১৯৬২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা (Director of Intelligence Bureau D.I.B.) জানতে পায় যে কলকাতার ভবানীপুর এলাকার একটি বাড়িতে, যা ছিল ভারতীয় কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থার অপারেশনাল সদর দফতর, সেখানে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি গােপন সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। তার। উদ্দেশ্য, পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রে পরিণত করা। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা এও জানতে পায় যে চিত্তরঞ্জন সুতার (৪) ও কালিদাস বৈদ্য (৫) নামক দুই পাকিস্তানি নাগরিকের সঙ্গে এই গােপন সংগঠনের যােগাযােগ রয়েছে। তাদেরকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা ভারতীয় কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট বলে মনে করতাে। গােয়েন্দা সংস্থা আরাে জানতে পায়, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামক সংগঠনটি সংখ্যালঘিষ্ঠ এলাকায় বিশেষ করে ফরিদপুরের সংখ্যালঘিষ্ঠ অঞ্চলে তৎপর রয়েছে। ছাত্রদের মধ্যে ওই সংগঠনটি কিভাবে এবং কি পরিমাণে জড়িত ছিল, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা সেটা আবিষ্কার করতে পারে নি।
পাকিস্তান গােয়েন্দা সংস্থা জানতে পারেনি ঠিকই, তবে ওই সময়ই ছাত্রদের মধ্যে ভারতীয় কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থার অনুপ্রবেশ ঘটে যায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি সংবলিত লিফলেট ভারতীয় কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা তার গােপন সংগঠন স্বাধীন বংলা বিপ্লবী পরিষদের মাধ্যমে বিলি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা পরবর্তীকালে মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক আবদুর রাজ্জাক আমাকে দেয়া এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে জানান, তিনিও ১৯৬২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি। সংবলিত লিফলেট পেয়েছিলেন। ওই সময় খুলনার বিভিন্ন অঞ্চলে একই ধরনের লিফলেট পাওয়া যায়। ওই লিফলেট যাদের হস্তগত হয়, তারা কেউই জানতে পায় না। কে বা কারা এসব বিলি করছে। খুলনার পিকচার প্যালেস সিনেমা হলে কিছু লিফলেট পাওয়া যায় । শো শুরু হবার আগ মুহূর্তে হলের বাতি নিভে যাবার সঙ্গে সঙ্গে লিফলেট দর্শকের মাঝে ছুঁড়ে মারা হয়। ১৯৬৮ সালে ভারতীয় কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থাকে পুনর্গঠিত করা হয় এবং নামকরণ করা হয় ‘রিসার্স অ্যান্ড অ্যানাল্যাসিস উইং’ সংক্ষেপে ‘র’ (Research and Analyses Wing Raw)। ‘র’ গঠিত হবার পর পূর্ব পাকিস্তানে পূর্বতন ভারতীয় কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থা সৃষ্ট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ছাত্রদের মধ্যে অধিকমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে।
——————————————————–
৪. , চিত্তরঞ্জন সুতার : বাড়ি পিরােপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলায় বাটনাতলা গ্রামে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর করতেন পাকিস্তান কংগ্রেস। বিয়ে করেন বরিশালের তৎকালীন কংগ্রেস নেতা প্রাণকুমার সেনের কন্যাকে। ১৯৫৪ সালে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে পিরােজপুর নির্বাচনী এলাকায় তফশিলীদের জন্য সংরক্ষিত আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে ডা, কালিদাস বৈদ্য, কণিকা বিশ্বাস ও গােপালগঞ্জ-সাতপাড় কলেজের বীরেন বিশ্বাসকে নিয়ে করেন গণমুক্তি পার্টি। চিত্তরঞ্জন সুতার ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে পূর্ব পাকিস্তান। পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হতেই তিনি ভারতে চলে যান। ১৯৭৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব নিহত হবার পরপরই তিনি আবার ভারতে চলে যান।
৫. কালিদাস বৈদ্য । পেশায় ডাক্তার। বাড়ি পিরােজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলায় । প্র্যাকটিস করতেন ঢাকায় শাঁখারি বাজারে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তিকালে পড়তেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে । দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন তখন। পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুদিন পর চলে আসেন ঢাকায় এবং ভর্তি হন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে । ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে গণমুক্তি পার্টির প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। তার রাজনৈতিক দর্শন। ছিল, ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ যদি না-ই থাকে, তবে সীমান্ত থাকবে কেন? ডাক্তার কালিদাস বৈদ্য ও চিত্তরঞ্জন সুতার দুজনেই তথাকথিত স্বাধীন বঙ্গভূমির প্রবক্তা।
সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক