You dont have javascript enabled! Please enable it! সালুটিকরের যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
সালুটিকরের যুদ্ধ
ভূমিকা
সালুটিকর ফেরিঘাট ও বিমানবন্দর এলাকার যুদ্ধ সিলেটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ, যেখানে মুক্তিবাহিনী বীরত্ব ও শৌর্য প্রদর্শন করেছে। পাকিস্তান সরকার যুদ্ধ ঘােষণার মাত্র ৩ দিনের মাথায় অর্থাৎ ৭ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবীর নেতৃত্বাধীন ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও গণবাহিনী কোম্পানি সিলেট শহরের শত্রুর সর্বশেষ প্রতিরক্ষা অবস্থানের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়। ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য ছাড়াই সিলেট শহরের কাছাকাছি যুদ্ধ পরিচালনা ও শক্রর অসংখ্য প্রতি-আক্রমণ রােধ করার জন্য এ যুদ্ধ বিশেষভাবে স্মরণযােগ্য। যুদ্ধের স্থান পরিচিতি সিলেট শহরের কেন্দ্র থেকে সালুটিকর বিমানবন্দর ৬ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত। এ বিমানবন্দর থেকে ৩-৪ কিলােমিটার উত্তরে গােয়াইনঘাট নদীর ওপর সালুটিকর ফেরিঘাট (বর্তমানে ব্রিজ তৈরি হয়েছে)। এ ফেরিঘাট হয়ে সিলেট-কোম্পানিগঞ্জ ও সিলেট-গােয়াইনঘাট যাওয়ার রাস্তা। সালুটিকর ফেরিঘাট সদর, গােয়াইনঘাট ও কোম্পানিগঞ্জ থানার সীমানায় অবস্থিত। এটি ৫ নম্বর সেক্টরের ডাউকি-মুক্তারপুর সাব-সক্টরের অন্তর্ভুক্ত অপারেশনাল এলাকা। যুদ্ধের পটভূমি অক্টোবর মাস থেকে ডাউকি-মুক্তারপুর সাব-সেক্টর এলাকার গণবাহিনীর কোম্পানিগুলাে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানগুলাের মুখােমুখি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলে। এ ছাড়া জাফলং রাধানগর, সারি, গােয়াইনঘাটসহ বিস্তৃত এলাকায় মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর অসংখ্য অ্যামবুশ, রেইড ও গেরিলা পদ্ধতির অপারেশন পরিচালনা করেন। ৫ নভেম্বরে শত্রুর এলাকা থেকে ‘জেড’ ফোর্সের ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা, ডেলটা, ইকো ও ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর কোম্পানিগুলােকে তামাবিল চেকপােস্টে এনে একত্র করা হয়। অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল নিজেই এতে নেতৃত্ব দেন। এ সাব-সেক্টরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপস্থিতির ফলে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা দেয়। গণবাহিনীর কোম্পানিগুলােও এ সময় আক্রমণাত্মক ভূমিকায় নেমে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ৫ ডিসেম্বর গােয়াইনঘাট দখল করে। গােয়াইনঘাটের পতনের পর মুক্তিবাহিনী সালুটিকর ফেরিঘাট ও বিমানবন্দর দখলের পরিকল্পনা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সালুটিকরের গুরুত্ব
সিলেট-কোম্পানিগঞ্জ-ভােলাগঞ্জ সড়কপথে সালুটিকর বিমানঘাটি এবং সালুটিকর ফেরিঘাট এলাকাটি সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফেরিঘাট সংলগ্ন রানীগঞ্জ বাজার এলাকাটিকে সিলেটের একটি উপশহর বলা চলে। সুরমা নদীতে এ ফেরিঘাটটি হয়েই কোম্পানিগঞ্জ যেতে হয়। এ ফেরিঘাটে বর্ষাকালে সুদূর জাফলং থেকে বড়াে বার্জ আসা-যাওয়া করে। জাফলং, শ্রীপুর ও বিষ্ণুকান্দি এলাকা থেকে বােল্ডার, সিঙ্গেল, পিগ্রাভেল ও মােটা বালু সংগ্রহ করে তা সুদূর ঢাকা পর্যন্ত পরিবহন করা হয়। ভৌগােলিক অবস্থানের কারণেই সালুটিকর ফেরিঘাট ও বিমানবন্দর এলাকাটি পাকিস্তানিদের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সালুটিকর বিমানঘাঁটিটি (বর্তমানে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) ছিল দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একমাত্র বেসামরিক বিমানবন্দর ভৌগােলিক ও সামরিক অবস্থানের কারণে সালুটিকর ফেরিঘাট ও সালুটিকর বিমানঘাঁটি আক্রমণ করা আর খােদ সিলেট আক্রমণ করার মধ্যে গুণগত তেমন কোনাে পার্থক্য ছিল না। অবস্থান ও প্রতিরােধ ব্যবস্থা ১. পাকিস্তান সেনাবাহিনী: সিলেট-কোম্পানিগঞ্জ-ভােলাগঞ্জ সড়কপথে সালুটিকর বিমানঘাটি এবং সালুটিকর ফেরিঘাট অক্ষে পাকিস্তানিরা অবস্থান গ্রহণ করে। পর্যায়ক্রমে তারা চাইতাবাড়ি, জাল্লর পাড় ও বেতুরকুলেও প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে (৭ এপ্রিল) মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মিলিত বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে সিলেট শহর দখল করে। শত্রুরা এ আক্রমণ প্রতিহত করতে পেরে সালুটিকর বিমানবন্দর এলাকায় থেকে নিজেদের পুনরায় সংগঠিত করে।
বিমানে করে ঢাকা থেকে এদের জন্য রিইনফোর্সমেন্ট পাঠানাে হয়। বিমানবন্দরের দক্ষিণে রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি ও কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। পাকিস্তানি বাহিনী মডেল স্কুল ও বিমানবন্দরের প্রতিরক্ষার জন্য গােয়াইন নদীর দক্ষিণ তীর পর্যন্ত বিস্তৃত বিভিন্ন টিলায় অবস্থান নিয়েছিল। তাদের এ অঞ্চলে প্রতিরক্ষা ছিল বেশ শক্তিশালী। যেহেতু বিমানবন্দরের পতনই শহরের পতন, তাই তারা এ অবস্থান না হারানাের জন্য মরিয়া হয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিল। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী: ৫ নভেম্বর ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তামাবিল এলাকায় এলে ডাউকি-মুক্তারপুর সাব-সেক্টরে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে প্রাণসঞ্চার ঘটে। স্থানীয় গণবাহিনী কোম্পানিগুলাে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ছােটখেল যুদ্ধে মেজর শাফায়াত জামিল আহত হলে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ডেলটা কোম্পানির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী এ অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর অপারেশনাল অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। গােয়াইনঘাট পতনের পর ঐ (৫ ডিসেম্বর) এলাকা থেকে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪টি কোম্পানি ও গণবাহিনীর কোম্পানিগুলাে সালুটিকরের দিকে অগ্রাভিযান শুরু করে। ভারতীয় বাহিনীর ২টি ইউনিট তথা ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট ও ২৫ আসাম রেজিমেন্ট। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় অপারেশন করলেও ৫ ডিসেম্বর ইউনিট ২টিকে ছাতকের দিকে পাঠানাে হয়। যুদ্ধ পরিকল্পনা। ৫ ডিসেম্বর সকালে আজির উদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়িতে সব স্তরের। অধিনায়করা একত্র হন। সেখানে লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী সালুটিকর অপারেশন।
পরিকল্পনার বিভিন্ন বিষয় অধিনায়কদের ব্রিফ করেন। তিনি অধিনায়কদের উদ্দেশ্যে একটি প্রেরণামূলক বক্তৃতা দেন। এ সময় ভারতীয় বাহিনীর মেজর সিং ওয়াই পি উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পনা সালুটিকর ফেরিঘাট ও বিমানঘাটি এলাকার অভিযানটি নিম্নলিখিত পর্যায়ে ভাগ করা হয়: ১. প্রথম পর্যায়: এ পর্যায়ে আক্রমণকারী দলগুলােকে চাইতাবাড়ি, জলুরপাড় ও বেতুরকুল এলাকায় সমবেত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২. দ্বিতীয় পর্যায়: এ পর্যায়ে আক্রমণকারী দলগুলাে নিয়ে সালুটিকর ফেরিঘাট, কচুয়ার পার দরিকান্দি ও চৌধুরীকান্দি এলাকাগুলাে দখল করে নিয়ে সেখানে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তৃতীয় পর্যায়: এ পর্যায়ে সুরমা নদী অতিক্রম করে নয়াটিলা এলাকায় বিশেষ বিশেষ টিলা দখল করে তথায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সাথে উত্তর পাড়ের অবস্থানগুলাের শক্তি বৃদ্ধিরও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া শক্রর প্রতিহামলা প্রতিহত করার সর্বাধিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৪. চতুর্থ পর্যায়: এ পর্যায়ে সুরমা নদীর উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ের অবস্থানগুলাের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার রদবদল এনে শত্রুর যে-কোনাে প্রতিহামলা প্রতিহত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
৫. পঞ্চম পর্যায়: এ পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানগুলােকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শত্রুর হামলা প্রতিহত করার সব ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি শত্রুর অবস্থানগুলাের ওপর অনবরত হামলা চালিয়ে তাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধনেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যুদ্ধের প্রস্তুতি। সালুটিকর অপারেশনের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। এটি শক্রর খুবই শক্তিশালী ঘাটি বিবেচনায় খুব সতর্কতার সাথে অভিযান পরিচালিত হয়। পরিকল্পনা চূড়ান্তকরণ ৫ ডিসেম্বর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। অভিযানে কিছু ভারতীয় অফিসার থাকলেও প্রত্যক্ষভাবে তাঁদের কোনাে অংশগ্রহণ ছাড়াই অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রস্তুতি ছােটখেল, রাধানগর ও গােয়াইনঘাট দখল করার পর যুদ্ধ জয়ের এক দুর্লভ দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছিল। এ সাফল্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে চূড়ান্ত পর্যায়ে পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল যে, শত্রু সম্পূর্ণরূপে পরাভূত না হওয়া পর্যন্ত একের পর এক আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে। বিভিন্ন ফ্রন্টে থাকা সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী সম্মুখযুদ্ধের মাধ্যমে আঘাত হেনে পরবর্তী অবস্থানগুলাে দখলের জন্য প্রতিরােধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তারা দুর্বল মনােবলসম্পন্ন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক আক্রমণ পরিচালনার মাধ্যমেও শক্ত প্রতিরােধ বা আক্রমণ প্রস্তুতি গড়ে তােলে।
যুদ্ধের বিবরণ ৫ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর অগ্রগামী দল গােয়াইনঘাট থেকে সালুটিকরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সন্ধ্যায় নদীর পাড় ধরে গাইডদের সহায়তায় আলফা, ইকো, ডেলটা এবং সর্বশেষে লেফটেন্যান্ট মতিউরের কোম্পানি রওনা হয়। ব্যাটালিয়নের রিয়ার রাখা হয় গােয়াইনঘাট। ৫ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী চাইতাবাড়ি পৌঁছেন ও স্থানীয় গণবাহিনীর কোম্পানি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট রউফের সাথে যােগাযােগ হয়। ৬ ডিসেম্বর ভোের হওয়ার পূর্বে ৩টি কোম্পানি চাইতাবাড়ি, জলুরপাড় ও বেতুরকুল গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করে। প্রতিটি কোম্পানি থেকে ৩টি দল ৬ ডিসেম্বর দুপুরের মধ্যে সালুটিকর ঘাট ও নদীর দক্ষিণ তীর রেকি সম্পন্ন করে। ৬ ডিসেম্বর রাত ৮টায় লেফটেন্যান্ট মঞ্জুরের আলফা কোম্পানি সালুটিকর ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাত ৯টায় লেফটেন্যান্ট নবী নদীর উত্তর পাড়ে অবস্থিত বনবিভাগের রেস্ট হাউজে অপারেশনাল সদর দপ্তর স্থাপন করেন। ৭। ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় পাকিস্তানি বাহিনীর আনুমানিক ৩০-৩৫জনের ১টি নিয়মিত প্যাট্রল পার্টি ফেরি পার হয়ে নদীর তীর ঘেঁষে আলফা কোম্পানির দিকে আসে। মুক্তিবাহিনী এদের ওপর গুলি চালালে ওরা পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর রাত ৮টায় সুবেদার বদির নেতৃত্বে ১টি প্লাটুন সুরমা নদী অতিক্রম করে নদীর দক্ষিণ তীরে ৩টি টিলায় অবস্থান গ্রহণ করে। রাতের মধ্যেই মুক্তিবাহিনী বাংকার তৈরি করে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল অগ্রবর্তী শত্রু অবস্থানের আনুমানিক ৪০০-৫০০ গজের মধ্যে। মধ্যখানে একটি মাঠ ছিল। ৮ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় পাকিস্তানিরা নদীর তীর ঘেঁষে গড়া তাদের প্রতিরক্ষার প্রথম লাইনে অবস্থান নিতে এলে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়।
মুহূর্তে এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুপুর ১২টায়। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের সব অবস্থানে আর্টিলারি শেলিং করে। দুপুর ১টায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ১৫০-১৬০জন সৈন্য নদীর দক্ষিণে ৩টি টিলার ওপর আক্রমণ করে, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। এর ১ ঘণ্টা পর আবার ঐ দিনই শত্রুরা আরও ৪টি প্রতি-হামলা পরিচালনা করে। শত্রুদের মারাত্মক ও ব্যাপক প্রতি-আক্রমণের মুখে লেফটেন্যান্ট নবী ৮ ডিসেম্বর রাতে প্রতিরক্ষার কিছুটা পুনর্বিন্যাস করেন। শত্রুও সারারাত ধরে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। | ৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী কেনরিপাড় এলাকা হয়ে জলুরপাড় এলাকায় অবস্থিত রিয়ার সদর দপ্তরের হামলা চালায় এবং নদী অতিক্রমের জন্য উদ্যত হয়। শুরু হয় প্রচণ্ড শেলিং, তবুও মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড মােকাবিলায় নদী পার হতে ব্যর্থ হয়। ৯ ডিসেম্বর শত্রুর বারবার আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে এবং অবস্থানের পুনর্বিন্যাস করে। ঐ দিন টিলাগুলাে দখলের জন্য শত্রু ১০বার প্রতি-হামলার চেষ্টা চালায়। ১০ ডিসেম্বর শত্রু ১০টি অবস্থানে একযােগে আক্রমণ করে এবং নদী অতিক্রম করে উত্তর পারে অবস্থান নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ১১ ডিসেম্বর ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আনােয়ার সালুটিকরে নিজ আলফা কোম্পানিতে যােগদান করেন। ঐ দিন বিকালে শত্রুরা মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর পিছন দিক দিয়ে আত্মঘাতী আক্রমণ চালায়। ১২ ডিসেম্বর শত্রুরা আবার প্রতিরক্ষার পিছন দিক আক্রমণ চালায়।
প্রথমে কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিলেও মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তারা বিতাড়িত হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৩ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবীকে ছাতক অপারেশনে পাঠানাে হয় এবং ক্যাপ্টেন আনােয়ার আক্রমণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী। শত চেষ্টা করেও মুক্তিবাহিনীর অবস্থানকে টলাতে পারেনি। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর সিলেটে তিন হয় এবং ১৭ ডিসেম্বর সালুটিকরের পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধের ফলাফল। সালুটিকর অপারেশনটির সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব ছিল। অপরিসীম। এ অপারেশনটি পরিচালনার ফলাফল ছিল নানাবিধ। নীচে সেগুলাের কয়েকটি উল্লেখ করা হলাে: ১, এ অপারেশনটি পরিচালনার ফলে শত্রুর পরিকল্পিত সর্বশেষ আত্মরক্ষামূলক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বিরাট ফাটল ধরে। ২. অপারেশনটি পরিচালনা করে শত্রুর সর্বশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অভ্যন্তরে প্রবেশের ফলে শত্রু নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে যায়। শত্রুর মনােবল ভেঙে পড়ে। অপারেশনটি পরিচালনা করে শত্রুর পরিকল্পিত শেষ প্রতিরক্ষা বলয়ের মধ্যে ঢুকে পড়লে তাদের দূরের অবস্থানগুলাের পতনও অনিবার্য হয়ে। ওঠে। সালুটিকর অপারেশনের সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযােদ্ধা কোম্পানিগুলাে নিজ নিজ ইউনিটের বা সাব-ইউনিটের কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য শত্রু নিধনে ঝাপিয়ে পড়ে। অপারেশনটি দেশি ও বিদেশি প্রচারমাধ্যমগুলাে ব্যাপক কভারেজ পায়, যা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে আরও বেগবান করার কাজে উল্লেখযােগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
উপসংহার
ছােটখেল, রাধানগর ও গােয়াইনঘাট অপারেশনের ন্যায় সালুটিকর অপারেশনেও মুক্তিবাহিনী মিত্রবাহিনীর কোনাে সাহায্য নেয়নি। নিজস্ব অভিজ্ঞতা, রণকৌশল, লােকবল, অস্ত্রবল ও সমরশক্তি খাটিয়ে সেদিন তারা। সালুটিকর এলাকা দখল করে। কর্নেল রাজ সিং মুক্তিবাহিনীর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে বাংলাদেশ সেনাসদরকে লিখেছিলেন, “সালুটিকর ঘাট এলাকায় পাকিস্তানি দুর্ধর্ষ আক্রমণকে যেভাবে প্রতিহত করেছে ও প্রতিহামলা চালিয়ে নিজেদের অবস্থানগুলােকে পুনরায় সংগঠিত করেছে, তা বিস্তারিত বলতে গেলে একটি ইতিহাস সৃষ্টি হবে।” এ যুদ্ধ মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস ও আত্মত্যাগের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
(সালুটিকরের যুদ্ধের নকশাটি ৮৫৪ পাতায় দেখুন)

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড