ইতিহাস বিকৃতি ও কল্পকাহিনির জন্য ক্ষমা চাইতে হবে সিরাজুল আলম খানকে
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা বরেণ্য পার্লামেন্টারিয়ান ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, সিরাজুল আলম খানের জবানবন্দিতে লেখা ‘আমি সিরাজুল আলম খান’ বইটি তাঁর মনগড়া এক কল্পকাহিনি ছাড়া আর কিছু নয়। এর বেশির ভাগ জুড়েই স্বাধীনতার ইতিহাস বা সত্যের কোনো ছায়া নেই। বইটি পাঠ করে তিনি সিরাজুল আলম খানকে টেলিফোন করে বলেছেন, ‘আপনার বইটি আমি সম্পূর্ণ পড়েছি। পাতায় পাতায় এত অসত্য তথ্য এসেছে যে আমি তার প্রতিবাদ করব।’ সিরাজুল আলম খান তাঁর টেলিফোনের জবাবে কিছু বলেননি এবং তিনিও আর কথা না বাড়িয়ে রেখে দেন।
মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তোফায়েল আহমেদ এ কথা বলেন। মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, মুজিববাহিনীর আমরা চারজন প্রধান ছিলাম। তার মধ্যে শেখ ফজলুল হক মণি, যিনি ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে ঘাতকের হাতে সস্ত্রীক নিহত হয়েছেন। আর আবদুর রাজ্জাক ইন্তেকাল করেছেন।
অন্যজন সিরাজুল আলম খান ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে ব্যর্থ ও দেউলিয়া হয়ে তাঁর কর্মকান্ড, বক্তব্য ও লেখালেখির মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে বিতর্কিত রহস্যপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। আমি অবাক হয়ে তাঁর জবানবন্দিতে লেখা বইটি পড়তে পড়তে বিস্মিত হয়েছি যে, কীভাবে একজন মানুষ একটি ইতিহাসকে এভাবে বিকৃত করতে পারেন! কোন রহস্যজনক কারণে এত বছর পর হঠাৎ করে এই মিথ্যাচারের দলিল উপস্থাপন করেছেন? সেই রহস্য একদিন উদ্ঘাটিত হবে এবং এ কে খন্দকারের মতো ইতিহাস বিকৃতি ও মিথ্যাচার করার ভুল স্বীকার করে জাতির কাছে তাকেও ক্ষমা চাইতে হবে।
সিরাজুল আলম খান তাঁর বক্তব্যে আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদকে নিয়ে ’৬২ সালে গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ বা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ গড়ে তোলার কথা বলেছেন। সেটির সঙ্গে ইতিহাসের কোনো যোগসূত্র বা সত্যতা নেই বলে দাবি করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, তখন আমাদের নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। তিনি এর সম্পর্কে কিছু জানতেন না। তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বকালে কাজী আরেফ আহমেদ ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। অথচ তিনিও জানেন না। তোফায়েল আহমেদ বলেন, এ ধরনের কোনো তথ্য-উপাত্ত কোথাও নেই। ছাত্রলীগের রাজনৈতিক ইতিহাসে বা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও এর নামগন্ধ নেই। এখন তারা বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তিগত চায়ের আড্ডায় কোনো আলাপ-আলোচনা করে থাকলে সেটি তাদের নিজস্ব বিষয়। এর কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা নেই, ইতিহাসে তার জায়গা নেই।
বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ছয় দফার প্রতি আওয়ামী লীগের সমর্থন ছিল না; এবং সংবাদপত্র, এমনকি ইত্তেফাকও প্রচারে ভূমিকা রাখেনি বলে সিরাজুল আলম খান যে কথা বলেছেন, তোফায়েলের ভাষায় তা নির্জলা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। সিরাজুল আলম খান ’৬৬ সালের ৭ জুনের হরতাল প্রসঙ্গে বলেছেন, তাঁরা নিউক্লিয়াস থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এবং তিনি একটি টুলের ওপর দাঁড়িয়ে হরতালের ঘোষণা দিয়েছেন। যেখানে সাতজন শ্রোতা ও তার দ্বিগুণ গোয়েন্দা সংস্থার লোক ছিল। এ বিষয়ে তোফায়েল বলেন, আসলে এ রকম কোনো ঘোষণা তিনি দেননি। তখন সব নেতাই জেলে। ঘোষণা দিলে তিনি গ্রেফতার হতেন। আর ৭ জুন হরতালের সিদ্ধান্ত, বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি এবং কতিপয় প্রস্তাব বাস্তবায়নের দাবিতে ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ঘোষণা করা হয়। দেশব্যাপী সেই হরতাল বাস্তবায়নে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে সব ছাত্রনেতা মাঠে কাজ করেন। তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, তিনি তখন তৎকালীন ইকবাল হল বর্তমান জহুরুল হক হলের ভিপি ও মাঠের কর্মী। ৭ জুনের হরতালে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ অনেকেই তখন রাজপথে ছিলেন। শেখ ফজলুল হক মণি সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রক্টর ছিলেন ড. ওদুদুর রহমান। তিনি শেখ মণিকে বললেন, ‘মণি! তুমি এখন ছাত্র নও। তুমি ক্যাম্পাস থেকে চলে যাও। তুমি না গেলে আমার চাকরি যাবে।’ শেখ মণি তখন বিনয়ের সঙ্গে হরতালের কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করলেন। সেদিনের হরতালে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে হরতাল সফল করার দায়িত্বে ছিলেন খালেদ মোহাম্মদ আলী ও নূরে আলম সিদ্দিকী। তেজগাঁওয়ের শ্রমিক মনু মিয়াসহ ১১ জন শহীদ হন এবং আট শ লোককে গ্রেফতার করা হয়। সেদিনের স্ততঃস্ফূর্ত হরতালকারীদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে দমন-পীড়ন চালায়।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলের কনভেনশনে বাংলার গণমানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিসংবলিত ‘ম্যাগনাকার্টা’ খ্যাত ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী গ্রহণ না করায় বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এসে ১১ তারিখ ঢাকা বিমানবন্দরে নেমেই সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন এবং ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ছয় দফা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সিরাজুল আলম খান যে প্রলাপ বকেছেন, তার সঙ্গে ইতিহাসের এই দলিলের কোনো মিল নেই। ছয় দফা ঘোষণার পর জনমত সংগঠিত করতে ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে জনসভায় ছয় দফাকে নতুন দিগন্তের মুক্তিসনদ হিসেবে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একদিন সমগ্র পাক-ভারতের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের জবরদস্ত শাসনব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এই চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে বীর চট্টলের বীর সন্তানরা স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিল। আমি চাই যে, পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের জন্য দাবি আদায়ের সংগ্রামী পতাকাও চট্টগ্রামবাসীরা চট্টগ্রামেই প্রথম উড্ডীন করুন।’ চট্টগ্রামের জনসভার পর দলের কাউন্সিল সামনে রেখে ছয় দফার যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি একের পর এক জনসভা শুরু করেন। ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট উপকমিটি গঠন করে ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় এবং তার প্রচার চালানো হয়। মার্চের ১৮ থেকে ২০ তারিখের কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনে শুরুতেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি পরিবেশিত হয়। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে, যেটি তিনি দেশের জাতীয় সংগীত করেছেন। সিরাজুল আলম খানের জাতীয় সংগীত প্রণয়নের যে আমিত্বের অহংকার ইতিহাসের এ সত্যের কাছে তা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। সেদিনের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। ছয় দফার ভিত্তিতে দলীয় গঠনতন্ত্রও সংশোধিত হয়। ছয় দফার ভিত্তিতে কর্মসূচি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধিত ও দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পরিবর্তন সাধিত হয় তা পরে ছয় দফার চূড়ান্ত পরিণতি এক দফা তথা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের পরিণতির দিকে যায়।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দেশের তরুণসমাজ থেকে মানুষের কাছে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে, প্রায় প্রতি ঘরে ছয় দফার পুস্তিকা সযত্নে ঠাঁই পেল। ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ এটি ছিল স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। কাউন্সিলের শেষ দিন ২০ মার্চ পল্টন ময়দানের বিশাল জনসভায় নেতা-কর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘চরম ত্যাগ স্বীকারের এ বাণী নিয়ে আপনারা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুন। প্রতিটি মানুষকে জানিয়ে দিন দেশের জন্য, দশের জন্য অনাগতকালের ভাবী বংশধরদের জন্য সবকিছু জেনেশুনে আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা এবার সর্বস্ব পণ করে নিয়মতান্ত্রিক পথে ছয় দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের জন্য এগিয়ে আসছে।’ আওয়ামী লীগের এ কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বাঙালির ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তক, যা ঊনসত্তরের মহান গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। বঙ্গবন্ধু সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপস নেই। রাজনীতিতেও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামী লীগ আর আস্থাশীল নয়, নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়, এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কোনো হুমকি ছয় দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ছয় দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তির সনদ। ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির জন্য এটাই সঠিক পথ।’ বঙ্গবন্ধু এই কাউন্সিল অধিবেশন শেষে সারা দেশে ৩৫ দিনে ৩২টি জনসভায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে সারা দেশে গণজোয়ার তৈরি হয়। আর আইয়ুব খান পরিস্থিতি দেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ নেতাদের ওপর নির্মম গ্রেফতার-নির্যাতন শুরু করেন। প্রতি জেলা থেকে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানাবলে বঙ্গবন্ধুকে লাগাতার গ্রেফতার করতে থাকে। ছয় দফা প্রচারকালে তিন মাসে বঙ্গবন্ধুকে আটবার গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করে দেশরক্ষা আইনের আওতায় বঙ্গবন্ধুসহ নেতাদের ওপর গ্রেফতার-নির্যাতন চালানো হয়। ১৩ মে সারা দেশে প্রতিবাদ দিবসের ডাক দিলে গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দেখা যায়। আর ৭ জুনের হরতালের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বিক্ষুব্ধ জনতা স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়।
সিরাজুল আলম খান আওয়ামী লীগ ও জনগণ ছয় দফাকে সমর্থন করেনি বলে যে কথা বলেছেন তা তোফায়েলর ভাষায়, ইতিহাসের সত্যের বিপরীতে অন্ধের প্রলাপের মতো শোনায়। তিনি বলেন, ’৬৬ সাল থেকে রাজনীতিতে আমরা সক্রিয় জড়িত। ছয় দফা থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি ঘটনায় সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার পরও তিনি যা বলেন তার কোনো সত্যতা আমরা দেখতে পাই না। এমনকি সিরাজুল আলম খান মুজিববাহিনীর চার প্রধানের সঙ্গে আমার উপস্থিত থাকার কথা বলে এমন সব ঘটনার বর্ণনা করেছেন, যা পড়ে আমি তাজ্জব হয়ে ভাবী, যাকে একদিন শ্রদ্ধা করতাম আজকে তার অসত্য বক্তব্যের বিরুদ্ধে আমাকে কথা বলতে হচ্ছে। আমার বিবেকের তাড়নায় এ ছাড়া কোনো পথ নেই।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অনেক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু যখন নতুন প্রজন্মসহ গোটা দেশের মানুষ আমাদের ইতিহাসের মীমাংসিত সত্য নিয়ে এক মোহনায় মিলিত হয়েছে, তখন আকস্মিকভাবে দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে কোন এক অজানা রহস্যে সিরাজুল আলম খান ইতিহাস বিকৃতির এক অসত্য মনগড়া কাহিনি সামনে নিয়ে এসেছেন?
এমনকি তিনি বলেছেন, ইত্তেফাক ছয় দফাকে সমর্থন করেনি। অথচ গোটা দেশবাসী জানে এখনো সেই সময়ের দৈনিক ইত্তেফাক খুললেই ছয় দফাসহ বঙ্গবন্ধুর একেকটি জনসভা ইত্তেফাক আট কলামে ব্যানার লিড করেছে। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা আন্দোলন সংগ্রামে জনগণকে ছয় দফার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ, উত্তাল করেছে। আর শ্রদ্ধেয় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে যেমন জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি ইত্তেফাককে ছয় দফা প্রচারের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের মুখপত্রে পরিণত করেছিলেন।
তোফায়েল বলেন, কী কারণে, কোন মতলবে কিংবা কোন রাগে বা জেদে সিরাজুল আলম খান এই মিথ্যাচারে ভরা বিকৃত ইতিহাস লিখছেন বুঝতে পারি না। বঙ্গবন্ধুকে ’৬৬ সালের ৮ মে কারাগারে নিক্ষেপ করেও স্বৈরশাসক আইয়ুব খান যখন ছয় দফা আন্দোলনের গতি থামাতে পারেননি, তখন তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য মামলা দেন। আর বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ও তার আন্দোলন সংগ্রামের সমর্থনে অনন্যসাধারণ সাহসী ভূমিকা রাখার জন্য বিশেষ করে ৭ জুনের হরতাল ও ছয় দফা সম্পর্কে কোনোরকম প্রতিবেদন, মুদ্রণ ও প্রকাশের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মানিক মিয়া তাঁর কলামে লিখেছিলেন, ‘ছয় দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গৃহীত নিষ্ঠুর ব্যবস্থার কারণে মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে একমাত্র সান্ত্বনার বিষয় হলো এই যে, জনসাধারণ ছয় দফা আন্দোলন তথা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে তাদের নিজেদের আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করেছে।’ মানিক মিয়া ও ইত্তেফাকের সাহসী ভূমিকায় ’৬৬ সালের ১৬ জুন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির আওতায় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার এবং দ্য নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়। পরে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইয়ুবের ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত মহানায়কের বেশে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে যেমন ফিরে আসেন, তেমনি আইয়ুব খানেরও পতন হয় এবং দৈনিক ইত্তেফাক ও বাজেয়াপ্ত করা নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসটি ফেরত দিতে সরকার বাধ্য হয়। সিরাজুল আলম খান কোন মতলবে ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার অবদান অস্বীকার করছেন? এ প্রশ্ন তুলে সাবেক ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ বলেন, কেন স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করছেন জানি না।
সিরাজুল আলম খান আরও বলেছেন, ১৮ জানুয়ারি ’৭০ সালে পল্টনে আওয়ামী লীগের জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁকে জয় বাংলা স্লোগান দিতে বলেছেন। আর আওয়ামী লীগ নেতাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি জয় বাংলা স্লোগান দিলে বঙ্গবন্ধুর মনে ধরে। তিনি কীভাবে ইতিহাসের সত্য দলিল থাকার পরও এ ধরনের আমিত্বের মোহে আর্কাইভে থাকা সেদিনের পত্রিকার সত্যতাকে অস্বীকার করেন? এ ধরনের মিথ্যাচারের বিকৃত সুখ ভোগ করেন? ’৭০ সালের ১৮ জানুয়ারি পল্টনে জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ ছিল এবং সেই জনসভায় বিক্ষুব্ধ জনগণের হামলা এবং সংঘর্ষের যে তান্ডব বয়ে যায়, সেটি পরদিনের দৈনিক ইত্তেফাকে ব্যানার লিড হয়েছিল। চাইলেই সেদিনের ইত্তেফাক দেখে নিতে পারেন। আর আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭০ সালের ১১ জানুয়ারি পল্টনের জনসভায় ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। আর সেই জনসভায় বঙ্গবন্ধু নিজেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছিলেন। সেদিন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগ নেতারা বক্তৃতা করেছিলেন। সেদিন সিরাজুল আলম খান মঞ্চেই ছিলেন না। আর ইত্তেফাক বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে ব্যানার লিড করেছিল, ‘বাংলার সাত কোটি জাগ্রত মানুষের এই জিজ্ঞাসার জবাব দাও’। ঊনসত্তর সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর-স্নেহে তাঁর কাছাকাছি ছিলাম। সক্রিয় কর্মী ছিলাম। কোনো দিন সিরাজুল আলম খানকে মঞ্চে বক্তৃতা বা স্লোগান দিতে দেখিনি।
সূত্র – বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১২ জুন ২০১৯