উত্তর বড়দেওয়ের যুদ্ধ
বর্তমান কোম্পানিগঞ্জ থানা সদর (ছাতক থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল) সিলেট শহর থেকে ২৫ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত। উত্তর বড়দেও কোম্পানিগঞ্জ সদরের পশ্চিম দিকে নিকটবর্তী একটি গ্রাম। পাকিস্তানিরা কোম্পানিগঞ্জের প্রায় ৮ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত সেনগাড়গাঁও ব্রিজের কাছে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। অন্যদিকে ভােলাগঞ্জ সাব-সেক্টর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট তাহের উদ্দিন আখঞ্জি টুকেরবাজারে মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটি স্থাপন করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি গ্রুপ কোম্পানিগঞ্জ গ্রামের পূর্ব দিকে সুরুজ আলীর বাড়িতে অবস্থান গ্রহণ করে। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে শক্রর ২৫-৩০জনের ১টি দল ৪টি নৌকাযােগে গৌখাল গ্রামে এসে বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ৮জন সাধারণ মানুষকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ খবরে কোম্পানি অধিনায়ক মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে ৪০জনের ১টি মুক্তিযােদ্ধা দল এগিয়ে আসে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ করে প্রায় দেড় ঘণ্টা গােলাগুলি চলাকালীন সুনামগঞ্জের অজ্ঞাতনামা একজন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং আনুমানিক ৯-১০জন আহত হয়। শেষ পর্যন্ত শত্রুরা টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং নৌকাযােগে পূর্ব দিকে পালিয়ে যায়।
সালুটিকর বিমানবন্দর অপারেশন
সালুটিকর বিমানবন্দর সিলেট শহর থেকে ৭ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত। সি ১৩০ বিমান দিয়ে শত্রু সিলেটে সালুটিকর বিমানবন্দরে সৈন্য ও অস্ত্র নামিয়ে দিয়ে যেত। তাই এ বিমানটি ধ্বংস করার একটি পরিকল্পনা করা হয়। ভারতীয় জেনারেল গুলবক্স সিং গিল ছিলেন মূল রূপকার। তৈরি হলাে পরিকল্পনা আর তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে ৫ নম্বর সেক্টরের অধীন ভােলাগঞ্জ সাব-সেক্টরের ওপর। গঠিত হলাে ১টি গ্রুপ সংখ্যায় এরা ৩৩ জন অধিনায়ক নিযুক্ত হন মুক্তিযােদ্ধা ইয়ামীন চৌধুরী অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে প্রায় ৩০ কিলােমিটার অতিক্রম করে সিলেট বিমানবন্দরের কাছে অবস্থান গ্রহণ করে তারা স্থানটি ছিল বর্তমান ন্যাচারাল পার্ক এখান থেকে বিমানবন্দর খুবই কাছে। তাই সময় ও সুযােগমতাে আক্রমণ করা হয়। এলএমজির গুলিতে ঘায়েল করা হয় সি-১৩০। বিমানে গুলি লাগলেও বিমানটি উডডয়নক্ষম থেকে যায়। তারপর আবার তারা নিরাপদে চলে যায় ভােলাগঞ্জে তাদের শিবিরে।
মুল্লারগাঁও অপারেশন
সিলেট শহর থেকে ৯ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের উত্তরে মুল্লারগাঁও মুল্লারগাঁও ছাতক এলাকায় একটি বড় ধরনের অপারেশন পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছিল ৫ নম্বর সেক্টরে। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন স্থানে কিছু কিছু অপারেশন চলছিল। তারই একটি সম্পন্ন হয় সিলেট শহরের পশ্চিম পাশে। স্থানটির নাম মুল্লারগাঁও এখানকার সেতু ধ্বংস করে সিলেট-সুনামগঞ্জছাতক সড়কে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য ১টি গ্রুপ গঠন করা হয়। মােট ছয়জন মুক্তিযােদ্ধার এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা ইয়ামীন চৌধুরী অন্যদের মধ্যে ছিলেন ডা, হারিস আলী, আবদুল কাদির প্রমুখ অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের কোনাে একদিন প্রচুর বিস্ফোরকদ্রব্যসহ মুক্তিযােদ্ধারা ১টি নৌকাযােগে ভােলাগঞ্জ সাব-সেক্টর সদর থেকে রওনা দেন। তারপর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে লামাকাজীর কাছাকাছি একটি গ্রামে ওঠেন। এখানেই অ্যাডভােকেট দবির উদ্দিনের বাড়ি তার ছেলেই মুক্তিযােদ্ধাদের পথপ্রদর্শক, সুতরাং তাদের বাড়িতেই যাত্রা বিরতি। রাতের প্রাথমিক রেকির পর পুরাে দলটি রওনা দেয়। তারপর মুল্লারগাঁও নামক সেতুর কাছে অবস্থান নেয় রাজাকারদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করার পর কর্তব্য নির্ধারণ করা হয়। ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকে অকুতােভয় মুক্তিযােদ্ধারা একসময় রাজাকারদের অগােচরে প্রবেশ করে সেতুর নীচে এবারে ঝটপট বিস্ফোরকদ্রব্য স্থাপন করে দ্রুতগতিতে চলে আসে রাজাকারদের নাগালের বাইরে নিরাপদ দূরত্বে থেকে অগ্নিসংযােগ করে উড়িয়ে দেওয়া হয় মুল্লারগাঁও সেতু। অবশ্য পুরাে সেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি। তবু যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। পরে পাকিস্তানি সৈন্যরা সেতুটি মেরামত করে যান চলাচলের উপযােগী করেছিল।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড