You dont have javascript enabled! Please enable it! ধরখার-উজানীসার ব্রিজের যুদ্ধ,কালতাদিঘির পাড়ে অ্যামবুশ,সরাইল সিঅ্যান্ডবি ব্রিজ ধ্বংস - সংগ্রামের নোটবুক
ধরখার-উজানীসার ব্রিজের যুদ্ধ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলােমিটার দক্ষিণে আখাউড়া থানার ধরখার ইউনিয়নে কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে ধরখার-উজানীসার ব্রিজটি অবস্থিত। ব্রিজের কাছে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিরক্ষা অবস্থানে (ডিফেন্সে) ছিল। ১৪-১৫ এপ্রিল কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে আসে। তারা কুটি চৌমুহনী থেকে এ ডিফেন্সের ওপর শেলিং আরম্ভ করলে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযােদ্ধারা পাল্টা গুলিবর্ষণ করেন কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে তারা টিকতে ব্যর্থ হন। তখন ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যােদ্ধারা ব্রিজটি ধ্বংস করে দিয়ে আখাউড়ার দিকে চলে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে এখানে প্রায় ১৫০জন শহিদ হন, যাদের তারা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু ব্রিজটি ধ্বংস। হওয়ায় তাদের রসদ সরবরাহ লাইনে অত্যন্ত অসুবিধা দেখা দেয়।
কালতাদিঘির পাড়ে অ্যামবুশ
কসবা থানার মন্দভাগ রেল স্টেশনের উত্তর পাশে কালতাদিঘির অবস্থান। ১২ এপ্রিল সংবাদ পাওয়া যায় যে, পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৭০জনের ১টি সৈন্যদল কসবা থেকে রেললাইন বরাবর দক্ষিণ দিকে শালদা নদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন গাফফারের অনুমতিক্রমে সুবেদার আব্দুল ওহাব তার নেতৃত্বাধীন ৭ নম্বর প্লাটুন নিয়ে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি বাহিনীকে অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা করেন। সুবেদার ওহাব তার দল নিয়ে মন্দভাগ রেল স্টেশনের উত্তর পাশে কালতাদিঘির পাড় গ্রামে পৌছেই জানতে পারেন, শত্রু ইতােমধ্যেই সালদা নদী এলাকায় পৌঁছে গেছে। তারা জেলা বাের্ড (ডিবি) রােড হয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সুবেদার ওহাব ত্বরিত কালতাদিঘির পাড় গ্রামে অ্যামবুশ স্থাপন করেন। কসবাতে পাকিস্তানি বাহিনীর এটিই একমাত্র পথ বিধায় শক্র নিশ্চিতভাবে ফাদে পড়বে। তিনি কড়া নির্দেশ জারি করেন, তাঁর নিজের অবস্থান থেকে ফায়ার
শুরুর আগে কেউ যেন গুলি না ছােড়ে। পশ্চাদপসরণের ও পুনঃসংগঠনের স্থান। নির্ধারণ করে দেন। শক্র পুরােপুরি অ্যামবুশ এলাকায় প্রবেশ করার পর পরই সুবেদার ওহাবের এলএমজি থেকে প্রথম ফায়ার আরম্ভ হয়। সাথে সাথে ৩৫টি অস্ত্র থেকে একযােগে গােলাগুলি শুরু হয়ে যায়। শত্ৰু ডিবি রােডসংলগ্ন খালটিতে নেমে আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু এ আচমকা আক্রমণে শত্রুপক্ষের ব্যাপক হতাহত হয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে উভয়পক্ষে অবিরত গুলিবিনিময় হয়। শত্রু বাহিনীকে তাদের হতাহত সৈনিকদের উদ্ধার করে নিয়ে যেতে দেখা যায়। এরপর সুবেদার ওহাব নিজ দলকে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন। সে রাতেই মুক্তিযােদ্ধারা দেবীপুরস্থ তাদের নিজ ক্যাম্পে পৌছেন। পরদিন ১৩ এপ্রিল খুব ভােরে সুবেদার ওহাব ২৫জনের ১টি সৈন্যদল নিয়ে কালতাদিঘির পাড় গ্রাম পর্যবেক্ষণের জন্য উপস্থিত হন। লােকজনের কাছে জানতে পারেন, সন্ধ্যার আগেই শত্রু তাদের হতাহতদের নিয়ে কসবায় চলে। গেছে। স্থানীয় লােকজনের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত হন যে ঐ অপারেশনে শত্রুর ১৮জন নিহত এবং ৯জন আহত হয়েছে। মুক্তিযােদ্ধাদের এ সাফল্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং লােকজন স্বাধীনতার ব্যাপারে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
সরাইল সিঅ্যান্ডবি ব্রিজ ধ্বংস
সরাইল থানার শাহবাজপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত পাকা সড়কে এ সিঅ্যান্ডবি ব্রিজটি অবস্থিত। আখাউড়া থেকে জেলার সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত নাসিরনগর পর্যন্ত পাকা সড়ক রয়েছে। এ সড়কপথেই পাকিস্তানি সেনারা কুমিল্লার সাথে যােগাযােগ রক্ষা করে এবং সৈন্য ও রসদ সরবরাহ করে। সরাইল থানাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও নাসিরনগরের মধ্যস্থলে অবস্থিত বিধায় সামরিক দিক থেকে সরাইল থানা শত্রু ও মুক্তিযােদ্ধা উভয়ের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। তাই উভয় পক্ষই চাইছিল এ এলাকার ওপর দখলদারি কায়েম রাখতে। এ লক্ষ্যে মুক্তিযােদ্ধারা পরিকল্পনা করেন যে যদি সরাইল থানার শাহবাজপুর ইউনিয়নের সিঅ্যান্ডবি ব্রিজ নামে পরিচিত ব্রিজটি ধ্বংস করা যায়, তবে পাকিস্তানিদের চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। পরিকল্পনা মােতাবেক ১৬-১৭ এপ্রিল মুক্তিযােদ্ধারা ঐ ব্রিজটি ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হন, ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকুমিল্লা সড়কপথে পাকিস্তানিদের যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হয়।
কসবা বাজার ও রেল স্টেশন আক্রমণ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সর্বদক্ষিণে ভারত সীমান্তে কসবা থানা অবস্থিত। সীমান্তের একেবারে কাছাকাছি কসবা বাজার ও রেল স্টেশন। ১৮ এপ্রিল রাতেই ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গাফফার কসবা বাজার ও কসবা রেলওয়ে স্টেশন আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে হঠাৎ করে শক্রদের ওপর আক্রমণ শুরু করে দেওয়া হয়। শত্রুরা এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারা এ আক্রমণে হতচকিত হয়ে পড়ে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে এ যুদ্ধ চলে এবং এর সাফল্য ছিল অপ্রত্যাশিত। শক্ররা তখন পর্যন্ত কোনাে বাংকার তৈরি করেনি। ফলে তারা গাড়িবােঝাই অস্ত্র ফেলে রেখে বাজারের কুড়েঘরে ও দোকানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ভাের সাড়ে ৪টায় আবার আক্রমণ করার সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন গাফফার লম্বা ১টা গাছের ওপর উঠে শত্রুদের অবস্থান দেখে নেন এবং তার সহযােদ্ধাদের ৩টি প্লাটুনে ভাগ করে তিন দিক দিয়ে পাকস্তানিদের ঘিরে ফেলেন। একটিমাত্র পথ শত্রুদের জন্য খােলা থাকে। এ সময় ৩.৫ ইঞ্চি রকেট লঞ্চার এবং ছােট অস্ত্র ও মর্টারের সাহায্যে শত্রুদের ওপর মুক্তিযোেদ্ধারা। গােলাগুলি ছুড়তে থাকেন। এ গােলাবর্ষণের ফলে শত্রুদের আনুমানিক ৭টি গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। প্রায় ৪৫-৫০জন নিহত এবং ৭০-৮০জন পাকিস্তানি। সেনা আহত হয়। শত্রুরা এ আকস্মিক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে কসবা ছেড়ে আড়াইবাড়ি কুটিরের দিকে পালিয়ে যায় এবং সেখানে গিয়ে অবস্থান নেয়। যাওয়ার সময় তারা বিধ্বস্ত গাড়ি ও অনেক মৃতদেহ ফেলে রেখে যায়।
বাটপাড়া জোড়াকাননের অ্যামবুশ
কসবা রেল স্টেশন ভারতীয় সীমান্তের সন্নিকটে অবস্থিত। সীমান্তের পাশ দিয়ে জঙ্গলাবৃত ছােট ছােট পাহাড়। এ কসবা থানাতেই অবস্থিত বাটপাড়া জোড়াকানন। আনুমানিক ২৫ মে রাত আড়াইটার সময় মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামিবুশ পাটি বাটপাড়া জোড়াকাননের কাছে শত্রুর ১টা ট্রাক এবং ১টা আরআর জিপ অ্যামবুশ করে। এ অ্যামবুশে শক্রর প্রায় ২০জন সৈনিকসহ যানবাহন ধ্বংস হয়ে যায়। ২৯ মে সকাল সাড়ে ৬টায় ১টি অ্যামবুশ পার্টি সুবেদার আব্দুর রহমান ১৫জন লােক নিয়ে কুমিল্লার উত্তরের ঘূরামপুরে অ্যামবুশ করে বসে থাকেন। শত্রুর ১জন অফিসার ও ২৫জন সৈনিকের ১টি প্যাট্রল মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশে পড়ে যায় এবং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়। ২৭ মে মন্দভাগ থেকে ১টি পাটুন বিকাল সাড়ে ৫টায় কুট শালদা নদীর সিঅ্যান্ডবি রাস্তার ওপর শত্রুকে অ্যামবুশ করে। এ অ্যামবুশের ফলে শক্রর প্রায়। ৯জন লােক নিহত এবং ১টি জিপ ও ১টি ডজ ধ্বংস হয়ে যায়। শক্ররা তাদের। মৃতদেহগুলাে রেখেই পলায়ন করে। টহল দল ২জন পাকিস্তানি সেনাকে জীবিত অবস্থায় ধরতে সক্ষম হয়।
কসবার ইমামবাড়ির রেলসেতু ধ্বংস
কসবার উত্তরে ইমামবাড়ির কাছে অবস্থিত রেলসেতু। ২৬ মে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে ১টি দল প্রায় ১৫০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে রেলসেতুটি ধ্বংস করে দেয়। এরপর দলটি শত্রুদের জন্য অ্যামবুশ করে বসে থাকে। শত্রুরা ব্রিজের দিকে অগ্রসর হয় কিন্তু ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছার আগেই অ্যামবুশের ভয়ে সেখান থেকে ফেরত চলে যায়। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন পরবর্তী সময় তাঁর দলটিকে নিয়ে কর্নেল বাজারে শক্ত অবস্থানের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালান। তাঁর এ আক্রমণের সময় ৭৫ মিলিমিটার আরআর এর সাহায্যে শত্রুদের কয়েকটি বাংকার ধ্বংস হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে শক্রর অবস্থানের ওপর গােলাবর্ষণ করা হয়। এতে শত্রুর আনুমানিক ৮জন সেনা নিহত এবং কয়েকটি বাংকার ধ্বংস হয়।
মনােহরপুর গ্রামে অ্যামবুশ
মনােহরপুর গ্রামটি সদর থানায় কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তার পাশে অবস্থিত। ২৮ মে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি প্যাট্রল দল নায়েক গিয়াসুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে এ গ্রামে শত্রুদের জন্য ১টি অ্যামবুশ পাতে। পাকিস্তানিদের ১টি কোম্পানি কুমিল্ল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তা দিয়ে জঙ্গলবাড়ির দিকে যাচ্ছিল। আনুমানিক সকাল সাড়ে ৮টায় পাকিস্তানিদের কোম্পানিটি নায়েক গিয়াসুদ্দিনের অ্যামবুশ এলাকায় প্রবেশ করে। চর্তুদিক থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে শত্রুর আনুমানিক ২৫জনের মতাে হতাহত হয়। শত্রুসেনারা পিছু হটে। তবে পুনরায় কামানের গােলার সাহায্য নিয়ে প্রতিআক্রমণের চেষ্টা করে। এমতাবস্থায় মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ পার্টি তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে শত্রুরা পার্শবর্তী মাগুরা, মনােহরপুর ইত্যাদি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং সাথে সাথে উদ্দেশ্যহীনভাবে কামানের গােলা ছুড়তে থাকে।
পচুয়ার অ্যামবুশ
পচুয়া গ্রামটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার ১টি গ্রাম। এ গ্রামের ভেতর দিয়ে সড়ক ও রেলপথ চলে যাওয়ায় এখানে অনেক সংঘর্ষ হয়। ৪ ও ৫ জুন রাতে সুবেদার পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল রেললাইনের ১টি সেতু উড়িয়ে দেয়। ৬-৭ জুন বিকাল ৩টায় এখানে মুক্তিযােদ্ধারা আবার এক অ্যামবুশ পাতেন। এতে শত্রুর ১টি দলের প্রায় ১০জন হতাহত হয়। অন্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
চার্নলের অ্যামবুশ
চার্নল এলাকাটি কসবা থানার অন্তর্গত। জায়গাটি কসবার উত্তরে অবস্থিত। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘ডি’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন ১১ জুন সকাল ৬টায় এখানে অ্যামবুশ পাতে। শত্রুদের ১টি কোম্পানি দুপুর ১২টার দিকে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ এলাকায় প্রবেশ করে মুক্তিযােদ্ধাদের অতর্কিত গুলিতে শত্রুদের মাঝে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় এবং ১২জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এতে ১জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন এবং পরে শাহাদতবরণ করেন। শক্র পর্যুদস্ত হয়ে চাল থেকে ইয়াকুবপুরের দিকে পশ্চাদ্ধাবন করে। পলায়নের পর শত্রুদেরকে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল দেখে ফেলে এবং তারা ইয়াকুবপুরের কাছে তাড়াতাড়ি অ্যামবুশ করার জন্য পজিশন নেয়। শত্রুরা আবার এ অ্যামবুশে পড়ে যায় এবং মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়। এ অ্যামবুশের পর অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়, যা পরবর্তী সময় অন্যান্য অপারেশনে ব্যবহৃত হয়।
বাগবাড়ি, কসবার যুদ্ধ
বাগবাড়ি কসবা থানার অন্তর্গত। প্রধান রাস্তা এ গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে। গেছে। বাগবাড়িতে ১৬ জুন মুক্তিবাহিনীর কসবা অবস্থান থেকে ১টি ছােট দল অ্যামবুশ পাতে। সকাল ৬টায় পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি প্যাট্রল পার্টি কসবার দিকে টহলে আসে। পাকিস্তানিদের এ দলটি অসতর্কভাবে হঠাৎ মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশ এলাকার ভেতর চলে আসে। মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ দলটি এ সুযােগের অপেক্ষায় ছিল। তারা খুব কাছ থেকে তাদের সমস্ত অস্ত্র দ্বারা একত্রে গুলি চালাতে থাকে। অতর্কিত গুলির আঘাতে প্রায় ১০জন পাকিস্তানি সেনা। নিহত হয় এবং ৫জন আহত হয়। শুধু ২জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
তিতাস গ্যাসলাইন ধ্বংস
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার উত্তর অঞ্চলে পূর্ব-পশ্চিমে তিতাস গ্যাসলাইন অবস্থিত। ১৬ জুন মুক্তিযােদ্ধাদের ২টি গেরিলা দলকে ৩ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স থেকে পাঠানাে হয়। ৬জনের ১টি দলকে কুমিল্লার দক্ষিণে ইলেকট্রিক লাইন ধ্বংস করার জন্য এবং আরও ৬জনের ১টি দলকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তরে তিতাস গ্যাসলাইন কাটার জন্য পাঠানাে হয়।  ২১ জুন প্রথম দলটি ২টি ইলেকট্রিক পাইলন ধ্বংস করে দেয়। এরফলে নােয়াখালী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় দলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তরে তালশহরে ২৭ জুন সন্ধ্যায় তিতাস গ্যাসের ৪ ফুট পরিমাণ পাইপ উড়িয়ে দেয়। ফলে তিতাস গ্যাস টাকা-নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনগুলােয় গ্যাস সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় এবং এরফলে এ পাওয়ার স্টেশনগুলােয় বিদ্যুৎ সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এতে শিল্প উৎপাদনের ক্ষতি হয় এবং বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়।
কৈখােলার যুদ্ধ
কসবা থানার অন্তর্গত কৈখােলা ১টি গ্রাম। এখানে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি অবস্থান ছিল। পাকিস্তানি সেনারা ১৮ জুন কৈখােলায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর গােলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ করে। এ আক্রমণের মুখে টিকতে পেরে মুক্তিযােদ্ধাদের প্লাটুনটি কৈখােলা ত্যাগ করে। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানিদের ১টি দল কৈখােলা দখল করে নেয়। ঐদিন রাতে মেজর সালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ কোম্পানি ভােররাতে কৈখােলায় অবস্থানরত শত্রুদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। হাবিলদার সালামের প্লাটুন শিবপুরের দিক থেকে এবং সুবেদার আব্দুল হক ভূঁইয়ার প্লাটুন দক্ষিণ দিক থেকে শত্রু সৈন্যদের অবস্থানের ভেতর অনুপ্রবেশ করে। হাবিলদার সালামের প্লাটুনের আক্রমণে পাকিস্তানিদের ভীষণ ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং পাকিস্তানি সেনারা সামনের অবস্থানটি পরিত্যাগ করে পেছনে পালিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানিদের ভেতর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় এবং শত্রুরা সমগ্র কৈখােলা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে। এ যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানিদের ১জন জেসিওসহ আনুমানিক ৩১জন সিপাহি হতাহত হয় এবং অবস্থানটি থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম দখল করা হয়।
রাজাপুর আক্রমণ
২ নম্বর সেক্টরের মতিনগর সাব-সেক্টর থেকে ১টি প্লাটুন কসবা থানাধীন রাজাপুরের পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর হামলা করার জন্য পাঠানাে হয়। এ প্লাটুনটি ২২ জুন মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটি থেকে রাজাপুরের দিকে অগ্রসর হয়। সন্ধ্যায় রাজাপুর শত্রু অবস্থানটি তারা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যবেক্ষণ করে। তারা জানতে পারে যে, পাকিস্তানি সেনারা বেশ অসর্তকভাবে অবস্থান করছে। ২২ জুন ভাের ৪টার দিকে মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি গােপন পথে অতর্কিত শত্রু অবস্থানের ভেতরে প্রবেশ করে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকিস্তানি। সেনারা সম্পূর্ণ হতচকিত হয়ে যায়। সংঘর্ষ প্রায় ১ ঘণ্টা চলার পর মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটে আসেন। এ আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধাদের আঘাতে প্রায় ১৫জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ১জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন।
চন্দ্রপুর-লাটুমুড়া অ্যামবুশ
কসবা থানার উত্তরে চন্দ্রপুর-লাটুমুড়ার অবস্থান। মুক্তিবাহিনীর রেকি পার্টি খবর আনে যে পাকিস্তানি সেনারা কসবার উত্তরে চন্দ্রপুর ও লাটুমুড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ সংবাদ পাবার পর লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবির পাকিস্তানিদের চতুর্দিক থেকে অ্যামবুশ করার জন্য ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘ডি’ কোম্পানির ৩টি প্লাটুন ইয়াকুবপুর, কুয়াপাইনা ও খৈনলে পাঠিয়ে দেন। এ ৩টি প্লাটুন নিজ নিজ জায়গায় ২৩ জুন সকাল ৬টার মধ্যে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনারা সমস্ত রাত অগ্রসর হওয়ার পর সকালে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের সামনে উপস্থিত পাকিস্তানিরা মুক্তিযােদ্ধাদের ওপরে উল্লিখিত অবস্থানের ৫০ থেকে ১০০ গজের মধ্যে এসে পড়লে ৩ দিক থেকে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকিস্তানিদের ৮জন নিহত এবং ৩জন আহত হয়। পাকিস্তানি সেনারা একটু পিছু হটে গিয়ে আবার আক্রমণের চেষ্টা চালায় কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর সমস্ত দিন উভয় পক্ষে গােলাগুলি চলতে থাকে এবং সন্ধ্যার সময় পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে যায়। পাকিস্তানিদের পশ্চাদপসরণের সময়ও মুক্তিযােদ্ধাদের ইয়াকুবপুরের প্লাটুন তাদের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করে বেশ ক্ষতিসাধন করে। তারা পিছু হটে গিয়ে লাটুমুড়ার উত্তরে অবস্থান নেয় এবং প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করতে থাকে। ২৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা যখন লাটুমুড়ায় তাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরিতে ব্যস্ত ছিল, ভাের ৫টায় মুক্তিযােদ্ধাদের কুয়াপাইনা ও খৈনল এলাকা থেকে শত্রুদের বামে ও দক্ষিণে মুক্তিযােদ্ধাদের ৩টি প্লাটুন আবার অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের ফলে পাকিস্তানিদের ৯জন নিহত হয়। ১জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন।
লাটুমুড়ায় আক্রমণ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে সর্বদক্ষিণে কসবা থানা অবস্থিত। এ থানারই উত্তরে লাটুমুড়ার অবস্থান। লাটুমুড়ায় পাকিস্তানি সেনারা তাদের শক্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তােলে। এখান থেকেই পাকিস্তানি সেনারা নােয়াখালীর উত্তরে ফেনী থেকে নােয়াখালী পর্যন্ত ট্রাকের মাধ্যমে টহল দিত। অপরদিকে ৪র্থ। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘ডি’ কোম্পানির লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবীরের। নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারাও সবসময় পাকস্তানিদের ব্যতিব্যস্ত রাখতেন। পাকিস্তান রেডিও থেকে ঘােষণা দেওয়া হয় যে, ২৮ জুন (সম্ভবত) সন্ধ্যায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষণ দেবেন। এ সংবাদ জানতে পেরে মেজর খালেদ মােশাররফ একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি সমস্ত সাব-সেক্টর অধিনায়ককে সদর দপ্তরে ডেকে পাঠান। আলােচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, ইয়াহিয়া খানের ভাষণের সময় পাকিস্তানি সেনারা সব জায়গাতেই রেডিও শােনার জন্য তাদের নিজ নিজ প্রতিরক্ষা অবস্থানে একত্র হবে এবং সর্তকতামূলক ব্যবস্থা কিছুটা শিথিল হবে। পাকিস্তানিদের এ অসর্তকতামূলক অবস্থায় সাব-সেক্টর অধিনায়করা একযােগে সব এলাকায় পাকিস্তানিদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালাবেন। | লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবীরের ‘ডি’ কোম্পানি ঐদিন ভাষণের সময় লাটুমুড়ায় শত্রু অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের ফলে শত্রুদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। আক্রমণের ফলে ৫জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ১০জন আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা আড়াই ঘণ্টা আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদে নিজ অবস্থানে ফিরে আসেন।
কর্নেলবাজার অপারেশন
আখাউড়া থানার অন্তর্গত মনিয়ন্দ ইউনিয়নে কর্নেলবাজার অবস্থিত। এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। আখাউড়া পতন হওয়ার পর মুক্তিযােদ্ধারা কর্নেলবাজারে জড়াে হন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে হত্যা করে তাদের সংখ্যা কমাননা। পাকিস্তানি সৈন্য ছিল ১ কোম্পানি আর মুক্তিবাহিনীর ৩টি কোম্পানি তথা নিয়মিত ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি ও অপর ২টি ছিল অনিয়মিত বাহিনী। আগরতলা থেকে যে রাস্তা গঙ্গাসাগরের দিকে গিয়েছে, ঐ রাস্তায় উত্তর মুখ হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ডিফেন্স নেয়। ঐ রাস্তার উত্তর দিকে ১টি খাল ছিল। পাকিস্তানি সেনারা উত্তর দিকে আখাউড়া থেকে কর্নেলবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। তারা খাল পার হয়ে রাতের বেলায় এসে পূর্ব দিকে অর্থাৎ মুক্তিযােদ্ধাদের পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে। এর ফলে মুক্তিযােদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধাদের এ কোম্পানি ছিল অনিয়মিত বাহিনী। তাদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। এখানে পাকিস্তানিদের বেয়নেটের আঘাতে ৭জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন।
কামালপুর মাইঝখাইয়ের অ্যামবুশ কামালপুর মাইঝখাই কসবা থানায় অবস্থিত। ১০ জুলাই রাতে ক্যাপ্টেন গাফফার ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি থেকে ২টি সেকশন শালদা নদীর পশ্চিমে কামালপুর ও মাইঝখাইয়ের ভেতরে অ্যামবুশ করার জন্য পাঠান। এ দলটি সকাল হওয়ার আগেই অবস্থানের ভেতরে অ্যামবুশ অবস্থান নিয়ে শত্রুর অপেক্ষায় বসে থাকে। বেলা আড়াইটার দিকে পাকিস্তানিদের ১টি ভারী দল শালদা নদী অবস্থান থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়। এ দলটি যখন মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশ অবস্থানের ভেতরে এসে পড়ে, ঠিক সে। সময় পাকস্তানিদের সম্মুখবর্তী অংশের ওপর মুক্তিযােদ্ধারা গুলি চালাতে শুরু করে। অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা হতভম্ব হয়ে যায় এবং কিছু বুঝে। ওঠার আগেই তাদের অনেকে হতাহত হয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে তারা পেছনের দিকে। পালাতে শুরু করে। সংঘর্ষে পাকিস্তানিদের ১জন মেজর, ২জন ক্যাপ্টেন ও প্রায়। ৮জন সৈনিক নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ পার্টি ১টি এসএমজি, মেশিনগান এবং তার ২২৫ রাউন্ড গুলি, ১টি জি-৩ রাইফেল ও ১টি পিইরসি ওয়্যারলেস সেট উদ্ধার করে।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড