লাঠিটিলার যুদ্ধ
অবস্থান মৌলভীবাজার জেলায় বড়লেখা থানা সদর থেকে প্রায় ১৬ কিলােমিটার দক্ষিণপশ্চিমে জুরী বাজার। এ বাজার থেকে প্রায় ১৬ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে লাঠিটিলা বিওপি। প্রায় ১৫০ ফুট উঁচু টিলার ওপর অবস্থিত এ ক্যাম্প প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত। সীমান্তের অপর পারে ছিল ভারতের কুকিতল বিএসএফ ক্যাম্প। চারদিকে উঁচু-নিচু টিলা, ঘন জঙ্গল আর চা-বাগান এ এলাকাকে গেরিলাযুদ্ধের জন্য উপযােগী করে তুলেছিল। লাঠিটিলা ছিল। পাকিস্তানিদের একটি পুরােনাে বিওপি। সীমান্ত চিহ্নিতকরণের সমস্যাজনিত কারণে এ বিওপি এলাকায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অনেক খণ্ডযুদ্ধ হয়। এ ঘাঁটির কারণে কুকিতল বিএসএফ ক্যাম্প থেকে এ অঞ্চলে অপারেশন। পরিচালনা করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। তাই এ বিওপি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারিখ: ২০ জুন, ১৯৭১। যুদ্ধের সংগঠন। ১. পাকিস্তানি বাহিনী: ২২ বালুচ রেজিমেন্টের ১টি প্লাটুন। ২. মুক্তিবাহিনী: ১টি মুক্তিযােদ্ধা কোম্পানি, ১টি আর্টিলারি ব্যাটারি। (ভারতীয়)। লাঠিটিলা ক্যাম্পটি প্রাকৃতিকভাবে বেশ সুরক্ষিত ছিল। ক্যাম্পটি একটি ছােট টিলার ওপর অবস্থিত। শক্র এখানে পরিখা খনন করে খুব শক্ত প্রতিরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করে। সব বাংকারই ছিল আর্টিলারি গােলা থেকে প্রতিরােধ ক্ষমতাযুক্ত। প্রতিটি বাংকারই এত সুন্দরভাবে ক্যামােফ্লেজ করা ছিল যে ১০০ গজ দূর থেকেও কোনাে কিছু বােঝার উপায় ছিল না। বাইরে থেকে বিওপি দৃষ্টিগােচর হতাে না। ১৮ জুন ক্যাপ্টেন আব্দুর রব আদেশ পান ১ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে কুকিতল বিএসএফ ক্যাম্পে যাওয়ার। ওখান থেকে পাকিস্তানিদের লাঠিটিলা ক্যাম্প আক্রমণ করতে হবে।
যথারীতি তিনি আদেশ পালন করেন এবং কুকিল পৌছান। ওখানে পৌছানাের পর তাকে আক্রমণের পরিকল্পনা জানান। ৭ রাজপুত রাইফেলের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল দেভাসন। পরিকল্পনা। অনুযায়ী লাঠিটিলায় অবস্থিত পাকিস্তানি প্লাটুনের ওপর মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি আর্টিলারি ফায়ারের সহায়তায় আক্রমণ করবে। ৭ রাজপুত রাইফেলের ২টি কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর পিছু পিছু অগ্রসর হবে। কিন্তু কর্নেল দেভাসনের এ পরিকল্পনা ক্যাপ্টেন রবের মনঃপূত হয় না। তিনি বলেন, তাঁকে।
এককভাবে এ অপারেশন করতে দেওয়া হােক অথবা ভারতীয় ৭ রাজপুত সক্রিয়ভাবে অপারেশনে অংশ নিক। পরবর্তী সময় তিনি টার্গেট রেকি করার অনুমতি চাইলে কর্নেল দেভাসন তা নাকচ করে দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০ জুন আনুমানিক ভাের ৪টায় যাত্রা শুরু হয়। প্রায় পৌনে ৬টায় মুক্তিবাহিনী লাঠিটিলা বিওপি অবরােধ করে ফেলে। প্রথমেই তাদের টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়া হয়। কিন্তু পাকিস্তানিরা তাদের অবস্থানগুলাে ক্যামােফ্লেজ করে রেখেছিল, যার ফলে আঁধারে সঠিক অবস্থানগুলাে চিনতে কষ্ট হচ্ছিল। এদিকে ৭ রাজপুত রাইফেলের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন রবকে অপারেশনে আসার পূর্বে লক্ষ্যবস্তু রেকি করার অনুমতি দেননি। তাই সঠিক অবস্থানগুলাে শনাক্ত করার জন্য ক্যাপ্টেন রব ৪জন মুক্তিযােদ্ধাকে গ্রেনেডসহ পাঠান। উদ্দেশ্য ছিল কাছ থেকে শক্ৰসংখ্যা ও অবস্থানগুলাে শনাক্ত করে আর্টিলারি গান পজিশনে তথ্য পাঠানাে হবে এবং পর্যাপ্ত আর্টিলারি গােলাবর্ষণের পর শক্র কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে গেলে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ রচনা করবে। ৪জনই ফেরত আসে এবং জানান, ক্যাম্পে কেউ নেই। কিন্তু আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য এবার ১জন হাবিলদার ও ২জন সৈনিককে পাঠানাে হয়। নির্দেশ দেওয়া হয়, তারা বাংকারের একেবারে কাছে যাবেন, বাংকারের ভেতর গ্রেনেড ছুড়বেন এবং চলে আসবেন।
যথারীতি তারা বাংকারের কাছাকাছি পৌছে যান এবং একজন মুক্তিযােদ্ধা যখন ১টি গ্রেনেড ছুড়ে মারেন তখন শত্রু তাদের সরধরনের অস্ত্র দিয়ে ফায়ার শুরু করে। ৩জনই আহত হন কিন্তু তারা জীবিত ফিরে আসতে সক্ষম হন। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন রব আর্টিলারি ফায়ার সহায়তা চান এবং প্রায় ২০ মিনিট ধরে প্রায় ৫০০ আর্টিলারি গােলা পাকিস্তানি ক্যাম্পের ওপর পড়ে। যে মুহূর্তে আর্টিলারি ফায়ার বন্ধ হয়, সাথে সাথে ক্যাপ্টেন রবের বিওপি’র ওপর আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা এত জোরে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করেন যে, শত্রু সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে যায় এবং তারা পরিখা থেকে উঠে আশপাশের জঙ্গলে পালাতে থাকে। পলায়নরত শত্রুর অধিকাংশই মুক্তিবাহিনীর গুলিতে মারা পড়তে থাকে। মুক্তিবাহিনী সম্পূর্ণ ক্যাম্প দখল করে নেয়। | লাঠিটিলার যুদ্ধে প্রায় ১৫জন পাকিস্তানি নিহত হয় এবং ২২ বালুচের ১জন সিপাহি ও ১জন হাবিলদার ধরা পড়ে। মুক্তিবাহিনীর মাত্র ৪জন আহত হন। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করে। লাঠিটিলা বিজয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আরেকটি গৌরবদীপ্ত মাইলফলক। লাঠিটিলা বিজয়ের প্রেরণাই বড়লেখা ও কুলাউড়া এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের পরবর্তী অপারেশনের মনােবল জোগায়। এ অপারেশনটি একটি রেইড অপারেশনের অনুরূপ হলেও এখানে পদাতিক ভারী অস্ত্র ও গােলন্দাজ ফায়ার সহায়তা প্রদানের মতাে বিষয়গুলাে অবশ্যই অপারেশন পরিকল্পনায় এক নতুন চিন্তাধারা।
দিলকুশা চা-বাগান আক্রমণ
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানা সদর থেকে প্রায় ১৯ কিলােমিটার দক্ষিণে জুরী বাজার। এখান থেকে আরও প্রায় ১৭ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সীমান্তবর্তী দিলকুশা চা-বাগান। বাগান থেকে সীমান্ত মাত্র ৩ কিলােমিটার, আর সীমান্ত থেকে কুকিতল সাব-সেক্টর ক্যাম্পের দূরত্ব ছিল ৬ কিলােমিটার। বেশ উঁচু পাহাড় ও টিলাময় এ এলাকাও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত। তারিখ: ১৭ জুলাই, ১৯৭১। যুদ্ধের সংগঠন। ১. পাকিস্তানি বাহিনী: ১ কোম্পানি পাকিস্তানি সৈন্য এবং ১ কোম্পানি রাজাকার। ২. মুক্তিবাহিনী: ১ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা এবং ১টি ভারতীয় আর্টিলারি | ব্যাটারি। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় যখন বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযােদ্ধারা চোরাগুপ্তা হামলার মাধ্যমে পাকিস্তানিদের ব্যস্ত করে রেখেছে, ঠিক তখনই ৪ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তর থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় মােটামুটি বড় ধরনের একটা অপারেশন করে কিছু জায়গা দখল করে নিয়ে পাকিস্তানিদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করার। দিলকুশা চা-বাগানে পাকিস্তানিদের একটি ক্যাম্প ছিল। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, কুকিতল থেকে অপারেশন চালিয়ে দিলকুশা দখল করে নিতে হবে। ৪ নম্বর সেক্টর সদর থেকে আদেশ পেয়ে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে দিলকুশা চা-বাগানে অবস্থিত পাকিস্তানিদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। অপারেশন পরিচালনা করার জন্য কুকিতল থেকে ২ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধার সমন্বয়ে একটি দল গঠন করা হয়।
দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন শরিফুল হক। আক্রমণের তারিখ। নির্ধারণ করা হয় ১৭ জুলাই। | ক্যাপ্টেন হক লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় তথ্য সংগ্রহ এবং যতটুকু সম্ভব পর্যবেক্ষণ করে একটা পরিকল্পনা তৈরি করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী কোম্পানি ২টিকে কয়েকটি দলে ভাগ করা হয়। ৩টি কাট অব পার্টির প্রতিটিতে ১২জন করে মুক্তিযােদ্ধা, ২টি এলএমজি এবং পর্যাপ্তসংখ্যক গােলাবারুদ ও বিস্ফোরক । দল ৩টির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যথাক্রমে ফারুক আহমেদ, লিয়াকত হােসেন ও নায়েব সুবেদার মতিউর রহমান। আক্রমণ করার জন্য ছিল ৩টি অ্যাসল্ট পাটি, যার নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে আবুল খায়ের চৌধুরী, তজমুল আলী ও আবদুল হান্নান। গােটা আক্রমণকে ফায়ার দ্বারা সহায়তা প্রদান করার জন্য ভারতীয়। আর্টিলারির একটি ব্যাটারি ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যার পর কুকিতল থেকে রওনা হয়ে প্রায় রাত ২টায় পুরাে দলটি লাঠিটিলায় পৌছায়। সেখান থেকে
ভাের ৪টার আগেই তারা পৌছে যায় দিলকুশা বাগানে। পাকিস্তানি ক্যাম্পের প্রায় ৫০ গজের মধ্যেই তারা অবস্থান নেয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দলগুলাে যার। যার জায়গায় পৌছে যায়। এবার চূড়ান্ত নির্দেশের অপেক্ষা। ঠিক ভাের ৫টায়। ক্যাপ্টেন হক আক্রমণের নির্দেশ দেন। একযােগে আক্রমণ করে ৩টি অ্যাসল্ট পাটি। আক্রমণ প্রায় সফলতার মুখ দেখছিল, তখন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন হক ফায়ার বন্ধের আদেশ দেন। সবাই ফায়ার বন্ধ করে কিন্তু ২টি কাট অব পার্টি ফায়ার বন্ধ করতে দেরি করে, যার ফলে অন্য দলগুলাে মনে করে যে, পাকিস্তানিরা এখনাে তাদের অবস্থানে আছে এবং গুলি ছুড়ছে। ভুল বােঝাবুঝির ফলে সব দল পুনরায় ফায়ার শুরু করে। ফলে নিজেদের মধ্যেই গুলিবিনিময় শুরু হয়। মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের গুলিতে হতাহত হতে থাকেন। অনেকে নিজ নিজ অবস্থান ছেড়ে পিছিয়েও আসে।
এ অবস্থায় ক্যাপ্টেন হক নিজ অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসেন এবং মুক্তিযােদ্ধাদের ভৎসনা করা শুরু করলে আরও ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয় এবং নিজেদের মধ্যে গুলিবিনিময়ও বেড়ে যায়। এ দিকে পাকিস্তানিরা যখন এ পরিস্থিতি বুঝতে পারে, তখন তারা আবার পাল্টা আক্রমণ রচনা করে। অপর দিকে পাথারিয়া টিলা ক্যাম্প থেকে। কয়েকজন পাকিস্তানি আর্টিলারি ফায়ার সহায়তা নিয়ে এ দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অপ্রয়ােজনে গােলাগুলি খরচ করায় মুক্তিবাহিনীর গােলাবারুদ প্রায়। ফুরিয়ে আসতে থাকায় পাকিস্তানিরা বাগানে ঢুকে পড়ে। ফলে কারখানার মধ্যে। আটকে পড়েন বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা। এঁদের মধ্যে কয়েকজন বেয়নেট দিয়ে। মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হন, কিন্তু রুহুল আহম্মেদ বাবুর বাম পায়ে। গুলি লেগে হাঁটুর নীচের হাড় ভেঙে যায়। ছত্রভঙ্গ হয়ে যান মুক্তিযােদ্ধারা। যে যেদিক দিয়ে পারেন, পালাতে শুরু করেন। মুক্তিযােদ্ধা তজমুল আলী সহযােদ্ধা। বাবুকে কাঁধে বহন করে সেখান থেকে সরে আসেন। নিজেদের সামান্য ভুল। বােঝাবুঝির জন্য ৬জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ এবং আহত হন প্রায় ১৭জন। এত কিছুর পরও মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর উল্লেখযােগ্য পরিমাণ ক্ষতিসাধন করতে সমর্থ হন। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের অসফলতার কারণ ছিল নিজেদের মধ্যে সঠিক সমন্বয়ের অভাব। এ ছাড়া বিকল্প কোনাে সংকেতেরও ব্যবস্থা ছিল না। তা ছাড়া কাট অব পাটিগুলাের অবস্থানও ছিল এত কাছে যে নিজেদের ফায়ারে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকিস্তানের ১৩জন সৈন্য মারা যায় এ যুদ্ধে এবং আহত হয় অসংখ্য। ২জন রাজাকারও আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটে গেলেও এ যুদ্ধে। পাকিস্তানিদের মনে প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার হয়। এ অঞ্চলে প্রথম বারের মতাে। তারা মুক্তিবাহিনীর সাথে সামনাসামনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বুঝতে পারে যে মুক্তিবাহিনী শুধু চোরাগুপ্তা হামলা নয়, সম্মুখসমরেও সমান পারদর্শী।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড