You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.17 | দি অটোয়া সিটিজেন (অটোয়া) | ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১ | সম্পাদকীয় - ব্যাপক ব্যবধান এবং তীব্র ঘৃণা – পাকিস্তান কি আর কখনই আগের মত হতে পারবে? - সংগ্রামের নোটবুক

দি অটোয়া সিটিজেন (অটোয়া) | ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১ | সম্পাদকীয় – ব্যাপক ব্যবধান এবং তীব্র ঘৃণা – পাকিস্তান কি আর কখনই আগের মত হতে পারবে?

লেখক আজ পাকিস্তানে বিভিন্ন মনোভাব নিয়ে আলোচনা করবেন। অনেক দেশ সময়ে সময়ে বিভক্ত হয়েছে – গৃহযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র, তার তীব্র যন্ত্রণার সময়ে নাইজেরিয়া। কিন্তু মনে হচ্ছে পাকিস্তানীরা আরো গভীরভাবে বিভক্ত। তরুণ পাঞ্জাবী একজন সনদপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক বলেনঃ “পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের সমস্যা একটাই – আমাদের কাছে সবগুলো ভারত-প্রেমীকে হত্যা করার মত পর্যাপ্ত গুলি নেই”। ভারত থেকে আসা একজন শরণার্থী, যিনি এখন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী বলেনঃ “এটা সত্যি যে আমরা এখন তাদেরকে একটি উপনিবেশের মতো শাসন করছি এবং ভবিষ্যতেও করবো। নারী, পুরুষ এবং শিশু নির্বিশেষে তারা যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে এরপর, এটা তাদের প্রাপ্য। আপনি এটা বিশ্বাস করবেন না। ওরা পশুর চেয়েও খারাপ আচরণ করেছে”। একজন পূর্ব পাকিস্তানী স্পর্ধাসহকারে বলেনঃ “তোমরা চাইলে মুজিবকে হত্যা করতে পারো। আমরা সবাই মুজিব। তোমরা আমাদের সবাইকে হত্যা করতে পারবে না। অথবা আজীবন আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না”। একজন বাঙালী গৃহপরিচারক একটি জুতো হাতে নেয় এবং টেলিভিশনের পর্দায় ছুড়ে মারে যেখানে দেখাচ্ছিল যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন। পুলিশ ডাকা হয় এবং ওরা তাকে থানায় নিয়ে যায়, যেতে যেতে সে বারবার বলছিলঃ “আমাদের বাহিনী ভারতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আমরা অচিরেই স্বাধীন হব”। পাকিস্তানীদের মধ্যকার ব্যবধান এবং ঘৃণা অবিশ্বাস্য ধরণের বলেই মনে হচ্ছে।

পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনী মার্চ মাসে বিদ্রোহ করে। যখন সরকারের কাজে ফিরে আসার আহ্বানে কেউ সাড়া দেয়নি, তখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজে করে পুলিশ বাহিনী নিয়ে আসা হয়। জাহাজভর্তি করে শ্রমিক নিয়ে আসা হয় কারখানাগুলোতে কাজ করার জন্য কেননা বাঙালীরা শহর ছেড়ে সবাই গ্রামে চলে গেছে। একইভাবে সরকারী কর্মচারী এবং আমলাদেরও নিয়ে আসা হয় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। আস্তে আস্তে এখন পূর্ব পাকিস্তানীরা তাদের শহরে এবং কাজে ফিরে আসছে। কিছু পুলিশ সদস্য ফিরে এসে তাদের কাজে যোগ দিয়েছে, কিন্তু তাদেরকে কোন অস্ত্র দেয়া হয়নি এখনো পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় সরকারে, যেসব পূর্ব পাকিস্তানীরা আছে তাদেরকে পুরো বেতনই দেয়া হচ্ছে কিন্তু তাদেরকে এমন সব জায়গায় বদলি করা হয়েছে যেখান থেকে তারা তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এই সাবধানতামূলক পদক্ষেপগুলোকে বর্তমানে ন্যায্য মনে হতে পারে – এবং খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যে একজন বাঙালী রাঁধুনিকে কোয়েটার সামরিক হাসপাতালে যে খাবার পরিবেশন করার কথা ছিল তাতে বিষ মেশানোর সময় হাতেনাতে ধরা হয়। এই কাহিনীগুলো শুনে, যে কেউ বিস্মিত হতেই পারে এই ভেবে যে এমন একটি দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে শক্তিপ্রয়োগ ছাড়া আর কিভাবে এক করা সম্ভব।

পশ্চিম পাকিস্তানে কিছুটা আশা এখনও আছে এই যুক্তির উপর ভিত্তি করে যে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার বা তাদেরকে স্বায়ত্তশাসন থেকে বঞ্চিত করার কোনো আগ্রহই নেই পশ্চিম পাকিস্তানের এবং পূর্ব পাকিস্তানীরা যখন বুঝতে পারবে যে ইসলামাবাদ শুধু বিদেশী সাহায্য প্রসূত একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করেছে মাত্র তখন তারা আবার ফিরে আসবে। অন্যরা মনে করে ঘা এতই গভীর যে তা আর কোনোদিনই ঠিক হবেনা। সব পশ্চিম পাকিস্তানীই, তাই বলে তাদের সরকারকে সমর্থন করেনা আবার সব পূর্ব পাকিস্তানীই দেশ ভাগের পক্ষে নয়। পশ্চিম পাকিস্তানে, ২৫শে মার্চের আগে অনেকেই সোচ্চার ছিলেন যেকোনো শক্ত পন্থা অবলম্বনের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান অ্যাডমিরাল এস. এম. আহসান, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে হুশিয়ারি দিয়ে বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হামলা করা অনৈতিক হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে অকার্জকর হবে। তাকে গভর্নরের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়। একইভাবে লেঃ-জেনারেল ইয়াকুবকেও প্রতিস্থাপন করা হয়।

এয়ার মার্শাল নূর খান, বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান যিনি পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর এবং উপ সামরিক প্রশাসকের দায়িত্ব পান যখন জেনারেল ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট হন। তিনি পরবর্তীতে পদত্যাগ করেন। ইয়াহিয়া সংসদ অধিবেশন মুলতবী ঘোষণা করার একদিন পর, নূর বলেনঃ “প্রেসিডেন্ট যেন অবশ্যই আবার অধিবেশন ডাকেন আগামী মার্চ মাসে, নইলে এমন ক্ষতি হবে যা মেরামতের অসাধ্য। উচ্চপদে আসীন একজন প্রেসিডেন্টকে ভুল পরামর্শ দিচ্ছেন। যদি ক্ষমতার পালাবদল না হয়, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বদাই সামরিক শাসন বজায় থাকবে”। এয়ার-মার্শাল আসগর খান, সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান, ৬ই মার্চ বলেনঃ “মুজিবের হাতে এখনই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের জন্য আমাদের হৃদয়ে রক্তাশ্রুক্ষরণ হচ্ছে”। ১২ই মার্চ মেজর-জেনারেল শের আলি খান, ইয়াহিয়ার মন্ত্রিসভার সাবেক তথ্যমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের কাছে এমন কিছু না করার জন্য আবেদন জানিয়ে তারবার্তা পাঠান যাতে করে “এই ইসলামিক প্রজাতন্ত্রটিকে ধ্বংস করার অপবাদ” তার ওপর পরে। ২০শে মার্চ, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হামলা চালানোর পাঁচ দিন আগে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু দলগুলি করাচীতে এক সম্মেলনের আয়োজন করে এবং জাতীয় সংসদের ৪০ জন নির্বাচিত সদস্য সামরিক শাসন বাতিল এবং জনগনের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানিয়ে একটি স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন।

৪ঠা এপ্রিল পাকিস্তানে আমেরিকান ছাত্রদের এসোসিয়েশন, পুরো পাকিস্তানে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, শহর থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, মুজিবের মুক্তি এবং আওয়ামী লীগকে দিয়ে সরকার গঠনের আহ্বান জানায়। আর পূর্ব পাকিস্তানে, নির্বাচনের আগে এবং পরে অনেকেই আওয়ামী লীগের কঠোর কার্জপদ্ধতির নিন্দা করেছে।

১লা ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০, এ ঢাকায় একটি গন সমাবেশে ব্যঘাত ঘটার পর পাকিস্তান গণতান্ত্রিক দলের সভাপতি নুরুল আমিন, যিনি পরে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন, বলেনঃ “আওয়ামী লীগের এসব কার্জকলাপের নিন্দা জানানোর মতো কোনো ভাষা আমার নেই যেখানে, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, তারা নিজেদের পরিকল্পনা অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্যই পরিকল্পিতভাবে এসব করছে”। আওয়ামী লীগ একটি অত্যন্ত উস্কানিমূলক নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। একটি গণসমাবেশে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদ বলেনঃ “এত বছর ধরে বাঙালীদের রক্ত এবং মাংস শোষণ করেছে শোষক এবং ডাকাতেরা। আগামী নির্বাচনে এই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে এদেরকে ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন করতে হবে”। নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা আসলেও আসতে পারতো যদি তারা বিচক্ষণতা বা অন্তত নমনীয়তা দেখাতো। কিন্তু তারা অনড় থাকে এবং এরপর যা ঘটে তার দায় তাদেরকেও অবশ্যই নিতে হবে।

নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া সকল প্রধান নেতৃবৃন্দকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আলোচনায় বসতে মুজিবের অস্বীকৃতি পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর অভিপ্রায় সম্বন্ধে শুধু সন্দেহের উদ্রেকই করেনি বরং মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী ভুট্টোকে এককভাবে ইয়াহিয়ার কান ভারী করার সুযোগও করে দেয়। যদিও এটি ভুট্টোর পরামর্শ মতো ইয়াহিয়ার কাজ করাকে ন্যায্য প্রমাণ করেনা, কিন্তু ঘটনাগুলো কেন এভাবে ঘটলো তার ব্যাখ্যা দিতে সাহায্য করে। ইয়াহিয়া, প্রায় সবার মতে, সংসদের অধিবেশন মুলতবী করে সবচেয়ে বড় ভুল করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল প্রতিক্রিয়ার মুখে ইয়াহিয়া পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হয় এবং ৩রা মার্চ সে সংসদের ১২ জন নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ঢাকায় অধিবেশনে বসতে আমন্ত্রণ জানায় সঙ্কট নিরসনের জন্য। মুজিব এতেও অস্বীকৃতি জানান।

৬ই মার্চ, ইয়াহিয়া ঘোষণা দেয়, ২৫শে মার্চ সংসদ অধিবেশন বসবে। মুজিব চারদফা দাবী জানান, তাৎক্ষনিকভাবে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবিসহ, তিনি অংশ নেবেন কিনা তা বিবেচনা করার আগে।

হতাশ হয়ে, ইয়াহিয়া বিমানযোগে ঢাকায় আসে মুজিবের সাথে আলোচনায় বসতে। এমনকি প্রেসিডেন্ট বাসভবনে যে পূর্ব পাকিস্তানীরা কাজ করতো তারাও ধর্মঘটরত ছিল এবং ইয়াহিয়া একারনে অস্বস্তিকর সময় কাটায় বলে জানা যায়। কিন্তু যদিও সে আওয়ামী লীগের ছয় দফা মেনে নেয়, তবুও তার কাছে নতুন দাবী উত্থাপন করা হয়, যার মধ্যে পাকিস্তানকে একটি সম্মিলিত রাষ্ট্র থেকে সার্বভৌম প্রদেশের মৈত্রী রাষ্ট্রে পরিবর্তন করার দাবীও ছিল। ২৫শে মার্চের আগে এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু-ভাষী বেসামরিক জনগনের উপর চালানো নিষ্ঠুরতার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের জনমত বাঙালীদের বিরুদ্ধে চলে যায়। এই খবরগুলো পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি, হয়তো একারনেই যে পশ্চিমা সাংবাদিকেরা যখন ঢাকায় ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার প্রতিবেদন করছিলেন তখন ভেতরে ভেতরে এই ঘটনাগুলো ঘটছিলো। পাকিস্তানী সরকারও এই খবরগুলো প্রাথমিকভাবে প্রকাশ করেনি যাতে করে পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালীদেরকে প্রতিশোধমুলক ঘটনার হাত থেকে বাঁচানো যায়।

যদি কোনো ষড়যন্ত্র থেকেই থাকে তাহলে ষড়যন্ত্রকারীরা যা চেয়েছিল আওয়ামী লীগ ঠিক তাই করেছে। একটু নমনীয়তা এবং ভাতৃত্তবোধ তাদেরকে ক্ষমতায় বসাতে পারতো এবং তারা তাদের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার একটি সুযোগ পেত এবং হাজার হাজার বাঙালী এবং অ-বাঙালীর হত্যা প্রতিরোধ করা যেত। পাকিস্তান আর কখনই আগের মতো হতে পারবে কিনা তা এখন আর কেউই জানে না।