You dont have javascript enabled! Please enable it! নবীনগর আক্রমণ,নােয়াগাঁও অভিযান,কাসিমপুর সেতু ধ্বংস, ,কলামুড়া ব্রিজে অ্যামবুশ, ধনদইল গ্রামে অ্যামবুশ, - সংগ্রামের নোটবুক
নবীনগর আক্রমণ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে নবীনগর থানা অবস্থিত। পাকিস্তানিদের ১টি দল নবীনগরে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে পাকিস্তানি সেনারা নবীনগরে অবস্থান গ্রহণের পর মুক্তিযােদ্ধাদের নরসিংদী, ভৈরববাজার ও কালীগঞ্জে যাতায়াতের রাস্তায় বাধার সৃষ্টি করে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন এ এলাকাকে পুনরায় বিপদমুক্ত করার জন্য ১৬জনের ১টি দলকে হাবিলদার। আওয়ালের নেতৃত্বে নবীনগর পাঠান। হাবিলদার আওয়াল কসবার উত্তর দিক দিয়ে অনুপ্রবেশ করে নবীনগরের ৩ মাইল পশ্চিমে তার গােপন ঘাঁটি স্থাপন করেন। এরপর স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তায় পাকিস্তানিদের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করেন। ৮ জুলাই সকাল ৬টায় পাকিস্তানিদের নবীনগরের অবস্থানটির ওপর তারা অতর্কিত আক্রমণ করেন। অতর্কিত এ আক্রমণের জন্য পাকিস্তানি সেনারা মােটেই প্রস্তুত ছিল না। এ সংঘর্ষে আনুমানিক ৭জন পাকিস্তানি সেনা এবং ৫জন দালাল নিহত হয়। ১জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন।
নােয়াগাঁও অভিযান
কসবা থানার মন্দভাগ এলাকায় নাপ্তারবাজার ও কামালপুর গ্রামের উত্তর দিকের। গ্রামটির নাম নােয়াগাও। ঐ গ্রামে পাকিস্তানিদের ১টি শক্ত ঘাঁটি ছিল। কয়েক দিন পর পরই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নােয়াগাঁও স্কুলঘর ও স্কুল মাঠে স্থানীয় মেম্বর, চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ডেকে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে মিটিং করতাে। এসব মিটিংয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিবাহিনীর সব কর্মকাণ্ড ঠেকানাে। স্কুল মাঠের পাশের বটগাছটিতে ছিল ১টি ওপি (Observation Post)। ১৭ জুলাই ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার ওহাব নির্ভরযােগ্য সূত্রের মাধ্যমে সংবাদ পান যে, পরদিন সকাল ১০টার সময় নােয়াগাঁও স্কুল মাঠে। পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের উপস্থিতিতে স্থানীয় মেম্বর, চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। সুবেদার ওহাব মর্টার প্লাটুন অধিনায়ক সুবেদার শামসুল হককে মিটিং চলাকালে নােয়াগাঁও স্কুল এলাকায় আক্রমণ পরিচালনার কথা জানান। এ আক্রমণে তিনি সুবেদার শামসুল হকের মর্টার ডিটাচমেন্টের সাপাের্ট ফায়ার চান। সুবেদার শামসুল হক এতে সম্মতি দেন। | ১৮ জুলাই সুবেদার ওহাব তার ৭ নম্বর প্লাটুনের ৪০-৫০জন সৈনিক নিয়ে। ভােরেই নােয়াগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সাথে সুবেদার শামসুল হকসহ মর্টার প্লাটুনের ৭জনের ১টি মর্টার ডিটাচমেন্ট। তাঁরা ঝােপঝাড়ের ভেতর দিয়ে নােয়াগাঁও স্কুলঘরটিকে সামনে রেখে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে নেন। সুবেদার শামসুল হকও তার ৩ ইঞ্চি মর্টারটি ১টি সুবিধাজনক স্থানে বসালেন।
যথারীতি পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে স্থানীয় মেম্বর, চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মিটিংয়ের কাজ শুরু হয়। সুবেদার ওহাব তার এলএমজিটি নিয়ে ঝােপঝাড়ের আড়াল নিয়ে শত্রুর অবস্থানের ৩০০ গজের মধ্যে পৌছালেন। সাথে নিলেন মর্টার ডিটাচমেন্টের ১জন সৈনিককে। ঐ সৈনিকের কাজ ছিল মর্টারের গােলা নিক্ষেপের জন্য ওহাবকে প্রয়ােজনীয় কারেকশন দেওয়া। সুবেদার ওহাব এলএমজি এমন স্থানে। বসালেন, যা থেকে শত্রুর ওপর কার্যকরভাবে গুলি নিক্ষেপ করা যায়। সুবেদার
ওহাব প্লাটুনের সব সদস্যকেই তার এলএমজি থেকে প্রথম ব্রাশফায়ারের। আওয়াজ শােনার পর সব অস্ত্র থেকে একযােগে গুলি ও গােলা নিক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৮ জুলাই আনুমানিক বেলা ২টার মতাে হবে। মিটিংয়ের বিরতি দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পায়চারি করতে দেখা গেল। মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই এদিক-সেদিক হাঁটাচলা করতে দেখা যায়। সুবেদার ওহাব তার বাইনােকুলার (দূরবীক্ষণ যন্ত্র) দিয়ে সব নিরীক্ষণ করছিলেন। একসময় শত্রুও। ২জন অফিসার এবং ১জন জেসিওকে স্কুল মাঠসংলগ্ন ওপিতে ওঠে বাইনােকুলারের সাহায্যে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলাে পর্যবেক্ষণ করতে দেখা। গেল। সুবেদার ওহাব এ সুযােগটি ছাড়তে চাইলেন না। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলাে তাঁর এলএমজি। এক ঝাক ব্রাশফায়ারের গুলি গিয়ে বিধলাে ওপিতে অবস্থানকারী শত্রু সৈন্যদের শরীরে। সাথে সাথে সব কয়টি অস্ত্র থেকেই গুলি ও গােলা নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। সুবেদার শামসুল হকও তার ৩ ইঞ্চি মর্টারটি থেকে স্কুলের অবস্থানের ওপর গােলা নিক্ষেপ করতে থাকেন। মুহূর্তের মধ্যেই পুরাে এলাকাটি একটি যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিয়ে নেয়। ওপিতে অবস্থানকারী ১জন শত্রুর মৃতদেহ মাটিতে পড়ে যেতে দেখা গেল। সম্ভবত ওপিতে অবস্থানকারী ২জন অফিসার এবং ১জন জেসিও’র মধ্য থেকে ১জনকে মূল প্রতিরক্ষার দিকে দৌড়ে যেতে দেখা গেল। কিছুক্ষণ পরই পাকিস্তানিদের উজানীসার অবস্থান থেকে ব্যাপক আর্টিলারি মিডিয়াম গানের গােলা নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। সুবেদার ওহাব তাঁর প্লাটুনকে ত্বরিত অবস্থান ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন। এটি ছিল সুবেদার ওহাবের ৭ নম্বর প্লাটুন কর্তৃক একটি সফল রেইড অপারেশন। এ অপারেশনে শত্রুপক্ষের ২জন অফিসারসহ অনেকেই হতাহত হয়েছিল। সুবেদার ওহাবের মুক্তিযােদ্ধাদের কেউ হতাহত হন নি।
কাসিমপুর সেতু ধ্বংস
কসবা থানাটি একেবারে সীমান্তবর্তী থানা এবং এর ভেতর দিয়ে রেললাইন চলে যাওয়ায় তার গুরুত্ব অত্যধিক। কসবার কাসিমপুরে অবস্থিত রেলসেতুটি তাই গুরুত্বপূর্ণ। কাসিমপুর রেলওয়ে সেতুর কাছে পাকিস্তানিদের ২টি প্লাটুন অবস্থান নিয়ে সেতুটি প্রহরার কাজে নিযুক্ত হয়। এ সেতুটিকে ধ্বংস করার জন্য ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ নির্দেশ পাওয়ার পর ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন সেতুটি রেকি করার জন্য ডেমােলিশন এক্সপার্টসহ ১টি রেকি পার্টি পাঠান। এ রেকি পার্টিটি শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে এবং সেতুটি সম্পর্কে বিস্তারিত খবর নিয়ে আসে। এরপর ১৮ জুলাই রাত ৮টায় ১টি রেইডিং প্লাটুন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে কাসিমপুর সেতুর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাত ২টার সময় সেতুটির নিকটবর্তী অবস্থানের ওপর প্লাটুনটি আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে প্রায় ১৭জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং যারা বেঁচেছিল, তারা অবস্থানটি পরিত্যাগ করে খাইরাতুল্লায় পালিয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের অবস্থান। থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেন।
কলামুড়া ব্রিজে অ্যামবুশ
কলামুড়া ব্রিজ কসবা থানার অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু। পাকিস্তানিরা এ ব্রিজ ব্যবহার করে এলাকায় তাদের ডেমােলিশন চালু রেখেছিল। আগস্ট মাসের এক রাতে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন গাফফার কলামুড়া ব্রিজ ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রুদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে ব্যস্ত রাখার জন্য সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে ৫টি অ্যামবুশ দল ৫ জায়গায় প্রেরণ করা হয়। রাত ১২টা থেকে ভাের পর্যন্ত তারা শত্রুদের অবস্থান সাহেবপাড়া, শালদা নদী। গােডাউন, শালদা প্রভৃতি জায়গায় হঠাৎ করে আক্রমণ করে শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। আর এদিকে পরিকল্পনা মতাে ইপিআর-এর সুবেদার আম্বিয়ার নেতৃত্বে ১টি প্লাটুন কলামুড়া ব্রিজে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে রাত ২টার সময় ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়। এ কাজে রাজাকাররা মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করে। ৭জন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ক্যাপ্টেন গাফফারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারা মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেয় এবং দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তারা ক্যাপ্টেন গাফফারের সাথেই ছিল।
ধনদইল গ্রামে অ্যামবুশ
ধনদইল গ্রামটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ও কুমিল্লা জেলার সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত। এখানে বেশ কিছু উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ হয়। ২৫ আগস্ট সকাল ৯টার সময় পাকিস্তানিদের ১টি প্লাটুনকে ব্রাহ্মণপাড়া থেকে ধনদইল গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়। মুক্তিবাহিনীর ১টি প্যাট্রল পার্টি দূর থেকে পাকিস্তানিদের অগ্রসর হতে দেখে ধনদইল গ্রামে অ্যামবুশ পাতে। | পাকিস্তানি সেনারা অ্যামবুশের ভেতর এসে গেলে তারা তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে ১জন ক্যাপ্টেনসহ ১০জন পাকিস্তানি সেনা। নিহত হয়। অবশিষ্ট সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। পরের দিন মুক্তিযােদ্ধাদের এ টহল দলটি উত্তর নাগাইশ ও ছােট নাগাইশ গ্রামের মাঝে শালদা নদীর পাড়ে অ্যামবুশ পাতে। সকাল ৫টায় মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ দল। পাকিস্তানিদের ১টি টহল দলকে শালদা নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে অগ্রসর হতে দেখে।  পাকিস্তানিদের এ দলটি তাদের কয়েকটা সরবরাহকারী নৌকাকে নয়নপুর থেকে মন্দভাগের দিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাে। এ দলটি মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশের আওতায় আসার সাথে সাথে তাদের ওপর আক্রমণ চালান। সঙ্গে সঙ্গে ২টি নৌকা ধ্বংস এবং ১৪জন সৈনিক নিহত হয়। পাকিস্তানিদের অপর দলটি মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশ পার্টির প্রতি পাল্টা গুলি চালায়। প্রায় ১ ঘন্টা উভয় পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় চলতে থাকে। নয়নপুর থেকে আরও ২টি নৌকায় পাকিস্তানি সেনারা তাদের দলটিকে শক্তিশালী করার জন্য অগ্রসর হয়। প্রথম নৌকাটি মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে ডুবে যায় এবং ৫জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অনন্যোপায় হয়ে দ্বিতীয় নৌকার সৈন্যরা তীরে নেমে পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা সমস্ত দিন ও রাত হরিমঙ্গল, শশীদল ও সেনের বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের সেনের বাজার ও গৌরাঙ্গ অবস্থানের ওপর গােলাবর্ষণ করতে থাকে। পরের দিন সকাল ৯টায় ৩০জন পাকিস্তানি ২টি নৌকায় সেনের বাজার ও গৌরাঙ্গ অবস্থানের দিকে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার সময় মুক্তিযােদ্ধাদের মেশিনগানের গুলিতে ২টি নৌকা ডুবে যায় এবং পাকিস্তানি সব সেনা নদীতে ডুবে নিহত হয়।
মুকুন্দপুরে অ্যামবুশ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার (জেলা সদর) দক্ষিণে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা থানা আখাউড়ায় মুকুন্দপুর অবস্থিত। এখানে পাকিস্তানিদের রেলপথে যাতায়াতে। বাধা সৃষ্টি করার জন্য মুক্তিযোেদ্ধারা রেললাইনে ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে রাখতেন। এ ব্যাপারে পাকিস্তানিরা বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে। তারা। | রেলগাড়ির ইঞ্জিনের আগে ২-১টি করে ওয়াগন জুড়ে দিত। এতে ঐ। ওয়াগনগুলােই প্রথম বিধ্বস্ত হতাে এবং ট্রেনের বিশেষ কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হতাে না। তাদের এ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযােদ্ধারা অন্য কৌশল অবলম্বন। করেন। মাইন এমনভাবে ফাটে, যাতে ট্রেনের বিশেষ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই ট্যাংকবিধ্বংসী মাইনকে ফাটানাের জন্য মুক্তিযােদ্ধারা বিদ্যুতের সাহায্যে | (ইলেকট্রিক ডেটোনেটিং সিস্টেম) নেন, যা মুক্তিযােদ্ধাদের ইচ্ছামতাে মাইন। ফাটানাের সুবিধা দেয়। এ পদ্ধতিতে ট্রেন ধ্বংস করার জন্য মুকুন্দপুর এলাকায়। ১টি অ্যামবুশ পাতা হয়। অ্যামবুশ পাতা হয়েছিল ২টি অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন | ‘দয়ে। তার সাথে বৈদ্যুতিক তার যােগ করে প্রায় ৩০০ গজ দূরে কন্ট্রোল স্থাপন করা হয়। সেখান থেকে সুইচ টিপলে যেন মাইন ফেটে যায়। ১৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানিদের প্রায় এক কোম্পানি সৈন্য ট্রেনে করে আখাউড়া থেকে মুকুন্দপুর হয়ে হরশপুর পর্যন্ত যাওয়ার পরিকল্পনা করে। মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশ ছিল। মাঝামাঝি জায়গায় মুকুন্দপুরের কাছে। ঐ ট্রেনে ২জন পাকিস্তানি অফিসারও ছিল। পাকিস্তানিদের ট্রেনের সম্মুখভাগে ২টি বালুবােঝাই ওয়াগন লাগানাে ছিল। রাত তখন প্রায় ৪টা। যখন ট্রেন মুকুন্দপুর থেকে হরশপুরের দিকে যাত্রা করে, তখনই মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশ পার্টি তৎপর হয়ে ওঠে। ট্রেন আস্তে আস্তে অগ্রসর হচ্ছে। বালুবােঝাই ওয়াগন ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পার হওয়ার পর যখন। ইঞ্জিন ও সৈন্যবােঝাই ওয়াগন মাইনের ওপরে আসে, তখনই সুইচ টিপে মাইন ফাটানাে হয়। এতে ইঞ্জিনসহ সৈন্যবােঝাই ওয়াগন ধ্বংস হয়। এ অপারেশনে। ২জন অফিসারসহ ২৭জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় বলে জানা যায়, তা ছাড়া অনেকে আহত হয়েছিল। এ অ্যামবুশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট মােরশেদ। বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়ায় ট্রেন ধ্বংস করার। পদ্ধতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এটাই প্রথমবারের মতাে ব্যবহার করা হয়।
চারগাছ বাজারের যুদ্ধ
কসবা থানায় মুলগ্রাম ইউনিয়নে চারগাছ বাজারের অবস্থান। ক্যাপ্টেন। আইনউদ্দিন আগরতলার মনতলা থেকে ১ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধাকে কসবা, নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুর এ ৩টি থানায় অপারেশনের জন্য পাঠান। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে এ কোম্পানিতে ১৪৫জন সৈন্য ছিল। কোম্পানিটি দেড় মাস ধরে উল্লিখিত থানায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন করে। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি দল ৩টি লঞ্চযােগে চারগাছ এলাকায় আসে এবং ২ দিন সেখানে থাকে। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা সুবেদার আউয়াল ও হাবিলদার আব্দুল হালিমের নেতৃত্বে তাদের প্রতিহত করার জন্য ওত পেতে থাকেন।
পাকিস্তানিদের লঞ্চ যখন চাঁদপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, তখন মুক্তিযােদ্ধারা লঞ্চের পেছন দিক থেকে গুলি করতে আরম্ভ করে। শত্রু লঞ্চগুলাের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে এক জায়গায় আটকিয়ে ফেলে। মুক্তিযােদ্ধাদের আঘাতে পাকিস্তানিদের অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কিছু। পাকিস্তানি সেনা সাঁতরিয়ে অন্য গ্রামে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ৪-৫জন সৈন্য লঞ্চ থেকে নেমে বােটে করে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা ঐ বােটটিকে গুলি করে ঘায়েল করেন। পাকিস্তানি সেনারা প্রায় সবাই খতম হলেও ১জন পাকিস্তানি বােটের মধ্যে লুকিয়েছিল। তাকে হাতেনাতে ধরার জন্য অন্য ১জন মুক্তিযােদ্ধা সাঁতরিয়ে বােটের কাছে যেতেই পাকিস্তানিটি উঠে। মুক্তিযােদ্ধাকে আঘাত করে এবং তিনি শাহাদতবরণ করেন। পরে মুক্তিযােদ্ধারা। পাকিস্তানিটিকে হত্যা করতে সক্ষম হন। ২টি লঞ্চের ভেতরে যে সমস্ত পাকিস্তানি সেনা জীবিত ছিল তারা ওয়্যারলেসে সংবাদ পাঠায় তাদের উদ্ধারের জন্য। পরে ৫টি লঞ্চভর্তি পাকিস্তানি সেনা তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে এবং তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
কাইমপুরের যুদ্ধ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানায় কাইমপুর অবস্থিত। এ স্থানে পাকিস্তানিদের  ১টি শক্ত অবস্থান ছিল। এখান থেকে শত্রু তার আশপাশের এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের গতিবিধির ওপর নজরদারি করতাে। এ অবস্থার অবসানের জন্য  ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন গাফফার কাইমপুর রেইড করার  পরিকল্পনা নেন।  ১৯ সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন গাফফার ১টি শক্তিশালী রেইডিং পার্টি নিয়ে শত্রু অবস্থানের পেছনে অনুপ্রবেশ করেন। তিনি পরদিন ভােরে এলাকাটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা সকাল ১০টায় পাকিস্তানি অবস্থানের পেছন দিক থেকে অতর্কিত আক্রমণ চালান। আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি সেনারা হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং আতঙ্কিত হয়ে ছােটাছুটি করতে থাকে। এ বিভ্রান্তি তাদের হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি করে।
চারদারী জগন্নাথপুরের যুদ্ধ
কসবা থানার কাইমপুর ইউনিয়নের চারদারী জগন্নাথপুরে পাকিস্তানি সেনারা সেপ্টেম্বর মাসে নৌকাযােগে শালদা নদীর পাড় দিয়ে আসে। চারদারী গ্রামের সামনে এসে তারা নদী পার হওয়ার চেষ্টা করে। পাকিস্তানি সেনারা নদীর মাঝখানে এলে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ারিং শুরু করে। ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর নৌকাটি ডুবে যায়। এবং কিছু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। নদীর পাড়ে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা তাদের সহযােগিতায় এগিয়ে আসে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। ফলে তুমুল যুদ্ধ বেধে যায়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা মাে. সাফিউদ্দিন শাহাদতবরণ করেন। গােপীনাথপুরের অ্যামবুশ সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন খবর পান যে, কুমিল্লা থেকে ২ কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা কসবা হয়ে সকাল ১০টার দিকে গঙ্গাসাগর আসবে। খবর পেয়ে মনতলী থেকে ৪৫জন মুক্তিযােদ্ধাকে পাঠান ২টি মেশিনগানসহ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈনিক নিয়ে রাতের বেলায় কোথায় কোথায় অ্যামবুশ করতে হবে তার স্থান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। স্থান হিসেবে কসবা থানার গােপীনাথপুর গ্রামের কাছে রেললাইনের ব্রিজের উত্তর ও দক্ষিণে অ্যামবুশ করার কথা বলা হয়। পাকিস্তানি সেনারা অ্যামবুশের আওতায় আসার পর পরই মুক্তিযােদ্ধারা একযােগে আঘাত হানেন। পাকিস্তানিদের ২টি কোম্পানির মাত্র ১০-১২জন বেঁচে যায়। এ অ্যামবুশের জন্য কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন হাবিলদার আবু বকর। অ্যামবুশকালে তিনি পাকিস্তানিদের কাছ থেকে ১২টি এলএমজিসহ প্রায় দেড় শ অস্ত্র উদ্ধার করেন। কিছু অস্ত্র পানিতে ডুবে যাওয়ায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ অ্যামবুশে ১জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন।
চক চন্দ্রপুরের যুদ্ধ
কসবা থানায় বিনাউটি ইউনিয়নে চক চন্দ্রপুরের অবস্থান। সেপ্টেম্বর মাসে লেফটেন্যান্ট আজিজের নেতৃত্বে হাবিলদার হালিমসহ ৯ম ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩টি প্লাটুন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী চক চন্দ্রপুরে পাকিস্তানিদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ করলে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে প্রায় ৬৩জন মুক্তিযােদ্ধা শাহাদতবরণ করেন এবং বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনাও। সেখানে মারা যায়।
কলাছড়া চা-বাগান রেইড
আখাউড়া থানায় কলাছড়া চা-বাগান অবস্থিত অক্টোবর মাসের শেষার্ধে লেফটেন্যান্ট হারুনুর রশীদ কলাছড়া চা-বাগান অপারেশন পরিচালনা করেন। এ চা-বাগানটি এরপর সব সময় মুক্ত ছিল। এ মুক্তাঞ্চলটি বাংলাদেশের সেনাদের কাছে অতিপ্রিয় ছিল, কারণ পরবর্তীকালে এ চা-বাগানটি পাকিস্তানি। সেনারা আর কখনােই তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি। পাকিস্তানিদের ১টি দল চা-বাগানে অবস্থান করছে, লেফটেন্যান্ট হারুন এ খবর পেয়ে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য লােক নিয়ােগ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি কোম্পানি ঐ বাগানে অবস্থান করছিল। লেফটেন্যান্ট হারুনের অধীনে ২ কোম্পানি সৈন্য ছিল। নিয়মমাফিক পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করতে হলে ২ ব্যাটালিয়ন দরকার। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা সাহস করে প্রস্তুতি নিলেন। ২টি কোম্পানির ১টির অধিনায়ক ছিলেন হাবিলদার হালিম এবং অপর কোম্পানির দায়িত্বে লেফটেন্যান্ট হারুন নিজে ছিলেন। এক রাতে মুক্তিযােদ্ধা ২টি কোম্পানি ভাগ হয়ে পাকিস্তানি অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি অবস্থানে আঘাত হানলেন। হাবিলদার হালিম যে কোম্পানি পরিচালনা করছিলেন, ঐ কোম্পানির ১জন যােদ্ধা প্রথমেই শহিদ হওয়ায় তারা আর সামনে অগ্রসর হতে পারেননি। কিন্তু লেফটেন্যান্ট হারুনুর রশীদ তাঁর কোম্পানি নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক সৈন্য হতাহত হয়। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর কিছু সৈন্য বাংকারে আশ্রয় নেয়।  মুক্তিযােদ্ধারা বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করে অনেক পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন। ঐ সংঘর্ষে পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে মুক্তিযােদ্ধারা এলএমজিসহ ১০০ অস্ত্র উদ্ধার করেন। এ সংঘর্ষে মুক্তিযােদ্ধাদের ৭জন আহত এবং ২জন শহিদ হন। পাকিস্তানিদের ২৭জন সেনার মৃতদেহ পাওয়া যায়। যুদ্ধের পরদিন সকালে ঐ স্থানের সাধারণ নাগরিকেরা ঐ সমস্ত পাকিস্তানি সেনার মৃতদেহ বহন করে আনেন এবং পরে দাফন করেন।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড