You dont have javascript enabled! Please enable it! তােফায়েল আহমদের সাক্ষাৎকার -সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লীগ - সংগ্রামের নোটবুক

তােফায়েল আহমদ
সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লীগ, মুজিব বাহিনী নেতা চতুষ্টয়ের অন্যতম
প্রশ্ন আপনি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদে ছিলেন না কেন?
তােফায়েল আহমদ এ প্রশ্নের উত্তর আমি কিভাবে দেব— বিপ্লবী পরিষদে আমি ছিলাম না, এ কথা তাে ঠিক নয়। কারণ, আপনারা জানেন যে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদেরই চূড়ান্ত রূপ হল বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-বিএলএফ। পরবর্তীকালে যার নাম হল মুজিব বাহিনী । আমরা চারজন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং আমি আমরা গঠন করি এই মুজিব বাহিনী । স্বাধীনতার জন্য যুব সমাজ এবং ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করা, এসব দায়িত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমাদের চারজনের ওপরই ন্যস্ত করেছিলেন । আজকে যারা এই বিপ্লবী পরিষদ সম্পর্কে ইন্টারভিউ দেন, বিভিন্ন খবরের কাগজে যাদের নাম দেখি তারা ওই সময় তাে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ। ছিলেন না। কিন্তু তাদের ইন্টারভিউতে মনে হয় তারাই ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ এবং যারা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তাদের কোন ভূমিকাই ছিল না। এইভাবে আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে। আসলে ১৯৬২ সালে আমরা যখন বরিশাল বিএম কলেজে পড়ি, তখন আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি লিফলেট পাই এবং আমরা সেটা বিলি করি এবং তার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব । কারণ, আপনারা জানেন যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু কিন্তু পাকিস্তানকে মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেননি । যার জন্য ১৯৪৭ সালের পরেই তিনি তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠন করেন এবং ছাত্রলীগ গঠনের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করেন। যার চূড়ান্তু রূপ নেয়া শুরু করে ১৯৬২ সালে এবং ১৯৬২ সালেই তিনি বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য যেসব রাষ্ট্রের সাহায্যসহযােগিতা গ্রহণের চেষ্টা করেছিলেন তার মধ্যে ভারতের নাম করা যায়। তখন তার। নির্দেশে সারা বাংলাদেশে আমরা লিফলেট ছড়াই এবং যুব সমাজে তার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি । আজকে শেখ ফজলুল হক মণির নাম নেই। আজ সেখানে কেউ কেউ বিবৃতিতে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদের নাম বলছেন । কাজী আরেফ আহমেদ তখন তাে কলেজের ছাত্র ছিলেন। তারা দুই তিনজনে বসে কোন একটা আলাপ করলে সেটাই বিপ্লবী পরিষদ
হয়ে গেল। আমার মনে হয় তারা কাজী আরেফই এটা বলতে পারেন। অথচ ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক যারাই হয়েছেন, তাদের ওপরেই বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে দায়িত্ব দিয়েছেন। কাজী আরেফ ছাত্রলীগের সে ধরনের নেতা, সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন না।
 প্রশ্ন তাহলে ১৯৬২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ডাক সম্বলিত একটি লিফলেট পেয়েছিলেন, এটা সত্য?
তােফায়েল আহমদ হ্যা সত্য। ১৯৬২ সালে আমরা সেই লিফলেট পাই । আমরা তখন বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র । 
প্রশ্ন : স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামক কোন সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল বলে কি আপনি জানতেন?
তােফালেল আহমদ : স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে কোন কিছু গঠন করা হয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা যে যেখানে ছিলাম সেখান থেকে স্বাধীনতার প্রক্রিয়া শুরু করি । 
প্রশ্ন : যেখানে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন করেন, সেখানে আপনারা মুজিব বাহিনী গঠন করলেন কেন? ভারত সরকার আপনাদেরকে ট্রেনিং এবং অস্ত্র দিতে চাইলই বা কেন?
তােফায়েল আহমদ এটাই মূল, অরিজিনাল । এটারই ট্রেনিং হবার কথা ছিল ১৯৬৯ সালে । বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার জন্যে এখানে পেছনের কথায় যেতে হয় । ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন গিয়েছিলেন। সফরটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক। সেখানে বসে তিনি এই স্বাধীনতার পরিকল্পনা রচনা করেন। পরিকল্পনা অনুসারে কথা ছিল আমরা মাসে পঁচিশজন ছেলে রিক্রুট করবাে এবং প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রের একটি বিশেষ জায়গায় গেলে ট্রেনিং পাবাে। আমরা চারজন রিক্রুটমেন্ট শুরু করি— সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক এবং আমি ।
প্রশ্ন : এটা ১৯৬৯ সালে?
তােফায়েল আহমদ ১৯৬৯ সালে। বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে ফিরে এলে আমরা ট্রেনিংয়ের জন্য, গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করবাে বলে মােটামুটি তৈরি হয়ে যাই। কিন্তু ইতােমধ্যে সত্তরের নির্বাচনের তারিখ ঘােষিত হয়ে যায়। তখন বঙ্গবন্ধু এই পরিকল্পনাটি স্থগিত রাখেন। বললেন, নির্বাচনে যাওয়ার প্রয়ােজন এই কারণে যে, বাংলার নেতা কে সেটা প্রমাণিত হওয়া উচিত। এখন যদি ট্রেনিং নিতে কেউ যায় এবং ট্রেনিং শেষে অস্ত্র হাতে কেউ ধরা পড়ে তাহলে এর অজুহাতে নির্বাচন তারা বানচাল করবে । যে কারণে আমাদের সেই ট্রেনিং পরিকল্পনা স্থগিত থাকে এবং নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তরিত হচ্ছে না দেখে বঙ্গবন্ধু আমাদেরই এক সহকর্মীকে বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে পাঠালেন ।
প্রশ্ন : তিনি কে ?
তােফায়েল আহমদ : সত্তরের নির্বাচনের আগেও বঙ্গবন্ধু তার প্রতিনিধিকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন। নির্বাচনের পর পাঠান ডাক্তার আবু হেনাকে। প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য হয়েছিলেন সিরাজগঞ্জ থেকে । আর আগে যিনি গিয়েছিলেন তিনি। আমাদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। তাে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় গিয়ে আমরা সানি ভিলায় উঠি । একাত্তরের যুদ্ধ শুরু হবার আগেই এ বাড়িটি নেয়া ছিল। এছাড়া বনগাঁ, বসিরহাট এবং আগরতলা আমাদের জন্য সেল্টার ছিল। আর এই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমাদের এই চারজনকে নিয়ে বসতে । সত্তরের নির্বাচনের পর যখন জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসছে না তখন আমরা তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে বৈঠক করি । বৈঠকে আলােচনা হয়েছে যে আমাদের সংগঠনই ট্রেনিং প্রাপ্ত হবে। এটা হবে রাজনৈতিক লক্ষ্য প্রণােদিত একটি বাহিনী। এটা কিন্তু একাধিকবার বঙ্গবন্ধু বলেছেন এবং তাজউদ্দীন আহমদ জানতেন  গণহত্যা শুরু হলে আমরা ভারতে গেলাম । ভারতে গিয়ে আমাদের আশ্রয়, যেটার ঠিকানা বঙ্গবন্ধু আমাদের মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিলেন, কাগজে লেখা ছিল, সেই ঠিকানায়। শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং আমি গিয়ে উঠি । তাে এটা মুজিব বাহিনী, অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের বিকল্প কিছু ছিল না। কারণ, এটা তাে আমাদের অরিজিনাল  আমি মুজিব বাহিনীর সদর দফতরে থাকতাম  কলকাতা ছিল সদর দফতর। সেখানে অস্ত্র এবং অর্থ আসতাে আমার কাছে  আমি বিতরণ করতাম  আমি তাজউদ্দীন আহমদের সাথে থেকে সমন্বয় সাধন করেছি। কাজেই মুজিব বাহিনীকে যারা অন্যভাবে চিহ্নিত করতে চান বা অস্থায়ী সরকারের প্যারালেল বা সমান্তরাল কিছু বলতে চান, সেটা ঠিক নয়।
প্রশ্ন মুজিব বাহিনী সংগঠক মেজর জেনারেল উবান তার বইতে বলেছেন, যুব নেতারা তাকে বলেছেন যে, ভারত সরকার নকশাল এবং মার্কসবাদীদের ট্রেনিং এবং অস্ত্র দিচ্ছে তাদের পঁচিশ বছরের অর্জিত সাফল্য নস্যাৎ করার জন্য। যুবনেতারা মানে আপনারা,মুজিব বাহিনী নেতা চতুষ্টয় । আপনারা তাকে এ কথা বলেছিলেন?
তােফায়েল আহমদ না। এ কথা ঠিক নয়। আমি জেনারেল উবানের বইটা। পড়েছি। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। খুব ভাল লােক। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সাহায্য-সহযােগিতা করেছেন। তার সঙ্গে আমরা ওৎপ্রােতভাবে জড়িত ছিলাম। তিনি তার বইতে আমাদের প্রশংসাও করেছেন। তথাপি বলতে হচ্ছে, তার বইয়ের সব তথ্যই সঠিক নয়। আর তাছাড়া, ভারত সরকার নকশাল ও মার্কসবাদীদের অস্ত্র দিতে পারে, এটা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। সুতরাং, তার সঙ্গে এ ধরনের আলােচনার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
 প্রশ্ন : জেনারেল উবান আরাে বলেছেন, যুব নেতারা তাকে জানিয়েছেন যে দেশ স্বাধীন হবার পর তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত । আপনারা তাকে কি এমন কথা বলেছিলেন?
তােফায়েল আহমদ এ কথাটাও ঠিক নয়। আমি তাে শুধু আপনার এই ইন্টারভিউতেই নয়, বইটা পড়ে অনেক জায়গায় আমি আমার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছি । বলেছি বইটায় ঘটনা বিকৃত করা হয়েছে। অনেক কথাই সঠিক নয়। তাজউদ্দীন আহমদ যেখানে সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন; যেখানে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন, সেখানে তিনি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চান— এটা কখনাে তার কাজকর্মে আমরা লক্ষ্য করিনি। কাজেই তার কথা সঠিক নয় ।
প্রশ্ন : আপনারা, চার নেতা জেনারেল উবানকে বলেছিলেন যে একটি ভারতীয় বিলাসবহুল হােটেলে নকশালপন্থী নেতাদের সঙ্গে ভারতীয় অফিসারদের আলাপআলােচনা করতে দেখেছেন। সম্ভবত তাদেরকে ওই হােটেলে রাখা হয়েছিল। আপনারা আরাে জানিয়েছিলেন তাকে, নকশালদের ট্রেনিং ও অস্ত্র দেয়া হয়েছে। ট্রেনিং প্রদানের জায়গার নামও আপনারা উল্লেখ করেছিলেন জেনারেল উবানের কাছে। এই নেতারা কারা এবং কোন হােটেলে ছিলেন তারা? ট্রেনিংটা কোথায় হয়েছিল?
তােফায়েল আহমদ এই ধরনের কোন কথা জেনারেল উবানকে বলেছি বলে। মনে পড়ে না। আর ভারত সরকার নকশালদের ট্রেনিং দেবে এটা আমাদের চিন্তার মধ্যে ছিল না। এটা সঠিক নয়। সে কারণেই তাে বলেছি জেনারেল উবানের বইয়ে এমন কিছু কথা আছে, যা সঠিক নয়।
প্রশ্ন : জেনারেল উবানের বই বাজারে এসেছে অনেকদিন আগে । তার অসত্য কথার প্রতিবাদ করেননি কেন? প্রতিবাদ করা উচিত ছিল।
তােফায়েল আহমদ এটা আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা প্রতিবাদ করবাে কীভাবে । এর প্রতিবাদে তাে একটা বই লিখতে হয়। আমাদের বিরুদ্ধে তাে অনেকেই। অনেক কথা লিখেছেন। যেমন অধ্যাপক আবু সাঈদ লিখেছেন, ‘ফ্যাক্টস এ্যান্ড ডকুমেন্টস’ নামে একটি বই । আমাদের বিরুদ্ধে যিনি যেখানে যা বলেছেন, সেটাই তার “ফ্যাক্টস অ্যান্ড ডকুমেন্টস”— এ স্থান পেয়েছে; বইটা তার নিজস্ব মতামত নয় এবং তা সত্য কি মিথ্যা সেটা যাচাই করেননি। কেউ যাচাই করছেন না। যেমন ধরুন, আমি একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী। ভিন্ন রাজনৈতিক দলের যারা, আমাদের রাজনীতি তাদের অপছন্দ। তাদের একজন আমাদের সম্পর্কে কিছু লিখলেন এবং সেটাই ফ্যাক্ট হয়ে গেল, এটা তাে ঠিক নয়। যেমন আপনি আজকে আমাকে কিছু প্রশ্ন করেছেন যাচাই করার জন্য, এই যাচাই তাে কেউ করেন না। আমাদের দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লেখালেখি হচ্ছে। এটা কি ঠিক? আজকে যাদের বয়স উনিশ, তারা তাে বাংলাদেশের সত্যিকারের ইতিহাস জানলাে না। কারণ, যে যা লেখেন সেখানে। নিজেকে মুখ্য করেই লেখেন। এতে সত্যিকারের ইতিহাস হারিয়ে যায় । 
প্রশ্ন : মঈদুল হাসান তার মূলধারা ‘৭১’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে “তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকলে দেশ স্বাধীন হবে না। তাজউদ্দীন আহমেদ শেখ মুজিবের গ্রেফতার হবার কারণ।” এ ধরনের প্রচারণা মুজিব বাহিনী নেতারা করেছিলেন। এ সত্য?
তােফায়েল আহমদ এই মঈদুল হাসান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কো) করতেন। সত্তরের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাজউদ্দীন আহমদের বন্ধু ছিলেন। মূলধারা ‘৭১ তিনি ভালই লিখেছেন। কিন্তু বইতে দু একটি কথা যেমন, এই কথাটি সঠিক নয়। সেই মুজিব নগরে ১৭ই এপ্রিল যখন অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়, আমরা সেখানে ছিলাম । আমরা চারজনেই গিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে একাধিকবার আলােচনা করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ । আমরা সেই থিয়েটার রােডে গিয়েছি। বৈঠক করেছি  সরকার গঠিত হয়েছে । তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেই হেলিকপ্টারে করে, প্লেনে করে সীমান্ত এলাকায় অনেকবার ঘুরেছি। শিলিগুড়িতে শেখ ফজলুল হক মণি, তাজউদ্দীন আহমদ এবং আমি এক সঙ্গে ছিলাম। তিনি তখন। প্রধানমন্ত্রী যদিও তখনাে ঘােষণা হয়নি কিন্তু ভাষণ টেপ করে এসেছিলেন। আমরা শিলিগুড়ি রেস্ট হাউজে বসেই রেডিওতে সেই ভাষণ শুনি । আমরা, আমি আর শেখ ফজলুল হক মণি জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম । আমি এবং আমরা মুজিব বাহিনীর জন্য সদস্য রিক্রুট করতাম । মনসুর আলীর চিঠি ছিল আমাদের কাছে যে আমরা মুজিব বাহিনীর জন্য সদস্য রিক্রুট করবাে। কিন্তু এই মঈদুল হাসান এবং তার মতাে আরাে কিছু লােকের জন্য ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যাতে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে দুরত্ব তৈরি হয়ে যায় এবং যা থেকে তারা পরবর্তীকালে ফায়দা লুটতে পারেন, সে চেষ্টায় এরা ছিলেন। কিন্তু তারা সফল হননি।
প্রশ্ন : ‘তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল,’- মঈদুল হাসান তার ‘মূলধারা ‘৭১’- এ কথা বলেছেন। এ কতটুকু সত্য?  তােফায়েল আহমদ এটা মঈদুল হাসানের বই না পড়লে কিন্তু আমরা জানতাম। একটা মুক্তিযুদ্ধ চলছে এবং যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে বন্ধুরাষ্ট্রে গিয়ে, সেখানে তাজউদ্দীন আহমদকে তারাই হত্যার ষড়যন্ত্র করছে এ ধরনের কল্পনা বা এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা মঈদুল হাসানরাই করতে পারেন। মঈদুল হাসানের বইটার প্রশংসা অনেকেই করেছেন। আমিও করি। কিন্তু কিছু অসত্য কথা রয়েছে তার বইতে । সত্যকে বিকৃত করা হয়েছে। খেয়াল করলে দেখতে পাবেন বইটিতে তিনি প্রচ্ছন্নভাবে আমাদেরই নেতা। তাজউদ্দীন আহমদকে বড় করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আর বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার চেষ্টা রয়েছে। কারণ, রাজনৈতিকভাবে মঈদুল হাসান আর আমরা তাে এক ছিলাম না।
প্রশ্ন : মুজিব বাহিনীর মটিভেশনটা কি ছিল?
তােফায়েল আহমদ মুজিব বাহিনী ছিল আমাদের আদর্শিক বাহিনী। শুধু ভৌগােলিক স্বাধীনতা আসবে, পতাকা বদল হবে, দেশের নামে পরিবর্তন আসবে, সেজন্য আমরা যুদ্ধ করছি না অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশ হবে শােষণমুক্ত বাংলাদেশ। এই শশাষণমুক্ত বাংলাদেশই একটা আদর্শ ১৯৬৯ এর এগার দফায় ছিল। বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা এর মধ্যেই ছিল। মটিভেশন ছাড়া হাতে অস্ত্র ভয়ঙ্কর ব্যাপার। তাই অস্ত্র নেবসে অস্ত্রের উদ্দেশ্য কী, লক্ষ্য কী, কেনই বা দেশ স্বাধীন করবাে এই মটিভেশন আমরা মুজিব বাহিনী সদস্যদের দিতাম। আমাদের ছেলেরা মুক্তি বাহিনীর সাথে কাধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন সেখানে মটিভেট করেছি আমরা।
প্রশ্ন : তানদুয়া মুজিব বাহিনী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রধান করা হয় হাসানুল হক ইনুকে । অথচ ইনু সে সময় ছাত্রলীগের কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। কেন তাকে কেন্দ্রপ্রধান করা হল?
তােফায়েল আহমদ : হাসানুল হক ইনুকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রধান করা হয়, এটা। একদমই সঠিক নয়। বাংলাদেশের নিয়ম হল, যিনি যখন ইন্টারভিউ দেন—এমনভাবে বলেন, মনে হয় তিনিই সব। যারা ভাল বক্তৃতা দিতে পারতেন, আমাদের আদর্শ বােঝাতে পারতেন, প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে তাদের থেকে ত্রিশজনকে আমরা ইনস্ট্রাক্টর করি । হাসানুল হক ইনু, ওই ত্রিশজন ইনস্ট্রাক্টরের একজন ছিলেন। সেখানে কাউকে প্রধান করা হয়নি। আমরা চারজন প্রত্যেক মাসে সেখানে যেতাম। প্রত্যেক ব্যাচকে মটিভেট করতাম, বক্তৃতা দিতাম।
প্রশ্ন : তাহলে তিনি প্রশিক্ষণ প্রধান ছিলেন না।
তােফায়েল আহমদ : না।
প্রশ্ন আপনাদের ভেতর অর্থাৎ মুজিব বাহিনীর চার নেতার মধ্যে মতাদর্শগত কোন বিরােধ ছিল কি?
তােফায়েল আহমদ যুদ্ধ চলাকালীন মুজিব বাহিনীর চার নেতার মধ্যে কোন মতাদর্শগত বিরােধ ছিল না।
প্রশ্ন : তানদুয়ায় মুজিব বাহিনীর সদস্যরা এক পর্যায়ে ট্রেনিং বন্ধ করে দেয়। এ সম্পর্কে কি জানেন?
তােফায়েল আহমদ : এ তথ্য সঠিক নয়। কোনদিনই ট্রেনিং বন্ধ হয়নি। কোথা থেকে যে এগুলাে আপনারা পেয়েছেন, কে এসব বলেছে। কোনদিনই ট্রেনিং বন্ধ হয়নি। একদিনের জন্যেও নয়। 
প্রশ্ন : নূরে আলম সিদ্দিকীকে মুজিব বাহিনীর নেতৃত্বে নেয়া হল না কেন?
তােফায়েল আহমদ : নূরে আলম সিদ্দিকীই বলুন আর শাহজাহান সিরাজ, এরা তখন ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক। শাহজাহান সিরাজ মুজিব বাহিনীর সঙ্গে খানিকটা যুক্ত ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী,এ কোন উত্তর নেই। আসলে আমরা যারা স্বাধীনতার পক্ষে আগেই কাজ করতাম বিভিন্নভাবে, তখন ছাত্রদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ স্বাধীনতার প্রশ্নে কম চিন্তা করতাে। নূরে আলম সিদ্দিকীকে আমি ঠিক সেভাবে বলতে চাচ্ছি না, মানে ছিলেন না আর কি  এটা হল বড় কথা।
প্রশ্ন : কলকাতার হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনাল হােটেলে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এবং মুজিব বাহিনী নেতাদের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠক সম্পর্কে কিছু বলুন।  তােফায়েল আহমদ আদতে আমাদের সঙ্গে অস্থায়ী সরকারের কোন বৈঠক হয়নি । ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষ থেকে ডি পি ধর সমম্বয় সাধন করতেন। তাে ডি পি ধরের সঙ্গে আমাদের এবং অস্থায়ী সরকারের আলাপ-আলােচনা হতাে। এ রকম একাধিকবার ডি পি ধরের সঙ্গে আমরা আলাপ-আলােচনা করেছি, পরিকল্পনা তৈরি করেছি। তারপর আবার আমরা বিশেষ করে আমি অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে বসেছি। আর ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। ছিলেন জেনারেল সরকার। ডি পি ধর ছিলেন না। যেহেতু আমি সদর দফতরে ছিলাম সেহেতু সাধারণ সমন্বয় সাধনের জন্য আমাকে থাকতে হয় ।
প্রশ্ন :বৈঠকটা কিসের ওপর ছিল?
তােফায়েল আহমদ : বৈঠকটা ছিল ইনডাকশনের ওপর। কারণ দু’এক জায়গায় আমাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর গােলমাল হয়েছিল । আগরতলায় শেখ ফজলুল হক মণির সেক্টরে  গােলমাল হয়েছিল আমার সেক্টরেও। এটা যাতে না হয় অর্থাৎ মুজিববাহিনী। মুক্তিবাহিনীর পরিপন্থী নয়—উভয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করার জন্য ভেতরে যাচ্ছি, এটারই সমন্বয় বিধানের জন্য বৈঠক।
প্রশ্ন : তাহলে মুজিব বাহিনী ভেতরে প্রবেশের সময় গােলমাল দেখা দেয় ।
তােফায়েল আহমদ : এক-আধটা।।
প্রশ্ন : স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন মুজিব বাহিনী সদস্যরা আওয়ামী লীগ বিরােধী এবং কমিউনিস্টদের হত্যা করেছে বলে অভিযােগ আছে। আপনি কি বলেন?
তােফায়েল আহমদ এটা একদম মিথ্যা। প্রশ্নই ওঠে না। আমরা কোন কমিউনিস্টকে হত্যা করিনি। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভাল ছিল । আমরা যেমন মুজিব বাহিনী করেছি, সে রকম ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা কমরেড ফরহাদের নেতৃত্বে একটা ব্রিগেড করেছে। তাদেরও ভিন্ন ট্রেনিং হয় । সুতরাং আওয়ামী লীগ বিরােধীদের হত্যা করেছে মুজিব বাহিনী, এ কথা ঠিক নয়। পরবর্তীকালে যারা আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গেছে বা এখনাে আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে না, তারা ইতিহাসকে বিকৃত করার জন্য, স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়কে ব্যঙ্গ করার জন্য এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তােলার জন্যে অবাস্তব, কল্পনাপ্রসূত, অসত্য এবং বিকৃত সংবাদ দিয়ে ইন্টারভিউ করেছে।
প্রশ্ন : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) লােকজন অভিযােগ করে যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতা মুক্তিযােদ্ধা স্বপন চৌধুরীকে মুজিব বাহিনীর শেখ ফজলুল হক মণি গ্রুপের লােকজন হত্যা করেছে। এ অভিযােগ সম্পর্কে আপনি কি বলেন? 
তােফায়েল আহমদ আমার জীবনে এই প্রথম আমি কথাটি শুনলাম । দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আর আজকে ১৯৮৯ সালের ১৪ই এপ্রিল, এই প্রথম শুনলাম। কারণ, সবাই জানে যে, পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে। সম্মুখ সমরে জীবন দিয়েছেন স্বপন চৌধুরী । এবং এত বছর, এত দিন চলে গেল, এ কথা শুনিনি। যারা আওয়ামী লীগ থেকে চলে গেছে এবং পরবর্তীকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল করেছে – সেই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ভেঙ্গে খান খান। হয়ে গেছে। সেই জাসদের এক নেতা নব্য রাজাকার হয়েছেন। সুতরাং জাসদের মুখ দিয়ে এ ধরনের অনেক কথা বেরুবে, এতে আমি বিস্মিত হই না। সত্যিকার ইতিহাস সত্যিকারই থাকবে। কারণ, শেখ ফজলুল হক মণি একজন উচুদরের নেতা ছিলেন। তিনি স্বপন চৌধুরী এবং অন্যদের প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। মুজিব বাহিনীর ছেলেদের | মধ্যে এমন কোন ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঘটেনি যার কারণে শেখ ফজলুল হক।
মণির নির্দেশে স্বপন চৌধুরীকে জীবন দিতে হতে পারে। এটা সর্বৈব মিথ্যা। তাদের (জাসদ) কিছু পরিকল্পনা ছিল, বঙ্গবন্ধু (পাকিস্তান জেল থেকে মুক্ত হয়ে) আসার পর। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে যার প্রকাশ ঘটে। আজকে স্বাধীনতা বিরােধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে । এই স্বাধীনতা বিরােধীরা সর্বপ্রথম জাসদের ছত্রছায়ায় পল্টন ময়দানে সমবেত হবার সুযােগ পেয়েছিল। সেদিন তারা নিজেদেরকে এক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করে। কে সেই হল্যান্ডের নাগরিক পিটার কাসটার্স? তিনি নিজে
বলেছেন যে আমি জাসদকে সাহায্য করেছি।’ কে সেই পিটার কাসটার্স এসব। আপনারা জানেন । কার সঙ্গে, কোন সম্রাজ্যবাদী গােষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল, আপনারা জানেন। তারা গণবাহিনী করে থানা লুট করে । ব্যাংক লুট করে । বিভিন্নভাবে তারা কী অত্যাচারই না করে। এ ধরনের বানােয়াট, মিথ্যা উক্তি করাটা। তাদের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়।
প্রশ্ন ১৯৭২ সালে মুজিব বাহিনী পুনরুজ্জীবিত স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম। পরিষদের মাধ্যমে শেখ মুজিবের কাছে প্রস্তাব রাখে যে, অস্থায়ী সরকার ভেঙ্গে দিয়ে জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠন করা হােক এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল শক্তিকে জাতীয় বিপ্লবী সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা হােক এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন শেখ মুজিব। এরপর মুজিব বাহিনী আরাে ছটি প্রস্তাব রাখে। সে প্রস্তাবগুলাে কি?
 তােফায়েল আহমদ : যারা জাসদ গঠন করেন, সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে, তারা ওই (জাতীয় বিপ্লবী সরকার) প্রস্তাব দেন বেশ পরে। যখন আমরা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের জন্য নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে গণপরিষদ। করে তাড়াতাড়ি সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে তার ভিত্তিতে নির্বাচন দেয়া এবং সেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দেশ শাসন করবেন—সেই কাজ করছিলাম। তাই এই কারণে বঙ্গবন্ধু ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। এবং সেটা গ্রহণ করা সমীচীনও হতাে না। এরপর আর কোন প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। কোন প্রস্তাবই নয়। 
প্রশ্ন ১৯৭২ সালে জুলাই মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ দু’ভাগ হয়ে যায়। এর কারণ কি?
তােফায়েল আহমদ : ছাত্রলীগের যে নিয়ম-কানুন অনুসারে সম্মেলন হবার কথা, সেই নিয়ম-কানুন অনুযায়ী সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমরা সম্মেলন করি। কিন্তু একটা অজুহাত তাে খুঁজতে হবে ছাত্রলীগ ভাঙার । কারণ, ছাত্রলীগ ভেঙ্গে তারা তাদের মূল। সংগঠন করবে। কেন ছাত্রলীগ দু’ভাগ হল, এই প্রশ্নের উত্তর আমরা জুজে পাব পরবর্তীকালে জাসদের জন্মের মধ্য দিয়ে । তখন তাদের কিছু কিছু পরিকল্পনা, যা ছিল অবাস্তব —তারা গ্রহণ করে তাদের ওই আদর্শগত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে। সেগুলাে আমরা গ্রহণ করতে পারিনি বলে আমরা নিয়ম-কানুন মােতাবেক সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলন করি। তারা পাল্টা সম্মেলন করে পরবর্তীকালে জাসদ করেছে।
প্রশ্ন : তারা কি চেয়েছিল?
তােফায়েল আহমদ এই আজকে যা করছে এটাই চেয়েছিল অর্থাৎ অরাজকতা, গােলযােগ সৃষ্টি করে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত সরকারকে ধ্বংস করা যেটা আজকে তারা করছে।
প্রশ্ন : সিরাজুল আলম খান ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিলেন, এটাই কি?
তােফায়েল আহমদ সিরাজুল আলম খান ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিলেন কী না, সেটা আলাদা কথা তার মূল উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে অপ্রিয় করে তােলা। এটার মধ্যে। অন্য যাদের হাত ছিল, আমি সেটা বলবাে না, তবে আমি জানি ।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী না করে রক্ষী বাহিনী গঠন করা হল কেন? আপনি তাে ওই সময় শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সচিব ছিলেন। আপনার পক্ষে এ প্রশ্নের জবাব দেয়া সম্ভব।
তােফায়েল আহমদ : এটা ছিল একটা অধাসামরিক বাহিনী। যেমন, পুলিশ ব্যর্থ। হলে তখন তাকে সাহায্য-সহযােগিতা করার জন্য আমরাই কিন্তু সেনাবাহিনীকে গড়ার। চেষ্টা করেছিলাম। এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে এর কোন সংঘাত ছিল না। আমরা রক্ষী। বাহিনী গঠন করি সেনাবাহিনীকে বাদ দিয়ে, এটা ঠিক নয়। সেনাবাহিনী সেনাবাহিনীই  রক্ষী বাহিনী রক্ষী বাহিনীই এবং সেই রক্ষী বাহিনীর সকল সদস্যই আজকে সেনাবাহিনীতে আছে।একটা আরেকটার প্যারালেল ছিল না। আমরা সেনাবাহিনী করার চেষ্টা করেছি। সাথে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে বিভিন্ন রকমের সমস্যা দেখা দেয়। সেই জন্য রক্ষী বাহিনী করি। এই ধরনের আধাসামরিক বাহিনী। বিশ্বের সবদেশেই আছে । রক্ষী বাহিনী একটি আধাসামরিক বাহিনী ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
প্রশ্ন : রক্ষী বাহিনী কি শেখ মুজিবের ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে প্রহরায় ছিল?
তােফায়েল আহমদ না। বঙ্গবন্ধু যখন প্রেসিডেন্ট হলেন তখন সেনাবাহিনী ছিল । যতদিন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ততােদিন তিনি পুলিশ প্রহরায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল। কোনদিন ভাবেননি তাকে এ দেশেরই লােকের হাতে প্রাণ দিতে হবে। সব সময় আমরা তাকে বলতাম কিন্তু তিনি সরকারি বাসভবনে যাননি। সেই অরক্ষিত ৩২ নম্বরেই তিনি থাকতেন। যখন প্রেসিডেন্ট, তখন সেনাবাহিনী ছিল। তার প্রহরায়। রক্ষী বাহিনী যদি সেনাবাহিনীর বিকল্প হতাে, তাহলে তাদের পাশাপাশি রক্ষী বাহিনীও তার প্রহরায় থাকতাে। তাহলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারতাে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল সেনাবাহিনীর ওপর । সে কারণে তাদেরকে তিনি মােতায়েন করেছিলেন। সুতরাং, যারা রক্ষী বাহিনী সম্পর্কে অপপ্রচার করে এই যেমন, রক্ষী বাহিনী হাজার হাজার লােক মেরেছে, কথাটা সত্য নয়। অথচ এটা কেউ বলে না যে, গণবাহিনীর হাতে, সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির লােকদের হাতে আমাদের পাঁচজন জাতীয় সংসদ সদস্যসহ হাজার হাজার লােককে জীবন দিতে হয়েছে। গ্রামকে গ্রাম ছারখার হয়েছে। একটা গ্রামে অস্ত্র হাতে নিয়ে কেউ কাউকে যদি হত্যা করে, স্বাভাবিকভাবে আইন প্রয়ােগকারী সংস্থা সেখানে যায়। সেখানে বাড়াবাড়ি কিছুটা যে হয় না, তা নয়। কিন্তু রক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে বলা হয়েছে ।
টেপকৃত ১৪ এপ্রিল, ১৯৮৯।

সূত্রঃ   বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক