নাইওরপুল ট্রান্সফরমার ধ্বংস
সিলেট শহরের পূর্ব পাশে রামকৃষ্ণ মিশন। সামনেই চৌরাস্তা। পূর্ব দিকের সড়কটি খাদিমনগর হয়ে চলে গেছে তামাবিল অভিমুখে। দক্ষিণ দিকের রাস্তাটি চলে গেছে শহরের কেন্দ্রস্থল বন্দর বাজারে পশ্চিম দিকের রাস্তাটি জিন্দাবাজার। আর উত্তর দিকেরটি কুমারপাড়া অভিমুখে এ ৪টি রাস্তার মিলনস্থলের নাম নাইওরপুল ২৮ মে সিলেট জেলার নাইওরপুল ট্রান্সফরমার ধ্বংসে মুক্তিবাহিনীর দলনেতা আলী ওয়াকিউজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ছাত্রলীগ নেতা নিজামউদ্দিন ভূইয়া, কুমিল্লার ১জন ছাত্র আশরাফ হােসেন এবং কুমিল্লার রেবতীর সাথে তাদের ২২৫ পাউন্ড উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকদ্রব্য, ২৪টি গ্রেনেড ও বেয়নেট ইত্যাদি বহন করছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, নাইওরপুল বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ধ্বংস করা এতে করে শত্রু সৈন্যরা মনোেবল হারাবে বিশ্বের মানুষ জানবে, মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযানের কাহিনী এ দিন রাত ১টা ১৫ মিনিটে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি জিপ চলে গেলে মুক্তিবাহিনী তাদের কাজ শুরু করে। আলী ওয়াকিউজ্জামান ও নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া টিলাগড়মুখী সড়কের উত্তর পাশে ১৫ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারে বিস্ফোরকদ্রব্য স্থাপন করেন রাস্তার দক্ষিণ পাশে টেলিফোনের ডিপি বক্সে বিস্ফোরক স্থাপন করলেন আশরাফ ও রেবতী অগ্নিসংযােগ করে বিস্ফোরিত করলেন ট্রান্সফরমার ও ডিপি বক্স। এরপর সুকৌশলে মুক্তিযােদ্ধারা ভারত অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে রনিকেলি, আমুড়া ও গােবিন্দশ্রী হয়ে একটি বাজারে আসার পর তাদেরকে রাজাকাররা বন্দি করে এবং একটি কাঁচা ঘরে আটকিয়ে রাখে রাজাকাররা পাকিস্তানিদের খবর দিতে গেলে সুযােগ বুঝে মুক্তিযােদ্ধারা বেড়া কেটে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
বিয়ানীবাজার থানা আক্রমণ
সিলেট-চরখাই-জকিগঞ্জ থেকে ১২ কিলােমিটার দক্ষিণে ও জকিগঞ্জ থেকে ২২। কিলােমিটার পশ্চিমে বিয়ানীবাজার থানা অবস্থিত। চরখাই থেকে একটি সড়ক। বিয়ানীবাজার হয়ে বড়লেখাকে সংযুক্ত করেছে ৪ নম্বর সেক্টরের কুকিতল সাবসেক্টর থেকে বিয়ানীবাজার এলাকায় মুক্তিযােদ্ধারা অপারেশন পরিচালনা করতেন জুনের মাঝামাঝি, অন্ধকার রাত। আকাশে মেঘের গর্জন। সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী থানা বিয়ানীবাজার চারদিক নীরব-নিস্তব্ধ সারপারের হাওর দিয়ে একটি ছােট নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে। আরােহী ১২জন মুক্তিযােদ্ধা আসছে কুকিতল সাব-সেক্টর থেকে। নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুক্তিযােদ্ধা জমিরউদ্দিন। বাড়ুদা গ্রাম থেকে নৌকা নিয়েছেন তারা সাথে তাদের হালকা অস্ত্রশস্ত্র ।
এ বাহিনীর লক্ষ্যস্থল বিয়ানীবাজার থানা। আক্রমণ করে থানার সমস্ত অস্ত্র লুট করে নিয়ে আসাই মূল লক্ষ্য। একসময় নৌকা ভিড়ে নয়াগ্রামে। তারপর অন্ধকারে পথ হাতড়ে হাতড়ে চলে আসেন তারা বাজারে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক বিভক্ত হয় তারা ৩টি ভাগে। ১টি গ্রুপ থানার ঠিক নীচে পশু হাসপাতালের সামনে অবস্থান গ্রহণ করে। এখান থেকে প্রায় ৩০ গজ উঁচু একটি টিলার ওপরই বিয়ানীবাজার থানা অবস্থিত দ্বিতীয় গ্রুপ অবস্থান নেয়। হরগােবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের টিলায়। এ টিলাটি উচ্চতায় থানার টিলার সমান। দূরত্ব প্রায় ১৫০ গজ তৃতীয়টি রাজাকারদের ধরে আনতে অবস্থান নিয়েছে। বাজারের ভেতরে। প্রত্যেকেই অবস্থান নিয়েছেন যার যার নির্ধারিত স্থানে। এবার পশু হাসপাতাল থেকে একটি গুলি ছােড়া হয়। সাথে সাথে প্রতি-উত্তরে থানা থেকে। এক ঝাঁক গুলিবর্ষণ করা হয়। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ তবে এলএমজি দিয়ে মুক্তিবাহিনী স্কুল টিলা থেকে লক্ষ্যস্থলের তেমন ক্ষতি করতে পারছিল না। আর পশু হাসপাতালের অবস্থানেরও একই অবস্থা এখানে আক্রমণ করেও তারা তেমন সুবিধা করতে পারলাে না। শত্রুদের প্রচণ্ড আক্রমণে একসময় মুক্তিযােদ্ধা খলিলুর রহমান ও আসাদউদ্দিন প্রমুখ ছত্রভঙ্গ হয়ে যান পথ হারিয়ে ফেলেন। আসাদ এদিক-সেদিক ঘােরাঘুরি করে থানার ঠিক নীচে একটি ছােট্ট কালভার্টের ভিতর ঢুকে পড়েন তিনি খুব ছােটো কালভার্ট কোনােরকমে নিজের দেহকে এর নীচে আড়াল করে রাখেন। তারপর পুরাে ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত করেন সেখানে পরের রাতে আবার গভীর অন্ধকারে মিশে গিয়ে বের হলেন গুহা থেকে। ক্রলিং করে অতি সন্তর্পণে অতিক্রম করলেন বাজার তারপর সােজা ভারতে গিয়ে মিলিত হলেন মূল দলের সাথে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও অভিজ্ঞতার অভাবে এ অপারেশন ব্যর্থ হয়।
বিয়ানীবাজার সার্কেল অফিস রেইড
সিলেট-চরখাই-জকিগঞ্জ থেকে ১২ কিলােমিটার দক্ষিণে এবং জকিগঞ্জ থেকে ২২ কিলােমিটার পশ্চিমে বিয়ানীবাজার সার্কেল অফিস অবস্থিত ১৫ জুন বিয়ানীবাজার ও বড়লেখায় ২টি অপারেশন পরিচালনা করে ৪ নম্বর সেক্টরের কুকিতল সাব-সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধারা সীমান্তবর্তী ক্যাম্প থেকে ১টি দল পৌছে যায় বর্তমান বিয়ানীবাজার থানা সদরে তখনাে বিয়ানীবাজার থানা হিসেবেই স্বীকৃত এর প্রশাসক ছিলেন সার্কেল অফিসার সার্কেল অফিসারই ছিলেন একটি থানার প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। থানার সমস্ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের দায়িত্বে তিনিই নিয়ােজিত থাকতেন সুতরাং একটি থানার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ছিলেন সার্কেল অফিসার তাই মুক্তিযােদ্ধারা সার্কেল অফিসারের কার্যালয়ে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ অপারেশন সফল হলে বিস্মিত হবে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর শক্তি সম্পর্কেও মানুষের আস্থা দৃঢ় হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিবাহিনী আক্রমণ। করে। হ্যান্ড গ্রেনেডের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সার্কেল অফিস এদিন মুক্তিযােদ্ধারা অপারেশন শেষে নিরাপদেই চলে যেতে সমর্থ হন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড