নলুয়া (তেলিয়াপাড়া-চুনারুঘাট চা-বাগান) অপারেশন
তেলিয়াপাড়া ও চুনারুঘাটের মধ্যবর্তী চা-বাগানের নাম নলুয়া। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানাধীন এ বাগানে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালিত হয়। ১৪ এপ্রিল ১৩জন সদস্য নিয়ে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। নলুয়ার চা-বাগানে আক্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাগানের ভেতর একটি সুবিধাজনক স্থানে শক্তিশালী মাইন স্থাপন করেন। উল্লেখ্য, মুক্তিবাহিনী সংবাদ পেয়েছিল যে, এ পথে সিলেট থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বিশাল সেনা বহর আসবে। তাই তারা মাইন পেতে রাস্তার দুই পাশে অপেক্ষা করতে থাকে। দুপুরে সিলেট থেকে ১টি বিশাল বহর। অগ্রসর হতে থাকে। একসময় তারা ঢুকে পড়ে মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশের ভেতর মুহূর্তে বিস্ফোরিত হয় মাইন। বিকট শব্দে এক এক করে পাকিস্তানি [৩টি গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায় চোখের পলকে। বিকল হয়ে যায় আরও ২টি গাড়ি। শত্রুরা ভয়ে বিকল হয়ে যাওয়া গাড়ি থেকে দ্রুত নামার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের বাহিনী তাদের ওপর দ্রুত আক্রমণ চালায়। একের পর এক শত্রুরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ৬৫জনকে প্রাণ দিতে হয়। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান তার দলবলসহ অপারেশন শেষে নিরাপদে আপন আশ্রয়স্থলে ফিরে আসেন।
নলুয়া বাগানে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড মার খাওয়ার পর পাকিস্তানিদের শক্তি-সামর্থ্য কমে আসে। তাই চুনারুঘাট থেকে তারা আরও সৈন্য সংগ্রহ করে আনে। পুনর্গঠিত হয় তাদের বাহিনী পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে তারা আবার রওনা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া অভিমুখে। ১৬ মে তেলিয়াপাড়া অতিক্রম করে যাওয়ার সময় আরও একটি অ্যামবুশে পড়ে পাকিস্তানিরা। ক্যাপ্টেন মতিন তখন। তেলিয়াপাড়া অ্যামবুশ পরিচালনা করেন। পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাপ্টেন মতিনের পেতে রাখা অ্যামবুশের ভেতরে সােজা ঢুকে পড়ে। নিজেদের আক্রমণ বৃত্তের ভেতর পেয়ে ক্যাপ্টেন মতিন ও তার দলবল একযােগে আক্রমণ করে হত্যা করে প্রায় ৪০জন পাকিস্তানি শত্রুকে। আর ধ্বংস করে ১টি সামরিক কনভয় এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল খালেক শহিদ হন। ২জন মুক্তিযােদ্ধা ধরা পড়েন। পরবর্তী সময় ১জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও অন্যজন শহিদ হন। ক্যাপ্টেন মতিন তাঁর সেনাদলসহ নিরাপদে ফিরে আসেন ক্যাম্পে। আবদুল খালেককে নলুয়া চা-বাগানে সমাহিত করা হয়।
আসামপাড়া আক্রমণ
আসামপাড়া হবিগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী চুনারুঘাট থানার অন্তর্ভুক্ত একটি স্থান। সীমান্ত বরাবর অবস্থানের কারণে আসামপাড়া মুক্তিযুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যাও ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। ১৫ জুন আসামপাড়ায় ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযােদ্ধারা একটি সফল আক্রমণ চালান। দীর্ঘ সময় পরস্পর গােলাগুলি চলে। পাকিস্তানিরা স্থান ত্যাগে বাধ্য হয়। এতে আনুমানিক ৬০জন পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায়। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে কোনাে প্রাণহানি ঘটেনি।
শাহজীবাজার রেলসেতু ধ্বংস
হবিগঞ্জের শাহজীবাজার রেলসেতু ছিল সিলেট-আখাউড়া সেকশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু। সড়কপথ ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্য। আনা-নেয়ার কাজে রেলপথকে ব্যবহার করতাে। তাই তারা এ রেলপথকে নিরাপদ রাখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। মুক্তিবাহিনী যাতে কোনােমতে রেলপথ ধ্বংস করতে না পারে, সে জন্য। সমস্ত রেলপথে রাজাকার বাহিনীকে সার্বক্ষণিক পাহারায় নিয়ােগ করে। স্থানীয় জনগণকেও বাধ্য করা হয় রেললাইন পাহারার কাজে। মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠক মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে ৩০-৩৫জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল শাহজীবাজার রেলপথে মাইন পুঁতে রাখেন। ১৫ জুন শাহজীবাজারের কাছে রেলসেতুতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ট্রেন ধ্বংস করা হয়। এতে প্রায় ১৫০জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় (মুক্তিফৌজ সদর দপ্তর থেকে ‘জয় বাংলা’ ১৯ জুন ‘৭১ সংখ্যায় প্রচারিত সংবাদ)।
শাহজীবাজার রেইড
হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার শাহজীবাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতাে। প্রায় পুরাে সিলেট অঞ্চলেই এখান থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতাে। সেখানকার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বাের্ডের রেস্ট হাউজে থাকতাে মিনালাল খান। জনশ্রুতি ছিল যে তিনি সম্পর্কে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ভাগ্নে। কী কাজে তিনি এখানে ছিলেন, সাধারণ মানুষ তা জানতাে না। তিনি নির্বিচারে স্থানীয় লােকদের নির্যাতন করতেন। এ সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন মতিন একটি অপারেশন পরিকল্পনা তৈরি করেন। যেভাবেই হােক মিনালাল খানকে হত্যা করতে হবে ইয়াহিয়া খান। ব্যক্তিগতভাবেও ক্ষগ্রিস্ত হবেন। মানসিক চাপ পড়বে তার ওপর। গঠিত হলাে একটি অপারেশন দল। এতে ছিলেন খােরশেদ আহমেদ খান, নুরুল ইসলাম, রশিদ আলী, মতিমিয়া, বাড়ু মিয়া, নুরুদ্দিন, ইসকির মিয়া প্রমুখ। জুন মাসের শেষ দিকে কিংবা জুলাইয়ের প্রথম ভাগে এ অপারেশন পরিচালিত হয়। সঠিক তারিখটির কথা আজ আর কারও মনে নেই। তবে ১৬ মাইল দূর থেকে পাহাড়ি পথে তাঁরা যে রওনা হলেন সে কথা অনেকেরই মনে আছে। তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছান রাতের আঁধারে। তাদের সাথে ছিল প্রচুর। অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন। সেই সাথে স্টেনগানসহ অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র।
বাহননগর গ্রামেই মুক্তিযােদ্ধা আসকিরের বাড়ি। পাশেরটি আওয়ামী লীগের স্থানীয় ইউনিয়ন সম্পাদক খুরশিদের বাড়ি। ২টি বাড়িতে অবস্থান গ্রহণ। করে তারা ৪ দিন অপেক্ষা করেন। এ অপেক্ষার ফাঁকে শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনী সম্পর্কে বিভিন্নভাবে খোঁজখবর নেয়া। সংবাদ সংগ্রহ করা হয় নিজস্ব লােক দিয়ে। চতুর্থ দিনে শুরু হয় প্রবল বৃষ্টিপাত। এ রকম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই মুক্তিযােদ্ধারা বের হলেন। শাহজীবাজার থেকে যে রাস্তা লালচান বাগানের ভেতরে চলে গেছে, তাতেই তারা স্থাপন করলেন মাইন। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই চলে রাস্তায় মাইন বসানাের কাজ। পথঘাট তখন পুরােপুরি জনশূন্য। পরদিন ভােরে মিনালাল গাড়ি নিয়ে বের হলেন। বাগানের ভেতরে আসতেই প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। ধ্বংস হয় গাড়ি, সমস্ত শরীর জ্বলে যায় মিনালাল খানের। পরে ১টি হেলিকপ্টার এসে তাকে নিয়ে যায়।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড