You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.02 | পাত্রখলা অ্যামবুশ - সংগ্রামের নোটবুক
পাত্রখলা অ্যামবুশ
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলােমিটার দক্ষিণে সীমান্তবর্তী চা-বাগান পাত্রখলা। প্রায় ৩,৭০০ একর এলাকা জুড়ে অবস্থিত এ বাগান, বাংলাদেশের বড়াে চা-বাগানগুলাের একটি। এর এক পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ধলই খাল আর বাকি তিন দিকে পাহাড় ঘেরা চা-বাগান। অদ্ভুত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভরা এ বাগান। পাত্রখলা বাগান থেকে প্রায় ৫ কিলােমিটার। উত্তরে কমলগঞ্জ-পাত্রখলা সড়কের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত ধলই ভ্যালি ক্লাব’। এ ক্লাবে ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। মূলত এখানে ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। রজিমেন্টের ১টি কোম্পানি সদর ছিল। সেখান থেকে ধলই, কুরমা ও পাত্রখলা প্রভৃতি চা-বাগানগুলাের ওপর আধিপত্য বিস্তার ও সীমান্ত প্রহরার কাজ চালানাে হতাে। এ ছাড়া এখানে ১টি আর্টিলারি ব্যাটারিও ছিল। এ কোম্পানির কোম্পানি অধিনায়ক ছিল মেজর আজিজ ঘটক। এপ্রিল মাস থেকেই কোম্পানিটি চা-বাগান এলাকাগুলাে দিয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রবেশ রােধ করতে দিনরাত টহল দিত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এ এলাকাটাকে ‘নাে এন্ট্রি পয়েন্টে পরিণত করা। এদিকে মে মাসের দিকে কমলপুর সাব-সেক্টর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রাথমিকভাবে এর দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন প্রাক্তন মুজাহিদ ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান। তিনি পাকিস্তানি টহল দলগুলাের ওপর বিভিন্ন স্থানে অ্যামবুশ করে তাদের মনােবল ভেঙে দেওয়া এবং ভীতি সঞ্চার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পাত্রখলা অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা করা হয়। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ধলই ভ্যালি ক্লাব থেকে পাত্রখলা বাগান এ এলাকায় শক্রর টহল অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা করা হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন সাজ্জাদের নেতৃত্বে প্রায় ৩১জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি গ্রুপ ধলই ভ্যালি ক্লাব ও পাত্রখলা বাগানের কুলি লাইন এ মধ্যবর্তী এলাকায় পাকিস্তানি ছাউনি থেকে প্রায় ৪ কিলােমিটার দূরে রাস্তার পার্শ্বে অ্যামবুশ করার জন্য পজিশন নেয়। উপ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করছিলেন ইপিআর-এর হাবিলদার মােহাম্মদ শুকুর মিয়া। রাত ৩টায় সব পার্টি তাদের পজিশনে চলে গেল। শুরু হলাে এবার অপেক্ষার পালা। অ্যামবুশ এলাকাটির পশ্চিম পার্শ্বে ছিল কিছুটা উঁচু টিলা, যাতে ছিল চাবাগান, অন্যান্য গাছের জঙ্গল এবং পূর্ব পাশে ছিল ধানক্ষেত, নিচু জমি এবং একটা ছােট খাল। অ্যামবুশ পার্টির কাছে অস্ত্র বলতে ছিল ১টি এলএমজি, ২টি | স্টেনগান, কয়েকটি এসএলআর এবং বাকি সব .৩০৩ রাইফেল। কাট অব পাটিতে ছিলেন মুজাহিদ, সুবেদার আবুল হােসেন, সুবেদার আশরাফ আলী ও নজরুল ইসলাম। সুবেদার আশরাফ আলী লুক-আউটম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সবাই যার যার পজিশনে সতর্ক অবস্থায় চা-গাছ আর জঙ্গলের মধ্যে শুয়ে আছেন, অপেক্ষা করছেন, কখন শক্রর টহল দল সামনের রাস্তা দিয়ে তাদের ফাঁদের মধ্যে এসে পড়বে। প্রায় আধা ঘন্টা পর পাকিস্তানিদের বুটের আওয়াজ পাওয়া গেল, ঐ দিন যেন তারা একটু বেশি সতর্ক। ধীরে ধীরে পুরাে টহল দল অ্যামবুশ এলাকায় প্রবেশ করল সুবেদার আশরাফ আলী অধিনায়ককে টহলের অবস্থান সম্পর্কে জানালেন। পুরাে দলটিতে প্রায় ১২জন। পাকিস্তানি সৈন্য এবং ৩জন রাজাকার ছিল। টহল দলটি সুবিধাজনক অবস্থানে আসামাত্রই গর্জে উঠল ক্যাপ্টেন সাজ্জাদের হাতের স্টেনগান। একসাথে মুক্তিযােদ্ধাদের সব হাতিয়ার অগ্নি উদ্‌গিরণ শুরু করল শত্রুর ওপর। 
প্রাথমিকভাবে হতচকিত পাকিস্তানিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও পর মুহূর্তে তারা পজিশন নিয়ে প্রতিআক্রমণ করে। কিন্তু এর মধ্যেই ২জন শক্র গুরুতর আহত হয়। চলতে থাকে গুলি বিনিময়। হঠাৎ করেই পাকিস্তানিরা ফায়ার থামিয়ে দেয়। দেখা গেল, পাকিস্তানিরা পালাচ্ছে। এ ঘটনায় উল্লসিত হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা নিজ অবস্থান ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। তাদের পিছু ধাওয়া করেন। পাকিস্তানিরা পালাতে পালাতে গুলি ছুড়তে থাকে, তারই ১টি গুলি হঠাৎ করে এসে লাগে মুক্তিযােদ্ধা নজরুলের পেটে। অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে থাকে। সহযােদ্ধারা এ অবস্থায় শত্রুকে তাড়া থামিয়ে দিয়ে আহত নজরুলকে কাধে নিয়ে রওনা দেন সীমান্তের দিকে। কিন্তু ততক্ষণে হিমশীতল হয়ে গেছে নজরুলের দেহ।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড