You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.16 | বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, ১৯৭২-১৯৭৫ - সংগ্রামের নোটবুক

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, ১৯৭২-১৯৭৫

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের কয়েকদিনের মধ্যেই মুজিবনগর প্রশাসনের সিনিয়র আমলাবৃন্দ (সচিব রুহুল কুদুসের নেতৃত্বে) ঢাকায় এসে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেন। ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকারের সদস্যবৃন্দ ঢাকায় আসেন। ঢাকায় পৌছে তাজউদ্দীন আহমদ তার অবস্থান সুদৃঢ় করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে তিনি খােন্দকার মােশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অপসারিত করে আব্দুস সামাদ আজাদকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন’ (তবে খােন্দকার মােশতাক আইন ও সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে বহাল থাকেন)। এমনি প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু ৮ জানুয়ারি (১৯৭২) পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং লন্ডন ও দিল্লী হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকা পৌঁছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান কারাগারে আটক থাকলেও তিনি মুজিবনগর সরকারের প্রেসিডেন্ট পদে বহাল ছিলেন। সুতরাং ১০ জানুয়ারি (১৯৭২) তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবেই নিজ মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনভার গ্রহণের সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবগরে ঘােষিত স্বাধীনতার সনদ। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম যে কাজটি করেন তাহলাে ১১.০১.৭২ তারিখে অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারির মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন। বঙ্গবন্ধুর আজন্মলালিত স্বপ্ন ছিল একটি সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ।  সেই লক্ষ্যে অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারির পর ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধান বিচারপতির কাছে প্রথমে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এভাবেই ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শাসনামল বা ‘বঙ্গবন্ধুর শাসনামল । ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলে ঐ শাসনামলের অবসান। ঘটে। সুতরাং, বলা যেতে পারে যে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামল মাত্র ৩ বৎসর ৭ মাস ৩ দিন। স্থায়ী ছিল।

বঙ্গবন্ধু সরকারের শাসনভার গ্রহণের সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের চিত্র বঙ্গবন্ধু যখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন সেসময় এই দেশটি নয় | মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তান বাহিনীর জ্বালাও পােড়াও নীতির ফলে হয়ে পড়েছিল এক যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ভূখণ্ড। এর প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামাে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কলকারখানা সবকিছুই তখন ছিল বন্ধ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তি ছিল নামে মাত্র । সারা দেশে ডাক বিভাগ ছিল বন্ধ, তার বিভাগ হয়ে পড়েছিল অচল, অসংখ্য কালভার্টব্রীজ-সেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল বিধ্বস্ত। মাইন পােতার কারণে নৌবন্দরগুলি ছিল অচল। ব্যাংকগুলি ছিল বন্ধ এবং তহবিল শূন্য। বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা রিপাের্টে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নিমরূপ চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে : Bangladesh inherited a poor, undiversified economy, characterised by an under-developed infra-structure, stagnant agriculture, and a rapidly growing population. She had suffered from years of colonial exploitation and missed opportunities with debilitating effects on initiative and enterprise. Superimposed on all these were the effects of the war of liberation, which caused serious damage to physical infrastructure, dislocation in managerial and organisational apparatus and disruption in established external trading partnership. যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের খাতওয়ারি ক্ষয়-ক্ষতির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিমে দেয়া হলাে : (১) কৃষি ক্ষেত্রে।

 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে খাদ্য শস্য উৎপাদন এমনিতেই বিঘ্নিত হয়েছিল, উপরন্তু পাকিস্তান বাহিনী পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে সরকারি গুদামে মওজুদ খাদ্যশস্য, শস্যবীজ, সার, কীটনাশক ঔষধ এবং মাঠের গভীর ও অগভীর নলকূপ ধবংস করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে আয় উপার্জন ব্যাহত হওয়ায় কৃষি উপকরণ সংগ্রহ করে আবাদ করার টাকা-পয়সা কৃষকের হাতে ছিল না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান। বাহিনী ও রাজাকার-দালালরা কয়েক লক্ষ হালের বলদ ও গাভী জবেহ করে গােশত খেয়েছে। ফলে হাল চাষের জন্য গবাদি পশুর সংকট দেখা দেয়। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে কৃষি ঋণ প্রদান, বীজ সংগ্রহ করা, গভীর ও অগভীর নলকূপ মেরামত বা পুর্নখনন করা, কয়েক লক্ষ গরু আমদানি করা ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষি পুনর্বাসন কাজ ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তান আমলে ভূমি উন্নয়ন ও সেচ কার্যক্রমের কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করায় ১৯৭১ সালে ৭৪% আবাদি জমি ছিল এক ফসলি এবং মাত্র ২৬% জমি ছিল দো-ফসলি ও তিন ফসলি। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলসেচের ব্যবস্থাও ছিল সামান্য। (২) খাদ্য সংকট বঙ্গবন্ধু সরকারের শাসনভার গ্রহণের সময় দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৪০ লক্ষ টন। সরকার মাত্র ৪ লাখ টন খাদ্য শস্য মজুদ পান। এমনি সংকটময় পরিস্থিতিতেও সরকারকে প্রায় নব্বই হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি, আটককৃত ৫০-৬০ হাজার রাজাকার ও দালাল এবং প্রায় সােয়া-লক্ষ ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর জন্য খাদ্য সরবরাহের এক। কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় ।

(৩) ধবংসপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি ভবন ও শরণার্থী পুনর্বাসন। পাকিস্তানী বাহিনী সারা বাংলাদেশে প্রায় ৪৩ লক্ষ বসতবাড়ি, ৩ হাজার অফিস ভবন, ১৮ হাজার প্রাইমারি স্কুল, ৬ হাজার হাই স্কুল ও মাদ্রাসা, ৯ শত কলেজ ভবন ও ১৯ হাজার গ্রাম্য হাট-বাজার পুড়িয়ে দেয়। এগুলাে নতুন করে নির্মাণের জন্য প্রয়ােজন ছিল প্রচুর পরিমাণ অর্থের এবং নির্মাণ সামগ্রী যেমন বাঁশ, কাঠ, টিন ইত্যাদি । উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় ১ কোটি শরণার্থী ও দেশের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু হওয়া লক্ষ লক্ষ পরিবারকে পুনর্বাসন করার এক কঠিন দায়িত্ব এসে যায় সরকারের সামনে। (৪) বিপর্যস্ত শিক্ষা কার্যক্রম মুক্তিযুদ্ধের সময় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কার্যত বন্ধ ছিল। সে সময় পুড়িয়ে দেয়া শিক্ষাভবনগুলাে পুননির্মাণ এবং ধবংসপ্রাপ্ত আসবাবপত্র, বেঞ্চ, টেবিল, চেয়ার ইত্যাদি মেরামত বা নতুন করে নির্মাণ করে ক্লাশ শুরু করা নতুন সরকারের জন্য ছিল এক বড়াে দায়িত্ব। তাছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের উপযােগী পাঠ্য বই রচনা ও প্রকাশের এক গুরু দায়িত্বও সরকারকে পালন করতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য শিক্ষক শহীদ হওয়ায় সে পদগুলাে পূরণের প্রয়ােজন হয়। শিক্ষকদের ৯ মাসের বেতন বন্ধ ছিল। তা পরিশােধ করাও ছিল এক গুরু দায়িত্ব। (৫) বিধ্বস্ত যােগাযােগ ব্যবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশে ২৭৪টি ছােট বড় সড়ক সেতু ও ৩০০টি রেল সেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সে সময় ৪৫ মাইল রেল লাইনের সম্পূর্ণ অংশ এবং ১৩০ মাইল রেল লাইনের আংশিক ক্ষতি সাধিত হয়। ১৫০টি বগি ও বেশ কয়েকটি রেল ইঞ্জিন অকেজো হয়। রেল ইঞ্জিন ও বগি মেরামতের কারখানাগুলাে সম্পূর্ণ ধবংস করা হয়। সরকারি পরিবহনের শত শত বাস ও ট্রাক ধবংসপ্রাপ্ত হয়। ধবংসপ্রাপ্ত বেসরকারি বাস ও ট্রাকের সংখ্যা বেহিসেবি। সারা দেশে প্রায় ৩০০০ মালবাহী নৌকা ডুবিয়ে দেয়া হয়। দেশের। শতকরা ৮৫টি জলযান ধ্বংস হয়। মাল পরিবহনের সরকারি কার্গোগুলােও নিমজ্জিত হয়। চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে মাইন পােতার কারণে বন্দর দুটি অকার্যকর হয়েছিল। দেশের বিমান বন্দরসমূহের রানওয়ের ক্ষতি সাধন করা হয়। অভ্যন্তরীণ যোগাযােগের জন্য বেসামরিক যাত্রীবাহী কোন বিমান সরকারের হাতে ছিল না। (৬) বিধ্বংস টেলিযােগাযােগ ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার সাথে বিভিন্ন জেলা শহরসহ বিদেশের টেলি-যােগাযােগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়। আত্মসমর্পণের পূর্বে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনগুলােতে পাহারারত পাকিস্তান বাহিনী ট্রাঙ্কব্যবস্থা বিনষ্ট করে দেয়। তারা টেলিফোন সংস্থার নথিপত্র পুড়িয়ে দেয় । টেলিফোন ব্যবস্থা সচল করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়ােজন ছিল ঢাকা শহরের জন্য কমপক্ষে ৫০০০ টেলিফোন সেট, ৩১টি ট্রাঙ্ক লাইন নতুন করে স্থাপন, এক্সচেঞ্জের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করা, ২০০০ কিমি দীর্ঘ টেলিফোন তার আমদানি করা, কমপক্ষে ১০০০ দক্ষ টেলিফোন কর্মী ইত্যাদি।

(৭) বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সারা দেশে বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনগুলাে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। অনেকস্থানে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন ও বিদ্যুৎ পােলগুলাে বিনষ্ট হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় গােডাউনগুলােতে বিদ্যুৎ খুঁটি ও তার কিছুই মজুদ ছিল না।

(৮) অর্থনৈতিক অবস্থা আত্মসমর্পণের পূর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাংকসমূহে গচ্ছিত কাগজের নােটগুলাে পুড়িয়ে দেয় এবং গচ্ছিত সােনা লুট করে। উপরন্তু ব্যাংকের নথিপত্রও তারা বিনষ্ট করে। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ অংশের ব্যাংকগুলােতে কর্মরত উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ৬০% এবং নিমস্তরের কর্মচারীদের ২০% ছিল অবাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের পর অবাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থলে অনুপস্থিত হলে ব্যাংকগুলােতে দক্ষ জনবলের অভাব দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিল্প-কল-কারখানাগুলাে প্রায় বন্ধ ছিল। ফলে অনেক মিল। অকেজো হয়ে পড়ে। এগুলাে চালু করার মত স্পেয়ারপার্টস ও কাঁচামাল কোন গুদামেই মজুদ ছিল না। উপরন্তু বিভিন্ন মিলে কর্মরত অবাঙালি শ্রমিকেরা আত্মগােপনে বা রিফুজি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়ায় দক্ষ শ্রমিকের অভাব দেখা দেয়। কাঁচামাল আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়ােজন হয়। (৯) বিপর্যস্ত প্রশাসনিক কাঠামাে ও দক্ষ প্রশাসকের অভাব। দেশ পুনর্গঠনের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়ােজন ছিল দক্ষ প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, ব্যাংকার এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যবসায়ীদের। ডাক, তার, রেল, মিল-কল-কারখানা প্রভৃতি সেক্টরে অভিজ্ঞ কর্মীর প্রয়ােজন ছিল। পাকিস্তান আমলে অবাঙালিরা এসব ক্ষেত্র। নিয়ন্ত্রণ করতে বিধায় নতুন রাষ্ট্রে দক্ষ কর্মীর অভাব দেখা দেয়।

(১০) সংবিধান ও আইনের শূন্যতা। নতুন সরকারের হাতে কোন সংবিধান ছিল না। ছিল উপনিবেশিক আইন ব্যবস্থা। স্বল্প সময়ে সংবিধান প্রণয়ন ও যুগােপযােগী আইন প্রণয়নের গুরু দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর সরকারকে পালন করতে হয়।

উপযুক্ত সমস্যাগুলাে মােকাবিলা করা ছাড়াও নতুন সরকারকে তাৎক্ষণিকভাবে আরও যে সকল চ্যালেঞ্জ মােকাবিলা করতে হয় তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল : (ক) মুক্তিযােদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও মুক্তিযােদ্ধাদের পুনর্বাসন করা। শহীদ

ও আহত মুক্তিযােদ্ধা পরিবারবর্গকে আর্থিক সহযােগিতা প্রদান করাও ছিল বঙ্গবন্ধুর সামনে অন্যতম গুরু দায়িত্ব;

মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতাকারী দালালদের আটক করে বিচারের সম্মুখীন করা; (গ) পাকিস্তানে আটক প্রায় ৪ লক্ষ বাঙালিকে ফিরিয়ে আনা; বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় সােয়া লক্ষ ভারতীয় সৈন্যকে ভারতে ফেরত পাঠানাে; স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি লাভ করা; জাতিসংঘসহ সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ অর্জন করা; যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক অনুদান লাভ করা;

(জ) বিরােধী রাজনীতিকে মােকাবিলা করা । সেসময় সর্বহারা পার্টি ও জাসদের সরকার বিরােধী কার্যকলাপ নতুন সরকারের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা | দিয়েছিল। (ঝ) সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ করা; (ঞ) আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে মূল্যবৃদ্ধিজনিত প্রভাব, বাংলাদেশকে ঘিরে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি মােকাবিলা

করা। এসব বঙ্গবন্ধুর সরকারের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। (ট) সর্বোপরি, দেশের জনগণের আকাশচুম্বী আশা-আকাক্ষার বাস্তবায়ন করা, ঐতিহাসিক ১১ দফায় উল্লেখিত দাবিগুলাে—যেমন, ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার সুযােগ, ব্যাংক-বীমা, পাট ব্যবসা ও বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করা, কৃষকদের উপর থেকে খাজনা হ্রাস করা, বকেয়া খাজনা মওকুফ করা, ইত্যাদি বাস্তবায়ন করা। বঙ্গবন্ধুর সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠনের কঠিন চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে মােকাবিলা করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনিক নীতি ও পরিকল্পনার ভিত্তি এবং পূর্ব প্রস্তুতি বলা হয়ে থাকে যে, বঙ্গবন্ধু সুদীর্ঘকাল আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, কিন্তু প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা তার ছিল না। সুতরাং সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের সময় তার। সরকারের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও নীতি কি হওয়া উচিত সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন পূর্ব পরিকল্পনা তার ছিল না। অর্থাৎ তার আজন্মলালিত সােনার বাংলা গঠনের জন্য, কিংবা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন করে দেশবাসীর আকাশচুম্বী আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের। জন্য তিনি কি ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুসরণ করবেন, কিভাবে তিনি কৃষি, শিল্প, শিক্ষা ও অন্যান্য সামাজিক সংস্কার সাধন করবেন সে বিষয়ে তার নিজস্ব কোন। কর্মপরিকল্পনা, কিংবা তাঁর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কোন ম্যানিফেস্টো ছিল বলে অপপ্রচার করা হয়। যেমন বলা হয়ে থাকে যে, বঙ্গবন্ধুর সরকার যে ব্যাপক জাতীয়করণ নীতি অবলম্বন করেন তা তিনি করেছিলেন বামপন্থীদের চাপে কিংবা সােভিয়েট প্রভাবে। আওয়ামী লীগের শ্রেণী চরিত্র ও আওয়ামী লীগ নেতাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুসরণের বিষয়টি মেলে না বলেই অমন ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে । কিন্তু আমরা যদি পাকিস্তান আমলের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে আওয়ামী লীগের উত্থাপিত বিভিন্ন দাবিদাওয়া, ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফা দাবি, সত্তরের নির্বাচনের সময় ঘােষিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার এবং মুজিবনগর সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিশ্লেষণ করি তাহলে এটা সুস্পষ্ট করে বলা যায় যে, রাষ্ট্রপরিচালনার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, আদর্শিক ভিত্তি ও দর্শন বঙ্গবন্ধুর সামনে ছিল। কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। যেমন: (১) ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট যে ঐতিহাসিক ২১ দফা কর্মসূচি ঘােষণা করেছিল তার ১২নং

দাবিতে পাটশিল্প জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল; (২) ৬ দফার অনুসরণে প্রণীত ১১ দফা দাবিতে ব্যাংক, বীমা ও সকল বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করার মত অর্থনৈতিক দাবি অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছিল। তাছাড়া চাষীদের জন্য কর হ্রাস, কিংবা শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য বেতন ও বােনাসের দাবিও ১১ দফাতে ছিল। আওয়ামী লীগ সত্তরের নির্বাচনে ৬ দফা ও ১১ দফার প্রতি

গণরায় লাভ করে; (৩) ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করা হযেছিল

যে, মানুষে মানুষে বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবিচার দূরীভূত করার লক্ষ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে ব্যাংক, বীমা, বৃহৎ শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট ও তুলা বাণিজ্য, শিপিংসহ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নৌপরিবহন ব্যবস্থা এবং অন্যান্য বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণের বিষয়টি পরিকল্পনা প্রণয়নকারী সংস্থাসমূহের মাধ্যমে স্থির করা হবে। এছাড়াও ইশতেহারে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। (৪) প্রবাসী সরকার গঠনের পর দশ এপ্রিল ৯.৩০ মিনিটে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র

শিলিগুড়ি কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ যে ভাষণ দেন তাতে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য নিমরূপভাবে স্থির করেন: বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্য রচিত হােক এই নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষকে শােষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হােক ক্ষুধা, রােগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়ােজিত হােক সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙালি ভাই-বােনের সম্মিলিত মনোেবল, অসীম শক্তি । যাঁরা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করেছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ। তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা; গণমানুষের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা হােক ‘জয়

বাংলা’, ‘জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’। (৫) বাংলাদেশ স্বাধীন করার পিছনে বঙ্গবন্ধুর যেমন একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল,

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠন করার জন্যও বঙ্গবন্ধুর মনে যেন একটা কর্ম কৌশল তৈরি করারই ছিল—তা তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন (১০.১.৭২) থেকে পরবর্তী ২/৩ দিন প্রদত্ত বক্তব্য বিবৃতি থেকে অনুধাবন করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে এমনিভাবে আটক ছিলেন যে তখন তিনি গােটা বিশ্বের ঘটনা প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। ৮ জানুয়ারি (১৯৭২) মুক্তি পেয়ে লন্ডন-দিল্লী হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকা পৌছা পর্যন্ত দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তার যােগাযােগ হয়নি, অথচ ঢাকা পৌঁছেই তিনি যে বক্তব্য দিলেন তাতে তাঁর সমস্ত পরিকল্পনার কথা এমনভাবে ব্যক্ত করলেন যেন সেগুলাে তিনি পূর্ব থেকেই মনের কোণে রচনা করে রেখেছিলেন। প্রথমেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন :

গত ৭ মার্চ আমি এই রেসকোর্সে বলেছিলাম, দুর্গ গড়ে তােল, আজ আবার

বলছি, আপনারা একতা বজায় রাখুন আমি বলেছিলাম বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়ব’। বাংলাদেশ আজ মুক্ত স্বাধীন। একজন বাঙালি বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন দেশরূপেই বেঁচে থাকবে। বাংলাকে

দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোন ব্যক্তি নাই। বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনী ফেরত পাঠানাে প্রসঙ্গে ১০ জানুয়ারি (১৯৭২) তিনি বলেন, আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই দেশে ফেরত যাবে। এখনই আস্তে

আস্তে অনেককে ফেরত পাঠানাে হচ্ছে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষা প্রশ্নে তিনি আরও বলেন: এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যে মুজিব সর্বপ্রথম তার প্রাণ দেবে। বাঙালি আর স্বাধীনতা হারাতে পারে

। যুদ্ধাপরাধী-দালালদের বিচার প্রসঙ্গে বাংলার মাটিতে পা রেখেই বঙ্গবন্ধু সেদিন দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন।

গত ২৫শে মার্চ থেকে এ পর্যন্তদীর্ঘ ৯ মাসে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। তারা আমার মানুষকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বােনের সম্রম নষ্ট করেছে। বিশ্ব এসব ঘটনার সামান্য কিছুমাত্র জানে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠন করে বর্বর পাক বাহিনীর কার্যকলাপের সুষ্ঠু তদন্ত করার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। এ দেশীয় দালালদের প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন: ইয়াহিয়া সরকারের সাথে যারা সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে তাদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। এদের বিচার হবে। সে তার সরকারের ওপর ন্যস্ত রাখুন। দেশের ভবিষ্যত রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন :

আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এদেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে

থাকবে। দেশের স্বাধীনতা অর্থবহ করার জন্য তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ঘােষণা করেন : বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এভাবে দেখা যায় যে, বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি (১৯৭২) ঢাকা পৌছে লাখ লাখ জনতার। যে প্রাণঢালা অভিনন্দন পান তার প্রতিক্রিয়ায় তিনি তাৎক্ষণিকভাবে যে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেন তাতে নতুন সরকারের করণীয় অনেক বিষয়েরই উল্লেখ ছিল। এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৪ জানুয়ারি তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে যে বক্তৃতা দেন তাতে তাঁর সরকারের নীতি ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা বিষয়ে স্পষ্ট দিক-নির্দেশনা ছিল।

তাঁর সরকারের অর্থনৈতিক নীতি বিষয়ে তিনি বলেন :

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠাই তাহার চূড়ান্ত লক্ষ্য। বর্তমান মুহূর্তে পুনর্বাসন ও জাতীয় অর্থনীতি পুনর্গঠনই সবচেয়ে জরুরী কাজ বলিয়া ঘােষণা করিয়া তিনি সমগ্র বিশ্বের সাহায্য কামনা করেন এবং এক প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, আমরা যেকো দেশেরই সাহায্যই গ্রহণ করতে প্রস্তুত-তবে সেই সাহায্য হবে শর্তহীন। অর্থনীতিকে পুনর্নির্মাণ ও গতিশীল করা বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন : অর্থনীতিকে পুনর্নিমাণ ও গতিশীল করাই সবচাইতে জরুরী কর্তব্য। অর্থনীতিকে পুনরায় সচল করিয়া তুলিতে হইবে। খাদ্য, আশ্রয় ও পরিধানের বস্ত্রের ব্যবস্থা করিতে হইবে । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি পুনরায় চালু করা হইবে এবং সকল শ্রেণীর মানুষের পক্ষে শিক্ষিত হওয়ার সুযোেগ গড়িয়া তােলা হইবে। জরুরী ভিত্তিতে সাহায্য ও পুনর্বাসনের। ব্যবস্থা করা হইবে। সংবাদ সম্মেলনে ‘মুজিববাদ’ সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলা হলে বঙ্গবন্ধু বলেন : ‘আমি এখন বলিতে পারিব না’। সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসাবে গঠন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট ঘােষণা ছিল যে, । আমরা শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী। আমাদের নীতি হইতেছে সকলের সহিত বন্ধুত্ব। কাহারাে সহিত বিদ্বেষ পরায়ণতা নয়। আমাদের পররাষ্ট্র নীতি হইবে জোট নিরপেক্ষ। বাংলাদেশ ভারতের প্রভাবিত একটি রাষ্ট্র কি-না সে বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এভাবে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতি ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর সরকারের কর্মপরিকল্পনা জাতির সামনে তুলে ধরেন। যেমন : (১) ১৪ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজে আহত মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে উপস্থিত হয়ে ঘােষণা করেন, ‘দেশের মুক্তির জন্য যে-সকল যুবক সংগ্রাম করিয়াছেন তাহাদের সমাজে যােগ্য স্থান দেওয়া হইবে, (২) ১৬ জানুয়ারি (১৯৭২) সমগ্র দেশব্যাপী জাতীয় শােক দিবস পালনের প্রাক্কালে (১৫ জানুয়ারি) তিনি ঘােষণা করেন যে,মাতৃভূমির মুক্তিযুদ্ধে দেশমাতৃকার যেসব কৃতী সন্তান শহীদ হইয়াছেন তাহাদের স্মরণে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হইবে (৩) ১৭ জানুয়ারি এক সরকারি হ্যান্ড আউটের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ১০ দিনের মধ্যে সকল অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ জারি করেন; অতএব, উপরের আলােচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শাসনভার গ্রহণ করার সময় বঙ্গবন্ধু সরকার তার কর্তব্য-কৰ্ম বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে এটা

স্পষ্ট ছিল যে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তার কি কি কাজ করতে হবে এবং কত দ্রুততার সাথে তা করতে হবে। তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা, ১৯৫৪ সালের ২১ দফা, ঐতিহাসিক ৬ ও ১১ দফা, সত্তরের নির্বাচনী ইশতেহার, স্বাধীনতা সনদ-ইত্যাদি ছিল তার রাষ্ট্র পরিচালনা নীতি নির্ধারণের সহায়ক। বঙ্গবন্ধুর সরকার পরিচালনা।

মন্ত্রী পরিষদ : আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু প্রধান। বিচারপতির নিকট দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। প্রধান বিচারপতি মনােনীত হন বিচারপতি আবু সাদত মােহাম্মদ। সায়েম। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ১২ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রীসভা গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীপরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৩ জানুয়ারি (১৯৭২)। ঐ সভায় কতকগুলাে মৌলিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যেমন : (১) ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে প্রচলিত বাংলাদেশের পতাকার নকশা থেকে

বাংলাদেশের মানচিত্র তুলে সবুজের মাঝখানে শুধু লাল গােলক রেখে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অনুমােদন করা হয়। (২) বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি’ নির্ধারণ করা হয়। (৩) বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল ঊর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল’ গানটি বাংলাদেশের রণসঙ্গীত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।’

আলােচনার এই পর্যায়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর সরকারের সাড়ে তিন বছরের কর্মকাণ্ড বিষয়ভিত্তিক আলােচনা করব।

ক, সংবিধান প্রণয়ন | আমরা ইতােপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ঘােষিত স্বাধীনতার সনদ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশে মৌলিক আইনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। ‘এই সনদ ছিলাে আইনের মূল সূতিকাগার এবং সরকারের সমস্ত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার উৎস। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এটিই ছিলাে দেশের সংবিধান’। এই সনদে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতির বিধান করা হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের শাসনপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল । উক্ত ক্ষমতাবলে বঙ্গবন্ধু ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পরের দিন ১১ জানুয়ারি (১৯৭২) ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। অস্থায়ী সংবিধান আদেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়। এটি ছিল জনগণকে প্রদত্ত। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। ১৯৪৯ সালে জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগ ছিল। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ১৯৫৪ সালের ২১ দফায়, ৬ ও ১১। দফায় এবং ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংসদীয় পদ্ধতির দাবী করেছে ।

‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ বলে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে সরকার ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ ‘গণপরিষদ আদেশ’ ও ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য (সদস্যপদ বাতিল) আদেশ’ নামক ২টি আদেশ জারি করে। প্রথমটির মাধ্যমে ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণকে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। গণপরিষদের একমাত্র দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। আইনসভা হিসেবে কাজ করার কোন ক্ষমতা গণপরিষদের ছিল। এই আদেশটি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়। দ্বিতীয় আদেশ অনুযায়ী গণপরিষদের কোন সদস্য তার রাজনৈতিক দল (অর্থাৎ যে দলের মনােনয়ন পেয়ে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন) থেকে পদত্যাগ করেন, কিংবা উক্ত দল থেকে বহিকৃত হন তাহলে তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে।’ এ দুটি আদেশ জারির পরপরই সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি কর্তৃক গণপরিষদের দলীয় নেতা নির্বাচিত হন। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সহকারী নেতা নির্বাচন করা হয়। রাষ্ট্রপতি ১০ এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশন উদ্বোধন করেন। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শাহ আবদুল হামিদ ও মােহাম্মদউল্লাহ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গণপরিষদের যথাক্রমে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৪১৪ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের লক্ষ্যে ১১ এপ্রিল একটি কমিটি গঠন করা হয়। ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ড. কামাল হােসেন। এই কমিটিতে একমাত্র বিরােধীদলীয় সদস্য ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি-ন্যাপ (মােজাফর) থেকে ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কমিটিতে একজন মহিলা গণপরিষদ সদস্য (মােট মহিলা সদস্যসংখ্যা ছিল ৭ জন) অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কমিটিতে পরবর্তী ১০ জুনের (১৯৭২) মধ্যে গণপরিষদে সংবিধানের খসড়া উপস্থাপন করতে বলা হয়। সে অনুযায়ী কমিটি অত্যন্ত দ্রুত সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু করে। ১৭ এপ্রিল কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ বৈঠকে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন সংবিধান বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে সংবিধান বিষয়ে প্রস্তাব আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কমিটির ঘােষিত শেষ তারিখের (৮ মে ১৯৭২) মধ্যে কমিটি ৯৮টি সুপারিশমালা লাভ করে। পূর্বনির্ধারিত ১০ জুনের মধ্যে কমিটি সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। সংবিধানটিকে পূর্ণাঙ্গ ও উত্তম করার উদ্দেশ্যে কমিটির সভাপতি ড. কামাল হােসেন ভারত ও ইংল্যান্ড সফর করে সেখানকার পার্লামেন্টের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করেন। তাছাড়া সংবিধানটিকে ত্রুটিমুক্ত করার উদ্দেশ্যে কমিটি একজন ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করে। ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবরের মধ্যে কমিটি সংবিধানের খসড়া চূড়ান্তভাবে প্রণয়ন করে । সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করার পূর্বে ৯ অক্টোবর তা আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে উপস্থাপিত ও আলােচিত হয়েছিল। এভাবে প্রণীত চূড়ান্ত খসড়াটি কমিটির সভাপতি এবং দেশের আইনমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন সংবিধানের বিলের আকারে

গণপরিষদের অধিবেশনে উপস্থাপন করেন। ১৩ অক্টোবর গণপরিষদ নিজস্ব কার্যপ্রণালীর বিধিমালা গ্রহণ করে। ১৮ অক্টোবর থেকে গণপরিষদে সংবিধান বিল সম্পর্কে সাধারণ আলােচনা শুরু হয় এবং ৩০ অক্টোবর তা সমাপ্ত হয়। ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মণি সিংহ ড. কামাল হােসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সংবিধানের বিষয়ে তার পার্টির সুপারিশ উপস্থাপন করেন। ৩১ অক্টোবর থেকে গণপরিষদে খসড়া সংবিধানের ধারাওয়ারি আলােচনা শুরু হয়। ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সে আলােচনা চলে। আলােচনাকালে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যগণ কর্তৃক আনীত কতিপয় সংশােধনী গ্রহণ করা হয়। সংবিধানের ৭৩নং অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কর্তৃক আনীত একটি সংশােধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

| ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধান বিল পাশ হয়। ১৪ ডিসেম্বর। (১৯৭২) স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ ও গণপরিষদ সদস্যগণ সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজি কপিতে স্বাক্ষর দান করেন। তবে একমাত্র বিরােধী দলীয় সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবিধান বইতে স্বাক্ষর দানে বিরত থাকেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস থেকে সংবিধানটি কার্যকর করা হয়। এরপর গণপরিষদ ভেঙে দেয়া হয়। গণপরিষদের প্রথম স্পিকার শাহ আব্দুল হামিদ মৃত্যুবরণ করায় (১২ অক্টোবর ১৯৭২) ইতােমধ্যে মােহাম্মদউল্লাহকে স্পিকার ও বায়তুল্লাহকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করা হয়েছিল। গণপরিষদ ভেঙে দেয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে ঘােষণা করেন যে, বিধিবদ্ধ সংবিধানের আওতায় দেশে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধান প্রণয়নকালীন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও দলের প্রতিক্রিয়া ও মতামত

সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে গণপরিষদ গঠনের ঘােষণা দেওয়ার পর সরকারকে রাজনৈতিক বিতর্কের সম্মুখীন হতে হয়। বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তােলে। তাদের যুক্তি ছিল যে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রণীত আইন শাসন কাঠামাে আদেশবলে । উক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের শাসন কাঠামাের মধ্যে ৬ দফার ভিত্তিতে একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটার সাথে সাথে ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও ঐ নির্বাচনে নির্বাচিত সদস্যগণ গ্রহণযােগ্যতা হারিয়েছেন। সুতরাং তারা দাবি করেন যে বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনা করতে হলে একটি নতুন সাংবিধানিক পরিষদ গঠন করতে হবে। এই দাবি নিয়ে ন্যাপ (ভাসানী) দলের নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী একটি সরকার বিরােধী আন্দোলন গড়ে তােলার চেষ্টা করেন। ১৯৭২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এক জনসভায় তিনি সরকারের পদত্যাগ ও একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু সে সময় শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকায় মওলানা

ভাসানীর আহ্বানে তেমন জনসমর্থন পাওয়া যায়নি।

সংবিধান সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া

গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর এর বিরুদ্ধে কোন জোরালাে বিক্ষোভ বা আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কোন রাজনৈতিক দলই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির বিরুদ্ধে কোন মতামত প্রকাশ করেনি বা সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকল্প কোন প্রস্তাব উত্থাপন করেনি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ঐ সংবিধানকে একটি ‘বাজে সংবিধান’ হিসেবে অভিহিত করে। এই দলের মতে সংবিধানে মৌলিক অধিকারের উপর নানা বাধা নিষেধ আরােপ করে দেশে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার কোন দিক নির্দেশনা সংবিধানে দেয়া হয়নি। তবে দলটি এই মর্মে সন্তোষ প্রকাশ করে যে দেশে কোন সংবিধান না থাকার চেয়ে একটি বাজে সংবিধান থাকাও শ্রেয়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মােজাফফর) সংবিধানের কিছু কিছু সংশােধনীর প্রস্তাব করলেও সংবিধানকে স্বাগত জানায়। সেসময় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলাে নিষিদ্ধ থাকায় কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকায় সংবিধান বিষয়ে খােলাখুলি কোন মন্তব্য বা সুপারিশ পেশ করতে পারেনি।

সংবিধানের বৈশিষ্ট্যাবলি।

১৯৭২ সালের সংবিধান একটি লিখিত দলিল। এই সংবিধানে সংযােজন করা হয় একটি প্রস্তাবনা, ১১টি ভাগ ও ৪টি তফসিল। এর প্রথম ভাগে প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ, দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিসমূহ, তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারসমূহ, চতুর্থ ভাগে নির্বাহী বিভাগ, পঞ্চম ভাগে জাতীয় সংসদ, ষষ্ঠ ভাগে বিচার বিভাগ, সপ্তম ভাগে নির্বাচন, অষ্টম ভাগে মহাহিসাব নিরীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রক, নবম ভাগে কর্মকমিশন, দশম ভাগে সংবিধান সংশােধন ও একাদশ ভাগে বিবিধ বিষয়াবলি আলােচিত হয়েছে।

১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ৪টি আদর্শকে গ্রহণ করা হয়েছে, যেমন: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। এর মূল লক্ষ্য ছিল:

| এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে। সংবিধানে বাংলাভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্রীয়ভাষা হিসেবে ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সােনার বাংলা’ গানটির প্রথম ১০ চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে দেশের নাগরিকদের বাঙালি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দেয়া হয়। ঐ সংবিধানে উল্লিখিত সমাজতন্ত্র যে উদ্দেশ্যে উল্লেখ করা হয়েছিল তা হচ্ছে: “মানুষের উপর মানুষের শােষণবিহীন ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করা’ (অনুচ্ছেদ ১০)। গণতন্ত্রের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয় যে, প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক

মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে। মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবােধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে’ (অনুচ্ছেদ ১১)। সংবিধানে উল্লেখিত ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ছিল সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করা, কোন বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতা প্রদান না করা, ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করা এবং বিশেষ ধর্মের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রদর্শন না করা। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে জনগণের সব ধরনের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। সংবিধানের ৪৪নং অনুচ্ছেদ দ্বারা সুপ্রিম কোর্টকে সকল ধরনের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার রক্ষাকবচ করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে মন্ত্রীপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর হাতেই প্রকৃত শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত করে। উক্ত সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে উপাধিসর্বস্ব করে। সংবিধানে একটি এক কক্ষ বিশিষ্ট এবং ৩০০ সদস্য ও সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত ১৫ জন মহিলা সদস্য সমন্বয়ে আইন সভা গঠনের বিধান করা হয় । আইন সভার নাম দেয়া হয় জাতীয় সংসদ’। ১৯৭২ সালে সংবিধানে মহিলা আসনগুলাে ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। এই সংবিধানে বিধিবদ্ধ করা হয় যে, ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ দালাল আদেশের অধীনে কেউ যে কোন অপরাধের জন্য যে কোন মেয়াদের জন্য দণ্ডিত হন তাহলে তিনি সংসদ সদস্য হবার অযােগ্য হবেন (৬৬ ৬ ধারা যা ১৯৭৮ সালে বিলুপ্ত করা হয়)। সংবিধানে একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে বলা হয় যে, মুক্ত ও স্বাধীন একটি বিচার বিভাগ গঠনের লক্ষ্যে ‘সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতিগণ স্বাধীন অবস্থায় থেকে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন’ (অনুচ্ছেদ ৯৪ (৪)। সংবিধানে নির্বাচন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক, পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন, ন্যায়পাল নিয়ােগ প্রভৃতি বিষয়ে বিধান করা হয়।  ১৯৭২-৭৫ সময়কালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকালে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য সাফল্য ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। সংবিধান বিষয়ে মওদুদ আহমদের মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে:

মাত্র এক বছরের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নের জন্য আওয়ামী লীগকে প্রশংসা না করে পারা যায় না। এটি ছিল একটি ব্যাপক, সুলিখিত দলিল এবং এই উপমহাদেশের অন্যান্য সংবিধানের তুলনায় উন্নত মানের। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব এবং দুর্বলতা। থাকলেও এই সংবিধান জনগণের তঙ্কালীন আশা আকাঙ্ক্ষা বহুলভাবে প্রতিফলিত করেছিলাে। সুদীর্ঘকালীন সংগ্রামে আওয়ামী লীগ জাতির সামনে যে অসংখ্য প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেছিলাে, এই সংবিধানের মাধ্যমে সেগুলাে এক বিরাট অংশের বাস্ত বায়ন ঘটানাের প্রচেষ্টা চালানাে হয়েছে। সংবিধানের সংশােধনী

আওয়ামী লীগ শাসনামলে (১২.১.১৯৭২–১৪.৮.৭৫) ১৯৭২ সালের সংবিধানকে ৪ বার সংশােধন করা হয়। প্রথম সংশােধনী গৃহীত হয় ১৯৭৩ সালের ১৫

জুলাই । যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে সংবিধানের ৪৭নং অনুচ্ছেদে সংশােধনী আনা হয়। সংবিধানের ৪৭ নং অনুচ্ছেদের সঙ্গে নিমরূপভাবে ৪৭-ক অনুচ্ছেদ সংযােজিত হয় :

এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও গণত্যাজনিত অপরাধ, মানবতা বিরােধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্রবাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনী সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারিতে সােপর্দ কিংবা দ দান করিবার বিধান সংবলিত কোন আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য হইবে না কিংবা কখনও বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে না।’ সংবিধানের দ্বিতীয় সংশােধনী গৃহীত হয় ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। এই সংশােধনীর মাধ্যমে সংবিধানে জরুরি বিধানাবলি সংযােজিত হয়। সংবিধানে তৃতীয় সংশােধনী গৃহীত হয় ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর। এটি বাংলাদেশের সীমানা সংশােধনী সংক্রান্ত। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দিল্লীতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দু দেশের ভূমি সীমানা সংক্রান্ত যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তাই কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সংবিধানের তৃতীয় সংশােধনী গৃহীত হয় (অনুচ্ছেদ ২)। সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের সবচেয়ে সমালােচিত বিষয়। সংশােধনীটি গৃহীত হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি । এই সংশােধনীতে সংবিধানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। ফলে মন্ত্রীপরিষদ ও জাতীয় সংসদ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। মূল সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সমস্ত অধিকার রক্ষা ও প্রয়ােগের যে সকল ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টকে দেয়া হয়েছিল চতুর্থ সংশােধনীতে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয় এবং মৌলিক অধিকারসমূহ প্রয়ােগের জন্য একটি সুপ্রিম সাংবিধানিক আদালত গঠর বিধান করা হয়। তাছাড়া চতুর্থ সংশােধনীতে হাইকোর্ট কর্তৃক অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা জারির বিধানও প্রত্যাহার করা হয়। চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে দেশে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক একক জাতীয় দল গঠনের ঘঘাষণা দেয়া এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করার বিধান প্রণীত হয়।

সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনীর যৌক্তিকতা | উপরের আলােচনায় আমরা দেখেছি যে, ১৯৭২ সালের সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনীতে মূল সংবিধানে কাঠামােতে অনেক পরিবর্তন সাধন করা হয়। সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন, রাষ্ট্রপতির হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে মন্ত্রীপরিষদ ও জাতীয় সংসদকে ক্ষমতাহীন করা, বিচার বিভাগের উপর রাষ্ট্রপতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি ইত্যাদিই ছিল চতুর্থ সংশােধনীর মূল বিষয়বস্তু। ১৯৭২-এর সংবিধানের উল্লিখিত পরিবর্তনগুলাে ছিল নিঃসন্দেহে অগণতান্ত্রিক প্রকৃতির। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে কেন এই পরিবর্তন?

জাতীয় সংসদে চতুর্থ সংশােধনী গৃহীত হওয়ার অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ পরিবর্তনের অপরিহার্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি এই মর্মে মন্তব্য করেন যে, দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি, শােষণহীন সমাজব্যবস্থা, শােষিতের সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মহৎ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী অনিবার্য হয়েছিল। দেশের বিরাজমান নৈরাজ্যকর অবস্থার অবসান ঘটানাে, জনগণের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা ও সকল শােষণ-অবিচার নির্যাতন দূর করার জন্যই সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন সাধন করতে তিনি বাধ্য হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মওদুদ আহমদ চতুর্থ সংশােধনীর অপরিহার্যতা বিষয়ে কিছু যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। যেমন: ১. ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন পদ্ধতি । সবসময় তিনি প্রশাসনের সংস্কারমুখী পরিবর্তন সাধনের পক্ষপাতী ছিলেন; ২. ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা যা ইতিমধ্যেই সংসদের ৪ জন আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিসহ দলের অসংখ্য নেতাকর্মীর প্রাণহানির কারণ হয়েছিল; গুপ্তহত্যা, অর্থনীতির ব্যাপক ধ্বংসসাধন, ধ্বংসমূলক তৎপরতা ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে দালালদের কথিত ভূমিকা; জাসদসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনগুলাের ভূমিকা এবং তাদের বিধ্বংসী তৎপরতা; ৫. গােষ্ঠীবিশেষের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রের অবস্থিতি এবং সরকারবিরােধী কাজে তা ব্যবহারের অব্যাহত প্রবণতা; দুর্যোগময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেশে দুর্ভিক্ষের মরণাঘাত, খাদ্যাভাব এবং বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা; শিক্ষিত শ্রেণীই ছিল দেশের সবচাইতে সুবিধাভােগী শ্রেণী এবং তারাই ছিল সমাজের মূল শােষক। জনগণের শ্রমলব্ধ অর্থে সুশিক্ষিত হয়েও তারা জনকল্যাণের লক্ষ্যে সেই প্রাপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থাতে নিদারুণভাবে উদাসীন ছিলেন, সর্বোপরি ব্যাপ্ত দুনীতির সাথে দেশের দরিদ্র জনগণ জড়িত ছিলেন না অথচ তার মতে দেশের ৫০% জনগােষ্ঠী শিক্ষিত শ্রেণীই ছিলাে সমস্ত দুর্নীতির ধারক ও বাহক; ৮, প্রশাসন, শিল্প এবং শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা; ৯. বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থা ছিলাে উপনিবেশবাদী ধারার বাহক এবং জনগণের প্রয়ােজন মেটানাের লক্ষ্যে তার সংস্কারমুখী পরিবর্তন ছিলাে অপরিহার্য; ১০. মুষ্টিমেয় শ্রেণীর মাধ্যমে ব্যাপক জনগােষ্ঠীর ওপর অব্যাহত শশাষণ; এবং ১১. চোরাচালান, অবৈধ মজুদদারি ও কালােবাজারির ক্রমবর্ধমান প্রবণতা।

সমাজের বুকে বিদ্যমান এসব দুষ্টক্ষত নিরাময়ের জন্যই শেখ মুজিব প্রশাসনিক পরিবর্তনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থা দিয়ে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছিল না বিধায় শেখ মুজিব জনগণের ঐক্যবদ্ধতা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সামগ্রিক পরিবর্তন সাধন করে তাঁর স্বপ্নের সােনার বাংলা’র বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। অতএব বলা যায় যে, সময়ের বিচারে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনীকে যুক্তিযুক্ত বলা যায় । কিন্তু এর পুরােপুরি বাস্তবায়ন ও ফলাফল প্রাপ্তির পূর্বেই শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়। তাই চতুর্থ সংশােধনীর ফলাফল বিষয়ে কোনরূপ মন্তব্য করা সম্ভব নয়। আইন প্রণয়ন

বঙ্গবন্ধু সরকার বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা মােকাবেলা করার জন্য সরকার গঠনের প্রথম এক বছরেই প্রায় দেড়শ আইন প্রণয়ন করে। উল্লেখযােগ্য আইনগুলাে নিচে আলােচনা করা হলাে পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখলীকরণ আইন।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত হবার পর অসংখ্য শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের অবাঙালি মালিকগণ দেশ ত্যাগ করলে সেগুলাের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দখল সংক্রান্ত এই আইনটি ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি প্রণীত হয়। এটি ১৯৭২ সালের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির ১নং আদেশ (APO-1) নামে পরিচিত। এই আইনের বিষয়বস্তু ছিল নিমরূপ: ৮ (১) যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক, পরিচালকম লী অথবা ব্যবস্থাপকবৃন্দ কিংবা তাদের অধিকাংশ বাংলাদেশ পরিত্যাগ করছেন কিংবা প্রতিষ্ঠান চালানাের জন্য উপস্থিত | নেই, সরকার সে সকল প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন; (২) এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার ভার এবং এগুলাের হিসাবরক্ষণের দায়িত্ব সরকার

মনােনীত ব্যবস্থাপকমণ্ডলী অথবা প্রশাসকদের হাতে কিংবা অন্যান্য কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত থাকবে; (৩) ১৯৭২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি জারিকৃত রাষ্ট্রপতির ১৬ নং-আদেশ (PO 16)-এর

মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তি শুধু দখল নয়, তার বিক্রয়ের অধিকারও সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়; পরিত্যক্ত সম্পত্তির কাছে কোন প্রতিষ্ঠানের ঋণ পাওনা থাকলে সে বিষয়ে

সরকারের হিসাব চূড়ান্ত বলে গণ হবে; (৫) PO 16-এর মাধ্যমে সরকার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর সম্পাদিত সম্পত্তির।

যেকোন ইজারা বা চুক্তি অযােগ্য বলে বিবেচিত করতে পারতেন। (৬) সরকারের হাতে কোন পরিত্যক্ত সম্পত্তির দখলিত্ব যাওয়ার পর আদালত এ

ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে না; (৭) সরকার ভুলক্রমে কোন সম্পত্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে দখল করে থাকলে,

ক্ষতিগ্রস্ত লােকদের প্রতিকার বিধানের ব্যবস্থা PO 16 তে রাখা হয়। (৮) PO 16-এর মাধ্যমে শুধুমাত্র পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির উপরই নয়,

দেশের নাগরিকদের যে কোন সম্পত্তি দখল করার ব্যাপারেও সরকারকে অনন্য সাধারণ ক্ষমতা প্রদান করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের অব্যবহিত পূর্বে পাকিস্তানীরা ২৮৮.৬০ কোটি টাকা মূল্যের ৭২৫টি শিল্প ইউনিট পরিত্যক্ত রেখে পালিয়ে যান। এগুলাে ছিল বাংলাদেশের আধুনিক

শিল্পসমূহের মােট অংশের ৪৭% এবং বেসরকারি খাতের মােট শিল্পের ৭১%। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক যেগুলাে এ অঞ্চলের মােট ডিপােজিটের ৭০% নিয়ন্ত্রণ করতাে’ । APO 1-এবং PO 16-এর মাধ্যমে সরকার পরিত্যক্ত সম্পত্তিগুলাের মালিকানা স্বহস্তে গ্রহণের মাধ্যমে সেগুলাে লুটপাটের হাত থেকে বহুলাংশে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। আমলাতন্ত্রের দুর্বলতার সুযােগে কিছু সম্পত্তি লুটপাট হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে মালিক উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কেবল অবাঙালি হওয়ার কারণে তার সম্পত্তি পরিত্যক্ত ঘােষণা করে সরকারি মালিকানায় বা ব্যক্তিনামে দখল করা হয়েছে।

বাংলাদেশ দালাল অধ্যাদেশ, ১৯৭২।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুঃসহ নির্যাতন, গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুটপাট, গৃহে অগ্নিসংযোেগ এবং অন্যান্য দুষ্কর্মে সহযােগিতা করার জন্য রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। সারাদেশে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত গঠিত হয়েছিল ‘পিস কমিটি’-যার সদস্যরা ‘দালাল’ নামে পরিচিত। এদের বিচার করার উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে গণহত্যা তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে বলা হয়, হাইকোর্টের কর্মরত কিংবা অবসরপ্রাপ্ত কিংবা সমপর্যায়ের মনােনীত কোনও ব্যক্তির নেতৃত্বে এই কমিশন গঠিত হবে, যার কাজ হবে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের সহযােগীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রণয়ন করা’ । এভাবেই দালালদের বিচারের উদ্যোগের সূচনা ঘটে।

বঙ্গবন্ধু স্বদেশ ফিরেই ঘােষণা করেছিলেন: “বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। ১৮ জানুয়ারী (১৯৭২) প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে (পরবর্তীতে স্যার) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধী রাজাকার আলবদরদের বিচার প্রসঙ্গে বলেছিলেন: “আমি সবসময় ক্ষমা এবং ভুলে যাওয়ায় বিশ্বাস করি। কিন্তু ক্ষমা করা এবং ভুলে যাওয়া এখন আমার পক্ষে অসম্ভব, কারণ, এগুলাে ঠাণ্ডা মাথার এবং পরিকল্পিত ধরনের হত্যা, আমার মানুষের উপর গণহত্যা। আপনি কি মনে করেন কোন মানুষ এগুলাে মেনে নিতে পারে? এই লােকগুলােকে শাস্তি। দিতেই হবে। এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন নেই’। অতএব বলা যায়, দালালদের বিচার প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধুর কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব লাভ করেছিল। তাই শাসনভার গ্রহণের ২ সপ্তাহের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু ২৪.১.১৯৭২ তারিখে জারি করেন বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইবুনাল) অধ্যাদেশ, ১৯৭২’ । এই আদেশ জারির প্রয়ােজনীয়তা প্রসঙ্গে অধ্যাদেশের প্রস্তাবনায় নিমরূপ কারণ ও যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছিল :

কতিপয় ব্যক্তি অথবা কোন সংগঠন বিশেষের সদস্যগণ প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ ভাবে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর দালালরূপে গণহত্যা, নির্যাতন, নারী ও শিশু নিধন ও বাংলাদেশের জনগণের সম্পত্তি ও সম্মান হরণের জন্য পাক বাহিনীকে সাহায্য করেছেন। এ ধরনের ব্যক্তিরা তাদের ঘৃণ্য তৎপরতা দিয়ে বাংলাদেশে একটি সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন এবং মানবতার বিরুদ্ধে তারা এমন জঘন্য অপরাধ করেছেন যে, বাংলাদেশের জনগণ এবং বিশ্ব বিবেকের কাছে তা জঘন্যতম তৎপরতা হিসেবে পরিচিহ্নিত হয়েছে। সে জন্যই তাদের কার্যধারার যথাযথ এবং কার্যকর প্রতিবিধান। এবং তাদের তৎপরতা অনুসারে আইনের ভিত্তিতে শাস্তি প্রদান করা একটি অবশ্য পালনীয় বিষয় হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে। আইনে কোনাে ব্যক্তিবিশেষকে দালাল হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য নিমলিখিত কারণগুলাে চিহ্নিত করা হয় :

(১) যারা বাংলাদেশে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীকে তাদের অবৈধ অবস্থানে সহায়তা, সমর্থন, সংরক্ষণ এবং জোরদার করণে সাহায্য করেছেনঃ (২) যারা তাদের প্রতিশ্রুতি, আকার-ইঙ্গিত বা আচরণের মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে যেকোনােভাবে বৈষয়িক সহায়তা দিয়েছেন; (৩) যারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত হয়েছেন অথবা যুদ্ধে রত হতে সহায়তা করেছেন; (৪) যারা পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলাদেশের জনগণের কোনাে প্রচেষ্টা প্রতিহত কিংবা ধবংস করেছেন; এবং (৫) যারা পাক হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশে তাদের অবৈধ অবস্থান সুদৃঢ়করণে সহায়তা করতে গিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন কিংবা দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে স্বেচ্ছাপ্রণােদিতভাবে অপপ্রচার করেছেন কিংবা হানাদার বাহিনীর কোনাে প্রতিনিধিদলে প্রতিনিধত্ব করেছেন বা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে পরিচালিত উপনির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছেন। মূল আইনের অপরাধের সংখ্যা ৬০টি নির্ধারণ করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের জুন মাসে প্রণীত সংশােধনীতে অপরাধের সংখ্যা বাড়িয়ে ৬৯টি স্থির করা হয় । এই ৬৯টি অভিযােগের যে কোন অপরাধের সঙ্গে জড়িত যে কোনাে ব্যক্তিকে ‘দালাল বলে যুক্তিসঙ্গতভাবে সন্দেহ করা হলে যে কোনাে পুলিশ অফিসার কিংবা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত যে কোনাে ব্যক্তি তাকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করতে পারতেন’ । এভাবে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ছয়মাস অন্তরীণ রাখা যেত । প্রয়ােজনে এই সময়সীমা আরাে বাড়ানাে যেত। এই আইন প্রণয়নের পূর্বে দালাল সন্দেহে আটককৃত ব্যক্তিদেরকেও এই আইনের আওতায় আনা হয়। প্রথমে মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে বিচারের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। পরে নির্দিষ্ট অপরাধের বিচার করার জন্য সেশন জজ বা অতিরিক্ত সেশন জজ, বা সহকারী সেশন জজ দ্বারা গঠিত এক সদস্যের বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। পরবর্তী কালে দালাল আইনের এক সংশােধনীবলে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। পলাতক দালালদের অনুপস্থিতিতেই বিচার পরিচালনার বিধান করা হয়। কোনাে দালালের অপরাধ প্রমাণের জন্য আইনে (সংশােধনী ১০ (ক)) নিমরূপ বিধান করা হয়:

কোন ময়নাতদন্ত রিপাের্ট, মেডিকেল রিপাের্ট কিংবা রাসায়নিক পরীক্ষার অন্য কোনাে রিপাের্ট পাওয়া না গেলে, কিংবা পুলিশের কাছে কোনাে অভিযােগ দায়ের করা না হলে, কিংবা তা বিলম্বে করা হলে, অথবা মৃতদেহের কোনাে খোঁজ পাওয়া না গেলেও, কোনাে অপরাধ প্রমাণের অযােগ্য বলে বিবেচিত করা হবে না। হানাদার বাহিনীকে সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত কোনাে দলিল যথাযযাগ্য প্রমাণ সহকারে আদালতে পেশ করা

হলে এবং এ বিষয়ে কোনাে প্রতিবাদ উত্থাপন না করা হলে, সেসমস্ত দলিল গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত করা হয়। বিশেষ করে: আল-বদর, আল-শামস বা রাজাকারবাহিনীর

লােকদের বিচার করার সময়ে এ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করা হতাে। দালাল আইনের আওতায় সারাদেশে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। এই আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তির সাজা ছিল মৃত্যুদণ্ড থেকে শুরু করে কমপক্ষে তিন বছরের কারাদণ্ড প্রদান। এ আইন সম্পর্কে মওদুদ আহমদের মূল্যায়ন নিমরূপ :

এই আইনের প্রতিটি বিধানই ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং সেকারণে উচ্চতর আদালতগুলাে অনেকগুলাে ক্ষেত্রে দালাল আইনে গ্রেফতারকৃত ও অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিকে জামিন প্রদানে অস্বীকার করে। এ ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টের আপীলেট ডিভিশনের মতামত হলাে, আইনের ১৪ নং অনুচ্ছেদ বলে হাইকোর্ট দালাল আইনে অভিযুক্ত কাউকে জামিন প্রদান করতে পারে না, কারণ আইনে বর্ণিত বিধানগুলাে ছিলাে অত্যন্ত পরিষ্কার এবং

অ-বিতর্কিত। দালাল আইনের প্রতি জনগণের প্রতিক্রিয়া ও এ আইনের প্রভাব সম্পর্কে মওদুদ আহমদ লিখেছেন:

সারা জাতির এক উত্তেজনা মুহূর্তে দালাল আদেশ জারী করা হয়। প্রথম মুহূর্তে জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এই আইনকে স্বাগত জানায়। কারণ জনগণ স্বভাবতই দালালদের শাস্তি কামনা করেছিলেন। অন্যদিকে দালাল এবং অবাঙালিদের ন্যায় দালালীর অভিযােগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্যও এই আইন যথেষ্ট আশীর্বাদ বহন করে আনে। এই আইন উত্তেজিত জনগণের ক্রোধ ও প্রতিহিংসা থেকে তাদের রক্ষা। করে … এই আইন যত নমনীয় কিংবা অনমনীয়ই হােক না কেন, ‘আইনের মাধ্যমে

সুবিচারের প্রক্রিয়া অবশ্যই ছিল আইনশূন্যতার চাইতে অনেক উত্তম। মওদুদ আহমদ-এর হিসাব মতে দালাল আইনে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আনুমানিক সংখ্যা ছিল ৫০ থেকে ৬০ হাজার এবং সমান সংখ্যক ব্যক্তি পলাতক ছিলেন বলে ধরণা করা হয়। অন্য আরেক হিসেব মতে ২৪.০১.৭২ থেকে ৩০.১১.৭৩ পর্যন্ত ৩৭,৪৭১ জন দালাল গ্রেফতার করা হয়। এ সময় ৭৫২জন দালাল দণ্ডিত হয়।

দালালদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে বঙ্গবন্ধু অভ্যন্তরীণ চাপের সম্মুখীন হন। অনেক মুক্তিযােদ্ধার আত্মীয় ছিল দালাল। এদের মুক্তির জন্য প্রচণ্ড তদবির শুরু হয়। তাছাড়া সে সময় পাকিস্তানে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ বাঙালি (১,৬০,০০০ সরকারি কর্মচারী, ৩৩,০০০ সেনাবাহিনীর সদস্য) আটকা পড়েছিল, তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচণ্ড চাপ আসতে থাকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, প্রয়ােজনে দালালদের মুক্তি দিয়ে হলেও পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ফিরিয়ে আনতে হবে। এমনি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ৩০.১১.৭৩ তারিখে সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করেন। তবে ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, ঘরবাড়ি অথবা জাহাজে অগ্নিসংযােগের দায়ে দণ্ডিত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমা প্রযােজ্য হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। ক্ষমা ঘােষণার পর গ্রেফতারকৃত ৩৭,০০০ ব্যক্তির মধ্যে ২৬,০০০ মুক্তি পেলেও ১১,০০০ ব্যক্তি নির্দিষ্ট অপরাধে কারাগারে আটক ছিল যাদেরকে ছেড়ে দিয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। “১৯৭৫-এর ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল। 

করেন ordinance no. 63 of 1975-এর মাধ্যমে। ‘৭৫-এর ৩১ ডিসেম্বর দ্বিতীয় ঘােষণার মাধ্যমে জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার দালাল আইনের নিরাপত্তা কবজটি ছুঁড়ে ফেলে দেন।’৭৬ সালেই জিয়া সংবিধানের ৩৮ নং অনুচ্ছেদ সংশােধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল করার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। একই সঙ্গে জিয়া একাত্তরের ঘাতক দালালদের ভােটার হওয়ার সুযােগ করে দেন। যেসব শীর্ষ স্থানীয় দালাল, রাজাকার, আলবদরদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল তাদের জন্য ‘৭৬-এর জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সার্কুলার জারী করে যাতে বলা হয় এসব ব্যক্তি নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার জন্য মামলা করতে পারে।
গ. যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন । পুনর্বাসন পদক্ষেপ।
পুনর্বাসনের বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শাসনকার্য শুরু করেছিলেন। ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় এককোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করা, দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৪৩ | লক্ষ বিধ্বস্ত বাসগৃহ পুনর্নির্মাণ করা এবং এদেরকে খাদ্যসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়ােজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা ছিল সরকারের বিরাট দায়িত্ব। সেসময় প্রশাসনিক কাঠামাে ভেঙে পড়েছিল। স্থানীয় পরিষদগুলাে ছিল পাকিস্তানপন্থীদের দখলে। নতুন সরকার প্রচুর পরিমাণ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সামগ্রী লাভ করলেও সেগুলির সুষ্ঠু বিতরণ করা বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামাে দিয়ে অসম্ভব ছিল। এমনি পরিস্থিতিতে সরকার রেডক্রস সােসাইটিকে জাতীয় পর্যায় থেকে নিমতর স্তর পর্যন্ত পুনর্গঠিত করেন। পাশাপাশি গ্রাম থেকে শুরু করে জেলা পর্যায় পর্যন্ত ত্রাণ কমিটি গঠনের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয় | (৯.১.১৯৭২)। গ্রামের আয়তন ও লােকসংখ্যার ভিত্তিতে ৫ থেকে ১০ সদস্যের ত্রাণ
ও পুনর্বাসন কমিটি গঠন করা হয়। আওয়ামীলীগপন্থী স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, | মুক্তিযােদ্ধা সমন্বয়ে গ্রাম পর্যায়ে ত্রাণ কমিটি গঠিত হয়। এভাবে ইউনিয়ন থানা ও জেলা ত্রাণ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য ও চেয়ারম্যান নিয়ােগে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। কমিটিগুলাের মাধ্যমে সারাদেশে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদগুলাের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা পাকিস্তান আমলে নির্বাচিত হয়েছিলেন—এই যুক্তিতে ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি দেশের সব স্থানীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। ফলে ত্রাণ কমিটিগুলাে আরাে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। স্বভাবতই অনেক স্থানে ত্রাণ কমিটির সদস্যরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন এর ফলে আওয়ামী লীগের দুর্নাম হয়। ১৯৭৩ সালের ৪ মার্চ সংবাদপত্রসমূহে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের ক্রোড়পত্রে দাবি করা হয় যে ঐ সময় পর্যন্ত সরকার ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায় ৯ লক্ষ ঘরবাড়ি পুর্নর্নির্মাণ করেছেন। একই সময়ে সামগ্রিক পুনর্বাসন কর্মকাণ্ডে মােট ব্যয় ৭২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
জাতীয়করণ কর্মসূচি বঙ্গবন্ধুর সরকার স্বাধীনতার প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে (২৬.০৩.১৯৭২-এ) পাট,
বস্ত্র, চিনিকল, ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয়করণের আইন পাশ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক (জাতীয়করণ) আদেশের আওতায় সমস্ত শাখাসহ ১২টি ব্যাংকের দখলিস্বত্ত্ব সরকার গ্রহণ করে এবং সেগুলাে সমন্বয় করে ৬টি নতুন ব্যাংকে রূপান্তর করে। ৩.১.১৯৭২ তারিখে জারিকৃত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির ১নং আদেশ (APO1) এবং ২৮.২.১৯৭২ তারিখে ঘােষিত রাষ্ট্রপতির ১৬নং আদেশ (PO 16)-এর আওতায় অবাঙালি তথা পাকিস্তানি মালিকানার প্রায় ৮৫% শিল্প-কল-কারখানা ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান পরিত্যক্ত ঘােষণা করা হয় এবং রাষ্ট্র সেগুলাের মালিকানা এবং দখল গ্রহণ করে। এই পরিত্যক্ত সম্পত্তিগুলাে জাতীয়করণ আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত’ হিসেবে অভিহিত হয়। পরিত্যক্ত সম্পত্তি আদেশের (PO 16) আওতায় সম্পত্তির মালিকানা ফিরে পাওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করার সুযােগ ছিল কিন্তু জাতীয়করণকৃত সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার কোন সুযােগ ছিল না, কাউকে সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারেও সরকারের কোন ক্ষমতা ছিল না। জাতীয়করণ আইনের আওতায় ৬৭টি পাটকল, ৬৪টি বস্ত্রকল এবং ১৫টি চিনিকল জাতীয়করণ করা হয়। জাতীয় বিমান সংস্থা ও জাতীয় শিপিং সংস্থা—যা পূর্বেও সরকারি মালিকানায় ছিল—আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রায়াত্ত খাতের অধীনে আনা হয়। এভাবে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের স্থায়ী সম্পদ বিশিষ্ট পরিত্যক্ত ও অনুপস্থিত মালিকদের শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বৈদেশিক বাণিজ্য জাতীয়করণ করা হয়। | জাতীয়করণ কর্মসূচি বঙ্গবন্ধুর সরকার হঠাৎ করেই গ্রহণ করেননি। এটি ছিল সত্তরের নির্বাচনের সময় ঘােষিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। তাছাড়া ছাত্রদের ১১ দফা দাবিতেও দেশের পাট, বস্ত্র, চিনিকল ও ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয়করণের (৫নং দাবী) দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এমনকি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের দেয়া ঐতিহাসিক ২১-দফা কর্মসূচিতেও পাটশিল্প জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।
যেহেতু জাতীয়করণকৃত সম্পদের পূর্ব মালিকরা প্রায় সকলেই অবাঙালি ছিলেন স্বভাবতই বাঙালিদের পক্ষ থেকে জাতীয়করণ সমর্থন করা হয়। তবে বঙ্গবন্ধুর সরকারের পক্ষে জাতীয়করণ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না। দুর্বল আর্থসামাজিক অবকাঠামাে এবং জাতীয়করণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার মত রাজনৈতিক শাসনযন্ত্র সরকারের ছিল না। মওদুদ আহমদ আশঙ্কা প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন:
এমনকি ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মােজাফফর) এবং জাসদের মতাে সমাজতান্ত্রিক দলগুলােকেও এই আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং সমসাময়িক প্রশাসনিক কাঠামােতে এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযােগ দিলে তারা কতটুকু সফলকাম হতাে, সে নিয়েও
সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কৃষি সংস্কার
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক শাসনভার গ্রহণের সময় শতকরা ৮৫ ভাগ লােক কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। জাতীয় আয়ের অর্ধেকেরও বেশি ছিল কৃষিখাত নির্ভর। বঙ্গবন্ধু জানতেন যে কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে না পারলে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড
সােজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এজন্য তিনি সুবজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। কৃষক। বাঁচলে দেশ বাঁচবে’-এ শ্লোগানকে শুধু শ্লোগান হিসেবেই ব্যবহার করেনি বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বাধীন সরকার। মুক্তিযুদ্ধের পর ২২ লক্ষেরও বেশি কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসন করার দায়িত্ব বর্তেছিল। সে দায়িত্ব দক্ষতার সাথেই পালন করেছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। এই পুনবার্সন ছিল সত্যিকার অর্থেই পুনর্বাসন। শুধু বসতবাড়ির জন্য কয়েকটি টিন কিংবা একটি লাঙ্গল কেনার টাকা দিয়ে দায়সারাভাবে কাজ সারা হয়নি। তাদের কৃষিযন্ত্রপাতি ও অন্যান্য কৃষিবিষয়ক মৌলিক কাঠামাে নির্মাণে সহায়তাদানের পাশাপাশি নামমাত্র মূল্যে কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ, বীজ, সার, কীটনাশক সরবরাহ করেছিল । কৃষি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সংস্কার নিমে আলােচনা করা হলাে: (১) জমির সমস্ত বকেয়া খাজনা মওকুফসহ ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ
করেন (২৬.৩.১৯৭২); (২) পরিবার পিছু সর্বাধিক ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সিলিং নির্ধারণ করেন; (৩) দখলদার পাকিস্তানি শাসনামলে রুজু করা ১০ লক্ষ সাটিফিকেট মামলা থেকে
ঋণী কৃষককে মুক্তি দেয়া হয় এবং তাদের সকল বকেয়া ঋণ সুদসহ মাফ করে
দেয়া হয়; (৪) ১৯৭২ সালের শেষ নাগাদ সারাদেশে হ্রাসকৃতমূল্যে ৪০ হাজার শক্তিচালিত লাে
লিফট পাম্প, ২৯০০ গভীর নলকূপ ও ৩০০০ অগভীর নলকূপের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ ১৯৬৮-৬৯ সালের তুলনায় ১৯৭৪-৭৫ সনে এক তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ লক্ষ একরে উন্নীত হয়। সেচ সুবিধে বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকদের মধ্যে ১৯৭২ সালেই কেবল মাত্র অধিক ফলনশীল ১৬,১২৫টন ধানবীজ, ৪৫৪ টন পাট বীজ এবং ১,০৩৭ টন গম বীজ বিতরণ করা হয়। পাশাপাশি সারের দাম বিশ্ববাজারের চেয়ে হ্রাসকৃত মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭২ সালে ইউরিয়া, পটাশ ও টিএসপি সারের মূল্য মণ প্রতি ছিল যথাক্রমে ২০ টাকা, ১৫ টাকা ও ১০ টাকা। ফলে ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় ১৯৭৩-৭৪ সনে রাসায়নিক সারের ব্যবহার গড়ে ৭০ শতাংশ, কীটনাশক ৪০ শতাংশ, উন্নত বীজ ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ধান, পাট, তামাক ও আখসহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে এসব পণ্যের ন্যূনতম ন্যায্য বিক্রয়মূল্য ধার্য করে দেয়া হয়; কৃষি গবেষণাকেও বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব দেন। কৃষি বিষয়ক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও
গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলাে পুনর্গঠনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গৃহীত হয়; (৭) বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের আট মাসের মধ্যে গঙ্গা-কপােতাক্ষ সেচ প্রকল্প পুর্ণোদ্যমে
চালুর ব্যবস্থা করেন; (৮) ফারাক্কা বিষয়ে আলােচনার জন্য বঙ্গবন্ধু বিশিষ্ট পানি বিজ্ঞানী বি এম আব্বাসকে
২১.১.৭২ তারিখে দিল্লী পাঠান এবং শুকনাে মওসুমে পদ্মা নদীতে ৫৪,০০০
কিউসেক পানি সরবরাহের নিশ্চয়তা লাভ করেন। পরবর্তী কোন সরকারই সে
লক্ষ্য মাত্রার ধারে কাছেও যেতে পারেনি; (৯) সরকারিভাবে খাদ্য মজুদ গড়ে তােলার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের মধ্যেই ১০০টি খাদ্য।
গুদাম নির্মাণ করা হয়; (১০) কৃষকদের মধ্যে ১ লক্ষ বলদ ও ৫০ হাজার গাভী এবং ৩০ কোটি টাকার কৃষি
ঋণ বিতরণ করা হয়;
কৃষি উন্নয়নে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার জাতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু পুরস্কার’ নামে কৃষকদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার ঘােষণা করেন।
এভাবে কৃষক-দরদি নীতি গ্রহণের ফলে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয় তারই ফলশ্রুতিতে আজ কৃষি ক্ষেত্রে শক্তিশালী ধারা সৃষ্টি হয়েছে।
শিক্ষা সংস্কার | দেশের মানব সম্পদ উন্নয়নের উপর জাতীয় অগ্রগতি নির্ভরশীল। বঙ্গবন্ধু সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিবেশেও মানব সম্পদের উন্নতির লক্ষ্যে শিক্ষার বিকাশের উপর জোর দেন। এমনকি ১৯৭২ সালের সংবিধানেও সর্বজনীন শিক্ষা প্রবর্তনের অঙ্গীকার। সন্নিবেশিত হয়েছিল:
(১) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্তসকল বালক বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য, (২) সমাজের প্রয়ােজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়ােজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণােদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, (৩) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। শাসনভার গ্রহণের মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন নিয়ােগ করেন। কুদরত-ই-খুদা কমিশন দেড় বছর কঠোর পরিশ্রম করে ব্যাপক জরিপ ও পর্যালােচনা ভিত্তিক বাংলাদেশের শিক্ষা সংস্কারের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে একটি রিপাের্ট ১৯৭৪ সালের ৩০মে সরকারের নিকট দাখিল করেন।
| কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষানীতি ঢেলে সাজানাের উদ্যোগ বঙ্গবন্ধুই নিয়েছিলেন। কমিশন রিপাের্টের অপেক্ষা না করে তিনি কতিপয় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন যেমন :
মার্চ ৭১ থেকে ডিসেম্বর ৭১ পর্যন্ত সময়কালের ছাত্রদের সকল বকেয়া টিউশন ফি মওকুফ করেন; শিক্ষকদের ৯ মাসের বকেয়া বেতন পরিশােধ করেন; আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পুস্তক বিতরণ করেন এবং অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ঘােষণা করেন; বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে তিনি দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে
সরকারিকরণ করেন। এর ফলে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি। সরকারি হয়; বঙ্গবন্ধুর সরকার ৯০০ কলেজ ভবন ও ৪০০ হাইস্কুল পুনর্নির্মাণ করেন; বঙ্গবন্ধুর আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে জাতীয় সংসদে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্বায়ত্তশাসন। প্রদান। বঙ্গবন্ধু অফিস-আদালতে বাংলা প্রচলনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। সেনাবাহিনীসহ সকল অফিসে বাংলা চালু করা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা একাডেমিতে সাঁটলিপি, মুদ্রাক্ষর ও নথি লেখার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা হয়। জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সারমর্ম নিম্নরূপ
কমিশন প্রস্তাব করেন যে, দেশের জনগণকে জাতীয় কর্মে ও উন্নয়নে গঠনমূলক ভূমিকা। রাখার যােগ্য করে তােলার জন্য একটি সার্বজনীন শিক্ষা পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে।… এজন্য অন্তত আট বছরের বুনিয়াদী শিক্ষা প্রয়ােজন। এ কারণে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে প্রাথমিক শিক্ষারূপে গণ্য করে … প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত যে অবৈতনিক শিক্ষা চালু আছে তাকে ১৯৮০ সালের মধ্যে বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং ১৯৮৩ সালের মধ্যে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এক অভিন্ন ধরনের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করতে হবে। প্রয়ােজন মতাে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য নৈশ স্কুল চালু করতে হবে … মাধ্যমিক স্তর প্রসঙ্গে কমিশনের প্রধান সুপারিশ হল দেশের বাস্তব অবস্থা এবং শিক্ষার্থীদের পরিবেশ ও জীবন পদ্ধতি বিবেচনা করে এই স্তরের শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলাে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়ােজন। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর মধ্যে (১৪-১৭ বছর বয়সের) প্রায় সাড়ে চার লাখ শিক্ষার্থী প্রতিবছর পড়াশুনা ত্যাগ করে, কিন্তু জীবিকা অর্জনের সহায়ক কোন শিক্ষা তারা পায় না। কাজেই মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চ শিক্ষার প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়ােজন। প্রারম্ভিক বৃত্তিমূলক শিক্ষা মােটামুটি একাদশ শ্রেণী পর্যন্ত এবং সাধারণ শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত হবে । এই উদ্দেশ্যে নবম শ্রেণী থেকে শিক্ষাক্রম মূলত: দু’ভাগে বিভক্ত হবে: বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষা । উভয় ধারাতেই নবম ও দশম শ্রেণীতে কয়েকটি বিষয় অবশ্য পাঠ্য থাকবে, এ ছাড়া অন্য কতকগুলাে বিষয় শিক্ষার্থীরা স্বনির্বাচিত ধারায় বেছে নেবে। বৃত্তিমূলক ধারায় মাধ্যমিক শিক্ষা হবে তিন বছরের, সাধারণ ধারায়
হবে চার বছরের …. কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট বাস্তবায়নের পূর্বেই বঙ্গবন্ধু নিহত হন।
অর্থনৈতিক সংস্কার।
বঙ্গবন্ধু সরকার শাসনভার গ্রহণের পরপরই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, সরকার যত দ্রুত
প্রধান প্রধান শিল্প, ব্যাংক বীমা প্রতিষ্ঠান এবং বৈদেশিক বাণিজ্যেরও প্রায় ৮০% রাষ্ট্রায়ত্ত করে। ভূমি মালিকানার সর্বোচ্চ সিলিং ১০০ বিঘা এবং ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সরকার ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে। ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) কার্যকর হয়। প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনায় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করেছিল। এর দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য ছিল বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ে তােলা। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্যসমূহ বিশ্লেষণ করলে আমরা ঐ কমিশনের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দর্শন সম্পর্কে ধারণা লাভ করব । প্রথম পঞ্চবার্ষিকীর লক্ষ্য ছিল নিম্নরূপ : ১. পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য হবে দারিদ্র্য হ্রাস। আর লক্ষ্য অর্জনের কৌশল হিসেবে | বলা হয়েছিল: কর্মের সুযােগ বৃদ্ধি, এবং সমতা-ভিত্তিক বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য।
কার্যকর আর্থিক ও দ্রব্যমূল্য সংশ্লিষ্ট নীতিমালা ।।
অর্থনীতির প্রতিটি খাতে বিশেষত কৃষি ও শিল্পের পুনর্গঠন ও উৎপাদন বৃদ্ধি। ৩. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৩% থেকে ৫.৫%-এ উন্নীত করা। আর আনুষ্ঠানিক
খাতসমূহে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি উন্নয়নে স্বেচ্ছাশ্রমের বিকাশ। মানব শক্তি ও অর্থনৈতিক সম্পদের সর্বোচ্চ বিকাশের লক্ষ্যে উন্নয়নমুখী স্থানীয় সরকার কাঠামাে শক্তিশালী করা। নিত্য প্রয়ােজনীয় ভােগ্য পণ্য (বিশেষ করে খাদ্য, বস্ত্র, ভােজ্য তেল, কেরােসিন, চিনি) উৎপাদন বৃদ্ধি এবং এসবের বাজার মূল্য দরিদ্র জনগােষ্ঠীর হাতের নাগালে
রাখা এবং স্থিতিশীল করা (কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে)। ৫. বণ্টন নীতিমালা (পুনর্বণ্টনমূলক আর্থিক নীতিকৌশল) এমন রাখা যাতে দরিদ্র
জনগােষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির হার গড় আয় বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হয় (এবং উচ্চ
আয়ের মানুষদের এক্ষেত্রে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে)। ৬. অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের ভূমিকা তার ব্যবস্থাপনা ও সাংগঠনিক যােগ্যতা
দক্ষতার ভিত্তিতে নিরূপণ করা; গ্রাম-শহরে স্ব-কর্মসংস্থান সুযােগ বৃদ্ধি করা অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাের জনকল্যাণকামী পরিবর্তন সাধন করা। বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা। স্ব-নির্ভরতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোচ্চ সমাবেশ নিশ্চিত করা। বৈদেশিক মুদ্রার আহরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে রপ্তানি কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ ও বহুমুখী করা এবং আমদানি কাঠামাে পুনর্বিন্যাস করা। বিশেষ করে সার, সিমেন্ট এবং স্টিলের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বিদেশ নির্ভরতা ভিত্তিক অনিশ্চয়তা হ্রাস করা। কৃষির প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নিশ্চিত করা; খাদ্য উৎপাদনে
স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা। ৯. জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাসে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কমিটমেন্ট এবং সামাজিক চেতনা
বিকাশ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা। ১০. শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ গৃহায়ন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ বৃদ্ধির
মাধ্যমে মানুষের সাধারণ সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা। বঙ্গবন্ধু পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাঝপথে গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন পরিকল্পিতভাবে | বিনষ্টের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে পরিবার-পরিজনসহ হত্যা করা হয় । কিন্তু বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে কি হতাে? সে প্রশ্ন ড, আবুল বারকাতেরও। তার প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ উন্নয়ন দৌড়ে কোথায় দাঁড়াতাে?’ ড. বারকাত এই প্রশ্নের একটা উত্তরও কল্পনা করেছেন: ‘বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে এবং সেই সাথে গণতন্ত্র-জাতীয়তাবাদ| ধর্মনিরপেক্ষতা-সমাজতন্ত্র সংশ্লিষ্ট চার -দর্শনের ভিত্তিতে পরিকল্পিতভাবে অর্থনৈতিক
উন্নয়নের প্রবণতা যদি বহাল থাকতাে তাহলে … মােট জাতীয় আয়, মাথাপিছু জাতীয় আয় এবং মাথাপিছু প্রকৃত আয়ের যে পরিবর্তন ঘটতে পারতাে তা জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের আজকের মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে যেতাে।’ যা হােক, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু | নিমরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন: ১. প্রথম পাঁচশালা (১৯৭৩-৭৮) পরিকল্পনায় বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা ৬২%। | থেকে ১৯৭৭-৭৮ এর মধ্যে ২৭%-এ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন। ২. তিনি নতুন চারটি করপােরেশন গঠন করেন, যেমন: | (ক) বাংলাদেশ জুট করপােরেশন। (খ) বাংলাদেশ সুগার করপােরেশন (গ) বাংলাদেশ টেক্সটাইল করপােরেশন এবং
(ঘ) বাংলাদেশ গ্যাস অ্যান্ড অয়েল করপােরেশন। ৩. বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা ও বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন; এবং
বিভিন্ন ব্যাংকের ১০৫০টি নতুন শাখা স্থাপন করেন। | ৪. বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে এর ৩৩৫টি শাখা স্থাপন করেন; ৫. স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য নতুন মুদ্রা চালু করেন; ৬. তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের জন্য সাহায্যদাতা গােষ্ঠী গঠন করতে সক্ষম
হয়েছিলেন; ৭. গ্রাম বাংলার উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি (IRDP)-এর
উপর গুরুত্ব আরােপ করেন এবং বগুড়ায় পল্লী উন্নয়ন একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। ৮, বঙ্গবন্ধু ঘােড়াশাল সারকারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য
নতুন শিল্পস্থাপন, বন্ধ শিল্পকলকারখানা চালুকরণসহ অন্যান্য সমস্যা মােকাবিলা করে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামাে তৈরি করে দেশকে ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার জোর প্রয়াস গ্রহণ করেন। সরকারি কর্মচারী ও শ্রমিকদের কল্যাণার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ।
বঙ্গবন্ধুর শাসনভার গ্রহণের সময় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যে অর্থ ছিল তা দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু তবুও সদ্য স্বাধীন
দেশের মানুষের আকাক্ষার পরিপূরক হিসেবে বঙ্গবন্ধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কমিশন গঠন করে ১০ স্তর বিশিষ্ট নতুন বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করেন। তিনি শ্রমিকদের জন্যও নতুন বেতন কাঠামাে ঘােষণা করেছিলেন । শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু আন্তরিক ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১ মে তিনি মে দিবসে শ্রমিকদের মজুরির হার বৃদ্ধির ঘােষণা দেন।
যােগাযােগ ও অবকাঠামােগত উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ (ক) সড়ক ও রেল যােগাযােগের ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপ
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দিকেও গুরুত্ব দেন। তিনি ১৯৭৪ সালের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত সকল ব্রিজ-সেতু পুনর্নির্মাণ করেন। এবং অতিরিক্ত ৯৭টি নতুন সড়ক সেতু নির্মাণ করেন। ঢাকা-আরিচা রুটের বড় বড় সড়ক সেতুগুলাে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে নির্মিত হয়। সেসময় ধ্বংসপ্রাপ্ত রেল সেতুগুলােও চালু করা হয়। যমুনা। নদীর উপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা ছিল বঙ্গবন্ধুর এক বৈপ্লবিক প্রয়াস। তাঁর উদ্যোগে গঠিত কমিশন ১৯৭৪ সালের ৪ নভেম্বর যমুনা সেতুর প্রাথমিক সম্ভাব্যতা। রিপাের্ট প্রণয়ন করে (দ্রষ্টব্য, ইত্তেফাক: ২২.১.১৯৭৫)।
(খ) বিমান যােগাযােগের ক্ষেত্রে উন্নয়ন।
বঙ্গবন্ধুর সময়ে ১৯৭২ সালের ৭ মার্চের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকাযশাের ও ঢাকা-কুমিল্লা রুটে বিমান চালুর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক রুটেও। একটি বােয়িং সংযােজিত হয় এবং ১৯৭৩ সালের ১৮ জুন ঢাকা-লন্ডন রুটে বিমানের প্রথম ফ্লাইট চালু হয়। কুর্মিটোলার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে।
(গ) সমুদ্র ও নৌপরিবহন ক্ষেত্রে উন্নয়ন
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ শিপিং করপােরেশন গঠিত হয়। এই শিপিং করপােরেশন ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই কোষ্টারসহ ১৪টি সমুদ্রগামী জাহাজ সংগ্রহ করে। | (ঘ) বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সারা দেশে বিদ্যুৎ সাব স্টেশনগুলাে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল। অনেক স্থানে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন ও বিদ্যুৎ পােলগুলাে বিনষ্ট হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় গােডাউনগুলােতে বিদ্যুৎ খুঁটি ও তার কিছুই মজুদ ছিল না। এগুলাে ছিল আমদানিযােগ্য পণ্য। এমনি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের ক্ষেত্রে কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি ৫০০০ বিদ্যুৎ পােল আমদানি করেন এবং ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ১৫০০ কিমি বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করেন এবং বিদ্যুতের উৎপাদন ১৯৭২ সালে জানুয়ারিতে উৎপাদিত ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ থেকে ডিসেম্বরে ৫০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৩ সালে দেশব্যাপী পল্লী বিদ্যুৎ কর্মসূচি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়।
এবং এমনকি সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে পল্লী বিদ্যুতায়নের প্রতিশ্রুতি সন্নিবেশিত হয়।
(ঙ) টেলিযােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। | মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে টেলিযােগাযােগ ব্যবস্থা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই ৫৫,০০০ টেলিফোন চালুর ব্যবস্থা করেন। বহির্বিশ্বের সাথে টেলিযােগাযােগ স্থাপনের জন্য বঙ্গবন্ধু পাবর্ত্য চট্টগ্রামে উপগ্রহ ভূ-উপকেন্দ্র স্থাপনের কাজ সমাপ্ত করেন।
১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন।
বাংলাদেশ সংবিধান কার্যকর হবার পর (১৬.১২.৭২) গণপরিষদ ভেঙে দেয়া হয় এবং সরকার ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান ঘােষণা জারি করেন। নির্বাচনের তারিখ ঘােষিত হওয়ার পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী)-এর সভাপতি মওলানা ভাসানী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের আহ্বান জানান (৩১.১২.১৯৭২)। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) জন্মলগ্ন থেকেই সরকার বিরােধী কর্মকাণ্ড শুরু করে। ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি (মােজাফফর) ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি সরকারের প্রতি নমনীয় মনােভাব প্রদর্শন করে। ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের তৎপরতার সেসময় নিষিদ্ধ ছিল। নির্বাচনে জাতীয় সংসদের মহিলা আসনসহ ৩১৫টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩০৬, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ২টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ১টি এবং স্বতন্ত্র সদস্যরা ৬টি আসনে জয়লাভ করেন।
আদমশুমারি অনুষ্ঠান। | বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে আর্থিক সংকট ও নানান ব্যস্ততার মাঝেও ১৯৭৪ সালের ৮ জুন বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারি সম্পন্ন করেন।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপ। (ক) সরকার গঠনের তিনদিনের মধ্যেই (১৫.১.১৯৭২) বঙ্গবন্ধু এক সরকারি
আদেশের মাধ্যমে দেশে মদ, জুয়া, হাউজি ও ঘােড়া দৌড় নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। তিনি একই সাথে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানকে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান।
হিসেবে ঘােষণা করেন। (খ) বঙ্গবন্ধু ২৪.৫.১৯৭২ তারিখে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে
ঢাকায় আনেন; (গ) ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ৯টি বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের
সাংস্কৃতিক চুক্তি সম্পাদন করেন; (ঘ) তিনি ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। (ঙ) ১৯৭৫ সালের ৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্থায়ী
নতুন ভবন উদ্বোধন করেন; (চ) ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’—এই আদর্শে বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু ইসলাম
সম্পর্কে গবেষণার লক্ষ্যে ২০.৩,৭৫ তারিখে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার জন্য এক অধ্যাদেশ জারি করেন। তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা বাের্ড পুনর্গঠন করেন।
বাংলাদেশের তবলীগ জামাতের কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ সম্প্রসারণের ব্যবস্থা
করেন। টংগীতে তবলীগের বিশ্ব ইজতেমার স্থান করে দেন। (ছ) ১৫.১২.৭৪ তারিখে বঙ্গবন্ধু দুঃস্থ শিল্পী সংস্কৃতিসেবীদের কল্যাণার্থে সরকারিভাবে
‘বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতিসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। (জ) ৭.৮.৭৫ তারিখে দুঃস্থ ক্রীড়াবিদদের কল্যাণার্থে ‘বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ
ফাউন্ডেশন’ গঠিত হয়। নারীদের কল্যাণে গৃহীত ব্যবস্থা
বঙ্গবন্ধু দুস্থ মহিলাদের কল্যাণের জন্য ১৯৭২ সালে নারী পুনর্বাসন বাের্ড প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৪ সালে এই বাের্ডের কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করে নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ সৃষ্টি করেন। চাকরির সকল ক্ষেত্রে নারীর জন্য তিনি ১০ ভাগ কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে তিনি ড. নীলিমা ইব্রাহীমকে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে নিয়ােগ দেন এবং মিসেস বদরুনেসা আহমেদ ও বেগম নূরজাহান মুরশিদকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। | প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ়করণে পদক্ষেপ গ্রহণ।
(ক) সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সৃদৃঢ় করার দিকেও বঙ্গবন্ধুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। তাঁর সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তিনি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে আধুনিক ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন । ৬.৩.১৯৭২ তারিখে তিনি বিডিআর গঠনের আদেশ জারি করেন। বঙ্গবন্ধু ৮.৪.১৯৭২ তারিখে পদাতিক বাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন । ১১.৩.১৯৭৪ তারিখে তিনি কুমিল্লায় বাংলাদেশের প্রথম সামরিক একাডেমী উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু যুগােশ্লাভিয়া থেকে ক্ষুদ্র অস্ত্রশস্ত্র ও সাঁজোয়া বাহিনীর জন্য ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করেন। সােভিয়েট ইউনিয়ন থেকে সংগ্রহ করেন মিগ বিমান, হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমান। তিনি ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য থেকে বিমান বাহিনীর জন্য হেলিকপ্টার ক্রয় করেন। তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে মিশর থেকে সংগৃহীত হয় সাঁজোয়া গাড়ি বা ট্যাংক (যা পরবর্তীকালে তাঁকে হত্যা করতে খুনিরা ব্যবহার করে)। সেনাবাহিনীর জন্য পােশাক ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার ভারতের কাছ থেকে ৩০ কোটি টাকা অনুদান হিসেবে লাভ করে। উন্নত প্রশিক্ষণ লাভের জন্য বঙ্গবন্ধু সামরিক অফিসারদেরকে বিদেশে প্রেরণ করেন। | বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনকারী ৩০ হাজারের অধিক সামরিক কর্মকর্তা ও জওয়ানদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পুনর্বাসিত করেন। | (খ) বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের স্বার্থে বঙ্গবন্ধু প্যারা মিলিশিয়া বাহিনী হিসেবে জাতীয় রক্ষী বাহিনী গঠন করেন। রক্ষীবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল সেনাবাহিনীর ৬ ভাগের ১ ভাগ। মুক্তিযােদ্ধাদের ফেরত দেয়া অস্ত্রে তাদেরকে সজ্জিত করা হয়েছিল।
পররাষ্ট্রনীতিতে সাফল্য অর্জন
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীন-স্বকীয়তার পরিচয় দেন। তিনি কোন পরাশক্তির চোখরাঙানি কিংবা পার্শ্ববর্তী কোন দেশের সন্তুষ্টি বিধানকে প্রাধান্য দিয়ে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেননি। তার পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা ছিল শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান এবং সকলের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। বঙ্গবন্ধু যখনই কোন আন্তর্জাতিক ফোরাম (জাতিসংঘ, জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন, কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধান সম্মেলন, ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার শীর্ষ বৈঠক ইত্যাদি) কিংবা দেশে গেছেন, তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে তার জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ঘােষণা করেছেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, তাতে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির মূল বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,
বাংলাদেশ প্রথম হইতেই শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, এই নীতিমালার উপর ভিত্তি করিয়া জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করিয়াছে । কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই কষ্টলব্ধ জাতীয় স্বাধীনতার ফলভােগ করিতে আমাদেরকে সক্ষম করিয়া তুলিবে এবং সক্ষম করিয়া তুলিবে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রােগ, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করিবার জন্য আমাদের সকল শক্তি ও সম্পদকে সমাবেশ ও কেন্দ্রীভূত করিতে । এই ধারণা হইতে জন্ম নিয়াছে শান্তির প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি। এইজন্য সমঝােতার অগ্রগতি, উত্তেজনা প্রশমন, অস্ত্র সীমিতকরণ এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতির সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরােপ, ল্যাটিন আমেরিকা তথা বিশ্বের যে কোন অংশে যে কোন প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হউক না কেন আমরা তাহাকে
স্বাগত জানাই।’ পররাষ্ট্র নীতিতে বঙ্গবন্ধু সাফল্য অর্জন করেন। যেমন: (ক) সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৩৫ দিনের মধ্যেই (১৪.৩.১৯৭২)
তিনি বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক উদ্যোগের ফলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট ৪.৪.৭২ তারিখে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে; বঙ্গবন্ধুর সরকার ১০.৫.১৯৭২ তারিখে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে মাসে ঢাকায় বিশ্ব শান্তি পরিষদের উদ্যোগে এশিয়া শান্তি
সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু ‘জুলিও কুরী’ পদক লাভ করেন। | (ঙ) ১৭.৯,৭৪ তারিখে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। (চ) ২৫.৯.৭৪ তারিখে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলা
ভাষায় ভাষণ দান করে বাঙালির মাতৃভাষার মর্যাদাকে বিশ্বের দরবারে উন্নত
করেন। (ছ) বঙ্গবন্ধুর দক্ষ কূটনৈতিক উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে ১২১টি দেশের
(গ)
স্বীকৃতি লাভ করে। তাছাড়া বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্য ও ইসলামি পররাষ্ট্র সম্মেলনের সদস্যপদসহ ১৪টি আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্যপদ লাভ করে । মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংরক্ষণ
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের স্মরণে সাভার ও মেহেরপুরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ প্রকল্প অনুমােদন করেন (৯.৩.১৯৭২)। ১৬.১২.৭২ তারিখে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের এবং ২২.১২.৭২ তারিখে ঢাকার মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি স্তম্ভের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
মুক্তিযােদ্ধাদের কল্যাণে গৃহীত ব্যবস্থা এবং মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন
বঙ্গবন্ধু প্রতিটি শহীদ পরিবারকে আর্থিক অনুদান প্রদানের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য তিনি গঠন করেন মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। ১৫.১.৭৩ তারিখে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বীর মুক্তিযােদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় বিশেষ খেতাব প্রদানের তালিকা সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। বঙ্গবন্ধু ৭ জন বীর মুক্তিযােদ্ধাকে বীর শ্রেষ্ঠ, ৬৮ জনকে বীর উত্তম, ১৭৫ জন মুক্তিযােদ্ধাকে বীর বিক্রম এবং ৪২৬ জন মুক্তিযােদ্ধাকে বীর প্রতীক পদক প্রদান করেন। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল (অব:) আতাউল গণি ওসমানীকে জেলারেল এবং চিফ অব স্টাফ কর্ণেল (অব:) আব্দুর রবকে মেজর জেনারেল পদে ভূষিত করেন। | বঙ্গবন্ধু সরকারের কিছু সমালােচিত পদক্ষেপ (ক) বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইন নামে একটি আইন প্রণয়ন করে। এই আইনে নিবর্তনমূলক আইনের বিধান রাখা হয়। অর্থাৎ সরকার যে কোনাে ব্যক্তিকে ক্ষতিকর কার্য থেকে বিরত রাখার জন্য আটক রাখতে পারবে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তার কারণ অবহিত করা, ও আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার দেয়া হয়। এই আইনের ১৫ ধারা বলে ক্ষতিকর ধবংসাত্মক কাজ, ১৬ নং ধারা বলে ক্ষতিকর রিপাের্ট প্রকাশ, ১৭ ও ১৮ নং ধারা বলে কোনাে দলিল তৈরি, মুদ্রণ বা প্রকাশনা এবং কতিপয় বিষয় প্রকাশনা থেকে যে কোন ব্যক্তিকে বা সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯ ও ২০ নং ধারা বলে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ কোনাে সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করার বিধান করা হয়। ২৪ নং ধারা বলে। সাক্ষ্য আইন জারির ক্ষমতা, ২৫ নং ধারার মাধ্যমে মজুদদারি, কালােবাজারি, চোরাচালানি, ভেজাল দেয়া, মুদ্রা বা স্ট্যাম্প জাল করা ইত্যাদি বিষয় নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীকে সাজা প্রদানের বিধান করা হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইনে সমাজবিরােধী তৎপরতা রােধের জন্য করা হয়েছিল। এ আইন অদ্যাবধি কোন সরকারই বাতিল। করেনি বা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
(খ) রক্ষীবাহিনী গঠন
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের পুলিশ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত নিরাপত্তা
বাহিনী ছিল না। সেনাবাহিনীও তখন সুসংগঠিত ছিল না। বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করার জন্য সেনাবাহিনীর সাহায্য লাভের সুযােগ ছিল না। এমনি অবস্থায় ষড়যন্ত্রকারীরা দেশে নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি করলে সরকার জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের চিন্তাভাবনা করতে থাকে। উদ্দেশ্য ছিল এই বাহিনী পুলিশকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করবে। প্রয়ােজনবােধে সেনাবাহিনীকেও সাহায্য করবে। তবে এই বাহিনী থাকবে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৭২ সালের ৭ মার্চ জাতীয় রক্ষীবাহিনী আদেশ’ প্রণয়ন করা হয় (রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২১, ১৯৭২) তবে তা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর করা হয়। এই আইনের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, ‘সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়ােজনবােধে এই বাহিনীকে অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলার কাজে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করার জন্য নিয়ােগ করতে পারবে। সরকার আহ্বান করলে এই বাহিনী সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করবে এবং সরকার নির্দেশিত অন্যান্য দায়িত্ব পালন করবে।’ ঐ আইনে ১৬ নং অনুচ্ছেদে বাহিনীর পরিচালক ও অফিসারদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। ১৭ নং অনুচ্ছেদে সরকারকে রক্ষীবাহিনীর জন্য আইন প্রণয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশাসন, হুকুমদান, নিয়ন্ত্রণ কিংবা শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষমতা দেয়া হয়। ৮নং অনুচ্ছেদে। বিধান রাখা হয় যে, ফৌজদারী দণ্ডবিধি বা অন্য যে কোন আইনের পরিপন্থী না হলে রক্ষীবাহিনীর যে কোন সদস্য বা অফিসার ৮নং অনুচ্ছেদ বলে বিনা ওয়ারেন্টে (১) যে কোন আইনের পরিপন্থী অপরাধে লিপ্ত থাকার সন্দেহবশত যে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার, (২) যে কোন ব্যক্তি, স্থান, যানবাহন, নৌযান ইত্যাদি তল্লাশ বা আইন শৃঙ্খলা বিরােধী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, এমন যেকোন সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করতে পারবেন …’। রক্ষীবাহিনীর মূল্যায়ন প্রসঙ্গে মওদুদ আহমদ লিখেছেন:
যাই হােক জাতীয় রক্ষীবাহিনী কোন ভালাে কাজই করেনি, একথা ঠিক নয়। বিপুল পরিমাণে বেআইনী অস্ত্র এরা উদ্ধার করেছে এবং আটক করেছে প্রচুর পরিমাণে। চোরাচালানকৃত পণ্য । কালােবাজারী এবং অবৈধ গুদামজাতকারী রক্ষীবাহিনীর নাম | শুনেই আতঙ্কবােধ করতাে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর রক্ষীবাহিনী ভেঙে দেয়া হয়। | (গ) বাকশাল গঠন।
আমরা সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী আলােচনা প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, উক্ত সংশােধনীর মাধ্যমে দেশের রাষ্ট্রপতিকে প্রয়ােজনমতাে দেশে একমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের ক্ষমতা দেয়া হয়। উক্ত দলের নামকরণ, কর্মসূচি প্রণয়ন ইত্যাদি ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। এভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল) নামক একটি একক জাতীয় দল গঠনের কথা ঘােষণা করেন। তিনি এর চেয়ারম্যান এবং বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ দলীয় সকল সংসদ সদস্য ও সকল মন্ত্রী এর সদস্য বলে গণ্য হন। রাষ্ট্রপতি ১৯৭৫ সালের ৬ জুন বাকশালের গঠনতন্ত্র ঘােষণা করেন । গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় দলের ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি এবং ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যগণের নামও ঘােষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কার্যনির্বাহী কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটি উভয়েরই সভাপতি এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী দলের সেক্রেটারি জেনারেল মনােনীত হন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সশস্ত্রবাহিনীর তিন প্রধান, তিনজন উপাচার্য, তিনজন সংবাদ সম্পাদক, রক্ষী বাহিনীর প্রধান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, চিকিৎসক ও সংসদ সদস্য অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। গঠনতন্ত্র অনুসারে বাকশালের ৫টি অঙ্গসংগঠন ছিল। (১) জাতীয় কৃষক লীগ, (২) জাতীয় শ্রমিক লীগ, (৩) জাতীয় মহিলা লীগ, (৪) জাতীয় যুবলীগ, ও (৫) জাতীয় ছাত্রলীগ। চেয়ারম্যানকে অন্যান্য ক্ষেত্রেও অঙ্গসংগঠন ও সংস্থা ইত্যাদি গঠন করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এসব অঙ্গসংগঠন কার্যনির্বাহী কমিটির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজ করবে মর্মে স্থির হয়। ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সভায় রাষ্ট্রপতি এক নতুন প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার কথা ঘােষণা করেন। এই নতুন ব্যবস্থায় বাংলাদেশের মহকুমাগুলােকে জেলায় রূপান্তরিত করে ৬০টি নতুন জেলা গঠন করে প্রতিটি জেলায় একজন গভর্নর নিয়ােগের ও এক একটি প্রশাসনিক পরিষদ গঠনের বিধান করা হয়। জেলা গভর্নর হবেন পরিষদের প্রধান। এ ব্যবস্থা ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারণে বাকশাল কর্মসূচি কার্যকর হতে পারেনি। তাই এর ভাল-মন্দ মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তবে বাকশাল প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তার পক্ষে বঙ্গবন্ধু যে যুক্তি উপস্থাপন করেন তা এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী গ্রহণের প্রাক্কালে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন যে, দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি, শশাষণহীন সমাজব্যবস্থা এবং শােষিতের সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মহৎ লক্ষ্যেই সংবিধানে সংশােধনী আনা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিলাে। তিনি বলেন দেশে বর্তমানে যে নৈরাজ্যকর অবস্থা চলছে তা আর চলতে দেয়া যায় না। তিনি সংসদকে লক্ষ্য করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সকল নির্বাহী ও প্রশাসনিক ক্ষমতা তার নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকা সত্ত্বেও জনগণের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা ও সকল শশাষণ-অবিচারনির্যাতন দূরীকরণের অপরিহার্য প্রয়ােজনেই সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন আনা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিলাে। বঙ্গবন্ধু একটি দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের মানুষের
ওপর সামগ্রিক শশাষণ অপসারণের দৃঢ় প্রত্যয় ঘােষণা করেন। বাকশাল অর্থ কেবল একটি একক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা নয় । বাকশাল গঠনের মাধ্যমে কিছু সুনির্দিষ্ট সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সােহরাওয়ার্দী ময়দানে আয়ােজিত বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু যে দীর্ঘ ভাষণ দেন তাতে বাকশাল কর্মসূচির বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলাে নিমে উল্লেখ করা হলাে : (১) “কেন সিস্টেম পরিবর্তন করলাম? সিস্টেম পরিবর্তন করেছি দুঃখী মানুষের মুখে
হাসি ফোটাবার জন্য। সিস্টেম পরিবর্তন করেছি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার জন্য।’ (২) “হ্যা, প্রেসিডেন্সিয়াল ফরম অব গভর্নমেন্ট করেছি। জনগণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
করবে। পার্লামেন্ট থাকবে। পার্লামেন্টের নির্বাচনে একজন, দুইজন, তিনজনকে নমিনেশন দেওয়া হবে। জনগণ বাছবে কে ভালাে কে মন্দ। আমরা চাই
শােষিতের গণতন্ত্র, আমরা চাই না শােষকের গণতন্ত্র । এটা পরিষ্কার। (৩) (আমাদের লক্ষ্য) : এক নম্বর হলাে দুর্নীতিবাজ খতম করা। দুই নম্বর হলাে,
কলে-কারখানায়, ক্ষেতে খামারে প্রােডাকশন বাড়ানাে। তিন নম্বর হলাে, পপুলেশন পানিং। চার নম্বর হলাে, জাতীয় ঐক্য । ‘জাতীয় ঐক্য গড়বার জন্য একদল করা হয়েছে। যারা বাংলাদেশ ভালবাসে, এর আদর্শে বিশ্বাস করে, চারটি রাষ্ট্রীয় আর্দশ মানে, সৎ পথে চলে তারা সকলেই এই দলের সদস্য হতে পারবে। যারা বিদেশি এজেন্ট, যারা বহিঃশত্রুর কাছ থেকে পয়সা নেয়, এতে তাদের স্থান নেই। সরকারি কর্মচারীগণও এই দলের সদস্য। হতে পারবে। কারণ, তারাও এই জাতির একটা অংশ। তাদেরও অধিকার থাকবে এই দলের সদস্য হওয়ার । এই জন্য সকলে যে যেখানে আছি, একতাবদ্ধ হয়ে দেশের কাজে লাগতে হবে।। ‘এই জাতীয় দলের আপাতত পাঁচটা ব্রাঞ্চ হবে। একটা শ্রমিক ভাইদের অঙ্গদল, কৃষক ভাইদের একটা, যুবক ভাইদের একটা, ছাত্রদের একটা এবং মহিলাদের একটা। এই পাঁচটা অঙ্গদল মিলে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। “যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, তাতে গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না যে, জমি। নিয়ে যাব। তা নয়। পাচ বৎসরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটি করে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে এই কো-অপারেটিভ। এর জমি। মালিকের থাকবে। কিন্তু তার ফসলের অংশ সবাই পাবে। প্রত্যেকটি বেকার, প্রত্যেকটি মানুষ, যে মানুষ কাজ করতে পারে, তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলি বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রােগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিলে যারা টাউট আছেন, তাদেরকে বিদায় দেওয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানাে যাবে
। এই জন্যেই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘােষণা করছি আজকে যে, পাঁচ বৎসরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচ শত থেকে এক হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত নিয়ে কম্পালসারি কো অপারেটিভ হবে। আপনার জমির ফসল আপনি নেবেন, অংশ যাবে কো-অপারেটিভের হাতে, অংশ যাবে গভর্নমেন্টের হাতে। | দ্বিতীয়ত থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে। এই কাউন্সিলে। রাজনৈতিক কর্মী বা সরকারি কর্মচারি যে-ই হন, একজন তার চেয়ারম্যান হবেন। এই থানা কাউন্সিলে থাকবে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সরকারি কর্মচারী, তার মধ্যে আমরা কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি থাকবে, যুব প্রতিনিধি থাকবে,
কৃষক প্রতিনিধি থাকবে। তারাই থানাকে চালাবে। | আর, জেলা থাকবে না, সমস্ত মহকুমা জেলা হয়ে যাবে। সেই মহকুমায় একটি করে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল হবে। তার চেয়ারম্যান থাকবে। সব কর্মচারী এক সঙ্গে তার মধ্যে থাকবে। এর মধ্যে পিপলস রিপ্রেজেন্টেশন থাকবে। পার্টি রিপ্রেজেন্টশন থাকবে। সেখানে তারা সরকার চালাবে। এইভাবে আমি একটা সিস্টেম চিন্তা করেছি এবং করব বলে ইনশাআল্লাহ আমি ঠিক
করেছি। আমি আপনাদের সাহায্য ও সহানুভূতি চাই।’ (৭) আর একটা কথা বলতে চাই। বাংলাদেশের বিচার ইংরেজ আমলের বিচার।
আল্লাহর মর্জি যদি সিভিল কোর্টে কেস পড়ে, সেই মামলা শেষ হতে লাগে ২০ বছর। আমি যদি উকিল হই, আমার জামাইকে উকিল বানিয়ে কেস দিয়ে যাই। ওই মামলার ফয়সালা হয় না। আর যদি ক্রিমিনাল কেস হয়, তিন বছর, চার বছরের আগে শেষ হয় না। এই বিচার বিভাগকে নতুন করে গড়তে হবে । থানায় ট্রাইবুনাল করবার চেষ্টা করছি। সেখানে যাতে মানুষ এক বছর, দেড় বছরের মধ্যে বিচার পায়, তার বন্দোবস্ত করছি। আশা করি সেটা হবে।’
বঙ্গবন্ধু এই কথাগুলােই হলাে বাকশাল কর্মসূচি। এগুলাে বাস্তবায়ন করা গেলে ফল ভাল হতাে না, মন্দ হতাে তা এখন বলা সম্ভব নয়। কারণ বাকশাল কর্মসূচি তাে আলাের মুখ দেখেনি। দেখতে দেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাকশাল কর্মসূচির অকাল মৃত্যু ঘটানাে হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন উঠে আসে: বাকশাল কর্মসূচি কাদের স্বার্থে আঘাত হানতাে? মওদুদ আহমদ সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ।
সমাজের অত্যন্ত প্রভাবশালী একটা অংশ এতে আতঙ্কিত বােধ করে। প্রকৃত পক্ষে শেখ মুজিবের ব্যাপক কর্মসূচিতে সমাজের প্রতিটি প্রভাবশালী শ্রেণীরই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান ছিল। গ্রামীণ নেতৃত্বের ধ্বজাধারী গ্রামীণ এলিট শ্রেণী, সমবায় ব্যবস্থাধীনে জমির মালিকানা হারাবার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, আমলারাও তাদের উপর স্থাপিত একক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে মেনে নিতে পারেননি। সেনাবাহিনীকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জাতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়ােজিত করা হয়। বিচারবিভাগকে নির্বাহী বিভাগের অধঃস্তন করে তােলায় তা বিচারক এবং আইনজীবীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। সর্বোপরি আওয়ামী লীগ সেই দলের পক্ষ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাও সাবেক দলীয় প্রতিষ্ঠানের অপমৃত্যু ঘটায় নিদারুণ অস্বস্তির শিকার
হল।’ বঙ্গবন্ধুর বাকশাল কর্মসূচির বাস্তবায়িত না হলেও বাকশাল কর্মসূচি ঘােষিত হওয়ার পরবর্তী কয়েক মাসে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শুভ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। যেমন :
১৯৭৫ সালের জুন মাস নাগাদ দেশের অর্থনীতিতে মােটামুটি একটা স্থিতিশীলতার প্রভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে … মুদ্রা সরবরাহ ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ৯৩৭.৭৬ কোটি টাকা থেকে হ্রাস পেয়ে ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ৮১৪.৩৩ কোটি টাকায় নেমে আসে এবং একই সময়ের ব্যবধানে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ১১১.৪৯ কোটি টাকা থেকে ৩৫০,৮০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। খাদ্য শস্যের মজুদ পরিস্থিতি
অনুকুলে চলে আসায় চালের মূল্যে নিমমুখী প্রবণতা পরিলক্ষিত হতে থাকে। আরাে কতিপয় নিত্যপ্রয়ােজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্যও নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে থাকে। জুন মাস নাগাদ চালের দাম জানুয়ারী মাসে সের প্রতি ৮ টাকা থেকে কমে ৫.৫০ টাকায়, লংক্লথ গজপ্রতি ১৩ টাকা থেকে ১১.৫০ টাকায়, সরিষার তেল সের প্রতি ৪১.৬৮ টাকা থেকে ৩০.৩৭ টাকায়, আলু সের প্রতি ২.০৫ টাকা থেকে ১৫০ টাকায়, রুই মাছ ১৪.১৪ টাকা থেকে ১০ টাকায় এবং কেরােসিন তেল ১.৪০ টাকা থেকে ১২০ টাকায় নেমে আসে। এতে করে জীবনযাত্রার ব্যয় ভারেও উন্নতির প্রভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে। ঢাকা শহরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাত্রার ব্যয়সূচক জানুয়ারী মাসের ৪৫৮.৫ থেকে এপ্রিল মাসে ৪১৬.৯ এ এবং খাদ্যমূল্য সূচক একই সময়ে ৫৪৬.৩ থেকে ৪৫৯.০-এ হ্রাস। পায়। পরিস্থিতির উন্নতি চক্রান্তকারীদের ভীতসন্ত্রস্ত করে। তারা আর কাল বিলম্ব না করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে।
(ঘ) ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ  বঙ্গবন্ধু সরকারকে আরেকটি সমালােচনার সম্মুখীন হতে হয় ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে। উক্ত দুর্ভিক্ষের জন্য উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত খাদ্য ঘাটতি, মুক্তিযুদ্ধের সময় সৃষ্ট খাদ্য ঘাটতি, ১৯৭২-৭৪ সময়ের খরা, বন্যা ও দেশী-বিদেশী চক্রান্ত কতটা দায়ী তা বিবেচনায় না নিয়ে একতরফাভাবে বঙ্গবন্ধু সরকারকে দায়ী করে অপপ্রচার চালানাের একটা প্রবণতা চলে আসছে। পাকিস্তান আমলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্য ঘাটতি অব্যাহত ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। খাদ্য ঘাটতি ১৯৫০ সালের ৫ লাখ টন থেকে বেড়ে ষাটের দশকের শেষের দিকে প্রায় ১৫ লাখ টনে উন্নীত হয়। ১৯৬৮, ১৯৬৯ এবং ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ বন্যা হয় তার ফলে ১৯৭০ সালে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ২২ লক্ষ টনে পৌছায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কৃষি কাজ ব্যাহত হওয়া ও বন্যায় ১৪ হাজার বর্গমাইল এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হলে খাদ্য ঘাটতি কমপক্ষে ৪০ লক্ষ টনে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় ১৯৭২ সালের খরায় আউশ ধানের ব্যাপক ক্ষতিসাধন, ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনায় ব্যাপক জলােচ্ছাসে মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া, ১৯৭৪ সালের ডবল বন্যায় (এপ্রিল মাসে সিলেটে এবং জুলাইআগস্টে সারা দেশে) প্রায় ১ কোটি টন ফসল নষ্ট হওয়ার ফলেই ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সেসময় আন্তর্জাতিকভাবে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যসাহায্য পাওয়া যায়নি। উপরন্তু দেশের যােগাযােগ ব্যবস্থা সেসময় খারাপ থাকায় খাদ্য পরিবহনেও সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তাছাড়া মজুদদারি ও চোরাচালান খাদ্য সংকট ভয়াবহ করে তােলে। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি থেকে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। জুন মাসে যেখানে প্রতি সের মােটা চাউলের মূল্য ছিল ৩,৯০ টাকা, আগস্ট মাসে তা’ হয় ৪.৭৮ টাকা, সেপ্টেম্বরে ৬ টাকা এবং অক্টোবর মাসে ৭.১৬ টাকায় উন্নীত হয়। সরকার পরিস্থিতি মােকাবিলা করার জন্য সারাদেশে ৫,৭০০টি লঙ্গরখানা চালু করেছিল। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও উক্ত দুর্ভিক্ষে সরকারি হিসাব মতে ২৭,৫০০ জন লােকের মৃত্যু ঘটেছিল।
বেসরকারি হিসেব মত তা তিনগুণেরও বেশি ছিল। ১৯৭৪ মালের নভেম্বর মাসেই পরিস্থিতি অনুকূলে চলে আসে।
(ঙ) ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি ১৯৭২।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতে অবদানের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের কাছেই পাকিস্তান বাহিনী। পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। সেই ভারতীয় বাহিনীকে ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়। এটি বঙ্গবন্ধুর বড় কৃতিত্ব । এরপর ১৭ মার্চ (১৯৭২) ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে আসেন। এ সফরের সময় (১৯ মার্চ) তিনি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নবায়নযােগ্য একটি ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী, সহযােগিতা ও শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এর মাধ্যমে ‘বন্ধুত্ব, রক্ত ও আত্মদানের মধ্য দিয়ে দু’দেশের গড়ে ওঠা সম্পর্ক আনুষ্ঠানিক ভিত্তি অর্জন করে। চুক্তিতে ১০টি মৌলিক উদ্দেশ্য ও ১২টি অনুচ্ছেদ ছিল । চুক্তির ভিত্তি ছিল উভয় দেশের সাধারণ আদর্শ, যথা শান্তি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। চুক্তির প্রস্তাবনায় সম্ভাব্য সকল রকমের পারস্পরিক সহযােগিতার ভিত্তিতে উভয় দেশের সীমান্তকে চিরন্তন শান্তি ও বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। চুক্তির শর্তগুলাে ছিল নিমরূপ: | (১) উভয় দেশ নিজ নিজ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগােলিক অখণ্ডতা বজায়
রেখে একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে; (২) উভয় পক্ষ সারা বিশ্বের উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদ বিরােধী ও জাতীয়
মুক্তির জন্য সংগ্রামরত জনসমষ্টির সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে তাদের সর্বতােভাবে সমর্থন প্রদান করবে; ‘উভয়পক্ষ তাদের জোটনিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে অটল
থাকবে; (৪) “যেকোন আন্তর্জাতিক সমস্যায় উভয়পক্ষের স্বার্থে তারা পরস্পরের সাথে
নিয়মিত যােগাযােগ ও মতবিনিময় করবেন’; ‘উভয়পক্ষ প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক এবং কারিগরি ক্ষেত্রে এবং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য পরিবহন ও যােগাযােগ ক্ষেত্রে যােগাযােগ বৃদ্ধি করবে এবং পরস্পরের স্বার্থ রক্ষা করবে; ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদীসমতল উন্নয়ন, জলবিদ্যুৎ, বিদ্যুৎ ও সেচব্যবস্থা উন্নয়নে যৌথ সমীক্ষা চালাবে’; ‘উভয়পক্ষ সাহিত্য, শিল্পকলা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সম্পর্ক
অব্যাহতভাবে ভাল রাখবে’; (৮) কোন এক পক্ষ অপরপক্ষের সঙ্গে বিবাদরত কোনাে শক্তির সাথে সামরিক
মৈত্রী স্থাপন থেকে বিরত থাকবেন, একে অপরের ওপর কোন আগ্রাসনমূলক তৎপরতা পরিচালনা করবেন না এবং নিজ ভূখণ্ডে এমন কোনাে সামরিক
আয়ােজনে ব্যস্ত থাকবেন না যা অপর পক্ষের জন্য সামরিক ক্ষতি বা নিরাপত্তার উপর হুমকী হয়ে দাঁড়াতে পারে’; ‘উভয় পক্ষ অপর পক্ষের সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামে যে কোন তৃতীয় পক্ষকে সহযােগিতা দানে বিরত থাকবে। কোন কারণে এক পক্ষ অন্য আরেক পক্ষ দ্বারা আক্রান্ত হলে বা আক্রান্ত হবার হুমকীর সম্মুখীন হলে উভয় পক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে পারস্পরিক মতবিনিময়ের জন্য আলােচনায় বসে তাদের। শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেই আক্রমণ বা হুমকী নিরসনে কার্যকর
ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। (১০) কোন পক্ষ এই চুক্তির পরিপন্থী হয় এমন কোনাে বিষয়ে কোনাে এক বা
একাধিক দেশের সঙ্গে প্রকাশ্যে বা গােপনে যে কোনাে রকমের প্রতিশ্রুতি
প্রদান থেকে বিরত থাকবেন। আলােচ্য চুক্তিকে বঙ্গবন্ধুর সমালােচকরা ‘গােলামির চুক্তি’ বলে সমালােচনা করে । কিন্তু চুক্তির ধারাগুলাে পর্যালােচনা করলেই দেখা যাবে যে, বঙ্গবন্ধুর ঐ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের মর্যাদা সামান্যতমও কমাননি। চুক্তিটি গােলামির হয়ে থাকলে ১৯৭৫১৯৯৬ সময়কালে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা তা বাতিল করতে পারতেন।
অতএব বলা যায়, বঙ্গবন্ধু সরকার সম্পর্কে বিরােধীপক্ষ যে সকল বিষয় নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন, সমালােচনা করেন সে বিষয়গুলাে কোনটিই সমালােচনা করার মতো নয়।
মূল্যায়ন
বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে কেবল একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রই উপহার দেননি, তিনি মাত্র তিন বছর সময়কালের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত পােড়ামাটির এক সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের শত সমস্যা জয় করে তাকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করান । বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি সর্বপ্রথম বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য ফেরত পাঠান। মাত্র তিন মাস সময়ের মধ্যে মিত্রবাহিনী প্রত্যাহার ছিল ইতিহাসে বিরল। তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন করেন, দেশকে স্বাভাবিক করেন, সংবিধান প্রণয়ন করেন, এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করেন, যােগাযােগ ব্যবস্থা ও সকল অবকাঠামােগত উন্নয়ন সাধন করেন, শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটান, মদ-জুয়া-ঘােড়া দৌড়সহ সমস্ত ইসলাম বিরােধী কর্মকাণ্ড কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ করেন, নারী পুনর্বাসন সংস্থা গঠন করেন, মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন ও বীর মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করেন, কৃষির উন্নতি ঘটান, শিল্পকল-কারখানা, ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণ করে সচল করার মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করেন, ১২১টি দেশের স্বীকৃতি অর্জন করেন, বাংলাদেশকে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, জোট নিরপেক্ষ ও ইসলামী ব্লকের সদস্য করার মাধ্যমে পররাষ্ট্রনীতিতে সফলতা অর্জন করেন এবং এভাবে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে একটি মর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর কৃতিত্বের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের জুন মাসে লন্ডনের সানডে
টাইমস পত্রিকায় নিমরূপ মন্তব্য করা হয়:
যে পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন, সে পরিস্থিতি তিনি যেভাবে আয়ত্তে এনেছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এ ব্যাপারে সকল বিদেশীর তিনি প্রশংসা কুড়িয়েছেন … এটা সত্যই একটা অলৌকিক ঘটনা যে স্বাধীনতার পর অন্তত পাঁচ লাখ লােকও নিহত হ’লাে না, এখন পর্যন্তকেউ অনাহারে মারা যায়নি এবং
সরকার দিব্যি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং এসব কিছুই শেখের জন্য সম্ভব হয়েছে । সােনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, আমরা যদি নিষ্ঠার সাথে কাজ। করি, দলীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের স্বার্থ সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিই তাহলে। বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব।
ঘ. সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও আদর্শিক পটপরিবর্তন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা কেবলমাত্র একজন বা কিছু ব্যক্তিকেই হত্যা করা ছিল না, সে হত্যাকাণ্ডটির উদ্দেশ্য ছিল একটি আদর্শকে হত্যা করা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শুধু সংবিধান থেকে নয়, বাঙালির মন থেকে মুছে ফেলা। স্বভাবতঃই হত্যাকাণ্ডটি ছিল। সুপরিকল্পিত। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সুদূর প্রসারি প্রভাব ছিল। নিমে তা আলােচনা করা।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর থেকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন পর্যন্ত একুশ বছরে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্যই বিকৃত করা হয়নি। বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করা হয় ।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত একুশ বছরে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সুবিস্তৃত পটভূমি, তেইশ বছর ব্যাপী পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে সংঘটিত বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম, রাজনীতিবিদ, ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণি মানুষ প্রমুখের অপরিসীম আত্মত্যাগ, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য অবদান, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন ও পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারের গৌরবময় ভূমিকা, শত-সহস্র বীর মুক্তিযােদ্ধার আত্মত্যাগ, তিরিশ লক্ষ শহীদের জীবনদান, চারলক্ষ নারীর সম্রম হানি প্রভৃতি সবকিছুই অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছিল। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডারকে স্বাধীনতার ঘােষক হিসেবে প্রচার করা হয় এবং একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে তার ঘােষণাতেই হঠাৎ করেই ২৭শে মার্চ (১৯৭১) থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এই গােষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে মাত্র নয় মাসের ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে । ইতিহাস বিকৃত করা ছাড়াও ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত একুশ বছরে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধী শক্তি সংগঠিত হয় এবং পুনর্বাসিত হয়।
১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় সংবিধান প্রণেতাগণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ এই অভিধায় অভিহিতকরেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই অভিপ্রায়কে পরিবর্তন করে জাতীয় স্বাধীনতার ঐতিহাসিক যুদ্ধ’- অভিধায়ে পরিবর্তন করে । একাজটি করেন জিয়াউর রহমান। তিনি সামরিক বিধির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক- ১৯৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি, যথা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাএর আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে পরিবর্তন করা হয়। ধর্ম নিরপেক্ষতার স্থলে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ কথাগুলাে সংযােজন করা হয় । সমাজতন্ত্রের স্থলে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ কথাগুলাে প্রতিস্থাপিত হয়। এভাবে সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান-মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই বিনষ্ট করেন। তাঁর সময়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটে। বঙ্গবন্ধু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন, জিয়াউর রহমান সে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। ফলে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলাে আত্মপ্রকাশ করার সুযােগ পায় এবং আরাে অসংখ্য ধর্মভিত্তি রাজনৈতিক দল ও জোটের উন্মেষ ঘটতে থাকে। এভাবে জিয়াউর রহমান সংবিধানে নিষিদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী দল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলকে বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার প্রদান করার মাধ্যমে, শাহ আজিজুর রহমানের মতাে কুখ্যাত দালালকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে, আব্দুল আলীম ও মওলানা মান্নানের মতাে যুদ্ধাপরাধীদেরকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়ে এবং সর্বোপরি ধর্মভিত্তিক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে মুক্তিযুদ্ধের অবমূল্যায়ন করেছেন। জেনারেল জিয়া ইনডেমনিটির মতাে অমানবিক আইন সংবিধানে সন্নিবেশিত করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। জিয়াউর রহমান একাত্তরের ঘাতক দালাল যুদ্ধাপরাধীদেরকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করা ও তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানের সকল ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
| বঙ্গবন্ধুর সরকার (১৯৭২-৭৫) যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য ২৪.১.১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইবুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২’ জারী করেন। তাঁর আমলে বিচার কার্য গুরুও হয়। ২৪.১.৭২ থেকে ৩০.১১.৭৩ পর্যন্ত ৩৭,৪৭১ জন দালালকে গ্রেফতার করা হয়। তারমধ্যে ৭৫২ জন দালাল দণ্ডিত হয়। ৩০.১১.৭৩ তারিখে বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করলেও তিনি ‘ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, ঘরবাড়ি অথবা জাহাজে অগ্নিসংযােগের দায়ে দণ্ডিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষমা করেননি। ক্ষমার অযােগ্য এরকম ১১ হাজার ব্যক্তি আটক ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালে ৩১শে ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করেন। বঙ্গবন্ধুর সময় যাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল জিয়া তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার সুযােগ করে দেন। একাত্তরের ঘাতক দালালদের ভােটার হওয়ার সুযােগও তিনি দেন। এভাবে জিয়ার শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের সকল চেতনার বিনাশ ঘটে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর জেনারেল এরশাদ এবং পরে বেগম খালেদা জিয়া একই পথ অনুসরণ করেছেন।
এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশােধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘােষণা করেন, যা জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশােধনীর ধারাবাহিকতা মাত্র। সংবিধানের অষ্টম সংশােধনী এদেশে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেছে । অষ্টম সংশােধনী মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা ও বাস্তবতাকে সরাসরি আঘাত করেছে।
| বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে ১৯৯১-এর নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে সমর্থ হন । জামায়াতকে খুশী রাখতে স্বভাবতঃই বেগম খালেদা জিয়া এরশাদের ৮ম সংশােধনীসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরােধী সকল রাষ্ট্রীয় নীতি
অব্যাহত রাখেন। খালেদা জিয়ার দল – বিএনপির সমর্থনে জামায়াতে ইসলামীর শক্তি | বৃদ্ধি পায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াত জাতীয় সংসদে ১৮টি আসন লাভ করতে সমর্থ হয়। এই ফলাফল লাভের পর ২৯.১২.৯১ তারিখে পাকিস্তানী নাগরিক গােলাম আযমকে তাদের দলের আমীর হিসেবে মনােনীত করে। ২০০১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় এসে বেগম খালেদা জিয়া দুই যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত করে মুক্তিযােদ্ধাদেরকে অপমানিত করেন। ২০০১ সালের পর বাংলাদেশে মৌলবাদীদের উত্থান ঘটে।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত একুশ বছর ব্যাপী ক্রমাগত মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের ফলে সেসময়ের প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়। সে দীর্ঘসময়ে বঙ্গবন্ধুর নাম মিডিয়াতে প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। পত্র-পত্রিকায় ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে সামান্যই আলোচনা হতাে। ২৬শে মার্চ ও ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু যেভাবে উপস্থাপিত হওয়ার কথা, তা হয়নি। বরং বিভিন্ন ইসলামী দল ও জোটের নেত্রীবৃন্দ, সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকারী মুক্তিযুদ্ধবিরােধী ব্যক্তিবর্গ অধিকাংশ সংবাদপত্রের সাংবাদিকবৃন্দ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডানপন্থি শিক্ষকবৃন্দ, বিভিন্ন সভা সমিতির আলােচনা সভায়, পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান করে ও কলাম লিখে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত করেন। ফলে সেসময়কার তরুণ প্রজন্মের মনে মুক্তিযুদ্ধের কোন চেতনা সৃষ্টি হয়নি। তাদের চেতনা থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ নির্বাসিত হয়। তারা বেড়ে উঠে বিকৃত ইতিহাস শুনে শুনে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে, আর কয়েকবছর বঙ্গবন্ধুর শাসন অক্ষুন্ন থাকলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সুদৃঢ় হতাে, দেশ উন্নত হতাে এবং সমাজে ও রাষ্ট্রে অসাম্প্রদায়িকতা সুদৃঢ় হতাে।
সহায়ক গ্রন্থ
আবু সাঈদ, আওয়ামী লীগের শাসনামল, ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৫। আবুল মাল আব্দুল মুহিত, বাংলাদেশ : জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব, ঢাকা ও সাহিত্য প্রকাশনী ২০০০। এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার, ১৯৭২-৭৫, ঢাকা ২০১৩ আবুল মাল আব্দুল মুহিত (সম্পাদিত), এই দেশ এই ঢাকা: প্রবন্ধ বক্তৃতা, বাণী নিউজ, ও সাক্ষাৎকার, শেখ মুজিবুর রহমান, ঢাকা : বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি, ২০০৮। মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ : শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল, ঢাকা ১৯৯৪। শাহরিয়ার কবির, শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধ, ঢাকা, সময় প্রকাশন ১৯৯৭। মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, বঙ্গবন্ধু কোষ, ঢাকা ২০১২।

সূত্রঃ   স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস – মুনতাসীর মামুন, মো. মাহবুবুর রহমান