You dont have javascript enabled! Please enable it! মহব্বতপুর অপারেশন,মৌলা অপারেশন, লীলপুর অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
মহব্বতপুর অপারেশন
সেপ্টেম্বর মাসের একটি অপারেশন ৫ নম্বর সেক্টরের এ অপারেশনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলে ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিন। পাকিস্তানিদের দখল করা একটি বিশাল স্থানের পুনর্দখলের দায়িত্ব পড়ে তার ওপর আর সেই লক্ষ্য থেকে তার নেতৃত্বে মহব্বত এলাকায় পাকিস্তানি শক্রর মুখােমুখি হন। মুক্তিযােদ্ধারা প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় সেখানে কিন্তু মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছিল দুর্বল। তাই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হতে হয় তাদের হাবিলদার মইনউদ্দিন এ যুদ্ধে অসম সাহস নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে গেছেন ফ্রন্ট লাইনে কিন্তু বিপর্যয় ঠেকাতে পারেননি। আর তার এ সাহসিকতার কারণেই শেষ পর্যন্ত তাঁকে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে হয়েছে। তার সাথে শহিদ হয়েছেন আরও ৫জন মুক্তিযােদ্ধা এ যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের স্বাক্ষর রাখেন হাবিলদার হুমায়ুন, খালেক, আমিন প্রমুখ।
মৌলা অপারেশন
সুনামগঞ্জ মহকুমার ছাতক থানার পূর্ব-উত্তর কোণের গ্রামগুলাে হলাে মৌলা, কুপিয়া ও পাণ্ডব এ গ্রামগুলােতেই মুক্তিবাহিনীর ৪টি দল তখন অবস্থান নিয়েছে তারই সামনে একটি বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তােলা হয়েছে মুক্তাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বেই তখন চলছিল সেই এলাকাগুলাের প্রশাসন। ব্যবস্থা। সেখান থেকেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত হচ্ছে মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশন মুক্তিবাহিনীর এ তৎপরতার খোঁজখবর পাকিস্তানিরাও নিচ্ছিল, কিন্তু সরাসরি আক্রমণ করার মতাে সাহস তাদের ছিল না। কিন্তু একটা সময় এসে এ দেশীয় সহযােগীদের বারবার অনুরােধ, সেই সাথে ওপর মহলের চাপে শেষ পর্যন্ত তারা মৌলা আক্রমণের পরিকল্পনা করে এবং তারা সেখানে সৈন্য সমাবেশ ঘটায় প্রচুর পরিমাণে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ শেষ রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিন্ন করে মােয়াজ্জিনের কণ্ঠে ঘােষিত হয় আযানের ধ্বনি মুসলমানরা যখন ওযু করে ছুটছে মসজিদের দিকে, ঠিক তখনই শােনা যায় এক গগনবিদারী শব্দ কেউ কিছু অনুভব করার আগেই আবার শােনা যায় অস্ত্রের গর্জন। মুহূর্তের ভেতর আগুনের স্ফুলিঙ্গ আর ধোয়ায় যেন আচ্ছন্ন হয়ে যায় সমস্ত পৃথিবী মৌলায় অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে পাকিস্তানিরা আক্রমণ করেছে। অতর্কিত এ আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা হতভম্ভ হয়ে গেলেও তাল সামলে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ রচনা। করেন তারাও কুপিয়ায় অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর দলটি এগিয়ে আসে তাদের সাহায্যে ২টি দলের মিলিত অভিযান বেলা ১১টা পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখে। শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণকে ৭ ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী কৌশল পরিবর্তন করার চিন্তা করে। এভাবে দীর্ঘক্ষণ পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধ করে অপরিসীম ক্ষতি স্বীকার করার চেয়ে পিছু হটাই শ্রেয়। বিবেচনা করে বালিউড়া হয়ে তারা সরে পড়ে পাকিস্তানিদের দলকে প্রায় দুই কিলােমিটার পর্যন্ত পিছু ধাওয়া করে অবশেষে মুক্তিযােদ্ধারা নরসিংপুর এসে অবস্থান গ্রহণ করেন এ যুদ্ধে ২জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন।
লীলপুর অপারেশন
লীলপুর হলাে একটি বাজার, যা সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের ডান পাশে অবস্থিত এ বাজারের পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদী দিয়ে ১টি নৌকা এগিয়ে আসছে সড়কের দিকে মাত্র ৬জন ছিল ঐ নৌকার আরােহী প্রচণ্ড উদ্বেগের চিহ্ন মুখে নিয়ে তারা নিজেরাই ঐ নৌকার দাঁড় টানছে চোখে-মুখে ভীতির ছাপ থাকলেও মনে তাদের তখন অদম্য সাহস, শত্রু জয়ের দৃঢ়সংকল্প সড়কটি অতিক্রম করতে পারলেই চিন্তামুক্ত হবে তাদের দিরাই অভিমুখী যাত্রা দিরাই সুনামগঞ্জ মহকুমার একটি থানা ছােট এ দলটি বিগত ৬ মাস আগে ঘরবাড়ির মােহ ত্যাগ করে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখায় পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এরা চলে যায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে সেখানকার মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে প্রবেশ করে বাংলার মাটিতে এবং অপারেশন করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে।
বালাট সাব-সেক্টরের অধীনে এসব গেরিলাই এখন মুক্তিযুদ্ধ করে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি চিয়াউরা নামক স্থানে অপারেশন পরিচালনার জন্য ২ শতাধিক মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এ দলের অধিনায়ক ছিলেন প্রাক্তন ইপিআর বাহিনীর হাবিলদার আবদুল গনি চৌধুরী  চিয়াউরা পৌছে তারা যথারীতি ক্যাম্প স্থাপন করে কিন্তু কোনাে অপারেশন পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে হাবিলদার গনির অনীহার কারণে মুক্তিযােদ্ধারা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্ন দল বিভিন্ন দিকে অপারেশন করার পরিকল্পনা করে এ অপারেশনে আগত ব্যক্তিরা ছিলেন গৌরাঙ্গ দেশী, প্রীতেশ চৌধুরী, আবু সুফিয়ান, পীযূষ দাস ও ঝন্টু ভদ্র। এ অপারেশন চালিয়েছিল নবাগত দলেরই সদস্যরাই সাব-সেক্টর থেকে গােয়েন্দাগিরির দায়িত্ব তাদের ওপরই ন্যস্ত ছিল। সেই হিসেবে ময়মনসিংহ জেলার ১জন মুক্তিযােদ্ধা তাদের সাথে যােগ দেন ৬জন মিলে তৈরি করেন একটি পরিকল্পনা আর সে অনুসারে চিয়াউরা থেকে ১টি নৌকা সগ্রহ করে রওনা হন তারা দিরাই থানা অভিমুখে।
মুক্তিযােদ্ধাদের নৌকাটি জয়নগর যাওয়ার আগেই রাজাকারদের ১টি নৌকার মুখােমুখি হয় তারাও সংখ্যায় ৬জন। হাতে চাইনিজ রাইফেল মুক্তিযােদ্ধারা লক্ষ্য করলেন, রাজাকার বাহিনীর ঐ ছয় সদস্য তাদের গতিতে এগােচ্ছে কিন্তু তারা সহজে শনাক্ত করতে পারল না মুক্তিযােদ্ধাদের এবার বুদ্ধি করে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সিগারেট ধরানাের জন্য আগুন দিতে এগিয়ে যায় রাজাকারদের দিকে উভয় নৌকা একত্র হওয়ার সাথে সাথেই মুক্তিযােদ্ধারা অতর্কিত রাজাকারদের নৌকায় আক্রমণ চালিয়ে তাদের রাইফেলগুলাে কেড়ে নেয় তারপর খরচ করে মাত্র ৬টি বুলেট ফলে হাওরের অথৈ জলে ডুবে যায় ৬জন রাজাকার মাঝিকে তার নৌকা নিয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা বাকি অস্ত্রশস্ত্র তুলে নিলেন তাদের নৌকায় তারপর তারা যাত্রা করেন গন্তব্য অভিমুখে। অবশেষে ভারতে অবস্থিত মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে এসে উপস্থিত হন।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড