You dont have javascript enabled! Please enable it! রাজনীতির রহস্যপুরুষ চিত্তরঞ্জন সুতার - সংগ্রামের নোটবুক

রাজনীতির রহস্যপুরুষ চিত্তরঞ্জন সুতার

পিরোজপুর অঞ্চল থেকে দু’দুবার নির্বাচিত আইন প্রণেতা চিত্ত রঞ্জন সুতার আজ নতুন প্রজন্মের কাছে একজন অপরিচিত রাজনীতিক। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বিশেষ অবদান রাখা এ অতি প্রভাবশালী মানুষটির কথা রাজনীতিবিদরাও ভুলে বসে আছেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের সময় নির্দলীয় ব্যানারে পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদ এবং আওয়ামী লীগের টিকেটে ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন তিনি। পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি (নেছারাবাদ) উপজেলার বাটনাতলা গ্রামের মানুষ চিত্ত সুতার বাংলার রাজনীতিতে এক প্রবাদপুরুষ যেমন তেমনি তাঁকে ঘিরে রাজনৈতিক সচেতন মহলে রহস্যেরও অন্ত নেই। ১৯৭৫ সনের ১১ আগস্ট তত্কালীন বাকশাল দলের এই এমপি ভারতে যাওয়ার পর আর কখনও বাংলাদেশে ফিরে আসেননি। প্রায় এক যুগ আগে দিল্লীতে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত কলিকাতার ভবানীপুরের বাসভবন সানি ভিলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। কখনো বামদল, কখনও নির্দল, কোন সময় নেপথ্যচারী এবং স্বাধীনতার পর দুই বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা গেছে তাঁকে। আবার ৭০ সালের নির্বাচনের সময় তফশিলী হিন্দু সম্প্রদায় ভিত্তিক নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গণমুক্তি দলের রূপকার ছিলেন চিত্ত সুতার। ৭৫ সালে বাকশাল গঠনেও ছিল তাঁর বিশেষ ভূমিকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরূপকাঠির বাটনাতলা ইজিএস হাইস্কুলের সাবেক এক প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং বিভিন্ন অনুসন্ধানে দেখা যায় চিত্তরঞ্জন সুতার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেপথ্য পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি ভারত সরকার ও সে দেশের রাজনৈতিক মহলের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুখ্য যোগসূত্রের কাজ করেছেন। ৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা তথা দেশ বিভাগের পর থেকে ২০০২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ৫৩ বছরের মধ্যে প্রায় ৩৯ বছর কাটিয়েছেন কলিকাতায়। পাকিস্তান আমলের এক যুগকাল এপার বাংলায় অবস্থান করলেও স্বাধীনতার পর দু’বছর মাত্র থেকেছেন বাংলাদেশে । ইংরেজি ১৯২৮ সালের ২৩ মার্চ, বাংলা ১৩৩৪ সালের ৯ চৈত্র বাটনাতলায় জন্মগ্রহণ করেন চিত্তরঞ্জন সুতার। মারা যান বাংলা ১৪০৯ সালের ১২ অগ্রহায়ণ, ইংরেজি ২০০২ সালের ২৭ বা ২৮ নভেম্বর ভারতের রাজধানী দিল্লীতে। এ সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তত্কালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দিল্লী সফরকালে তাঁর সাথে চিত্ত সুতারও গিয়েছিলেন। সেখানে উভয় দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একটি বৈঠকের মধ্যস্থতা করার সময় দিল্লীর এক হোটেলে অবস্থানকালে চিত্ত সুতারের মৃত্যু ঘটে বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর উক্ত প্রধান শিক্ষক সূত্রে জানা যায়। চিত্তরঞ্জন সুতারের পিতার নাম ললিত কুমার সুতার ও মাতার নাম বেলোকা সুন্দরী। তিনি বরিশালের বিপ্লবী সতীন সেনের ভাই প্রাণ কুমার সেনের মেয়ে মঞ্জুশ্রী সেনকে বিয়ে করেন। এ দম্পত্তির একটি মাত্র সন্তান বাপী সুতার কলিকাতার ভবানীপুরে বসবাস করছেন।।

ভারত বিভাগের বিরোধী চিত্ত সুতার ৪৭’র পর পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। এ সময় পূর্ববঙ্গ ত্যাগী অসংখ্য হিন্দু বাস্তুহারা আশ্রয় নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। সেখানে শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থানকালে বাস্তুত্যাগী এ হিন্দুরা “রিলিফ মঙ্গার” বা ত্রাণনির্ভর হয়ে ওঠায় তারা ক্রমেই অলস শ্রেণীতে পরিণত হতে থাকেন। তাস-পাশা খেলে দিনাতিপাত করায় তাদের এ অবস্থা তরুন চিত্ত সুতারকে ব্যথিত ও চিন্তিত করে তোলে। তিনি উপলব্ধি করেন যে, এভাবে ভারতে এই শরণার্থীরা ক্রমান্বয়ে একটি কর্মহীন ভবঘুরে শ্রেণীতে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং এক পর্যায়ে বিলুপ্ত গোষ্ঠী হয়ে সমাজ থেকে হারিয়ে যাবে। এই ধারণা থেকে প্রসূত বিশেষ ভাবনা তাঁকে পুনরায় নিজ জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনে এবং গ্রামের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ব্যাপৃত হতে উত্সাহিত করে। ভূস্বামী পিতার বিত্ত-বৈভব তাঁকে নতুন চিন্তা বাস্তবায়নে প্রেরণা যোগায়। পিতার একমাত্র উত্তরাধিকার চিত্তসুতার আনন্দ চিত্তে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বজাতির মুক্তির কাজে। ৪৭ সালের পর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বাটনাতলা হাইস্কুল পুনর্গঠিত করে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হন এবং তফশিলভুক্ত হিন্দুদের সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করতে শুরু করেন। একই সাথে নিজ গ্রামে একটি বালিকা বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন। এ দু’টি বিদ্যালয়কে কেন্দ করে তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন এবং সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনারও চিন্তা-ভাবনা করতেন। এক পর্যায় কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে হিন্দু সংরক্ষিত আসন থেকে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের স্বতন্ত্র সদস্য নির্বাচিত হন। প্রকাশ এ নির্বাচনের সময় স্কুল সার্টিফিকেট অনুযায়ী তাঁর বয়স ২৫ বছর হয়নি। হিন্দুদের “কুষ্টিনামা” বলে তিনি প্রার্থিতার ক্ষেত্রে বয়সের অযোগ্যতা দূর করেছিলেন। জানা যায়, তিনি যে এ নির্বাচনে অংশ নেবেন তা নির্ধারিত হয়েছিল ৫৩ সালে পিরোজপুর থানার সিকদার মল্লিক ইউনিয়নের চালিতাখালী গ্রামের সতীশ মলঙ্গির (মজুমদার) বাড়িতে একটি বৈঠকে আগ্রহী হিন্দু নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে। যুক্তফ্রন্টের সময় প্রাদেশিক আইন পরিষদে বিভিন্ন সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পাশাপাশি কৃষকদের সংগঠিত করেন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করলে চিত্ত সুতার সে দলে যোগ দেন । ৫৮ সালে আইয়ূব খান পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করার পর তাঁকে কারাবন্দী করা হয়। ৬০’র দশকে বিভিন্ন আন্দোলনে তাঁকে তত্পর দেখা যায়। এক পর্যায়ে ন্যাপের রাজনীতি পরিত্যাগ করে তিনি আবার ভারতে চলে যান। মাঝে মাঝে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে অতি গোপনে আসা-যাওয়া করতেন। ভারতে অবস্থানকালে এস বি রায় বা সত্যব্রত রায় ছদ্মনামে তিনি কলিকাতায় দু’বাংলার অনুসারীদের যোগাযোগে রাজনৈতিক তত্পরতায় লিপ্ত ছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু’র ৬ দফা আন্দোলন, “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” মোকাবেলা ও গ্রেফতার, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন ইত্যাদি বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন চলছিল। চিত্ত সুতার কলিকাতায় অবস্থান করেও এ রাজনৈতিক আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু’র অন্যতম পরামর্শদাতা বা সংগঠক হিসাবে সক্রিয় ছিলেন। ৭০ সালের নির্বাচনের আগে তিনি দেশে ফিরে এসে গণমুক্তি দল নামে নিজস্ব চিন্তাধারা বাস্তবায়নের জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ভিত্তিক একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন নিজে নেপথ্যে থেকে। যে দলের সভাপতি হন নাজিরপুর থানার সামন্তগাতী গ্রামের ঢাকা প্রবাসী ডাঃ কালীদাস বৈদ্য। এ নির্বাচনে ডা. বৈদ্য মোমবাতি প্রতীকে স্বরূপকাঠি-নাজিরপুর-বানারীপাড়া জাতীয় পরিষদ আসনে ৪০ হাজার ভোট পেয়ে সংগঠনটির শক্তি প্রদর্শন করেন। বঙ্গবন্ধুর নৌকা আর শেরে বাংলার ইমেজের পাল্টা গণমুক্তির মোমবাতি মার্কার এ বিপুল ভোট প্রাপ্তি তখন রাজনৈতিক মহলকে বেশ ভাবনায় ফেলেছিল। উল্লেখ্য, তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে শেরে বাংলা পুত্র এ কে ফায়জুল হক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ নির্বাচনে এ দলটির যে ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছিল তা পরবর্তীকালে ৭২ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে প্রতিফলন ঘটেছে বলে এ প্রতিবেদনের তথ্য দাতা উক্ত সংগঠনের তত্কালীন অন্যতম সংগঠক অবসর জীবনযাপনকারী এ প্রধান শিক্ষকের দাবি। নির্বাচনের পরপরই চিত্তরঞ্জন সুতার আবার ভারতে চলে যান। আরও জানা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সাথে ভারতের রাজনীতিবিদ, দিল্লী ও কলিকাতা সরকার এবং আন্তর্জাতিক মহলের সাথে যোগাযোগের বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ সময় কলিকাতার ভবানীপুরের সানি ভিলা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে বসবাসের জন্য বরাদ্দ করা ছিল এবং বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক রাজনীতিবিদদের মূল আড্ডা বসত এখানে। দেশ মুক্ত হওয়ার পর ৭৩ সালের প্রথম দিকে চিত্ত সুতার দেশে ফিরে আসেন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি—বানারীপাড়া সংসদীয় আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি যখন প্রার্থী হন সে সময় বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় তার কোন নাম ছিল না। এ কারণে নির্বাচন কমিশন প্রণীত সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্রে প্রার্থী ভোটার কিনা তার কলামটি রাখা হয়নি বলে কথিত আছে। সমসাময়িক রাজনীতিতে তিনি এতটা প্রভাবশালী ও অনিবার্য (!) ছিলেন যে, কোনদিন আওয়ামী লীগের সদস্য না হয়েও এ দলের প্রার্থী হন । সেই চিত্ত রঞ্জন সুতার ৭৫ সালের ১১ আগস্ট ভারতে যান বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রাক্কালে । তাঁর ঘনিষ্ঠ জনদের কাজ থেকে জানা যায়, এসময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন, যা কার্যকর না হওয়ায় তিনি মনঃক্ষুণ্ন হন। তারপর আর কখনও জন্মভূমিতে ফেরেননি। তারপরও বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন আমৃত্যু।
– দৈনিক ইত্তেফাক