাম উল্লেখযোগ্য।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যুদ্ধকালে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটির পক্ষে সরাসরি নেতৃত্ব বা যোগাযোগ প্রতিষ্টা করা সম্ভব ছিল না, ফলে যেখানে কমিটির যে সংগঠন বেশি শক্তিশালী ছিল সেখানে অন্য সংগঠনের সদস্যরা তার অধীনে মিলিতভাবে যুদ্ধ করতো। সংগঠন হিসাবে আমাদের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি নিজেদের মধ্যে মোটামুটি যোগাযোগ রক্ষা করতে পারতো। যেখানে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি সেখানে পূর্বঘোষিত নির্দেশানুযায়ী কর্মীরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আমাদের পক্ষ থেকে যুদ্ধের কোন পর্যায়েই সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়নি। জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল স্রোতধারার সাথে আমরা মিশে গিয়েছিলাম। মাও সে তুঙ্গের চিন্তাধারা প্রেরণার অন্যতম উৎস হলেও যুদ্ধাকালে গনচীনের ভূমিকার আমরা তীব্র সমালোচনা করেছিলাম। মার্কিন সম্রাজ্যবাদ ছিল আমাদের ঘোষিত শত্রু। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বিশেষ করে ভারতের সাহায্যকে আমরা স্বাগত জানালেও সে প্রশ্নে আমাদের সন্দেহ ছিল, সংশয় ছিল। আমরা কোন পর্যায়েই চাইনি ভারতের সেনাবাহিনী আমাদের যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিক। ভারতের বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন বিশেষ করে মার্কসবাদী কমিউনিষ্ট পার্টির সহযোগীতা আমাদের উপকারে এসেছে। এই সাহায্য ছিল প্রধানত নৈতিক। অনেক সময় তাঁরা আমাদের আশ্রয় এবং খাওয়ার ব্যাবস্থা করেছেন, বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের সাহায্যের ফলে শত্রুর হামলার কবল থেকে আমাদের জীবনও বেঁচে গেছে।
যুদ্ধ চলাকালে বাঙালি সামরিক অফিসারদের মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমান,, মেজর খালেদ মোশারফ এবং মেজর আবুল মঞ্জুর আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের একাংশের কার্যকলাপ সম্পর্কে বিক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ। ভারতের সেনাবাহিনীর অযাচিত হস্তক্ষেপও তাদের ক্ষুদ্ধ ও নিরুৎসাহী করতো বলে মনে হয়েছে।
এই সময় কলকাতার একটি হোটেলে আমার সাথে আলোচনা হয় মুজিব বাহিনীর দুই নেতা এবং আমার এককালীন বন্ধু ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের সাথে। মুজিব বাহিনী গঠনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা বলেছিলেনঃ “আমরা নিশ্চিত নই যে মুজিব বেঁচে আছেন কিনা, কিংবা তিনি জীবিত অবস্থায় ফিরে আসবেন কিনা। যদি না আসেন তাহলে যে শুন্যতার সৃষ্টি হবে তার জন্যই মুজিব বাহিনী-যাতে (পরিহাসচ্ছলে) তোমরা কিংবা সামরিক বাহিনীর কোন বাঙালি অফিসার সে শুন্যতার সুযোগ নিতে না পারে। তাঁদের বক্তব্যে বোঝা গিয়েছিল যে তাঁরা বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোন কোন কমান্ডার সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয় কিংবা আশংকায় আছেন।
ভারতসহ বিদেশে অবস্থানরত বাঙালি প্রগতিশীলরাও আমাদের নানাভাবে সাহায্য করছিলেন। বিশেষ করে বৃটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালিরা এ ব্যাপারে ছিলেন বিশেষ ভূমিকায়।
-কাজী জাফর আহমদ
মার্চ, ১৯৮৪