ভাষা আন্দোলন ও বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা
১৯৪৭ সালের বিভাগ পূর্ব অখণ্ড বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন পূর্ববাংলা মুসলিম লীগ নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে (ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত) বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পূর্ববাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং অবিভক্ত বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় । ১৯৪৬ সালের ২৫ নভেম্বর অবিভক্ত বাংলার সর্বশেষ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা বাংলাকে দুটো অংশে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। বাংলা বিভক্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পূর্ববাংলার আইনসভার জন্য নেতা নির্বাচনের নির্দেশ দেয়। ৫ আগস্ট (১৯৪৭) অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে খাজা নাজিমউদ্দিন ৭৫-৩৯ ভােটে সােহরাওয়ার্দীকে হারিয়ে সংসদীয় নেতা নির্বাচিত হন। সুতরাং খাজা নাজিমউদ্দিন ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পূর্ববাংলার প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করেন। স্যার ফ্রেডারিক বাের্ন পূর্ববাংলার প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হন। এই মন্ত্রিসভা পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, ১৪ আগস্ট পূর্ববর্তী সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার কোনাে সদস্যকেই স্বাধীন পূর্ববাংলার প্রথম মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। স্বভাবতই নবীন রাষ্ট্রের জন্মেলগ্নেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমঝােতার অভাব। লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করলে খাজা নাজিমউদ্দিন গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। তখন পূর্ববাংলায় প্রাদেশিক পরিষদের মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যবৃন্দ সংসদীয় পদ্ধতিতে একজন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হয়নি।
কারণ গভর্ণর জেনারেল তার মনােনীত নুরুল আমিনকে মুখ্যমন্ত্রী নিয়ােগ করার জন্য পূর্ববাংলার গভর্নরকে নির্দেশ দেন। গভর্নর সে অনুসারে নূরুল আমিনকে মুখ্যমন্ত্রী নিয়ােগ করেন। তিনি ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এতে সংসদীয় রীতিনীতি চর্চার বিষয়টি বাধাপ্রাপ্ত হয়। অনেক মুসলিম লীগ সদস্য ক্ষুব্ধ হন। এমনি পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলায় পর পর কয়েকটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। পাঠক্রমের উপ অধ্যায়ে আছে ক. মুসলিম লীগের শাসন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংগ্রাম এবং খ, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা, ১৯৪৯। আমরা এখানে প্রথমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয় বিস্তারিতভাবে আলােচনা করেছি যাতে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, ১৯৪৭ সাল থেকে কী ধরনের রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনগুলাে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ দল গঠনের প্রক্রিয়ায় জানা যাবে তাদের। রাজনৈতিক চরিত্র। আওয়ামী মুসলিম লীগের [পরবর্তী কালের আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা ছিল এ পর্বে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এখানে তা গুরুত্ব দিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। তারপর ভাষা আন্দোলন আলােচিত হয়েছে বিস্তারিতভাবে। ‘ঘ’ উপ অধ্যায়ে পাঠক্রমে আছে যুক্তফ্রন্ট ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচন। এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে এবং বিবরণেই মুসলিম লীগের অপশাসনের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের সংগ্রামের চিত্রটি পরিস্ফুটিত হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল : উৎপত্তি, বিকাশ, ভাঙন ও অবক্ষয় পূর্ববাংলার জন্মলগ্নের দলসমূহ (১৯৪৭-৪৮) ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় যে-সকল রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম পূর্ববাংলায় চালু ছিল সেগুলাে হচ্ছে মুসলিম লীগ, জাতীয় কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি। এ.কে. ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির নামমাত্র অস্তিত্ব ছিল। স্বাধীনতা লাভের পূর্বে অখণ্ড বাংলায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ। ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে এই দলটি ১১৯টি মুসলমান আসনের মধ্যে ১১৪টি আসনে জয়লাভ করে । বাকি ৫টি আসনে জয়লাভ করে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পাটি।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর অবিভক্ত বাংলার সরকার গঠন করেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। সে সময় বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছিল। পাটির সম্পাদক আবুল হাশিম এবং মুখ্যমন্ত্রী সােহরাওয়াদী ছিলেন একদিকে, আর পাটির সভাপতি মওলানা আকরাম খা এবং খাজা নাজিমউদ্দীন ছিলেন অন্যদিকে। সােহরাওয়াদী মন্ত্রিপরিষদ গঠন করলে খাজা নাজিমউদ্দীন রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রশ্নে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় হাই কমান্ড নাজিমউদ্দীন-আকরাম খা গ্রুপকে সমর্থন দিলে তাদের গ্রুপটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতে সােহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের অখণ্ড বাংলা গঠনের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়। বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয় এবং পূর্ববাংলা পাকিস্তানে যােগদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নবগঠিত পূর্ববাংলা প্রদেশে কে সরকার গঠন করবেন এই প্রশ্নে ৫ আগস্ট ১৯৪৭ বঙ্গীয় মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পাটিতে যে ভােটাভুটি হয় তাতে খাজা নাজিমউদ্দিন পূর্ববাংলা প্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার নিযুক্তিতে দলের মধ্যেই একটি বিরােধী অংশের জন্ম হয়। দুই অংশের মধ্যে আদর্শগত মতভেদও ছিল। যেমন খাজা নাজিমউদ্দিন গ্রুপের উদ্দেশ্য ছিল শক্তিশালী কেন্দ্র গঠন করে মুসলিম জাতীয়তাবাদের নামে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। এর বিপরীতে অন্য অংশের লক্ষ্য ছিল পূর্ববাংলার জন্য অধিক স্বায়ত্তশাসন লাভ ও পাকিস্তানকে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তােলা। মুসলিম লীগের সরকারবিরােধী অংশের নেতা-কর্মীরা দেশভাগের পূর্বে এবং পরে কয়েকটি নতুন দল গঠন করে। নিমে তা আলােচনা করা হল :
(১) গণআজাদী লীগের জন্ম নাজিমউদ্দীন বিরােধী অংশটি ছিল মূলত তরুণ কর্মীদল। বাম রাজনীতির দিকে তাদের কিছুটা ঝোকও ছিল । ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে দেশ স্বাধীন হবার পূর্বেই তারা একটি আলাদা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠিত উক্ত সংগঠনটির নাম ছিল গণআজাদী লীগ (People’s Feedom League)-এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হয়েছিলেন কমরুদ্দিন আহমদ। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আক্রোশ ও রাগের অভিব্যক্তি থেকেই এই সংগঠনের জন্ম । কিন্তু এই সংগঠন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। এর কারণ : প্রথমত, আহ্বায়ক কমরুদ্দিন আহমেদের কর্মবিমুখ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, কারাগার-ভীতি ও ত্যাগী মনােভাবের অভাব; দ্বিতীয়ত, সমগ্র দেশে উৎকট সাম্প্রদায়িক বিষাক্ত আবহাওয়া, তৃতীয়ত, তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকারের কঠোর দমননীতি। (২) পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের জন্ম স্বাধীনতা লাভের এক মাস পরেই ৬-৭ সেপ্টেম্বর (১৯৪৭) পূর্ববাংলার তরুণ-যুবক রাজনৈতিক কর্মীদল তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসনাতের বেচারাম দেউরিস্থ বাসভবনের হল কামরায় একটি যুব সম্মেলনে ‘পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ গঠিত হয়। এর সভাপতি নির্বাচিত হন তসাদুক আহমদ চৌধুরী। পাকিস্তান যুবলীগ বারাে দফা কর্মসূচী প্রণয়ন করে। উক্ত কর্মসূচীগুলাে ছিল নিমরূপ : ১. অবিলম্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া পূর্ণ আজাদী ঘােষণা করিতে হইবে। আগামী অক্টোবরের ব্রিটিশ উপনিবেশ সম্মেলনে যােগদান করা চলিবে না। ব্রিটিশ আমলের কোনাে ইংরেজ অফিসারের পেনশনের খরচ পাকিস্তান সরবার বহন করিতে পারিবে না।
১৯৪৮ সালের মধ্যেই পাকিস্তানের স্টার্লিং পাওনা কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়া লইতে হইবে-কোনােরকম দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি করা চলিবে না। প্রাপ্তবয়স্কদের সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে অবিলম্বে নূতন গণপরিষদ মারফত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করিতে হইবে। ভাষার ভিত্তিতে স্বয়ং শাসন অধিকার সম্পন্ন প্রদেশ গড়িবার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মানিলয়া লইতে হইবে। ৪. সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার স্বীকার করিতে হইবে। জনগণের স্বার্থে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য এবং সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক দেশগুলির সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করিতে হইবে। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করিয়া কৃষককে জমির মালিক করিতে হইবে। কৃষকের ঋণ মওকুফ করিতে হইবে । ক্ষেতমজুরদের ন্যায্য মজুরি দিতে হইবে। বড় বড় শিল্প, বড় ব্যাংক, ইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলাে জাতীয়করণ করিতে হইবে । শ্রমিকদের খাটুনির সময় আট ঘণ্টা বাঁধিয়া দিতে হইবে এবং বাঁচার মতাে মজুরির ব্যবস্থা করিতে হইবে। ব্যাংক, চা-বাগান, খনি ইত্যাদি বড় বড় ব্যবসায় নিয়ােজিত বিদেশী মূলধন বাজেয়াপ্ত করিতে হইবে মার্শাল প্ল্যান অথবা অন্য কোনাে বিদেশী মূলধন জাতীয় স্বার্থবিরােধী শর্তে গ্রহণ করা চলিবে না। বিনাব্যয়ে শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও সার্বজনীন শিক্ষা চালু করিতে হইবে। ১০. রাষ্ট্রের খরচে স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে। ১১. জনগণকে সামরিক শিক্ষা দিতে হইবে এবং জনগণের সামরিক বাহিনী গড়িয়া তুলিতে হইবে। ১২. নারীদের সমান গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকার করিতে হইবে। পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটির সেক্রেটারি মােহাম্মদ একরামুল হক কর্তৃক এই ইস্তাহার উত্থাপিত হয় এবং উপস্থিত প্রতিনিধিগণ কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। (সূত্র : স্বাধীনতার দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১০২-১০৩)।
‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ঢাকা, রাজশাহী ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় এর শাখা খােলা হয়, কিন্তু তীব্র পুলিশি নির্যাতন ও ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের অত্যাচারের ফলে ১৯৪৮ সালের শেষদিকে এই সংগঠনের বিলুপ্তি ঘটে। (দ্রষ্টব্য : ঐ, পৃ. ১০৮, পাদটীকা)। (৩) তমদুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তমদুন মজলিশ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক। প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সূচনায় এই সংগঠনের ভূমিকা ছিল। উল্লেখযােগ্য। (৪) অন্যান্য দল। ব্রিটিশ আমল থেকে পূর্ববাংলা কম্যুনিস্ট পার্টির সহযােগী সংগঠনরূপে ‘রেল ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, ‘রেল কর্মচারী লীগ’ প্রভৃতি কার্যকর ছিল। কম্যুনিস্ট পার্টির সহযােগী কৃষক সংগঠন হিসেবে ‘কৃষক সভা সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, যশাের, খুলনা প্রভৃতি এলাকায় কার্যকর ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন-এর সরকার মুসলিম লীগ বিরােধী সকল দলকে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। ষড়যন্ত্রকারীদের দলরূপে অভিহিত করে এবং সংগঠনসমূহের ওপর নানাভাবে হয়রানি করতে থাকেন। ফলে এসব দলের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। (৫) মুসলিম লীগের অবক্ষয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৭- এর ডিসেম্বরে করাচীতে উক্ত কাউন্সিল অধিবেশনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ বিভক্ত করে পাকিস্তান মুসলিম লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উক্ত কাউন্সিল অধিবেশনে সােহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত করার প্রস্তাব দিলে তা নাকচ হয়ে যায়। পাকিস্তান মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটি কর্তৃক প্রণীত গঠনতন্ত্র ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে অনুমােদিত হয়।
নতুন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মন্ত্রীদের কোনাে সাংগঠনিক কর্মকর্তার পদ গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়। এই অধিবেশনে চৌধুরী খালিকুজ্জামানকে দলের আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ৩য় কাউন্সিল অধিবেশনে চৌধুরী খালিকুজ্জামান প্রথম সভাপতি নিযুক্ত হন। জিন্নাহর জীবদ্দশায়। মুসলিম লীগ তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। তার মৃত্যুর পর লিয়াকত আলী খান দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। এইভাবে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে মুসলিম লীগ চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের হাতে। তাদের কাউন্সিলের মােট ৪৬৫ জন সদস্যের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত করা হয় মাত্র ১৮০ জন। উপরন্তু জিন্নাহর সময় মুসলিম লীগে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা স্থগিত রাখা হয়। এইভাবে দলীয় নেতৃবৃন্দ স্বেচ্ছাচারিতা দেখাতে থাকলে দলের প্রগতিশীল কর্মী-নেতাদের মধ্যে অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়। দলের মধ্যে। ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে। এ সকল ক্ষোভ-অসন্তুষ্টি উপেক্ষা করে দলের নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যায়। দলের গঠনতন্ত্র সংশােধন করে (১৯৫০ সালের ৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে) প্রধানমন্ত্রী পদাধিকার বলে দলের সভাপতি নিযুক্ত হবেন বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ফলে সভাপতির পদ প্রধানমন্ত্রীর হাতে চলে যায়। খাজা নাজিমউদ্দীন, বগুড়ার মােহাম্মদ আলী এরা সকলেই দলের সভাপতি ছিলেন। এতে দলে গণতন্ত্র চর্চা ব্যাহত হয়। দল সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবে- এর পরিবর্তে সরকারই দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। দল সরকারের অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল হয়।
এমতাবস্থায় দলের ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা দল থেকে আলাদা হয়ে নতুন দল গঠন। করে। পশ্চিম পাকিস্তানে মানকী শরিফের পীরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ (মে, ১৯৪৯) এবং পূর্ববাংলায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ (২৩ জুন ১৯৪৯) গঠিত হয় । এইভাবে মুসলিম লীগের পতন সূচিত হয়। পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগ দুর্বল হয়ে যায়। দলের এই দুর্বলতা স্পষ্ট হয় ১৯৪৯ সালের টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে। উক্ত উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রবীণ নেতা খুররম খান পন্নী বিপুল ভােটে পরাজিত হন। আওয়ামী-মুসলিম লীগের তরুণ কর্মী সােহরাওয়ার্দী-হাশিম সমর্থিত শামসুল হকের নিকট। এই পরাজয়ে শাসকগােষ্ঠী এত বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হন যে তারা পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের অন্য ৩৪টি আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত করেননি এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তারা তা ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখেন। মুসলিম লীগের শাসকগােষ্ঠীর এই স্বৈরাচারী মনােভাব দলের মধ্যে এত বেশি | ক্ষোভের সৃষ্টি করে যে, অনেক বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মী মুসলিম লীগ ত্যাগ করে আওয়ামী
মুসলিম লীগে যােগদান করেন। এইভাবে পুরাতন পরীক্ষিত কর্মীবৃন্দ দল ত্যাগ করায়। দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। দলের মধ্যেও অস্তদ্বন্দ্ব শুরু হয় । নূরুল আমিন মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে হামিদুল হক চৌধুরী একটি প্রতিদ্বন্দ্বী সমর্থক গােষ্ঠী তৈরি করেন। দলের অভ্যন্তরে কোন্দল এমন খারাপ পর্যায়ে পৌছে যে, পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আকরাম খাঁ ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে পদত্যাগ করেন।
১৯৫১ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের কোনাে কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়নি। মওলানা আকরাম খাঁ পদত্যাগ করলে ১৯৫২ সালের ২৩ আগস্ট পূর্ববাংলা মুসলিম লীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এই কাউন্সিল অধিবেশনে নূরুল আমিন পূর্ববাংলা মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি পূর্ববাংলায় বিতর্কিত হওয়ায় তার পক্ষে মুসলিম লীগকে পূর্ববাংলায় শক্তিশালী করা সম্ভবপর হয়নি । ভাষা-আন্দোলনে মুসলিম লীগ জনপ্রিয়তা হারায়। এর প্রভাব পড়ে ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের সময়। ঐ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। নির্বাচনে শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে মুসলিম লীগ পূর্ববাংলার রাজনীতি থেকে চিরবিদায় নেয়। নির্বাচনের পর নূরুল আমিন সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন (৩-১-১৯৫৫)। তার দলীয় সহকর্মীরা তার বিরুদ্ধে অভিযােগ উত্থাপন করে যে তিনি প্রদেশে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে, বিহারি-মােহাজের পুনর্বাসন করতে এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। নূরুল আমিনের পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে পার্টির কাউন্সিল অধিবেশন বসে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫। উক্ত অধিবেশনে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগে ধস নামে। নূরুল আমিনের সঙ্গে আরাে পদত্যাগ করেন পার্টির সহ-সভাপতি খাজা হাবিবুল্লাহ, ট্রেজারার এম.এ. সলিম, যুগ্ম-সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান ও মঈনুদ্দীন চৌধুরী এবং প্রচার সম্পাদক সবুর খান। দৈনিক সংবাদ- যা এই দলের মুখপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল- তা এই দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
এদিকে কেন্দ্রেও মুসলিম লীগে কোন্দল দেখা দেয়। দ্বিতীয় গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে মুসলিম লীগ কৃষক-শ্রমিক পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন করতে বাধ্য হয়। এমনি পরিস্থিতিতে ১৯৫৬ সালের ২৮-২৯ জানুয়ারি পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে আবদুর রব নিশতার সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ডা. খান সাহেবের সঙ্গে তার সংঘাত বাধে। এই সুযােগ গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মীর্জা। তিনি তার অনুগত একটি দল গঠনের অভিপ্রায়ে মুসলিম লীগ থেকে কিছু গণপরিষদ সদস্যদের নিয়ে গঠন করেন রিপাবলিকান পাটি (মে, ১৯৫৬)। এইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে মুসলিম লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়। ২২ জন গণপরিষদ সদস্য মুসলিম লীগ থেকে রিপাবলিকাণ্ড পার্টিতে যােগ দেন। ফলে চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর কোয়ালিশন মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয় (১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬)। ১৯৪৭ সালের পর এই প্রথমবার মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়। এরপর আই.আই. চুন্দ্রীগড়ের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ আরেকবার মাত্র দুই মাসের জন্য পাকিস্তানে সরকার গঠন করতে সক্ষম হলেও ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এই দল আর ক্ষমতায় যেতে পারেনি।
সামরিক আইন চলাকালীন (১৯৫৮-৬২) সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘােষিত থাকে। ১৯৬২ সালে সামরিক আইন তুলে নেয়ার পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। আইয়ুব খান নিজেও একটা রাজনৈতিক দলের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। তার অভিপ্রায় অনুযায়ী চৌধুরী খালিকুজ্জামান ১৯৬২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর করাচীতে মুসলিম। লীগের এক কনভেনশন আহ্বান করেন এবং কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠন করেন। ১৯৬৩ সালে আইয়ুব খান কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর খান, মেমানেম খান কনভেনশন মুসলিম লীগে। যােগদান করেন। কনভেনশন মুসলিম লীগে যােগদানের পুরস্কারস্বরূপ এরা প্রত্যেকে মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। মন্ত্রিত্ব ভােগ ছাড়াও ফজলুল কাদের চৌধুরী জাতীয় পরিষদের স্পিকার এবং মােনেম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়েছিলেন। কনভেনশন মুসলিম। লীগে আইয়ুবের একান্ত আজ্ঞাবহ এবং অনুগতরাই সমবেত হয়েছিল। আইয়ুবকে খুশি রাখতেই এই দলের সদস্যরা সদা ব্যস্ত থাকতেন। ফলে সংগঠন হিসেবে কনভেনশন মুসলিম লীগ শক্তিশালী করার কোনাে উদ্যোগ ছিল না। আইয়ুবও এই দলকে শক্তিশালী করতে চাননি। ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে ঘােষিত মেনিফেস্টোর শিরােনাম দিয়েছিলেন ‘মাই মেনিফেস্টো’ অর্থাৎ একটি দলের নয়, ব্যক্তি আইয়ুবের মেনিফেস্টো ছিল। কনভেনশন মুসলিম লীগ আইয়ুবের স্বেচ্ছাচারিতাকে সমর্থন দিয়েছে, প্রতিবাদ করেনি। আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনে এই দলের কোনাে ভূমিকা ছিল কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠনের পর মুসলিম লীগের প্রাক্তন নেতারা গঠন করেছিলেন কাউন্সিল মুসলিম লীগ।
১৯৬২ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকায় আয়ােজিত কাউন্সিলে এ দল গঠিত হয়। এর সভাপতি নিযুক্ত হন খাজা নাজিমউদ্দীন। তার মৃত্যুর পর (১৯৬৪) মিয়া মমতাজ দৌলতানা এর সভাপতি হন। এই দলটি মূলত পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের নিয়ে গঠিত ছিল। পূর্ব পাকিস্তান এর নেতা ছিলেন খাজা খয়েরউদ্দিন কাউন্সিল মুসলিম লীগ আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। ১৯৬৫-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দল মিস, ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন করেছিল । পিডিএম, ‘ডাক’ প্রভৃতি রাজনৈতিক জোট এই দলে যােগদান করেছিল। তবে ছয়দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতি এই দলের সমর্থন ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ বিঘ্নিত হােক তা এই দল চায়নি। ১৯৭০-এর নির্বাচনে এই দল মাত্র একটি আসন লাভ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এই দল পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার দোহাই দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী ভূমিকা পালন করে। এমনকি ১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত ‘শান্তি কমিটির আহ্বায়ক হয়েছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান প্রধান খাজা খয়েরউদ্দিন। মুসলিম লীগ বিভক্তির সময় কাইয়ুমপন্থী নামক আরেকটি দলের সৃষ্টি হয়েছিল।
মুসলিম লীগের এই অংশ কাইয়ুমপন্থী মুসলিম লীগ নামে পরিচিত ছিল। এই দলটিও মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
(৬) আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে আওয়ামী লীগ)-এর প্রতিষ্ঠা এবং বিকাশ। স্বাধীনতা প্রাপ্তির দুই বৎসরের মধ্যেই মুসলিম লীগের মধ্যে একটি সুবিধাভােগী শ্রেণী গড়ে উঠে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে অবাঙালিরা নিয়ােগপ্রাপ্ত হলে তারা নানান উপায়ে সুবিধা পেতে থাকে। মুসলিম লীগের মধ্যেও শাসকগােষ্ঠীর অনুগত একটি অংশ সকল সুযােগ সুবিধা ভােগ করতে থাকে। স্বভাবতই নাজিমউদ্দীন পন্থীদের বিরােধী একটা অংশের মধ্যে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মুসলিম লীগের এই ক্ষুব্ধ অংশটুকু ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার ১৫০নং মােগলটুলিতে এক সম্মেলনে মিলিত হয়ে ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ নামে একটা গ্রুপ গঠন। করে । ওয়ার্কার্স ক্যাম্প গ্রুপের সঙ্গে শীঘ্রই মুসলিম লীগ নেতাদের বিবাদ শুরু হয়। ওয়ার্কার্স ক্যাম্প গ্রুপ চেয়েছিল দলের সদস্য সংখ্যা বাড়াতে । দলের চাঁদা আদায়ের রসিদ বই ছিল তৎকালীন বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আকরাম খাঁ-এর। নিয়ন্ত্রণে। তিনি ওয়ার্কার্স ক্যাম্প গ্রুপকে রসিদ বই দিলেন না। তখন ক্যাম্প গ্রুপ। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সভাপতি খালেকুজ্জামানের নিকট অভিযােগ উত্থাপন করেন। কিন্তু খালেকুজ্জামান আকরাম খাঁ-গংদের সিদ্ধান্তকেই সমর্থন জানালেন। এর প্রতিবাদে ওয়ার্কার্স ক্যাম্প গ্রপ ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন ঢাকাস্থ কে.এম দাস লেনের বিখ্যাত রােজ গার্ডেনে সারা পূর্ববাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কর্মী সদস্যদের এক সম্মেলন আহ্বান করে।
এই সম্মেলনে পূর্ববাংলার প্রায় সব জেলা থেকে প্রতিনিধি উপস্থিত হয়। সম্মেলনের ঘটনা প্রসঙ্গে আবু আল সাঈদ লিখেছেন : বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া থেকে ধারণা করা যায়, তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন তাতে । এতে সভাপতিত্ব করে আতাউর রহমান খান। আবদুল হামিদ। খান ভাসানী উদ্বোধনী ভাষণ পাঠ করেন। এ.কে. ফজলুল হক তখন পূর্ববাংলা সরকারের অধীনে এডভােকেট জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত। এই সম্মেলন এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হয় যখন পূর্ববাংলা মুসলিম লীগ সরকার প্রদেশের শাসন পরিচালনায় ব্যর্থতার নানা উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। আবু আল সাঈদ লিখেছেন : ১৯৪৯ সালের মে মাসের শুরু থেকেই পূর্ববঙ্গে খাদ্যাভাব চলছিল….ঢাকা শহরে পানির অভাব । ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বিতা, গ্রামে। গ্রামে কৃষক বিদ্রোহ। কমিউনিস্টদের তৎপরতা…রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক। এমন পরিস্থিতিতে সম্মেলনে আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামক একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি; আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, সাখাওয়াত হােসেন, আলী আহম্মদ এবং আলী আমজাদ খান সহ-সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান, রফিকুল ইসলাম ও খন্দকার মুশতাক আহমেদ যুগ্ম-সম্পাদক
নির্বাচিত হন ।
২৫ নবগঠিত পার্টির উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করা। নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান। আওয়ামী মুসলিম লীগ ১২ দফা কর্মসূচী ঘােষণা করে। এর মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা, বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি দেয়া, পাটশিল্পকে জাতীয়করণ করা এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান না করে জমিদারি ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করা ।২৬ প্রতিষ্ঠার সময় থেকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানে বিরােধীদলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। প্রতিষ্ঠার সময় আওয়ামী মুসলিম লীগের মধ্যেও রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল-এই দুই ধারার রাজনীতিবিদ ছিলেন। প্রথম অংশ মুসলিম লীগের ন্যায় গতানুগতিক ধারার। রাজনীতি করার পক্ষপাতী ছিলেন। প্রগতিশীল অংশ সামন্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদ, পুজিবাদ বিরােধী গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দল গঠনের প্রয়াসী ছিলেন। এরা পার্টির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পার্টিকে ধর্মনিরপেক্ষ করার পক্ষপাতী ছিল । কিন্তু রক্ষণশীল অংশের মনমানসিকতা থেকে সাম্প্রদায়িক চেতনার অবসান না-ঘটায় তারা মুসলিম শব্দ বাদ দেয়ার বিরােধী ছিলেন। তাই পার্টির একতা বজায় রাখতে মওলানা ভাসানী ‘মুসলিম’ শব্দ রেখেই পার্টির নামকরণ করে। তাছাড়া মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে মুসলিম শব্দযুক্ত বিরােধীদলের প্রয়ােজনীয়তা তখন ছিল। পার্টি গঠনের সময় সােহরাওয়ার্দী এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে বসতি করে আইন ব্যবসা ও জিন্নাহ আওয়ামী লীগ নামে একটি দল সংগঠিত করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী-মুসলিম লীগ গঠিত হলে সােহরাওয়ার্দী জিন্নাহআওয়ামী লীগকে এর সঙ্গে সংযুক্ত করে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে দলটিকে জাতীয়রূপ দান করেন এবং তিনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠনের এক বছরের মধ্যেই পার্টি পাকিস্তান গণপরিষদে উত্থাপিত মূলনীতি কমিটির রিপাের্টের বিরােধিতা করে এক আন্দোলন গড়ে তােলে। এই আন্দোলনের ফলে মূলনীতি কমিটির রিপাের্ট গণপরিষদ থেকে প্রত্যাহৃত হয়। এইভাবে প্রতিষ্ঠার সূচনাতেই আওয়ামী মুসলিম লীগ একটি আন্দোলনমুখী দলে পরিণত হয়। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারিতে যে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল তার সভাপতি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং (মুসলিম) ছাত্রলীগ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে । ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ উদ্যোগী ভূমিকা রাখে এবং নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকারকে পরাজিত করে ক্ষমতা থেকে এবং বাংলার রাজনীতি থেকে মুসলিম লীগকে নির্বাসিত করে।
১৯৫৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত পার্টির কাউন্সিল মিটিংয়ে পার্টিকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দলে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে অনুসারে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয় এবং পার্টির নাম হয় আওয়ামী লীগ। তখন থেকে এই দলটি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণের একটি গণসংগঠনে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে ন্যাশনাল কংগ্রেস এবং হিন্দু তফশিলি সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক দলগুলি বিকাশ লাভের সুযােগ না-পাওয়ায় তারা অনেকে আওয়ামী লীগে যােগদান করেন। ফলে এই দল পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র বিস্তার লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের পতন এবং আইয়ুবের আমলে এখানে তার দল- কনভেনশন মুসলিম লীগ শক্তিশালী হতে না-পারায় আওয়ামী লীগ একক বৃহত্তম এবং শক্তিশালী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাঙালিরা জন্মগতভাবে অসাম্প্রদায়িক এবং উদার মতাবলম্বী হওয়ায় এখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বী দলগুলাে যেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি, তেমনি বামপন্থী দলগুলাে বৃহত্তম জনগােষ্ঠীর গ্রহণযােগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ১৯৬০-এর দশকে মওলানা ভাসানী আইয়ুব-বিরােধী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং বামপন্থী রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়ায় তিনি ন্যাপকে শক্তিশালী করতে ব্যর্থ হন। উপরন্তু ন্যাপের ভাঙনের (মােজাফফর ন্যাপ অর্থাৎ মস্কোপন্থী ন্যাপ এবং ভাসানী ন্যাপ অর্থাৎ চীনাপন্থী ন্যাপ) ফলে লাভবান হয় আওয়ামী লীগ। এর প্রমাণ ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬২টি সাধারণ আসনের মধ্যে ১৬০টিই দখল করে। ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে যে, আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণআন্দোলন ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগই নেতৃত্ব দেয় । শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বেই এই দল ১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। সাংগঠনিকভাবে এই দলকে অনেক সংকট মােকাবিলা করতে হয়েছে। অনেক প্রবীণ নেতা এই দল ত্যাগ করে নতুন দল গঠন করেছেন। যেমন মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে ন্যাপ গঠন করেছেন।
আতাউর রহমান খান গঠন করেছেন ন্যাশনাল লীগ। তারা অনেক নেতা-কর্মীকে আওয়ামী লীগ থেকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এতে বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বরং নানান আন্দোলনের পথ পাড়ি দিয়ে এই দল দিন দিন শক্তিশালী হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে একক বৃহত্তম দলে পরিণত হয়েছে। মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান প্রমুখ প্রবীণ নেতারা দল থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণে শেখ মুজিবের উত্থান সহজ হয়েছে। তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছেন। বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনে সঠিক নেতৃত্ব দান এবং সময়ােপযােগী দিকনির্দেশনা দেওয়ার কারণে তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছেন। গণভিত্তি থাকায় এবং তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত জনসমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হওয়ায় আওয়ামী লীগ তার জন্মের ষাট বৎসর পরেও আজ দেশের সর্ববৃহৎ দল হিসেবে টিকে আছে। (৭) কমিউনিস্ট পার্টি, যুবলীগ, গণতন্ত্রী দল, ন্যাপ ইত্যাদি ভারত বিভক্তির পর ভারতীয় কমিউনিস্ট পাটিও বিভক্ত হয় এবং ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির শাখা হিসেবে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সদর দফতর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত ছিল। কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে পূর্ব পাকিস্তান শাখার যােগাযােগ ছিল ক্ষীণ। স্বভাবতই পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনভাবে সাংগঠনিক কাজ করতে থাকে। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র সংগ্রামের লাইন, যা বি,টি, রনদীতে লাইন নামে খ্যাত, অনুসরণ করছিল। তখন এই পার্টির নেতৃত্বে চলছিল তেভাগা আন্দোলন নাচোল ও হাজং এর কৃষক আন্দোলন। পূর্ববাংলার সরকার এসব আন্দোলন দমন করতে ব্যাপক হিংসাত্মক কর্মপন্থা গ্রহণ করে। পূর্ববাংলার হাজার হাজার কম্যুনিস্ট নেতা-কর্মীকে কারারুদ্ধ করা হয় । কারাগারেও এসব বন্দির উপর চালানাে হয় চরম নির্যাতন।
এমনকি ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলার খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের বেপরােয়া গুলিবর্ষণে সাতজন কমিউনিস্ট বন্দি নিহত হন। পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের উপর সরকারি নির্যাতনের মুখে পার্টির প্রকাশ্য তৎপরতা বন্ধ হয়। এ সব পার্টির অসংখ্য হিন্দুকমী দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। এমতাবস্থায় পূর্ববাংলায় অবস্থানরত কমিউনিস্ট তথা বামপন্থীরা অন্য দলের মধ্যে ঢুকে পাটির আদর্শ বাস্তবায়িত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কমিউনিস্ট মনােভাবাপন্ন অনেক মুসলমান নেতা-কর্মী পূর্ব। পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগদান করেন। এমনকি তারা আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে জায়গা করে নিতে সমর্থ হন। তালুকদার। মনিরুজ্জামানের মতে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে ৩৭ জনের মধ্যে ৯ জন ছিলেন কমিউনিস্ট । কিন্তু ১৯৫৫ পর্যন্ত আওয়ামী মুসলিম লীগের নামে মুসলিম’ শব্দ থাকায় সেখানে অমুসলমানদের অনুপ্রবেশ সম্ভব। ছিল না। এমতাবস্থায় কমিউনিস্ট নেতাদের উদ্যোগে ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে ‘পূর্ব। পাকিস্তান যুবলীগ’ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই দলের সভাপতি ছিলেন মাহমুদ আলী ও সেক্রেটারি অলি আহমদ। ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতা, সামন্তবাদ বিরােধিতা, বিশ্বশান্তি, গণতন্ত্র, সকলের জন্য চাকুরির সুযােগ প্রভৃতি ছিল এই দলের মূলমন্ত্র। যুবলীগ ১৪ দফা ঘােষণা ও দাবিনামা ঘােষণা করে। উক্ত ঘােষণা ও দাবিগুলাে ছিল নিমরূপ : ১. আমরা যুদ্ধ চাই না। দুনিয়ার যুবসমাজ আজ যুদ্ধের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ঘােষণা করিতেছে ।
তাহাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলাইয়া আমরাও ঘােষণা করিতেছি যে, আমরা সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধপ্রচেষ্টা ব্যর্থ করিব। সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধের কামানের খােরাক হইবাে না। আমরা দাবি করিতেছি যে আমাদের সরকার যুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াক। এ কথাও আমরা ঘােষণা করিতে চাই- এটম অস্ত্র হইতেছে আক্রমণের অস্ত্র, মানুষকে ব্যাপকভাবে নিশ্চিহ্ন করার অস্ত্র । তাই আমরা দাবি করিতেছি এটম অস্ত্রকে বিনাশর্তে অবৈধ ঘােষণা করা হউক এবং এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকরী করার জন্য তারপর কঠোর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হােক। যে সরকার প্রথম কোনাে দেশের বিরুদ্ধে এটম অস্ত্র ব্যবহার করিবে, সেই সরকার মানবজাতির শত্রুতা করিবে। আমরা তাহাকে যুদ্ধ-অপরাধে অপরাধী মনে করিব। আজ আমরা ইহাও লক্ষ্য করিতেছি যে, দুনিয়ার গুটিকয়েক রাষ্ট্র এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি মানুষকে দাসত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে এবং ঔপনিবেশিক দেশগুলির আজাদীর আন্দোলনে ভীত সাম্রাজ্যবাদী দস্যুরা মারমুখাে হইয়া ঐসব দেশে রক্তের স্রোত বহাইয়া দিতেছে । আমরা এই সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে দৃঢ় আওয়াজ তুলিতে চাই এবং আজাদী সংগ্রামে নিযুক্ত আমাদের কোটি কোটি ভাই-বােনদের অভিনন্দন ও অকুণ্ঠ সমর্থন জানাই। আমরা চাই পাকিস্তান ব্রিটিশ কমনওয়েলথ ত্যাগ করুক এবং পাকিস্তানে স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কায়েম হউক, যাহাতে প্রত্যেকটি ভাষাভাষী প্রদেশ পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ভােগ করিবে, প্রত্যেকটি উপজাতি পাইবে কৃষ্টির স্বাধীনতা ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকটি নাগরিক ভােগ করিবে সমান নাগরিক অধিকার এবং আরবি হরফহীন বাংলা হইবে রাষ্ট্রভাষা। আমরা চাই বেকারীর অবসান এবং জাতিধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক যুবক-যুবতীর চাকুরি ও সৎভাবে জীবিকার্জনের নিশ্চয়তা, বেকারদের জন্য সরকারি ভাতা।
আমরা চাই প্রাপ্তবয়স্কদের সার্বজনীন ভােটাধিকার ও যুক্ত নির্বাচন। আমরা চাই দেশের নিরক্ষরতা দূরীকরণ, শিক্ষার উন্নতি, যুদ্ধ খাতে ব্যয় কমাইয়া শিক্ষার জন্য বর্ধিত হারে ব্যয়াদ্দ, বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, প্রয়ােজন অনুসারে মেয়েদের জন্য শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা ও প্রাপ্তবয়স্ক অশিক্ষিত যুব সমাজের জন্য শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা, স্কুল-কলেজের উন্নতি, ছাত্রছাত্রীদের আবাসস্থল বৃদ্ধি ও ছাত্র-বেতন হ্রাস। আমরা চাই যুব সমাজের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্য শহরে ও গ্রামে সরকার কর্তৃক প্রচুর পরিমাণে পাঠাগার, ক্লাব ও খেলাধুলার ব্যবস্থা এবং বর্তমানে যে-সমস্ত পাঠাগার ও ক্লাব আছে সেগুলিতে সরকারি সাহায্য, মেয়েদের জন্য বিশেষ পাঠাগার ও ক্লাবের ব্যবস্থা। আমরা চাই জনসাধারণের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সরকার কর্তৃক প্রভূত পরিমাণে ব্যয়বরাদ্দ। শহরে ও গ্রামে প্রচুর চিকিৎসালয় ও ব্যায়ামাগার স্থাপন। আমরা চাই বিনা খেসারতে জমিদারি, জায়গিরদারি প্রথার উচ্ছেদ ও কৃষকের হাতে জমি। ৯, আমরা চাই শ্রমিকের জীবন ধারণের উপযােগী মজুরি, দৈনিক ৮ ঘণ্টা হিসেবে সপ্তাহে ৪৪ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ । শ্রমিক-যুবকদের জন্য খেলাধুলা, পাঠাগার ও ক্লাবের ব্যবস্থা। ১০. আমরা চাই সমস্ত বিদেশী মূলধন বাজেয়াপ্তকরণ, বড় বড় শিল্পগুলির জাতীয়করণ। ১১. আমরা চাই যুবসমাজের জন্য সামরিক শিক্ষাব্যবস্থা ও অস্ত্র বহন করিবার অধিকার ।। ১২, আমরা চাই সমস্ত দাসত্বমূলক আইনের প্রত্যাহার, বিনাবিচারে আটক রাখার কানুন নাকচ, সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, সমাজের প্রত্যেকটি শ্রেণীর শ্রমিকের, কৃষকের, মধ্যবিত্তের, ছাত্রদের, মেয়েদের, চাকুরেদের নিজ নিজ সংগঠন গড়ার সভাসমিতি করার ও মত প্রকাশের পূর্ণ ও অবাধ অধিকার। প্রত্যেকটি দলের নিজ মতানুযায়ী কাজ ও মত প্রকাশ করিবার বৈধ অধিকার। ১৩. আমরা চাই দেশের প্রত্যেকের নিজ নিজ ধর্ম পালন করার পূর্ণ অধিকার, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্ম ও অন্যান্য অধিকার রক্ষার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা। ১৪. আমরা চাই সকল প্রকার প্রাদেশিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার অবসান ।
সূত্র : স্বাধীনতার দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১২-২১৩। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যুবলীগের বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। বলা যায় যে, ভাষা আন্দোলন পরিচালনার নেতৃত্বও ছিল যুবলীগের নেতাদের হাতে। ফলে এই দলের অনেক নেতা-কর্মী জেল-জুলুমের মুখােমুখি হয়। অনেকে গ্রেফতার হন। আবার কেউ কেউ গােপনে চলে যান। ফলে যুবলীগে নামে কাজ করা অনেকের পক্ষে অসম্ভব হয়। এমতাবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে ১৯৫২ সালের এপ্রিলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’ নামের ছাত্রফ্রন্ট এবং ৩১ ডিসেম্বর ‘গণতন্ত্রী দল’ (Democratic Dal) নামের রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। হাজী মােহাম্মদ দানেশ গণতন্ত্রী দলের সভাপতি ও মাহমুদ আলী এর সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। গণতান্ত্রিক দল গঠনের উদ্দেশ্য ছিল যেসব কমিউনিস্ট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজ করতে অনাগ্রহী। ছিলেন কিংবা হিন্দু হওয়ার কারণে যাদের পক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগের সদস্যপদ লাভ সম্ভব ছিল না তাদেরকে সম্পৃক্ত করা। এই দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল: The destruction of imperialism and feudalism and agent (the Muslim League). the confiscation of all foreign capital investments in Pakistan, the nationalization of foreign banks and insurance companies, the abolition of the Zamindary System without compensation, and the distribution of excess land to the landless peasants. ১৯৪৫ সালের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে কমিউনিস্টরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। কমিউনিস্ট সদস্যগণ যুক্তফ্রন্ট (আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে) এবং হিন্দুসদস্যরা সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট, তপশিলি ফেডারেশন এবং গণতন্ত্রী দল থেকে নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির চারজন সদস্য- পুর্ণেন্দু দস্তিদার, সুধাংশু বিমল দত্ত, বরুণ রায় ও অজয় বর্মণ সরাসরি প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করে। অন্যান্য দলের ছত্রচ্ছায়ায় যেসব কমিউনিস্ট পার্টি সদস্য নির্বাচিত হন তাদের মধ্যে ছিলেন মােঃ তােয়াহা, হাজী মােঃ দানেশ, সেলিনা বানু, মাহমুদ আলী, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, মহিউদ্দিন আহমদ, আতাউর রহমান, সরদার ফজলুল করিম প্রমুখ ।
নির্বাচনের পর আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৫ সালে কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলের সদস্যপদ সকল সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করলে অনেক কমিউনিস্ট সদস্য আওয়ামী লীগে ঢুকে যান। কমিউনিস্ট পার্টি তার প্রকাশ্য দল পূর্ব পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ভেঙে দেয়। ফলে এই দলের অনেক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যােগ দেন। আওয়ামী লীগে কমিউনিস্টদের অনুপ্রবেশ বিষয়ে আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক সমর্থন ছিল না। এ বিষয়ে কোনাে চুক্তি ও আনুষ্ঠানিক আলােচনা দুই দলের মধ্যে হয়নি। আওয়ামী লীগের কমিউনিস্টদের অনুপ্রবেশ ছিল ‘একতরফা ও গােপনীয়। আওয়ামী লীগে ঢুকে কমিউনিস্টরা মওলানা ভাসানীকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে একটি গ্রুপ সৃষ্টি করতে থাকে। এই গ্রুপ বিলুপ্ত-ঘঘাষিত গণতন্ত্রী দল এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগের আদর্শ ও উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগকে দিয়ে বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে থাকে। পাকিস্তান সরকার ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে কমিউনিস্ট পার্টিকে দ্বিতীয়বারের মতাে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে (প্রথমবার নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়েছিল ২৩ জুলাই ১৯৫৪)। তখন এই দল আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত পাটির। কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গেও যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে পূর্ব পাকিস্তান কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করে। ১৯৫৬ সালে কলিকাতায় গােপনভাবে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয়-কংগ্রেস পূর্ব পাকিস্তান কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি পায়। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান। কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক নিযুক্ত হন মণি সিংহ। সম্পাদকমণ্ডলীর। সদস্য হিসেবে ছিলেন মণি সিংহ, খােকা বায়ে নেপাল নাগ, বারীন দত্ত ও অনিল মুখার্জী। সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন শহীদুল্লাহ কায়সার, সুখেন্দু দস্তিদার, মােহাম্মদ তােয়াহা, আমজাদ হােসেন ও কুমার মৈত্র। (৮) ন্যাপ গঠন।
১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সােহরাওয়ার্দী কেন্দ্রে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তখন থেকেই আওয়ামী লীগের দুই নেতা সােহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর মধ্যে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতভেদ দেখা দেয়। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সিয়াটো (সাউথ-ইস্ট-এশিয়া ট্রিটি অরগানাইজেশনস) এবং ১৯৫৫ সালে সেন্ট্রো সেন্ট্রাল ট্রিটি। অরগানাইজেশনস) নামক দুটি সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। প্রথম চুক্তিভুক্ত দেশগুলি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন এবং পাকিস্তান। দ্বিতীয় চুক্তিভুক্ত দেশগুলি পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্ক। এই চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্দেশ্য ছিল সােভিয়েত ও চীনের চারদিকে মার্কিন-পক্ষের শক্তিবলয় সৃষ্টি করা। কমিউনিস্টরা এইসব সামরিক চুক্তির সমালােচনা করতে থাকে। তারা মওলানা ভাসানীকে তাদের দলে টানতে সক্ষম হন। এই গ্রুপ এমন একসময় শক্তিশালী হয় যখন সােহরাওয়ার্দী কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছেন। মার্কিনঘেঁষা সােহরাওয়ার্দী উপরিউক্ত চুক্তিদ্বয়ের সমর্থক ছিলেন। সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করলে ভাসানী তাকে পাকিস্তানকে সকল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধজোটের বাইরে এনে আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো অনুযায়ী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ, পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে দিয়ে স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে সাবেক প্রদেশসমূহ পুনর্গঠন এবং ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও মুদ্রাব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রেখে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক
স্বায়ত্তশাসন দেয়ার জন্য আহ্বান জানান।
কিন্তু সােহরাওয়ার্দী মার্কিনঘেষা নীতিতে অবিচল থাকলে ভাসানী ক্ষুব্ধ হন। পার্টিতেও এর প্রভাব পড়ে। আওয়ামী লীগের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে থাকা কমিউনিস্টরা সক্রিয় হয়ে উঠে। তারা ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারীতে অনুষ্ঠিত পার্টির কাউন্সিল অধিবেশনে মার্কিনঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি বিরােধী প্রস্তাব পাস করাতে ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগে ভাঙন সৃষ্টি করে। পার্টি সভাপতি মওলানা ভাসানীসহ নির্বাহী কমিটির নয়জন সদস্য পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগকারীগণ ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই ঢাকায় এক মহাসম্মেলন আয়ােজন করে। সেখানে আওয়ামী লীগভুক্ত বামপন্থী নেতৃবৃন্দ, লুপ্ত হয়ে যাওয়া গণতন্ত্রীদলের সদস্যরা। এবং এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক কমিউনিস্ট নেতা যােগ দেন। এই সম্মেলনে ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) নামক একটি নতুন পার্টির জন্ম হয়। মওলানা ভাসানী কেন্দ্রীয় ন্যাপ এবং পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। নবগঠিত ন্যাপের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল: ১, পাকিস্তানকে সাম্প্রদায়িক, প্রাদেশিকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও শােষণমুক্ত একটি শক্তিশালী জাতিতে সংগঠিত করণ; ২. জনসাধারণের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধন; ৩, নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দেশের উভয় অশের স্বায়ত্তশাসন কায়েম করার উদ্দেশ্যে দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা…। ন্যাপ গঠিত হলে বেআইনি ঘােষিত কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতা-কর্মী এই দলে যােগদান করেন। ফলে এই দলের শক্তি অনেক বেড়ে যায়। পরবর্তী এক দশকের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতা ন্যাপের নেতৃত্ব পদে আসীন হন। ন্যাপ পূর্ব পাকিস্তানে জনসমর্থন অর্জন করতেও সক্ষম হয়। ন্যাপ তার অঙ্গ সংগঠনরূপে পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি গঠন করে (ডিসেম্বর, ১৯৫৭)। আবদুল হক এর সভাপতি নির্বাচিত হন।
এরপর কমিউনিস্ট ও ন্যাপ নেতাদের উদ্যোগে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মজদুর ফেডারেশন (১৯৫৮, ফেব্রুয়ারি)। মােহাম্মদ তােয়াহা এর সভাপতি নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ও পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের বিভক্তিকরণ। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হলে সকল রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়। মওলানা ভাসানী গ্রেফতার হন। অনেকের নামে হুলিয়া জারি করা হয়। যে সকল কমিউনিস্ট নেতা-কর্মী ধরা পড়েননি তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকে। ১৯৬২ সালে সামরিক আইন তুলে নেয়া হলে দেশে পুনরায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। কিন্তু ইতােমধ্যে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট শিবিরে বিভেদ ঘটে যায়, যার প্রভাব এদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতেও পড়ে। সােভিয়েত ইউনিয়নের ২০তম কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাবাবলি, ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধে পাকিস্তানের চীনকে সমর্থন দেয়ার নীতি কমিউনিস্টদেরকে চীনাপন্থী ও সােভিয়েতপন্থী। দুই ধারায় বিভক্ত করে। এর প্রভাব পড়ে ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। এই নির্বাচনে বিরােধী দলগুলি মিস ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন দিলে ভাসানী এবং তার দল (আইয়ুব খানের সরকার চীনা সরকারের মিত্র হওয়ায়) নির্বাচনে ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন দেয়নি। কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের মধ্যে সৃষ্ট মতাদর্শ বিরােধ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নকে প্রভাবান্বিত করে। এসময় ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকবর খান রানাে প্রমুখ নেতৃবর্গ কমিউনিস্ট পার্টির চীনাপন্থী নেতা মােহাম্মদ। তােয়াহা প্রমুখের লাইন অনুসরণ করেন। অবশেষে ১৯৬৫ সালের ১ থেকে ৩ এপ্রিল ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে ছাত্র ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত হয়। সম্মেলন শেষে সােভিয়েতপন্থীদের গ্রুপ মতিয়া চৌধুরী ও সাইফুদ্দিন মানিক এবং চীনাপন্থীরা রাশেদ খান মেনন ও সফিকুর রহমানকে যথাক্রমে দুই গ্রুপের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন। এইভাবে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) এবং ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) নামে অভিহিত হয়।
মতিয়া গ্রুপ সােভিয়েট ইউনিয়ন এবং মেনন গ্রুপ চীনের সমর্থকে পরিণত হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে চীন পাকিস্তানকে সমর্থন দেয় এবং সােভিয়েত রাশিয়া ভারতকে সমর্থন দেয়। তখন থেকে এদেশে চীনাপন্থী ও সােভিয়েতপন্থীদের দূরত্ব আরাে বেড়ে যায়। ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্তির পর কমিউনিস্ট পার্টিও চীনাপন্থী ও সােভিয়েটপন্থী এই। দুই অংশ বিভক্ত হয়। চীনাপন্থীরা তােয়াহা ও সুখেন্দু দস্তিদারের নৃেতৃত্বে গঠন করে। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদ-লেলিনবাদ) এইভাবে চীনাপন্থীরা কমিউনিস্ট পার্টি থেকে আলাদা হয়ে গেলে মূল কমিউনিস্ট পার্টি দুর্বল হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ঘােষিত থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি তার অস্তিত্বই কেবল ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি, বরং সারাদেশ জুড়ে শাখা বিস্তার করে পার্টিকে শক্তিশালী করতে পেরেছিল। চীনাপন্থীরা বেরিয়ে যাওয়ার পর ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়; এবং উক্ত অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিকে একটি স্বতন্ত্র সত্বাবিশিষ্ট স্বাধীন পার্টিতে পরিণত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাস্তবে এই পার্টি মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি নামে পরিচিতি লাভ করে।
ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পাটির মতো ন্যাপেও ভাঙনের ধারা লাগে। সেখানেও নেতৃবর্গ সােভিয়েতপন্থী ও চীনাপন্থীতে বিভক্ত হয়। ১৯৬৭ সালে ন্যাপের রংপুর কাউন্সিল অধিবেশনে ভাসানীর নেতৃত্বে চীনাপন্থী ন্যাপ নেতা-কর্মীবৃন্দ উপস্থিত থাকলে মােজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে সােভিয়েতন্থীরা অনুপস্থিত থাকে এবং তারা ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় পৃথক অধিবেশন আয়ােজন করে। এইভাবে দুই পৃথক সম্মেলনে ন্যাপ দ্বিধাবিভক্ত হয়। এরপর থেকে চীনাপন্থী ন্যাপ পরিচিতি লাভ করে ভাসানী ন্যাপ নামে এবং সােভিয়েত পন্থীরা (মস্কোপন্থী) মােজাফফর ন্যাপ নামে। বিভক্তির মাধ্যমে ন্যাপ দুর্বল হয়ে পড়ে । ন্যাপ বিভক্তি হয়ে গেলে এর কিছু সদস্য কমিউনিস্ট পার্টিতে ফিরে যান এবং কিছু সদস্য আওয়ামী লীগে যােগদান করেন। | ১৯৬৬ সালের পর থেকে কমিউনিস্টদের একটি অংশের মধ্যে অতিবিপ্লবী ঝোক প্রবল আকার ধারণ করে। বিপ্লবের রণকৌশল নির্ধারণের প্রশ্নে চীনাপন্থীরা ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল শামসুজ্জোহা-মানিক, আমজাদ হােসেন, নূরুল হাসান, মাহবুবউল্লাহ, আবুল কাশেম ফজলুল হক মিলে গঠন করেন পূর্ববাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন। দেবেন শিকদার ও আবুল বাশার এই সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ করে ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে পাবনার জয়নগরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মা,লে,) গঠন করেন। তবে অল্প কিছুদিন পর এই দুই সংগঠন একত্রীভূত হয়। ১৯৬৯ সালে কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকবর খান রনাে, রাশেদ খান মেনন প্রমুখ ছাত্রনেতা ছাত্রজীবন শেষ করে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমস্বয় কমিটি’ নামে পৃথক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এদের মধ্যে কাজী জাফর আহমদ শ্রমিক আন্দোলনে মনােনিবেশ করেন এবং টঙ্গী শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক সংগঠন গড়ে তােলেন।
সিরাজ শিকদার মাও গবেষণা কেন্দ্র’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে চীনাপন্থী কমিউনিস্টদের সংঘবদ্ধ করেন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই এই কেন্দ্র বিলুপ্ত করে ৮ জানুয়ারি (১৯৬৮) পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠন সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনার ডাক দেয়। এইভাবে দেখা যায় যে, ১৯৬০-এর দশকে বামপন্থী দলগুলি নানান উপদলে। বিভক্ত হয়ে যায় । বিভক্তি ঘটে চীনাপন্থী দলগুলাের মধ্যে বেশি। (৯) কৃষক-শ্রমিক পার্টি (কে.এস.পি) ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ভরাডুবির পর এ.কে. ফজলুল হক রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হন। কিন্তু ১৯৫৩ সালের ২৩ আগস্ট তিনি তার পার্টি কৃষক-প্রজা পার্টিকে পুনর্জন্ম দেন এবং পার্টির নামকরণ করেন কৃষক-শ্রমিক পার্টি। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় পার্টির নামে ‘প্রজা’ শব্দটি পরিবর্তন করে শ্রমিক’ শব্দ যুক্ত করা হয়। এ.কে. ফজলুল হক এর সভাপতি নিযুক্ত হন। মুসলিম লীগ থেকে অনেক হতাশাগ্রস্ত সুবিধাবঞ্চিত নেতা ও কর্মী কে.এস.পি.তে যােগদান করে। যােগদানকারী উল্লেখযােগ্য মুসলিম লীগার ছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক, আবু হােসেন সরকার, আশরাফউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তাতে যােগ। দেন মুসলিম লীগের তরুণ কর্মীরা, যারা অধিকাংশ ছিলেন নিমবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর । কেএসপিতে মূলত যােগ দেন মুসলিম লীগের সিনিয়র সদস্যরা, যারা অধিকাংশই ছিলেন প্রবীণ এবং সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর। ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি গঠিত হয় । দল গঠনের পর পরই আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং নেজামে এছলামীর সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। মওলানা ভাসানী কিংবা সােহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী না-হওয়ায় এ.কে. ফজলুল হক যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি পাটি নেতা নির্বাচিত হন। এরপর তার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া, তার দলের কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠন, যুক্তফ্রন্টের ভাঙন, পূর্ববাংলায় কে.এস.পির সরকার গঠন- ইত্যাদি বিষয়ে দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে। এখানে কেবল এইটুকু মন্তব্য করা যায় যে, ১৯৫৮ সালের পর এই দলটি কেবল কাগজে-কলমে থেকে যায়, এর। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। (১০) পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পূর্ববাংলা কংগ্রেস দলীয় সদস্যরা তাদের পাটিকে ‘পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ নামে পুনর্গঠিত করেন। ইসলামী দেশ পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষাই ছিল এই দলের উদ্দেশ্য । সে-সময় তফশিলি সম্প্রদায়ের অনেক হিন্দু কংগ্রেসে যােগদান করে। ১৯৪৭-এর পর পাকিস্তানের মতাে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে কংগ্রেসের রাজনীতি সহজ ছিল না। মুসলিম লীগের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সাম্প্রদায়িক আচরণ, প্রাদেশিক পরিষদ ও গণপরিষদে কংগ্রেস দলীয় সদস্যদেরকে পাকিস্তানের শত্রু এবং ভারতীয় অনুচর হিসেবে গালমন্দ করা, পত্রপত্রিকাগুলিতে বিরূপ সমালােচনা ইত্যাদি কারণে পূর্ববাংলা তথা পাকিস্তানে কংগ্রেস পার্টির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনি পরিস্থিতিতে পাকিস্তান কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি কিরণ শঙ্কর রায় খুব শীঘ্র ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন এবং দেশভাগের আট মাসের মাথায় তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। তখন শ্ৰীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কংগ্রেসের হাল ধরেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক আসন নির্দিষ্ট আসন নির্দিষ্ট থাকায় আইন পরিষদে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান প্রতিটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ছিল। স্বভাবতই পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ববাংলা প্রাদেশিক আইন পরিষদে এবং প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যদের ভােটে গঠিত পাকিস্তান গণপরিষদে হিন্দু-প্রতিনিধিও ছিল। প্রকৃতপক্ষে এই হিন্দু-সদস্যরাই পূর্ববাংলা প্রাদেশিক আইন পরিষদ এবং পাকিস্তান গণপরিষদে বিরােধী দলের ভূমিকা পালন করে। তখন সকল মুসলমান-সদস্য ছিলেন। মুসলিম লীগ দলের।
বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদানের দাবি গণপরিষদে উত্থাপন করেছিলেন কংগ্রেস দলীয় সদস্য কুমিল্লার বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলে এক সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু যেহেতু একজন হিন্দু সদস্য বাংলাভাষার প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন অতএব এর পিছনে ভারতের চক্রান্ত আছে বলে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন। স্বভাবতই কোনাে হিন্দু সদস্যের পক্ষে এখানে স্বাধীনভাবে রাজনীতি করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। তথাপি ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলার যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করায় ৭২ জন হিন্দুপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। পাকিস্তান দ্বিতীয় গণপরিষদেও এরা আসন পায়। ১৯৫৪-৫৮ সময়কালে পূর্ববাংলার সরকার ভাঙা-গড়া’ খেলায় হিন্দু-প্রতিনিধিরা ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িকীকরণ করা হলে অনেক হিন্দু রাজনীতিবিদগণ এই দলে যােগদান করেন। ফলে কংগ্রেস দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘােষিত হলে কংগ্রেস দলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। সামরিক আইন প্রত্যাহৃত হলে অনেক দলের পুনরুজ্জীবন ঘটলেও পাকিস্তান কংগ্রেসের কার্যক্রম বিষয়ে কোনাে তথ্য পাওয়া যায় না।
(১১) খিলাফতে রব্বানী পার্টি ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মতান্তরে ২০ এপ্রিল এই পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। শােষণহীন ইসলামী সমাজ জীবন কায়েম করা এই পাটির উদ্দেশ্য ছিল। যেহেতু তৎকালীন নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানে ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনে ব্যর্থ এবং যে-উদ্দেশ্য নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি সেই দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা যেহেতু মুসলিম লীগকে দিয়ে সম্ভব নয় তাই খিলাফতে রব্বানী পাটির প্রতিষ্ঠা করা হয় বলে এই পাটির আহ্বায়ক ও তমুদ্দন মজলিশের প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব সােলায়মান খান বলেন। (১২) নেজামে এছলামী। কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষাভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে ১৯৫৩ সালের ১ আগস্ট এই পার্টি গঠিত হয় । মওলানা হাফেজ আতাহার আলী এই দলের সভাপতি নিযুক্ত হন। যদিও মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত উলামাবৃন্দ এই দলের সদস্য হন, কিন্তু ফরিদ আহমদ এবং সৈয়দ কামরুল আহসানের মতাে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু ব্যক্তিত্ব এই দলে যােগ দেন। মূলত উচ্চবিত্ত মুসলমানেরা এই দলের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত থাকেন। | ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগ বিরােধী গঠিত জোট যুক্তফ্রন্টের শরিকদল ছিল নেজামে এছলামী। সামরিক আইন প্রত্যাহৃত হওয়ার পর এই দল পূর্ব পাকিস্তানে উল্লেখযােগ্য প্রসার লাভ করতে পারেনি। (১৩) জামায়াতে ইসলাম ব্রিটিশ আমলেই এই দলের জন্ম । যদিও জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরােধী ছিল, কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে এই দল পাকিস্তানকে দলীয় আদর্শ বাস্তবায়নের উত্তম ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে ।
দেশ ভাগের প্রথম দিকে জামায়াতে ইসলামী সামাজিক কর্মকান্ড এবং ইসলামী জ্ঞানচর্চার কর্মসূচি গ্রহণ করে। এইভাবে একটা সমর্থক গােষ্ঠী শুরু হলে জামায়াত রাজনৈতিক কর্মসূচি হাতে নেয় । পাকিস্তানের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে এই দল প্রথম সফলতা অর্জন করে ১৯৫৮ সালের করাচী মিউনিসিপ্যাল করপােরেশনের নির্বাচনের এক ডজনেরও বেশি আসন লাভের মাধ্যমে। এই দল একটি আদর্শভিত্তিক দল হওয়ায় এবং দলীয় নেতা-কর্মীদেরকে কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা অনুসরণ করতে হত বিধায় দলটি আপামর জনসাধারণের সমর্থন অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। অন্য রাজনৈতিক দলগুলিতে যেমন যে-কেউ যখন খুশি তখন দলের সদস্যপদ লাভ করতে পারে, জামায়াতে ইসলামের সদস্যপদ লাভ তেমন। সহজসাধ্য ছিল না। এই দলের সদস্যপদ লাভ করতে হলে দলের নির্দেশিত মত ও পথ অনুসরণ করতে হতাে। ফলে দলের সদস্য সংখ্যা বাড়েনি। ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানে। এই দলের মােট সদস্য সংখ্যা ছিল ১২৭১ জন। দলের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। জামায়াতে ইসলামী দলের সদস্যদেরকে নিয়মিত চাদা, জাকাত, কোরবানির পশুর চামড়া, অনুদান প্রভৃতি দিতে হত। স্বাধীনতার পর থেকে মওলানা মওদুদী এই দল পরিচালনা করতে থাকেন। তিনি প্রচুর ইসলামী সাহিত্য রচনা করেছেন যা প্রায় ক্ষেত্রে বিতর্কিত। জামায়াতের যে দর্শন তার দিক নির্দেশক মওলানা মওদুদী। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ পূর্ব পাকিস্তানেও এর শাখা গঠিত হয়।
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের জন্ম যাহােক, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে বাংলায় তিনটি ছাত্র-সংগঠন ছিল : ১. কম্যুনিস্ট পন্থী All Bengal Student Federation. ২. কংগ্রেসপন্থী All Bengal Student Congress. ৩. মুসলিম লীগ পন্থী All Bengal Muslim Student League. বাংলা বিভক্তির পর পূর্ববাংলাতে উপরিউক্ত প্রতিটি সংগঠনের শাখা গঠিত হয়। | ABMSL-এ দুই গ্রুপ বিদ্যমান ছিল। তন্মধ্যে হাশিম-সােহরাওয়ার্দীর অনুসারীরা ছিল উদারনৈতিক, অন্যপক্ষে নাজিমউদ্দীন-আকরাম খা’র অনুসারীগণ ছিল রক্ষণশীল । বাংলা বিভক্তি প্রশ্নে বাংলা মুসলিম লীগে হাশিম-সােহরাওয়ার্দীরা বাংলা বিভক্তির বিরােধিতা করেন এবং ফলশ্রুতিতে তারা ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পরেও কলকাতায় থেকে যান। কিন্তু তাদের অনুসারী অনেক ছাত্রনেতা ও কর্মীবৃন্দ পূর্ববাংলায় চলে আসে। স্বাধীন পূর্ববাংলায় নাজিমউদ্দীনের মুখ্যমন্ত্রিত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হলে শাহ আজিজ-শামসুল হুদা চৌধুরী প্রমুখ রক্ষণশীল ছাত্রনেতৃবৃন্দ সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে। অন্যপক্ষে হাশিম গংদের অনুসারী ছাত্রবৃন্দ সরকারের বিরােধীপক্ষ অবলম্বন করে। ফলে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ববাংলা মুসলিম স্টুডেন্ট লীগ’ দ্বিধাবিভক্ত হয় এবং নঈমুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে East Pakistan Muslim Student League গঠিত হয়। সরকার সমর্থিত অংশের নামকরণ হয় All East Pakistan Muslim Student League. ১৯৪৮থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত সংঘটিত ভাষা আন্দোলনে যেখানে EPMSL অগ্রণী ভূমিকা রাখে সেখানে AEPMSL সরকারের গুণ্ডাবাহিনীতে পরিণত হয়। ১৯৪৯ সালের জুন মাসে East Pakistan Awami Muslim League গঠিত হলে EPMSL আওয়ামী-মুসলিম লীগের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয় এবং AEPMSL মুসলিম লীগের এক কাগুজে ছাত্র-সংগঠনে পরিণত হয়। এই অংশের নেতা ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান।
(১) পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (পরে ছাত্রলীগ) ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন নঈমুদ্দিন আহমদ (রাজশাহী)। ছাত্রলীগের প্রথম সাংগঠনিক কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন : | ১. আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল); ২. শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর); ৩. অলি আহমদ (কুমিল্লা); ৪. আজিজ আহমদ (নােয়াখালী); ৫. আবদুল মতিন (পাবনা), ৬. দবিরুল ইসলাম (দিনাজপুর), ৭. মফিজুর রহমান (রংপুর); ৮. শেখ আবদুল আজিজ (খুলনা); ৯. নওয়াব আলী (ঢাকা); ১০. নূরুল কবির (ঢাকা সিটি); ১১. আবদুল আজিজ (কুষ্টিয়া); ১২. সৈয়দ নুরুল আলম (ময়মনসিংহ); ১৩. আবদুল কুদ্স চৌধুরী (চট্টগ্রাম)। | প্রতিষ্ঠালগ্নে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নিমলিখিত কর্মসূচী গ্রহণ করে : ছাত্রলীগের আদর্শ ও উদ্দেশ্য। ১. ক, পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন প্রতিভা সৃষ্টির উপযােগী পরিবেশ তৈরি করা; খ, বিভিন্ন রকমের কারিগরি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি ও ধাত্রীবিদ্যা শিক্ষার জন্য ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহিত করা। ২. পাকিস্তানকে আভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুদের কবলমুক্ত করা এবং সর্বশক্তি দিয়ে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। ৩, ক, স্বার্থান্বেষী নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম এবং ছাত্রসমাজকে তাহাদের স্বার্থসিদ্ধির যন্ত্ররূপে চালিত হইতে না দেওয়া; খ, ছাত্রসমাজকে দলীয় রাজনীতি হইতে মুক্ত রাখা। ৪. ক, নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা; থ, ছাত্রসমাজকে পরস্পর সহযােগিতার ভিত্তিতে অবিচ্ছেদ্যভাবে একত্রীভূত করা; গ. ছাত্রসমাজের ন্যায্য দাবি-দাওয়াগুলােকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা; ঘ, ছাত্রসমাজকে কৃষ্টি ও আধুনিক রাজনৈতিক আন্দোলনের সংস্পর্শে আনিয়া নৈতিক ও চারিত্রিক বিপ্লবের সৃষ্টি করা; ভ, জাতি ও দেশের কল্যাণের জন্য ছাত্রসমাজের বিক্ষিপ্ত কর্মশক্তিকে সুসংবদ্ধ কেন্দ্রীভূত করা। ইসলামিক নীতির উপর ভিত্তি করতঃ জাতীয় দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়া অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সমতা আনয়ন করা। পাকিস্তানের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সমানাধিকারের ভিত্তিতে সৌহার্দ্য ও মিলনের পথ সুপ্রশস্ত করা। জনসংখ্যার অনুপাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়াগুলাের সুনিশ্চিত ব্যবস্থা করিয়া দিয়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মিলনকে সুদৃঢ় করা। ৮, সরকারের জনকল্যাণকর কর্মপদ্ধতিকে সমর্থন করা এবং গণস্বার্থবিরােধী কর্মপন্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা।
প্রাপ্তবয়স্কদের সার্বজনীন ভােটাধিকারের দাবি। ১০. দুনীতি, স্বজনপ্রীতি, মুনাফাকারী ও চোরাকারবারীদের উচ্ছেদ সাধন এবং ব্যক্তিকে কেন্দ্র করিয়া ছাত্র-আন্দোলন পরিচালনার যে রেওয়াজ প্রচলিত আছে, তার ধ্বংস সাধন। ছাত্রলীগের দাবি। আজাদী লাভের পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পাঠ্যপুস্তকের আমূল পরিবর্তন। অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন ও বর্তমান শিক্ষা সংকোচ নীতির প্রতিরােধ। ৩. ক. বিনাব্যয়ে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার প্রবর্তন; খ. পূর্ব পাকিস্তানের যুবকদের বিমান, নৌ, স্থল প্রভৃতি সামরিক শিক্ষা প্রদানের জন্য অনতিবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন; গ. পাকিস্তান নৌবিভাগের সদর দফতর চট্টগ্রামে স্থানান্তরিতকরণ। ৪. কারিগরি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারী, ধাত্রীবিদ্যা প্রভৃতি প্রসারের অধিকতর সুবন্দোবস্তকরণ। ৫. ক, স্বল্পব্যয়ে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা; খ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে অধিকতর সরকারি সাহায্য; গ. শিক্ষায়তনগুলােতে উপযুক্ত বেতন দিয়া উপযুক্ত শিক্ষক নিয়ােগ; ঘ, পল্লী অঞ্চলকে শিক্ষাকেন্দ্ররূপে গড়িয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে মফস্বল শিক্ষায়তনগুলাের জন্য অধিকতর ছাত্রাবাসের প্রতিষ্ঠা। ঙ. গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য শিক্ষায়তন ও ছাত্রাবাসগুলােতে অধিকতর ফ্রি স্টুডেন্টশিপ এবং বৃত্তির সংখ্যা বাড়াইয়া দেওয়ার ব্যবস্থা; চ. শিক্ষায়তনসমূহের পাঠাগারগুলিতে ইসলামিক কৃষ্টি ও ঐতিহ্যমূলক গ্রন্থের সমাবেশ; ছ, বিনাব্যয়ে ছাত্রদের চিকিৎসার উপযুক্ত ব্যবস্থা। ৬. নারীশিক্ষা প্রসারের উপযুক্ত ব্যবস্থা। ৭, পূর্ব পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজসমূহে বাংলাভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান ও পরীক্ষা গ্রহণের আশু ব্যবস্থা। ৮. শিক্ষায়তনগুলােকে স্বায়ত্তশাসনমূলক ক্ষমতা প্রদান। ৯. শিক্ষায়তন ও ছাত্রাবাসগুলােতে স্বায়ত্তশাসনমূলক ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার। ১০.শিক্ষায়তনসমূহে পুলিশের অন্যায় ও অযথা হস্তক্ষেপ বন্ধ করিয়া দিয়া শিক্ষায়তনগুলাের পবিত্রতা রক্ষা করা।” সূত্র : স্বাধীনতার দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড, পৃ.৪৭-৪৮।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে ‘মুসলিম’ শব্দ থাকায় হিন্দু-সদস্যদের ঐ দলে যােগদান সম্ভব হয়নি। ১৯৪৯ সালে ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িকীকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । কিন্তু গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তা কাউন্সিলারগণের অনুমােদনের প্রয়ােজন ছিল। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কোনাে কাউন্সিল অধিবেশন না-হওয়ায় ছাত্রলীগের নাম থেকে মুসলিম’ শব্দ বাদ দেয়া বিলম্বিত হয়। ১৯৫৩ সালে কাউন্সিল অধিবেশনের পর থেকে ছাত্রলীগ অসাম্প্রদায়িক ছাত্র-সংগঠনে পরিণত হয়। কালক্রমে পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রলীগ একক বৃহত্তম দলে পরিণত হয়। পাকিস্তান আমলে অন্যান্য ছাত্র-সংগঠনে ভাঙন ধরলেও ছাত্রলীগের ঐক্য অটুট থাকে। এই সংগঠনটি পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে সকল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। ১৯৪৮-৫২ সময়ের ভাষা আন্দোলনে, ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনে: ১৯৬০, ৬২ ও ৬৪-এর আইয়ুব-বিরােধী ছাত্র। আন্দোলনে, ১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলনে এবং ৬৯-এর গণআন্দোলনে বলিষ্ঠ । ভূমিকা রাখে। এর সংগ্রামী ঐতিহ্য গৌরবােজ্জ্বল অলি আহমদ ছাত্রলীগের কৃতিত্বের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে লিখেছেন।
ছাত্রমহলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে উদ্বুদ্ধ করে। প্রকৃতপক্ষে প্রদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে ছাত্রলীগ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করিয়াছে । বিভিন্ন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের একক দাবিদার এই ছাত্রসংগঠন। ভাবীকালে এই সংগঠন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামাের রূপায়ণ ও পরিবর্তনে এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে এক উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। ছাত্র ফেডারেশন দেশভাগের পর পূর্ববাংলা ছাত্র ফেডারেশনের যে শাখা গঠিত হয় তা গােড়াতেই বেশ দুর্বল ছিল। এই সংগঠনটি কম্যুনিস্ট পার্টির অঙ্গ সংগঠন ছিল। এর অধিকাংশ সদস্য ছিল হিন্দু। দেশভাগের পর হিন্দু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা ব্যাপক হারে ভারতে গমন করায় কম্যুনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ফেডারেশন উভয় সংগঠন এখানে দুর্বল এবং অকার্যকর হয়ে পড়ে। তাছাড়া সরকারের দমননীতির কারণেও ছাত্র ফেডারেশন এখানে স্থায়ী হতে পারেনি। পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালে এই দলের অনেক নেতা-কর্মীর উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হয়।
সূত্রঃ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস – মুনতাসীর মামুন, মো. মাহবুবুর রহমান