বাহুবলের যুদ্ধ
নভেম্বর মাসের শেষ ভাগ। হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানা সদর তখনাে নিয়ন্ত্রণ করছে পাকিস্তানি বাহিনী। অথচ এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। তাই বাহুবল মুক্ত করার একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। ৪ নম্বর সেক্টরে এ পরিকল্পনা প্রণীত হয়। অপারেশন করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন মুক্তিযােদ্ধা আবদুল কাইয়ুম। সাথে ছিলেন তার সহযােদ্ধা এম এ রউফ, আবদুল গনি, মাফিল উদ্দিন ও ময়না মিয়াসহ আরও ৩০জন। হাতে তাদের সেই প্রচলিত অস্ত্র রাইফেল, স্টেনগান, এসএমজি, এলএমজি ও গ্রেনেড। পরিকল্পনা অনুযায়ী মানচিত্র ও পথপ্রদর্শক ইত্যাদি সংগ্রহ করার পর রওনা হলেন তারা। মুক্তিযােদ্ধাদের এ দলটি কোনােরকম বাধাবিপত্তি ছাড়াই বাহুবলের কাছে খাগাউড়া গ্রামে পৌছে যায়। এখানেই থাকার ব্যবস্থা হলাে তাদের। আহার সরবরাহের দায়িত্ব এলাকার জনগণ। নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন। এখানে অবস্থান নেয়ার পর বাহুবল সম্পর্কে আরও তথ্য সগ্রহ করে আক্রমণের দিন-তারিখ নির্ধারণ করা হলাে। তখনাে। বাহুবল থানা ভবনকেই শত্রুরা তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে। ১ ডিসেম্বর রাত ৪টার দিকে এ ভবনের সামনে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন ৩০জন মুক্তিযােদ্ধা। তারা রাত ৮টায় খাগাউড়া থেকে রওনা দিয়ে ৫ কিলােমিটার পথ নৌকায় এবং দেড় কিলােমিটার পথ পায়ে হেঁটে এসে গন্তব্যস্থলে পৌঁছান। ভবনের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে অবস্থান গ্রহণ করলেন তাঁরা। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে শুরু করেন গুলিবর্ষণ। বিনিময়ে ভারী অস্ত্রে পাকিস্তানিরা জবাব দেয়। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত প্রবল ও প্রচণ্ড গােলাবর্ষণের পরও শত্রুরা নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। মাত্র দেড় ঘণ্টা যুদ্ধের পর তারা ঘাটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাদের দোসর ৩জন পুলিশ মুক্তিযােদ্ধার হাতে ধরা পড়ে। বাহুবল শত্রুমুক্ত হয়। এখানকার যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের তেমন কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বললেই চলে।
দিনারপুর আক্রমণ
হবিগঞ্জ জেলার পূর্ব প্রান্তে নবীগঞ্জ থানা। থানার পূর্ব সীমান্ত বরাবর দিনারপুর পরগনা। অধিকাংশ জায়গাজুড়ে দিনারপুরের পাহাড়। মৌলভীবাজার জেলার কিছু অংশও এ পাহাড়ের অন্তর্ভুক্ত। পাহাড়ের পাদদেশ ধরে ছােটো-বড়াে বহু গ্রাম। ২৫ মার্চের পর থেকে এ পরগনায় বারবার হামলা করছিল পাকিস্তানিরা। মােহাম্মদপুর, গুয়াহুরি ও শত প্রভৃতি গ্রামে হত্যা করেছে অসংখ্য লােককে। ধর্ষণ করেছে বহু মা-বোেনকে। লুটপাট, অগ্নিসংযােগ ইত্যাদি চলেছে সমগ্র পরগনা জুড়ে। ডিসেম্বর মাসে কাউফলা বাজারে রাজাকাররা মুক্তিযােদ্ধাদের ধরে এনে শতক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জড়াে করে। অত্যাচারের মাত্রাও বাড়িয়ে দেয়। সমগ্ৰ দিনারপুর পরগনাকে একটি কসাইখানায় পরিণত করে তারা। এ সময় দিনারপুর পরগনায় প্রবেশ করে শতাধিক মুক্তিযােদ্ধার একটি দল। প্রবেশ করেই তারা অগ্রসর হতে থাকে নবীগঞ্জের দিকে। কাউফলা বাজারে তারা অপারেশন করে একজন রাজাকারকে ধরে নিয়ে আসে।
দলটি আসে কমলপুর ঘাঁটি থেকে। সেখানে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমানের অধীনে। ছিলেন তাঁরা। তারপর নভেম্বরের শেষ দিকে নবীগঞ্জে অপারেশন করার জন্য ১ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা রওনা হন। রাস্তায় জেরিছড়া ও রাধানগর গ্রামে এক এক দিন করে কাটিয়ে শ্রীমঙ্গল বনবিভাগের অফিসের কাছে পাকিস্তানি ১টি টহল দলের মুখােমুখি হলে এখান থেকে পিছু হটে নিকটতম একটি গ্রামে এক রাত যাপন করে পরের দিন রেলপথ অতিক্রম করেন। এ সময় কোম্পানি অধিনায়ক ৪০-৫০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে পাহাড়ের ভেতরে অবস্থান নেয়া মূল দল থেকে। চলে যান। মূল দলটির আর কখনাে কোনাে সন্ধান পাননি তারা। এ সময় শতাধিক মুক্তিযােদ্ধার অধিনায়কের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেন কুলাউড়ার কৃষক ও কমিউনিস্ট নেতা সুশীলচন্দ্র দেব। তাঁরই নেতৃত্বে বিরাট বাহিনী দিনারপুর পৌছালে সেখানকার জনগণ তাদের স্বাগত জানান এবং রাজাকার রাজা কাজির অত্যাচার থেকে রক্ষার অনুরােধ জানান। মুক্তিযােদ্ধারা রাজা। কাজির বাড়ি ঘেরাও করেন। কিন্তু সে টের পেয়ে ঘরের পিছন দিক দিয়ে। চোরাপথে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মুক্তিযােদ্ধারা এবার শতক প্রাথমিক বিদ্যালয় আক্রমণ করেন। এ বিদ্যালয়টিকে রাজাকাররা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতাে।
৫ ডিসেম্বর সুশীলচন্দ্র দেবের নেতৃত্বাধীন এ বাহিনী শতক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অপারেশন পরিচালনা করে। এখানে তখন ৫৭জন রাজাকার অবস্থান করছিল। তাদের সাথে ৩৪টি রাইফেল এবং অন্যদের হাতে অন্যান্য অস্ত্র ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা অতর্কিত বিদ্যালয়গৃহ আক্রমণ করলে পাকিস্তানিরা কোনােরকম প্রতিরােধ করার সুযােগ পায়নি। এমনকি আত্মরক্ষার উপায় পর্যন্ত তাদের ছিল চারদিক থেকে বিদ্যালয়গৃহটি ঘেরাও করার পর মুক্তিযােদ্ধারা তাদের আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানান। তাদের পালানাের পথও বন্ধ। তাই তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। স্কুলঘর থেকে বেরিয়ে হাতের অস্ত্র মাটিতে রেখে তারা একে একে আত্মসমর্পণ করলে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের সবাইকে বন্দি করেন। রাজাকারদের কাছ থেকে মুক্তিযােদ্ধারা অধিকার করে ৩৪টি ৩০৩ রাইফেল এবং অন্য অস্ত্রশস্ত্র।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড