You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাদেরটেক রেইড,তাজপুর রেললাইন ধ্বংস - সংগ্রামের নোটবুক
ভাদেরটেক রেইড
বালাট সাব-সেক্টরের কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শক্তভাবে অবস্থান নিয়েছেন। সুনামগঞ্জ থানার অন্তর্গত পলাশ নামের একটি সবুজ-শ্যামল গ্রামে। তাদের সংখ্যা ১ সেকশন নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেকশন অধিনায়ক মুক্তিযােদ্ধা পাণ্ডবচন্দ্র দাশ। প্রতিটি মুহূর্তেই মুক্তিযােদ্ধারা অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় দণ্ডায়মান। বাংলার ১ ইঞ্চি জায়গা যেন তারা পাকিস্তানিদের কবল হতে ছিনিয়ে নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তাদের উদ্দেশ্যই ছিল পাকিস্তানিদের পরাজিত করে বাংলার মাটিকে মুক্ত ও স্বাধীন করা। পলাশ গ্রাম থেকে ৩ কিলােমিটার দূরে ভাদেরটেক গ্রাম পাকিস্তানিরা অবস্থান গ্রহণ করেই সেখানকার অধিবাসীদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ আর অগ্নিসংযােগ চালাচ্ছে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে। এ সংবাদ শুনে স্থির থাকতে পারেননি সাব-সেক্টর অধিনায়ক। নির্দেশ দিলেন আক্রমণের তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী অতি দ্রুততার সাথে তৈরি করা হয় যুদ্ধ পরিকল্পনা। রণকৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও সন্নিবেশিত হয় সেই পরিকল্পনায়। সবকিছু মিলিয়ে রূপ লাভ করে একটি পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ পরিকল্পনা। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত ২৭ আগস্ট দিনটি উপস্থিত হলাে। রাত আনুমানিক ৩টা ২৫জন দুঃসাহসিক মুক্তিযােদ্ধা রওনা হলেন ভাদেরটেক অভিমুখে ভাের ৫টায় দলপতির নির্দেশে ২৫টি আগ্নেয়াস্ত্রের নল থেকে এক সাথে আগুন ঝরতে শুরু করে। একটি ছােটো নদীর হাঁটুজলে থেকে মুক্তিযােদ্ধারা পুরাে ১ ঘণ্টা যুদ্ধ করেন। এর চেয়ে অধিক সুবিধাজনক অন্য কোনাে স্থান ছিল না আক্রমণের ভাের ৬টার দিকে দিনের আলােয় উদ্ভাসিত হয় চারদিক আর তখনই দেখা যায় পাকিস্তানিরা অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে গেছে। পুরাে ভাদেরটেকে কর্তৃত্ব কায়েম করেন মুক্তিযােদ্ধারা আর পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানস্থলে পড়ে ছিল ১জন পাকিস্তানি সেনা ও ৩জন রাজাকারের মৃতদেহ।
তাজপুর রেললাইন ধ্বংস
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে গােবিন্দগঞ্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখান থেকে ডান দিকে চলে গেছে ছাতক সড়ক। বাঁয়ে সিলেট ছাতক রেললাইন। রেললাইন উড়িয়ে দিয়ে যােগাযােগ বিছিন্ন করার একটি পরিকল্পনা গৃহীত হয়। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতেই শেলা সাব-সেক্টরে তা অনুমােদিত হয়। আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৯জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ১টি দলও গঠিত হলাে। নেতৃত্ব দেন মাে, নুরুল হক। আর অন্যদের মধ্যে ছিলেন আব্দুর রহমান, বদিউজ্জামান, নুরুজ্জামান, বুলু মিয়া, পিয়ারা মিয়া প্রমুখ নির্দিষ্ট দিনে সাব-সেক্টর সদর দপ্তর থেকে পায়ে হেঁটে রওনা হন। মুক্তিবাহিনীর ৯জন সদস্য। চানপুর নামক স্থানে তারা নৌকায় আরােহণ করেন। তখন তারা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রচণ্ড বিস্ফোরক দ্রব্য এবং হালকা অস্ত্রসহ তাদের নির্ধারিত পথে যাত্রা করেন। কিন্তু চলার পথে হঠাৎ নৈনগাঁও নামক স্থানে তাঁদের পথ হারিয়ে ফেলেন। পথ হারিয়ে ফেলায় কিছুক্ষণ সময়। ঘােরাঘুরির পর তারা একটি বাড়ির সামনে তাদের নৌকা ভেড়ান। ঐ বাড়ির মালিক আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়ায় তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের সাদরে গ্রহণ করলেন এবং তাঁদের আহার ও রাত্রি যাপনের যাবতীয় ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু পাশের বাড়িটি ছিল এক পাকিস্তানি দালালের। বুঝতে পারলে সর্বনাশ হবে। তাই অতি সঙ্গোপনে দিন অতিবাহিত করতে হলাে। সন্ধ্যার আবছা আঁধার নামার সাথে সাথেই। মুক্তিযােদ্ধারা প্রস্তুত হয়ে আবার আরােহণ করলাে নৌকায়।
এবার নির্দিষ্ট সময়েই নৌকা পৌছাল গােবিন্দগঞ্জের কাছে। রেললাইনের ২০০ গজ দূরে নৌকা লাগানাে হয়। তারপর অতি সন্তর্পণে নেমে আসেন বাংলার মুক্তিযােদ্ধারা তাজপুর গ্রামের কাছে একটি সেতু। এর নাম ঝাওয়ার সেতু। এখানে রাজাকারদের ১টি বিরাট দল সার্বক্ষণিক প্রহরায় থাকে আবার গােবিন্দগঞ্জেও বহু রাজাকার বিভিন্ন দলে মধ্যবর্তী স্থানগুলাে টহল দিচ্ছে। এরপর মুক্তিযােদ্ধারা ক্ষেতের ভেতর দিয়ে রেললাইনে এসে ওঠেন। রাজাকাররা আসার আগেই তারা রেললাইনে বিস্ফোরক স্থাপন করে ফেলেন এবার চুপি চুপি চলে যান তারা নৌকার কাছাকাছি। অগ্নিসংযােগ করে দিয়েছেন। বিস্ফোরক দ্রব্যে প্রচণ্ড শব্দের সাথে উড়ে যায় রেললাইন। পুরােপুরি সফল হয়। মুক্তিযােদ্ধারা বিস্ফোরণ ঘটার পর হতচকিত রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পায়। ভয়ে তারা এলােপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে কিছুক্ষণ গুলির জবাব দিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা নৌকা ভাসিয়ে দেন। চলে যান বহু দূরে। কিন্তু পথিমধ্যে নৈনগাওয়ের কাছে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যামবুশের মধ্যে পড়েন তবে কোনােরূপ ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন তারা ৭ ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী কৌশল পরিবর্তন করার চিন্তা করে। এভাবে দীর্ঘক্ষণ পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধ করে অপরিসীম ক্ষতি স্বীকার করার চেয়ে পিছু হটাই শ্রেয় বিবেচনা করে বালিউড়া হয়ে তারা সরে পড়ে। পাকিস্তানি দলকে প্রায় ২ কিলােমিটার পর্যন্ত পিছু ধাওয়া করে অবশেষে মুক্তিযােদ্ধারা নরসিংপুর এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ল্যান্স নায়েক আবু ইসহাক ও পাণ্ডব নামের গণবাহিনীর ১জন সদস্য আহত হন।

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড