You dont have javascript enabled! Please enable it! আটগ্রামের যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
আটগ্রামের যুদ্ধ
ভূমিকা
আটগ্রামের যুদ্ধ সিলেট রণাঙ্গনের অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ। এখানে মুক্তিবাহিনী (নিয়মিত ও অনিয়মিত) ও মিত্রবাহিনী একযােগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এলাকা মুক্ত করে। বস্তুত আটগ্রামের যুদ্ধই সিলেট সেক্টরে প্রথম সর্বাত্মক যুদ্ধ। ২২ নভেম্বর আটগ্রাম মুক্ত হলে সিলেট শহর অগ্রাভিযান। বেগবান হয় এবং অভিযানে নতুন মাত্রা সংযােজিত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান আটগ্রাম সিলেট জেলার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত জকিগঞ্জ থানার একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম। সিলেটের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে একটি অংশ (জকিগঞ্জের কিছু উত্তরে) ভারতের এলাকায় প্রবেশ করেছে। এ পেনিনসুলা সদৃশ এলাকার উত্তরে আটগ্রাম অবস্থিত। আটগ্রাম ৪ নম্বর সেক্টরের জালালপুর সাব-সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভৌগােলিকভাবে জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। আটগ্রাম সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। আটগ্রাম জকিগঞ্জ থানা সদর থেকে ১৫ কিলােমিটার উত্তরে ও কানাইঘাট থেকে ১৪ কিলােমিটার পূর্বে অবস্থিত। দর্পণগর গ্রাম আটগ্রাম থেকে ৪ কিলােমিটার পশ্চিমে এবং গােটাগ্রাম ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। সুরমা নদীর উত্তরে অবস্থিত ছিল সালামটিলা ও রাজাটিলা গ্রাম । যুদ্ধের পটভূমি ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর পরিকল্পনা অনুসারে ৫৯ মাউন্টেন ব্রিগেড, ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড ও ইকো সেক্টরকে সিলেট শহর দখলের নির্দেশ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ বাহিনীর ‘জেড’ ফোর্সের ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সিলেট দখল অভিযানে অংশগ্রহণ করে। 
এদিকে নভেম্বর মাসে সিলেটে পাকিস্তানিদের সৈন্যসংখ্যা প্রায় ব্রিগেডে উন্নীত হয়। ব্রিগেডিয়ার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ২০২ পদাতিক ব্রিগেডের অবস্থান ছিল সিলেটে। সীমান্ত থেকে সিলেট অভিমুখী পথে তাদের শক্তিশালী অগ্রবর্তী পােস্ট ও ডিলেইং পজিশন ছিল। আটগ্রাম ছিল তেমনি পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটি। যুদ্ধের প্রথম দিকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত মূলত ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধারা (সেক্টর ট্রপস) আটগ্রাম ও জকিগঞ্জ এলাকায় অপারেশন করছিলেন। অক্টোবর মাস থেকে এ অঞ্চলে ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশেরনিয়মিত বাহিনীর (জেড ফোর্সের ১ম ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) উপস্থিতি ও সংশ্লিষ্টতা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আটগ্রামের দখল নিয়ে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সৈন্য সংখ্যা ও অস্ত্র বৃদ্ধির সাথে সাথে স্থানীয় জনগণের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনও বাড়তে থাকে। জালালপুর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক মাহবুবুর রব সাদি ২৯ জুন রাতে আটগ্রামের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। সেপ্টেম্বর মাসে মাহবুবুর রব সাদি পুনরায় দুটি আক্রমণ পরিকল্পনা করেন। প্রথমটি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পরিচালিত হয় মূল ঘাটিতে। ২২ সেপ্টেম্বর আটগ্রাম ডাকবাংলােয় আক্রমণ পরিচালিত হয়। | সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম অবস্থান থেকে পাকিস্তানিরা চরদের মাধ্যমে ভারতীয় রেললাইনে মাইন পুঁতে রাখতাে। ফলে ভারতীয় রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত এবং রেলগাড়ি হতাহতের সংবাদ আসে।
যে-সব এলাকায় এ জাতীয় ঘটনা ঘটে সেগুলাে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ৪ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত আটগ্রাম দখলের পরিকল্পনা করেন। বাংলাদেশ ও ভারত যৌথবাহিনীর সিদ্ধান্তে ৪ নম্বর সেক্টর ট্রপস যৌথবাহিনীর আটগ্রাম-চারখাই-সিলেট অক্ষে এবং আটগ্রাম-কানাইঘাট-দরবস্তসিলেট অগ্রাভিযানের সুবিধার্থে আটগ্রাম আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মেজর দত্ত আটগ্রাম দখলের উদ্দেশ্যে একটি বিস্তারিত অবরােধ অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আটগ্রামের গুরুত্ব জকিগঞ্জের মতাে সীমান্তবর্তী আটগ্রাম ছিল সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম অবস্থান থেকে পাকিস্তানিরা চরদের মাধ্যমে ভারতীয় রেললাইনে মাইন পুঁতে রাখতাে। ফলে ভারতীয় ট্রেন ক্ষতিগ্রস্ত এবং রেলযাত্রী হতাহতের সংবাদ পাওয়া যায়। এটি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দূরবর্তী শক্তিশালী ঘাঁটি। যােগাযােগ ব্যবস্থা, সীমান্তবর্তী এলাকা ইত্যাদি বিবেচনা করে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ নিয়মিত কোম্পানিসহ প্রায় ২০০ জনবল মােতায়েন করে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ‘জেড’ ফোর্স ও ৪ নম্বর সেক্টর ট্রপস সিলেটের দিকে অগ্রাভিযান পরিকল্পনা করে। ভারতীয় সীমান্ত পেরুলেই আটগ্রামের শক্তিশালী শত্রুর ঘাঁটি। তাই সিলেটমুখী অগ্রাভিযানে মুক্তিবাহিনীর আটগ্রাম দখল ছিল অবশ্যকরণীয় অপারেশন। পাকিস্তানিরাও সীমান্তবর্তী এই শক্তিশালী ঘাঁটি রক্ষা করতে অটল ছিল।
যুদ্ধের সংগঠন ১. মুক্তিবাহিনী: আটগ্রাম এলাকাটি ছিল ৪ নম্বর সেক্টরের জালালপুর। সাব-সেক্টরের অন্তর্গত। চূড়ান্ত যুদ্ধে ৪ নম্বর সেক্টরের লেফটেন্যান্ট জহির ও ক্যাপ্টেন রব এ অঞ্চলে যুদ্ধ করেন। অক্টোবর মাসের গােড়ার দিকে এ সেক্টরে ‘জেড’ ফোর্সের ১ম এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যােগ দেয়। “জেড ফোর্সের ২টি রেজিমেন্ট এ সেক্টরে আসায় সেক্টরের শক্তি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ১ম এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাপক তৎপরতা পাকিস্তানিদেরকে ভীষণভাবে পর্যুদস্ত করে ছাড়ে। তবে যুদ্ধের প্রথমদিকে এ অঞ্চলে সাব-সেক্টর অধিনায়ক হিসেবে তরুণ ছাত্রনেতা মাহবুবুর রব সাদি সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী: আটগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়মিত ইউনিট ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের প্রায় ১ কোম্পানি সৈন্য ছিল। এ ছাড়া ঐ স্থানের স্থানীয় রাজাকার ও খাইবার স্কাউটের ১ কোম্পানি। সৈন্য ছিল। নভেম্বর মাসে ঐ স্থানের শক্তি বৃদ্ধি করা হয় এবং শত্রুর আর্টিলারি ব্যাটারি সমর্থনে আনা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী গােটা গ্রামে একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অবস্থান  ১. পাকিস্তান সেনাবাহিনী: আটগ্রাম ছিল পাকিস্তানের ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের (খাদিমনগরে ব্যাটালিয়ন সদর) নিয়ন্ত্রিত একটি সীমান্ত বর্তী ঘাটি। এখানে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের প্রায় ১টি কোম্পানি ছাড়া প্রায় শতাধিক সৈন্য ছিল খাইবার স্কাউট ও স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখানে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে।
জকিগঞ্জ-সিলেট লাইনের বাসস্ট্যান্ডে তারা ঘাঁটি গড়ে। অন্য একটি ঘাঁটি গড়ে তােলে নদীর তীরবর্তী আটগ্রাম ডাকবাংলােয়। যুদ্ধের শেষের দিকে সৈন্য সমাবেশ বৃদ্ধি করা হয় এবং একটি মসজিদকে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এলাকায় চতুর্মুখী অবস্থান গ্রহণ করে। দক্ষিণ দিকে গােটা গ্রামে একটি রাজাকার ক্যাম্প গড়ে তােলে। আটগ্রামে তাদের অবস্থানটি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। আটগ্রামের সাথে জকিগঞ্জের যাতায়াতের সুবিধার জন্য তারা উত্তর-দক্ষিণে এক লিংক রােড তৈরি করে। অক্টোবরের শেষদিকে তারা ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। এ স্থানে ১০ নভেম্বর ১০৫ মিলিমিটার হাউইটজার গান মােতায়েন করা হয়। ২. মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী: আটগ্রাম ৪ নম্বর সেক্টরের জালালপুর সাব সেক্টরের অন্তর্গত ছিল। প্রথম দিকে সাব-সেক্টর অধিনায়ক মাহবুবুর রব সাদি এ অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। সেক্টর অধিনায়ক কর্তৃক আটগ্রাম দখলের পরিকল্পনার পর সেক্টরের সংগঠনের কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। আটগ্রাম অপারেশনের জন্য কুকিতল ও আমলসিদ সাব-সেক্টর, ধর্মনগর, মহিশাসন এলাকা থেকে সেক্টর ট্রপস জালালপুর সাব-সেক্টরে একত্র করা হয়। এ অপারেশনের অধিনায়ক নির্বাচন করা হয় ক্যাপ্টেন আব্দুর রবকে। এ সময় (নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ) লেফটেন্যান্ট জহির তার কোম্পানি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধ পরিকল্পনা ১. পাকিস্তান সেনাবাহিনী: নভেম্বরের প্রথম দিকে আটগ্রাম একটি শক্তিশালী পাকিস্তানি ঘাঁটিতে পরিণত হয়। পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্য ছিল সীমান্তবর্তী এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করা এবং আটগ্রামচরখাই-সিলেট এবং আটগ্রাম-কানাইঘাট-দরবস্ত-সিলেট এলাকার মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযানে বাধা দেওয়া।
আটগ্রামে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি এবং রাজাকার ও খাইবার স্কাউটের ১টি কোম্পানি ছিল। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আটগ্রামকে সহায়তার জন্য আর্টিলারির ১টি ব্যাটারি আনা হয়। পাকিস্তানিদের লক্ষ্য ছিল সর্বশক্তি দিয়ে আটগ্রামের অবস্থান দখল করে রাখা এবং এরপর কানাইঘাটে প্রত্যাহার করা। এ লক্ষ্যে পাকিস্তানি বাহিনী আটগ্রাম ও জকিগঞ্জের মধ্যে একটি লিংক রােড স্থাপন করে। এর ফলে আটগ্রাম ও জকিগঞ্জে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান আরও শক্তিশালী হয় । ২. মুক্তিবাহিনী: ক. ৪ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত আটগ্রাম।
অবরােধ অপারেশনের বিস্তারিত এবং ব্যাপক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ৪ নম্বর সেক্টরের অন্যান্য সাব-সেক্টর থেকে অধিকাংশ সৈন্য জালালপুর সাব-সেক্টরে একত্র করা হয় এবং ক্যাপ্টেন রবকে অপারেশনাল অধিনায়ক নিয়ােগ করা হয়। খ, লেফটেন্যান্ট জহিরের নেতৃত্বে ২ কোম্পানি সৈন্যকে নদী অতিক্রম করে দর্পনগরে অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ২টি কোম্পানির কাজ হবে সিলেট-আটগ্রাম সড়কে অবস্থান নিয়ে (আটগ্রামে ৪ কিলােমিটার পশ্চিমে) শত্রুর রি-ইনফোর্সমেন্ট ও পশ্চাদপসরণ বন্ধ করার জন্য ব্লকিং পজিশন স্থাপন।
গ. লেফটেন্যান্ট গিয়াসের নেতৃত্বে ১টি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আটগ্রাম-জকিগঞ্জ পাকা রাস্তা শত্রুমুক্ত ও কামালপুরে
অবস্থান গ্রহণ করা। ঘ, ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে ২টি কোম্পানিকে মেঠোপথে গিয়ে গােটাগ্রামে অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া হয় (আটগ্রামের ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে)। ক্যাপ্টেন রবের আরেকটি দায়িত্ব ছিল জকিগঞ্জ ও আটগ্রামের মধ্যে স্থাপিত সংক্ষিপ্ত কাঁচা রাস্তা বন্ধ করা। এভাবে উত্তর দিক ছাড়া (উত্তর দিকে সুরমা নদী প্রবাহিত) সব দিক থেকেই মুক্তিবাহিনী শত্রুকে অবরােধ করার পরিকল্পনা করে।  ঙ. ৯-১০ নভেম্বর রাতে অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যুদ্ধের বিবরণ। ৯ নভেম্বর আটগ্রাম অবরােধ অভিযান শুরু হয়। ৯ নভেম্বর সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। পশ্চিম দিগন্তে লাল আভা ছড়িয়ে ক্রমশ সূর্যটা ডুবে গেল। ঘনিয়ে এল রাতের অন্ধকার। সুরমা নদীর তীরে অপেক্ষমাণ লেফটেন্যান্ট জহিরের নেতৃত্বে ২ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা রাতের অন্ধকারে নদী অতিক্রম করে আটগ্রাম অভিমুখে যাত্রা শুরু করলাে। নিঃশব্দে মুক্তিযােদ্ধারা চারগ্রাম ও দর্পণনগর গ্রামের সন্নিকটে সুরমা নদী অতিক্রম করে পাকিস্তানি সৈন্যদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি পাশে রেখে এবং মূল ঘাটির সামনে রাস্তার দুই পাশে অবস্থান নিয়ে চরম আঘাত হানার জন্য ওত পেতে রইলেন।  অপরদিকে লেফটেন্যান্ট গিয়াস ১ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধাসহ শত্রু অধিকৃত  আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়ক মুক্ত করার জন্য অগ্রসর হন। লেফটেন্যান্ট গিয়াস কামালপুরে অবস্থান গ্রহণকালে (রাত ১১টা) শত্রুর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। তবে আধ ঘণ্টার মধ্যে কামালপুর শত্রুমুক্ত হয়। ক্যাপ্টেন রব ১ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ১০ নভেম্বর ভােরে গােটাগ্রামে অবস্থান নিলেন। এখানে রাজাকারের। একটি ক্যাম্প ছিল। প্রায় ১০-১২জন রাজাকার তখন ঘুমাচ্ছিল।
ক্যাপ্টেন রবের অতর্কিত হামলার মুখে এরা সবাই আত্মসমর্পণ করে। ১জন রাজাকার কোনােমতে পালিয়ে গিয়ে আটগ্রামে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের খবর। দিতে সক্ষম হয়। ক্যাপ্টেন রবের নির্দেশে রাস্তার দুই পাশে দ্রুত বাংকার খুঁড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সংবাদ পেয়ে শত্রুর ১টি প্লাটুন গােটাগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এদিকে শত্রুরা কামালপুর ও দর্পণনগরে (মুক্তিবাহিনী প্রতিবন্ধক অবস্থান) সৈন্য পাঠায়। ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় আটগ্রামের পাকিস্তান সেনাবাহিনী সিলেট থেকে কিছু  রি-ইনফোর্সমেন্ট পায়। তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে ১টি আর্টিলারি ব্যাটারি(১০৫ মিলিমিটার হাউইটজার)। ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় শক্র বাহিনী গােটা গ্রামের (বিকাল ৫টা) দিকে অগ্রসর হয়। শত্রু বাহিনী মুক্তিবাহিনীর রেঞ্জের ভেতর এলে মুক্তিবাহিনী ফায়ার শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর্টিলারির সহযােগিতায় ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে। শত্রুর আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী। নিজ অবস্থান থেকে শত্রুর মােকাবিলা করতে থাকে। রাত ৮টার দিকে ক্যাপ্টেন রবের কোম্পানির গােলাবারুদ ফুরিয়ে আসে। গোলাবারুদের সরবরাহ সম্ভব ছিল না। এ পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন রব গােটাগ্রাম অবস্থান থেকে পশ্চাদপসরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এভাবেই লজিস্টিক সাপাের্টের অভাবে আটগ্রাম অবরােধ ব্যর্থ হয়।
প্রথম পর্যায়ে অবরােধ ব্যর্থ হলে মুক্তিবাহিনী প্রথাগত আক্রমণের মাধ্যমে  আটগ্রামে দখলের সিদ্ধান্ত নেন। ২১ নভেম্বর রাতে যৌথবাহিনী দখলের সিদ্ধান্ত  গ্রহণ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, আটগ্রাম অবরােধ অভিযানের পর আটগ্রাম। দখলের দায়িত্ব ভারতীয় বাহিনী ও ‘জেড’ ফোর্সকে দেওয়া হয়। চূড়ান্ত আক্রমণের সময় ২০/২১ নভেম্বর নির্ধারণ করা হয়। এর পূর্বের দিন। ঈদ থাকায় পাকিস্তানিরা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। আটগ্রাম আক্রমণের জন্য ভারতীয় বাহিনীর ৪/৫ গুর্খা ও ‘জেড’ ফোর্সের ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মধ্যরাতে সর্বাধিক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ভারতীয় বাহিনী আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে। মিত্রবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানি রবার ডিঙি দিয়ে আক্রমণকারী সৈন্যদের পারাপার করে  আর্টিলারির সাহায্য নিয়ে শেষ রাতে ৪/৫ গুখা ব্যাটালিয়ন আটগ্রাম এলাকায় শক্তিশালী পাকিস্তানি ঘাটির ওপর আক্রমণ চালায় এবং কয়েক ঘণ্টা প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে আটগ্রাম দখল করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর অধিনায়ক ১জন মেজরসহ অনেকে হতাহত হয়। গুর্খা  ব্যাটালিয়নের মেজর বিক্রম, ৬জন সেকেন্ড লেফটেন্যান্টসহ বেশ কয়েকজন  নিহত হয়। এদিকে ভারতীয় বাহিনীর গার্ড ব্যাটালিয়ন ট্যাংক ও আর্টিলারির সহযােগিতায় ২০-২১ নভেম্বর মধ্যরাতে আক্রমণ করে এবং ২১ নভেম্বর দুপুর ১টায় জকিগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। ক্যাপ্টেন রব ও লেফটেন্যান্ট জহিরকে তাদের কোম্পানি নিয়ে সুরমা নদীর ওপর পাড়ে সালাম টিলা ও রাজা টিলা আক্রমণের নির্দেশ দেওয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর এ আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং সালামটিলা ও রাজাটিলা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।  ২১ নভেম্বর বিকালে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রাভাে কোম্পানি আটগ্রামের কাছে চারগ্রাম ইন্সপেকশন বাংলাে আক্রমণ করে। ২২ নভেম্বর ভােরে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানিটি চারগ্রাম ডাকবাংলাে দখল করে। ঐ ক্যাম্পে পাকিস্তানিদের প্যারা মিলিটারি বাহিনী থল স্টাউটের ২০জন সৈনিক মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। আহত হন ৫জন মুক্তিযােদ্ধা। এখানে উল্লেখ্য যে, চারগ্রাম বাংলাে দখল করার দায়িত্ব ৪/৫ গুর্খা ব্যাটালিয়নের ছিল কিন্তু আটগ্রামে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ওয়ার্টকে ‘জেড’ ফোর্স অধিনায়ককে চারগ্রাম দখলের অনুরােধ করেন। যুদ্ধের ফলাফল এ যুদ্ধে আটগ্রামে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়। যুদ্ধের ফলে সীমান্তবর্তী দুটি ঘাঁটি জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম মুক্ত হয়। আটগ্রাম পতনের পর সুরমা নদীর পশ্চিম দিকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সুসংহত হয় এবং সিলেটের দিকে অগ্রাভিযান সহজতর হয়। যুদ্ধের সার্বিক মূল্যায়ন ১. পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যর্থতার কারণ: ক. ইন্টেলিজেন্সের অভাব: শত্রুদের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে তাদের ইন্টেলিজেন্সের অভাব। যুদ্ধ শুরুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তথ্য জানতাে । দুর্বল লজিস্টিক সাপাের্ট: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্বল লজিস্টিক সরবরাহ ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। মুক্তিবাহিনী আটগ্রাম অবরােধ করলে শত্রুপক্ষ দুর্বল হয়ে পড়ে। স্থানীয় জনসমর্থনের অভাব: হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালানাের ফলে স্থানীয় জনগণ পাকিস্তানি বাহিনীকে কোনােপ্রকার সহায়তা করেনি।
যুদ্ধ পরিকল্পনায় নমনীয়তার অভাব: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়কের মধ্যে নমনীয়তার অভাব ছিল। সে জন্য তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়। ঙ. পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিচু মনােবল: পরিবার থেকে দূরে থাকা, নিরীহ মানুষকে হত্যা, নির্যাতন চালানাে ইত্যাদি কারণে সৈনিকদের মনােবল নিম্নমুখী ছিল। চ. এ ছাড়া অন্যান্য কারণ ছিল নিম্নরূপ: • আর্টিলারি সমর্থন ব্যবহার সঠিক ছিল না। নিজেদের ওপর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। • মুক্তিবাহিনীর শক্তিকে দুর্বল মনে করা। • নিজেদের মধ্যে ছিল যােগাযােগের অভাব। ২. মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সাফল্যের কারণ: ক. মুক্তিবাহিনীর আটগ্রাম যুদ্ধের অন্যতম দিক ছিল মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নির্ভীক আত্মবিসর্জন। এটা সম্ভব হয়েছিল তাদের উঁচু মনােবলের জন্য। যুদ্ধ পরিকল্পনায় নমনীয়তা ছিল। এর ফলে প্রথম অবরােধ অভিযান প্রত্যাহার হলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন রব নিজেদের মানিয়ে নেন। গ. শত্রু সম্পর্কে বিস্তারিত ইন্টেলিজেন্স যৌথবাহিনীর ছিল। ঘ. মুক্তিবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত রেকি ও দক্ষ মােতায়েন ব্যবস্থা  ঙ. যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর ব্যাপকভাবে আর্টিলারির সমর্থন প্রদান। চ, স্থানীয় জনগণের সমর্থন ছিল অন্যতম প্রধান দিক। তারা শত্রুর বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে এবং অন্যভাবে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করে।
উপসংহার
আটগ্রামের যুদ্ধ সিলেট রণাঙ্গনের একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। এ যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ১০ দিন। যুদ্ধের শেষপর্যায়ে মিত্রবাহিনী ও ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আটগ্রাম মুক্ত করে। আটগ্রাম পতনের সাথে সাথে সীমান্ত থেকে এবং সিলেট শহর থেকে মুক্তিবাহিনীর (৪ নম্বর সেক্টর ট্রপস ও ‘জেড’ ফোর্স) অগ্রাভিযান অব্যাহত থাকে। এ যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ৪ নম্বর সেক্টরের অবরােধ অভিযান ও পরবর্তী সময় চূড়ান্ত আক্রমণে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সাহস ও বীরত্ব বিশেষ স্মরণীয়। এটি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য বিরাট পরাজয়। এ যুদ্ধে সিলেট সেক্টরে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল বৃদ্ধি পায়। (আটগ্রামের যুদ্ধের নকশাটি দেখুন ৮৫২ পাতায়)

সূত্রঃ    মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – দ্বিতীয় খন্ড