বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১২ই ডিসেম্বর, বুধবার, ২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮০
কার্যকর উপায় উদ্ভাবনের প্রয়োজন
বিশ্বব্যাপী মানুষ আজ মানুষের ন্যায্য অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই চায় অত্যাচার, অবিচার, নিপীড়ন ও অমানবিক নির্যাতনের করালগ্রাস থেকে রক্ষা পেতে। কিন্তু বিশ্বের দেশে দেশে নির্যাতন ও লাঞ্ছনার কি ইতি ঘটেছে? আমরা যতই মানবাধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার হই না কেন, বিশ্বের বুক থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিহ্ন এখনো লুপ্ত হয়ে যায়নি। ধনবাদী দেশগুলোতে নিত্যনিয়ত মানবাধিকার পদদলিত হচ্ছে, শোষণ ও শাসনের নামে মানুষ মানুষের ওপর চালাচ্ছে নির্যাতন ও নিপীড়নের এক মারণযজ্ঞ। বর্ণ বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়ে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জীবনে নেমে আসছে নিরন্ধ্র অন্ধকারের জগদ্দল পাথর। এমনি করেই মানুষ হারাচ্ছে তাদের মৌলিক অধিকারের শর্তাবলী। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশ জাতিসংঘে আনীত প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানায় না। তাই যখনই বিশ্বের কোন দেশে মানবতা ধুলায় লুণ্ঠিত হয়, তখন মানবতার জয়গান গাইতে কিংবা ধূলি ধূসরিত কালিমালিপ্ত মানবতাকে রক্ষার জন্য কোন বাস্তব উপায় উদ্ভাবিত হয় না।
আর্ত মানবতার করুণ হাহাকারে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন বাংলাদেশের নিরীহ জনসাধারণের ওপর সশস্ত্র পাশবিক আক্রমণের ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, তখনও জাতিসংঘ মানবিক অধিকার সংরক্ষণের দাবিতে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। রক্তপাতময় এক দূর্জয় সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্বাধীনতার রক্তিম পতাকা অবশেষে উড্ডীন হয়েছে। তাই, বাংলাদেশের মানুষ মানবিক অধিকার রক্ষার সংকল্পে অটুট ও অবিচল। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানেও মানবাধিকারের প্রতি আন্তরিক আনুগত্য ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা পঁচিশতম বার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমাদের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন যে, জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলো যাতে মৌলিক মানবাধিকারের বরখেলাপ করতে না পারে সেজন্যে অবশ্যই একটি কার্যকর উপায় উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি সোচ্চার কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন যে, বাংলাদেশের জনগণ কথায় এবং কাজে বিশ্বজনীন মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এবং মানবিকতার উজ্জ্বল পতাকাকে সমুন্নত রাখবে। রাষ্ট্রপতি বিশ্বের বিভিন্ন সামরিক একনায়কদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় উল্লেখ করেছেন। সামরিক স্বৈরাচারীর নিষ্পেষণে বাংলাদেশের মানুষ এক বুক রক্তের ভেতর থেকে নতুন জীবন লাভ করেছে। তাই বাংলার মানুষ সামরিক জান্তার নিপীড়নের স্বরূপটি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে। মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণ যে ঐক্যবদ্ধ, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহের কারণ নেই।
কিন্তু জাতিসংঘ যদি মানবাধিকার রক্ষাকল্পে প্রতিষ্ঠানগতভাবে কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বন না করে, তাহলে মানবাধিকারের প্রশ্নটি নিতান্ত বায়োবীয় ব্যাপারেই পরিণত হবে বলে আমরা মনে করি। জাতিসংঘ মানবাধিকার দলিল বাংলাদেশ মানবে। কিন্তু জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলো যদি মানবাধিকার দলিল লংঘন করে, তাহলে সমস্ত ব্যাপারটাই একটা হাস্যকর কাগুজে বিধানেই সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য। আমরা আশা করি, মানবাধিকার দলিল জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলো যাতে মেনে নেয়ার নিশ্চয়তা বিধান করে, সে ব্যাপারে জাতিসংঘের বাস্তব পন্থা অবলম্বন করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
ঘূর্ণিঝড় ও সমন্বিত ত্রাণ কর্মসূচী
আবার ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেলো। দক্ষিণাঞ্চলের সাতটি জেলা এই ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছে গত সোমবারে সর্বশেষে পাওয়া খবর অনুসারে এই ঘূর্ণিঝড়ে ৪৮ জনের মৃত্যু, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি ও আনুমানিক ৫০ ভাগ কাঁচাবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এটা প্রাথমিক হিসাব। বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় নতুন নয়। মাসখানেক আগেও একবার তীব্র নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময় সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণকার্য পরিচালনার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। এবারের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপদ্রুত এলাকার জনগণের ত্রাণ কাজেরও ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্গত এলাকায় সামগ্রিক ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের জন্য সমন্বিত ত্রাণ কর্মসূচি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এজন্য তিনি ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতির প্রতি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দান করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত এবারকার ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দুর্গত এলাকার দুঃস্থ মানুষদের মধ্যে কেবল নগদ অর্থ কিংবা জিনিসপত্র বা সাময়িক ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ না করে সে সব মানুষ যাতে তাদের নিজেদেরকে স্থায়ীভাবে নিজ নিজ কর্মজীবনে পুনর্বাসিত করতে পারে সে জন্য শস্য উৎপাদনে বীজ, সারা, পাওয়ার পাম্প, হালের গরু ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ দিয়ে সাহায্য করা। দুর্গত এলাকার সংগ্রামী মানুষও শুধু সাময়িক সাহায্য সামগ্রী চায় না। তারাও নিজেদের দ্বারাই পুনর্বাসিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম ও কৃষি সাহায্য চায়। এ ধরনের সাহায্যের সুফলও সুদুরপ্রসারী। সুতরাং আমরাও একে শুভ কর্মসূচি বলে উল্লেখ করতে চাই।
প্রকৃতির খেয়ালীপনার হাত থেকে পরিত্রান পাওয়ার আজও পথ হয়নি। তাই প্রকৃতির তাণ্ডবলীলাকে মেনে না নিয়েও উপায় থাকে না। শুধু মাত্র ধ্বংসের বুকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। পুনর্বাসনের সে কর্মসূচি নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুও নির্দেশ দিয়েছেন। এক্ষণে অবশিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ভর করছে ত্রাণ কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মীদের উপর। তাদের সুসংহত পরিকল্পনা যথার্থভাবে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়ার প্রতিই নির্ভর করে পরিকল্পনা ও নির্দেশের পূর্ণ সাফল্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গতকালকের একটি দৈনিকেই খবর বেরিয়েছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ সত্ত্বেও নাকি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সাহায্য পাঠানো হয়নি। খবরটি সত্য হলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের মানবতাহীন দায়িত্ব বোধেরই পরিচয় মিলবে।
আমরা আশা করি অন্ততঃ মানবতার সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই এমন হীন মনোবৃত্তির পরিচয় দেবেন না। আমরা আরো আশা করি আর্তের সেবায় নিয়োজিত বন্ধুরা তাদের কথায় এবং কাজে কেবল মানবতার প্রশ্নটিই সর্বাগ্রে স্থান দিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত সমন্বিত ত্রাণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে উপদ্রুত এলাকার দুঃস্থ জনগণ নিজেদের দ্বারাই পুনর্বাসিত হতে সক্ষম হবেন। সর্বশেষ দুর্গত এলাকার জনগণের প্রতি দেশবাসীর সঙ্গে আমরাও আমাদের গভীর সমবেদনা এবং তাদের দুঃখে একাত্মতা ঘোষণা করছি।
ভোটার তালিকা নিয়ে ব্যবসা
যেখানে দেখিবে ছাই, কুড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো মানিক-রতন। এককালে এদেশের মানুষ ছাই কুড়াবার মত পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজ করতেও পিছ-পা হতো না। কিন্তু বর্তমানে ঠিক তার উল্টো রীতিনীতিই চালু হয়েছে। সমাজের একশ্রেণীর মানুষ এখন আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জন করতে রাজি নয়। চোরাচালান, মজুতদারী, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো থেকে যত রকমের অকাজ-কুকাজ করতে এই শ্রেণীর মানুষগুলো পিছ-পা হয়না। শহরাঞ্চলে যেমন চলছে গ্রামাঞ্চলেও একই অবস্থা। গতকাল স্থানীয় একটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, সিরাজগঞ্জ নির্বাচনী কমিশনের কার্যালয়ে ভোটার তালিকা নিয়ে রীতিমতো যাত্রা শুরু হয়েছে। নির্বাচনী অফিস থেকে ভোটার তালিকা ক্রয়ের রসিদ চাইলে রসিদ ফুরিয়ে গেছে বলে নির্বাচনী কার্যালয়ের কর্মচারীদের উপর চাপ দিলে এখানে ভোটার তালিকাই নেই বলে তাদের বিদায় করে দেয়া হয়।
সংবাদে আরো প্রকাশ, জনৈক ব্যক্তি ভোটার তালিকা ক্রয়ের জন্য নির্বাচনী কার্যালয়ে গেলে জনৈক কর্মচারী ভোটার তালিকার মূল্য হিসেবে ৫১ টাকা দাবী করে। এতে করে ক্রেতার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হলে তিনি অন্য ব্যক্তির সাহায্য নেয়ায় তার কাছ থেকে ভোটার তালিকার মূল্য হিসেবে ৩৯ টাকা রাখা হয়। ৩৯ টাকা নেয়ার পরও ভোটার তালিকা ক্রয়ের কোন রসিদ নির্বাচনী কর্মচারীরা দেয়নি।
এ অভিযোগ যদি সত্য হয় তাহলে আতঙ্কগ্রস্থ হবার কারণ থাকে বৈকি! কারণ বর্তমান সরকার দেশের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে একটা সুষ্ঠু গতি আনয়নের জন্য ইউনিয়ন পরিচয় নির্বাচনের আয়োজন করেছেন। গ্রাম বাংলায় ইউনিয়ন পরিষদই সাধারন মানুষের সুখ দুঃখ, চাওয়া পাওয়ার প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। সরকারকে নানান গ্রামীণ অভাব অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত করবেন। অথচ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করতে গিয়ে শুরুতেই যদি ভোটার তালিকা কিনতে গিয়ে অতিরিক্ত মূল্য দিতে হয় তাহলে পরবর্তী সময়ে ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে অনেকে হয়তো অতিরিক্ত মূল্যের মাশুল নিরীহ গ্রামবাসীদের কাছ থেকে আদায় করতে পারেন। সে সম্ভাবনা যে নেই এমন নয়। সুতরাং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিৎ বিসমিল্লায় যে গলদ তা দূর করা অর্থাৎ ভোটার তালিকার ব্যবসাটি বন্ধ করাই হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আশা করি কর্তৃপক্ষ এ সম্পর্কে যথাযথ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক